বৃহস্পতিবার, ২৫ আগস্ট, ২০১৬

স্মৃতি

একটি স্মৃতির কথা বলা যেতেই পারে। স্মৃতি আসলে মাছের মতো যতোক্ষণ মনজলে ডুবে থাকে ততোক্ষণ তরতাজা থাকে। স্মৃতি কিন্তু একটি নামও হতে পারে। স্মৃতি কখনো ছেলেদের নাম হবে না। নামের বৈষম্য পৃথিবীতে আমার কাছে  বৈষম্যের মা। শিশুকাল থেকেই একজন মানুষ দুটি পরিচয়ে বড়ো হতে থাকে -- ছেলে অথবা মেয়ে,  মানুষ ব্যতিত অন্য কোনো প্রাণির মধ্যে এই বিষয়টি এতো তীব্রভাবে পরিচয়প্লেট হিসেবে অবস্থান করে না।

মাঝেমধ্যে দেখি বিড়ালের বাচ্চা জন্ম হলে ওলা বিলাই দুই একটি বাচ্চাকে গুম করে ফেলতে। পরে জানতে পারি গুম হওয়া বাচ্চারা বেটা বিলাই ছিলো। বেটা বিলাই বেটা বিলাইকে সহ্য করতে পারে না। ওলা বিলাই বাচ্চাদের গুম করে নিয়ে প্রথমে গলায় আঘাত করে, পরে ইন্দুর যেভাবে খায় সেভাবে সে বেটা বেলাইকে খাইতে থাকে। ওলা বিলাই কিন্তু মেয়ে বিলাই বাচ্চাকে আক্রমণ করে না। যে মার কাছে ছেলে-মেয়ের কোনো পার্থক্য  নেই সেই মায়ের স্বামী ওলা বিলাইয়ের কাছে বেটা বিলাই খাবারের বস্তু!

ওলা বিলাইকে আমি সুস্থ বলি না। মানুষের পৃথিবীতে সে শেষ পর্যন্ত সুস্থ থাকতে পারে না। বনের বিলাইকে ওলা হতে হয় না, মৃত্যুর পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত সে পুরুষ বিলাই-ই থাকতে পারে।

এই সমাজ কিছু পারলেও অধিক কিছু নষ্ট করে। এই সমাজ কখনো নতুন কিছুকে খুব সুন্দর করে গ্রহণ করতে শিখে নাই। ব্যাপারটা অনেকটা বাংলাদেশের রাজনীতির মতো -- এক সরকার যখন ক্ষমতা থেকে বিদায় নেয় আরেক সরকার ক্ষমতায় এসে প্রতিশোধ গ্রহণ বাবদ তিন বছর ঢনঢন করে নষ্ট করে, এক বছর ভোগ করে, আর এক বছর কাজ করে। ফলে নতুন কিছু এই সমাজ তখনই গ্রহণ করে যখন নতুন অনেক পুরাতন হয়ে যায়।
গ্রহণ করবে কী করে?

বাসিখাবার প্রবণতা এখনো এই সমাজের শেষ হয় নাই। তাই এই সমাজে ত্যাগের হোক কিংবা ভোগের হোক স্মৃতি একটাই-- বাসি স্মৃতি!

তরতাজা স্মৃতি এখানে দেখতে পাওয়া যায় না। তরতাজা স্মৃতি এখানে ট্যাবু।

একখান স্মৃতির কথা বলা যেতেই পারে।
মেয়েটির নাম স্মৃতি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য আমি কোচিংয়ে ভর্তি হই। ভৈরব। অন্য দশজন ছাত্রের মতো আমি ভর্তি হইনি। আমি কোচিংয়ের পরিচালককে গিয়ে বললাম ` আপনার এখানে কোচিং না করলেও আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারবো, আমার কাছে বেশি টাকা নেই, ভর্তি করাবেন?

এনাম ভাই হেসে আমার বিস্তারিত জিজ্ঞেস করলেন। ব্যাস তিনি সন্তুষ্ট। আমাকে ভর্তি করিয়ে নেন। ভর্তি হলেও আমি ক্লাস করি না। সপ্তাহে একদিন এসে গতিবিধি লক্ষ্য করি। ছাত্ররা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের রাজধানী মুখস্থ করার জন্য, আর Tense অর্থ কাল এই ধারনা নিতে কোচিংয়ে ভর্তি হয়।

হটাৎ একজন স্যারের দেখা পেলাম। ইংরেজি পড়ান। কবিতাও লেখেন। একটি বইও বের করেছেন। তিনি কোচিংয়ের ভেতর শুধু ইংরেজির জন্য আলাদা কোচিংয়ের ব্যবস্থা করেছেন। আমি তাঁর কোচিংয়ের নিয়মিত ছাত্র। একদিন হঠাৎ তিনি বললেন এখন স্বরচিত কবিতা পড়বে রেজা। মনে মনে খুব লজ্জাবোধ করেও কবিতা পড়তে ডেস্কে গেলাম।
কবিতা পড়তে লাগলাম -- বহুদিন তোমার স্বপ্নে আমার স্বপ্ন ছিল, বহুরাত আমার জীবনের আলকেমিতে তোমার বিচরন ছিল .....।

পীনপতন নীরবতা। কবিতা পড়া শেষ। এবার কমপ্লিমেন্টের পালা। স্যার এমন কমপ্লিমেন্ট করলেন আমার মর্যাদা দুই চারজন চেয়ারম্যানের মতো সালামমার্কা হয়ে গেলো। সবাই এবার আমাকে ঘিরে ধরে। আমিও প্রেসব্রেফিংয়ের মতো এক এক করে উত্তর দিয়ে যাচ্ছি।

সবাই বিদায় নিলে ভৈরব নদীর মতো একটি মেয়ে আমার কাছে আসে। খুব মোলায়েমভাবে তার চোখ আমার চোখের উপরে রাখে। আমাকে জিজ্ঞেস করে আপনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো সাব্জেক্টে ভর্তি হবেন। আমি তো অবাক। অবাক দুটি কারনে। প্রথম কারন : বনলতা সেনের মতো কোনো উচ্চারন আমার কানে বাজে। দ্বিতীয় কারন : আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবো এই বিষয়ে সে নিশ্চিত।

আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় ভর্তি হই, আর সে ভর্তি হয় ইংরেজিতে। বাংলা বিভাগের প্রতিবেশী বিভাগ ইংরেজি বিভাগ। খুব কাছাকাছি দুই বিভাগের অবস্থান। অথচ স্মৃতির আর আমার দূরত্ব আকাশ আর জমিনের মতো। কদাচিৎ তার সাথে দেখা হই। আমি তাকে দেখামাত্র চিনতে পারি না। কারন সে এখন হুফাওয়ালা বোরখা ব্যবহার করে। কিন্তু মাঝে মাঝে টের পাই দুটোচোখ আমাকে দেখছে, আর সেই চোখদুটো চিনতাম বলেই চিনি। স্মৃতি আসলেই স্মৃতি। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন