মঙ্গলবার, ২৫ আগস্ট, ২০২০

তা বি জ

 যে মানুষ অতীত ভুলে যায় তার ভবিষ্যৎ অতীত হয়ে যেতে পারে, অতীত একটা ফুল গাছের মতো ফল গাছের মতো যাকে প্রয়োজনে জল দিতে হয় আবার ফল খেতে হয় গন্ধ নিতে হয়

শুক্রবার, ২১ আগস্ট, ২০২০

বুধবার, ১৯ আগস্ট, ২০২০

রেললাইনের পাথর

 তুমি কি ভুলে গেছো 

তুমি কি ভুলে গেছো

বিছানো সে রাত 

পাখিদের ঘরে ফেরা 

হয়নি হয়নি 

হয়েছে আমাদের প্রভাত।।


প্রবাল

ভেসে যায় ভেসে যায়

থেকে যায় থেকে যায়

রেখে যায় রেখে যায় আমাদের রাত।।


গল্প জমা হলে 

মেঘেদের দেশে গেলে 

বৃষ্টি হয়ে ঝরে 

সৃষ্টি হয়ে ঝরে গল্প বিরাট ।।


চোখে চোখে কথা বলা

ইশারায় পথ চলা 

মনে মনে গন্ধ তুলা

দুটি মন এক হয়েছে

দুটি মন এক রয়েছে 

হয়েছে লোপাট।।

শনিবার, ১৫ আগস্ট, ২০২০

ভাবনা

 ভাবিয়া কী হবে বন্ধু 

যা হবার তা হয়ে গেছে 

সকাল বেলার পাখি এসে 

রাতের কথা বলে গেছে

বৃহস্পতিবার, ১৩ আগস্ট, ২০২০

সিন্দাবাদ টুর

 সিন্দাবাদ টুর। আমাদের সিন্দাবাদ টুরের কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। আলাদা বৈশিষ্ট্য। সচারাচর আমরা যে টুর দিয়ে থাকি সিন্দাবাদ টুর তার থেকে আলাদা। সিন্দাবাদ নামটি নেয়া হয়েছে আরব্য রজনীর গল্পাংশ আলিফ লায়লা থেকে। আলিফ লায়লার সিন্দাবাদ খুবই আল্লাভক্ত মানুষ। আল্লা তার কথা শুনে। সিন্দাবাদ নাবিক। মূলত সে আল্লার প্রেরিত একজন মহাপুরুষ। এই মহাপুরুষ পৃথিবীর অপরাধচক্র দমন করার জন্যে সাগর টু সাগর কাফেলা নিয়ে টুর করে থাকে। আমাদের সময়ের, আমাদের শৈশবের নায়ক আলিফ লায়লার সিন্দাবাদ। এই সিন্দাবাদ ভ্রমনে আমরা আমাদের শৈশবের নায়ক সিন্দাবাদের বিভিন্ন দিক বর্তমান সামাজিক বিশ্লেষণে আলোচনা করে থাকি। 


আমাদের সিন্দাবাদ টুর শুরু হয় দুই হাজার উনিশ সালের কোরবানির ইদের দ্বিতীয় দিন থেকে নাছিরনগরের চৈয়ারকুড়ি গ্রাম থেকে। চৈয়ারকুড়ি গ্রামটি মহাগঙা আর সিংরা নদীর আদুরে লালিত। এটি মূলত হাওড় গ্রাম। বর্ষাকালে এই গ্রামের আভিজাত্য হাওড়ের জল,আফালের আতঙ্ক,নদীর তরতাজা মাছ, প্রবীন লোকদের বংশধরা সূচীভেদ্য কিসসা,হিন্দু মুসলিম পরিবারের আয়েসি কৃষ্ণ মোহাম্মদ মাহফিল। চৈয়ারকুড়ি গ্রামের বাজারটি আমার খুবই ভালো লাগে। বাজারের দক্ষিনপ্রান্তে মাছবাজার সংলগ্ন বটতলা আমার একপ্রকার বেহেস্ত। আজ থেকে তিন হাজার বছর আগে এই বটতলা বসে ধ্যান করেছিলাম। ধ্যানে প্রেমে বহু বছর, ধ্যানের ফসল চৈয়ারকুড়ির বাজার সভ্যতা। 


সিন্দাবাদ টুরের প্রধান শর্ত জোছনা থাকে এমন রাত নির্ধারণ করতে হবে। হাওড়ে রাতযাপন করবো আর জোছনা থাকবে না তা হবে না। জোছনা রাতকে নুরানি ছুরত দান করে। রাতদুপুর থেকে শুরু হবে জ্বিনভূতের গল্প। থাকবে পারসোনাল শৈশব থ্রিলিং স্টোরি। থাকবে দ্বন্দ্ব ও ঝগড়ার গল্প। থাকবে চরম তারুন্যচর্চা। অবশ্যই ডাকাত আসবে ডাকাত আসবে এমন একটি আতঙ্ক কাজ করতে হবে। হাওড়ের মাঝখানে থাকবে নৌকা। তারপর বাতাসে ভাসতে থাকবে নৌকা আপন মনে। রাতে একটু পর পর চলবে আতসবাজি। থাকবে বাউলের গান। প্রায় সকালের দিকে দুই একজন ব্যতীত সবাই ঘুমাবে। নৌকা তখনো ভাসতে থাকবে। পর্যাপ্ত ঘুমের পর নৌকা চলবে গন্তব্যের দিকে। নৌকাযাত্রা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত খাওয়া দাওয়া নৌকাতে। যাত্রা শুরুর প্রথম পনেরো ঘন্টা বিভিন্ন বাজারে চলবে নোঙর। আমাদের নৌকা চলবে চারটি বিভাগের জলপ্লাবনে-- ঢাকা, ময়মনসিংহ, সিলেট, চট্রগ্রাম। থাকবে আফালের আতঙ্ক, থাকে সিন্দাবাদের দরবেশগিরি। 


দুই হাজার বিশ সালের সিন্দাবাদ টুরে আমরা একুশ জন। দুইজন দুই এলাকার-- আমি আর হাসান মেহেদী। আমি আশুগঞ্জবাসী, হাসান মেহেদী নরসিংদীবাসী। হাসান মেহেদী নরসিংদী হিমু পরিবহনের টিম লিডার আর আমি এমরানুর রেজা স্বয়ং হিমু। আমি যে একনিষ্ঠ হিমু এই ব্যাপারে কোনো বুগিঝুগি নাই। তবে আমার রূপা নীল শাড়ি পরে বাড়ির বারান্দায় আমার জন্য অপেক্ষা করে না, মাঝে মাঝে হোয়াটসঅ্যাপের ইনবক্সে গালি দিয়ে যায়। আমার রূপা ইদানিং গালি শিখেছে। রূপার জন্যে আমার প্রার্থনা যেন সে ভীমকান্তি মহিলা না হয়ে যায়, যেন সে থাকে জামদানি শাড়ির গোপন ভাজ জীবনভর। 


আমি আর হাসান মেহেদী বাদে সবাই চৈয়ারকুড়ি গ্রামের সম্মানিত অধিবাসী। সবার বাজারধর ও রাজনৈতিকধর অনেক উচুতে। 


ছয় আগষ্ট দুই হাজার বিশ। বুধবার। সকাল আটটায় বাড়ি থেকে বের হই।মোস্তফার রিকসা করে যাই আশুগঞ্জ। আশুগঞ্জ গিয়ে বাসে উঠে যাবো বিশ্বরোড।কিন্তু মোস্তফা বলে সেই আমাদেরকে বিশ্বরোড দিয়ে আসবে। হাইওয়ে রোড দিয়ে রিকসা চলাচল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। তাকে নিষেধ করি। কিন্তু সে আমার নিষেধ শুনতে রাজি নয়।পীড়াপীড়ি করা আমার আচরনধর্মে নাই।তাই রিকসা চলছে মহাসড়ক দিয়ে। ভাবছি ট্রাফিক পুলিশ তাকে ধরলে তার অনেক বড় লস হয়ে যাবে। আমি তো তার জন্যে আধা ইঞ্চিও সুপারিশ করবো না। কারন অন্যায়ের পক্ষে সুপারিশ করা আমার আচরনধর্মে নাই।বেড়তলায় রিকসা চলে যায় পনেরো থেকে কুড়ি মিনিটের মধ্যে। বিষয়টি আমার কাছে ছোটোখাটো মিরাকলের মতো মনে হয়েছে। এতো অল্প সময়ে বেড়তলা যাওয়া সম্ভব নয়। তাও আবার চায়না রিকসা দিয়ে।বেড়তলা নেমে তিনজনে চা খাই। চাপানের বিরতির পর চায়না রিকসা চলে আসে বিশ্বরোড। এবার মোস্তফাকে বিদায় দেই।এবার আমাদের গন্তব্য দাতমন্ডল ব্রিজ।সরাইল হয়ে নাছিরনগর যাওয়ার পথে দাতমন্ডল ব্রিজ। মন্ডল সাবের নাম দাত ছিলো। ভাবতেই কেমন লাগে। আগের দিনের মানুষের নাম এমনই ছিল-- পয়সা,পয়সার মা, লোহা, টেহার মা, মিশ্রি ইত্যাদি ইত্যাদি। তাই দাতমন্ডল ব্রিজ নাম শুনে খুব বেশি অবাক হওয়ার কোনো কারন নাই। গুনে যার পরিচয় নামে কী আসে যায়।


আকিব নৌকা থেকে নেমে যাচ্ছে। সে যাবে না টুরে। তাকে নেয়ার জন্যে অনেকে আসছে। কী এক মহান কারনে তুহিনের সাথে আকিবের কথা কাটাকাটি হয়েছে। সুতরাং আকিব নৌকায় থাকবে না।আকিবের সাথে রাশিয়া ফেরত রিফাত মামাও নেমে গেছে। সেও যাবে না। আকিব সরকারি চাকরি করে। তুহিন সাংবাদিক। এরা এখনো ক্লাস সেভেন এইটের মতো ঝগড়া করে। কারো মনে অপার সৌন্দর্য না থাকলে রাষ্ট্রের এমন গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে থেকে শৈশবের গুল্লি খেলার মতো ঝগড়া করা যায় না। আকিবকে নৌকায় তুলতে আমার অনেক কষ্ট হয়েছে। যতই কষ্ট হচ্ছিল ততই মনে আনন্দ পাচ্ছিলুম।শৈশবকে ফিরে পাওয়ার আনন্দ। অবশেষে আকিব ও রাশিয়া ফেরত রিফাত মামা নৌকার আনন্দে যোগদান করে। 


নৌকা চলছে। মহামান্য রাষ্টপতি রাস্তার দিকে। অষ্টগ্রাম কিশোরগঞ্জ ইটনা মিটামইন অঞ্চলের মানুষ মহামান্য রাষ্টপতির উপর ব্যাপকভাবে শ্রদ্ধাশীল। নৌকা চলছে। রাশিয়া ফেরত রিফাত মামা নৌকা থেকে লাফ দিলো। লাফ দিলো নদীর জলে। জলে লাফ দেয়ার আগে আমার সম্মতি নিলো।আমি শতভাগ সম্মতি দিলাম। আমি যে সম্মতি দিলাম আমি আর রিফাত মামা ব্যতীত কেউ জানে না, সুপ্রিমকোর্টের আইনবিদ মামাও জানে না। সবাই ভয় পেয়ে গেলো। ভাবছে  'যদি' রিফাত মামা মারা যেতো? 'যদি' শব্দ দিয়ে মানুষ কবর থেকে উঠে আসে না, তাই 'যদি' রিফাত মামা মারা যায়নি।


এক লোক ডাক্তারের কাছে যায়।তার প্রস্রাব হলুদ।ডাক্তারের কাছে প্রস্রাব স্বাভাবিক হওয়ার ঔষধ চায়।ডাক্তার খুবই মহান। ডাক্তার এমন ঔষধ দেয় যে লোকটির প্রস্রাব বন্ধ হয়ে যায়। বাংলাদেশে এমন ডাক্তারের অভাব নাই যারা প্রানের মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে সৌন্দর্য নির্মান করে।কিন্তু ইটনা মিটামইন অষ্টগ্রামের এই রাস্তাটি দেখে এমন কেউ বলতে পারবে না রাস্তাটি নদী হন্তারক। হাওড়ের জলবুক বরাবর বয়ে যাওয়া সাব মার্চেবল রাস্তা। মহামান্য রাষ্টপতি আবদুল হামিদের প্রতি শ্রদ্ধা বেড়ে যায়, বেড়ে যায় শ্রদ্ধা এই রাস্তাটি নির্মান মানসিকতার প্রতি।


নৌকা থেকে নেমে আমি আর হাসান মেহেদী হাটতে থাকি। আমাদের হাটাসঙ্গী হয় শরীফ,তানবীর, রুমান মামা। শরীফকে আমি বয়াতি ডাকি। কারন চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৃতি শরীফকে বয়াতি নামে জানে। চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদার আয়নায় শরীফের সাথে আমার প্রথম মোলাকাত। রুমান মামার চৈয়ারকুড়ি বাজারে ফলের দোকান। তিনি অবিবাহিত থাকতে পারেন নাই। হাটতে হাটতে আমরা একটা চায়না রিক্সা পেয়ে যাই।রিক্সার মালিক মিস্টার সোহেল।দারুন রসিক মানুষ। এমন সময় নামে হাওড়ের বৃষ্টি। জাস্ট অসাধারণ। বৃষ্টিপতনকে  মনে হচ্ছে চুলখোলা আয়েশা আক্তার। রাস্তার সবদিক বৃষ্টিজল দিয়ে সূচীভেদ্য জলঘর নির্মান করে রেখেছে আকাশ।আমরা কয়েকজন সেই ঘরের আন্তরিক বাসিন্দা। ছুটছে আমাদের চায়না গাড়ি।এমন মুহূর্তে বলতে হয় নাই আনন্দরে আনন্দ তুই কোথায় থাকিস বল।কারন আনন্দের ভেতরে যে প্রশান্তি সেখানেই আমরা আছি।আমাদের অন্যরা নদীর জলে লাই খেলায় ব্যস্ত।


রাস্তায় অনেক মানুষের ভীড়।কেউ খেলছে। কেউ গান গাচ্ছে। কেউ প্রেমিকের হাত ধরে বসে আছে। কেউ পরিবার নিয়ে পারিবারিক আনন্দে ব্যস্ত। 

বাংলাদেশের মানুষ প্রায় রাস্তায় নামে।তবে উদ্দেশ্য থাকে অন্যরকম। কাটা গাঙয়ের এই রাস্তায় মানুষের ভীড় কেবল আনন্দ প্রশান্তি আর একমোঠো স্বস্তি পাওয়ার আশায়।স্বস্তি আনন্দ আর মোঠো মোঠো প্রশান্তি নিয়ে আমরা চললাম অষ্টগ্রামের উদ্দেশ্যে।


হাওড়ে আফাল উঠে। সবার মনে ভয়।নৌকা ডুবে যেতে পারে। নৌকা ডুবেও যায়। পনেরো বিশ জনের মতো মারাও যায়।তবে আমাদের নৌকায় আফাল সুবিধা করে উঠতে পারে নাই। আমাদের মতো অন্য কারো নৌকায় এমন ঘটনা ঘটে। আফাল আতঙ্ক মাথায় নিয়ে আমরা পৌঁছে যাই অষ্টগ্রাম বাজারে। দুধ চা খাই।ভালো লাগার কারনে দুই কাপ দুধ চা খাই।অষ্টগ্রাম বাজারটিকে মনে হয়েছে গ্রামীন মা যার দর্শনধারী কোনো ব্যাপার স্যাপার নাই কিন্তু কার্যধারী দাত্রীগঙা। 


এই বাজারে সবার মুখে পনিরের গুনাগুন শুনে মুগ্ধতা জন্মে। এই অষ্টগ্রাম বাজারে পুনির যেমন বিখ্যাত তেমনি বিখ্যাত হিন্দু-মুসলিম সম্প্রতি। পুনির কেনার লোভ সামলাতে হলো। কারন সংরক্ষণ করা পর্যাপ্ত জায়গা নেই।অষ্টগ্রামকে আমাদের দাদাদের বলতে শুনতাম আটগাও। আটগাও থেকে অষ্টগ্রাম হয়েছে কিনা আমার জানা নেই।


সারারাত নৌকায়। আমাদের আন্টি মানে তানবীরের আম্মা চমৎকার রান্না করে।আমি নিজেও ভালো রান্না করতে পারি।তাই ভালো রাধুনি চিনতে আমার ভুল হওয়ার কথা না। পোলাও আর মাংস খেলাম রাতে। আমাদের নৌকা নোঙর করেছে শ্মশানের পাশে। আকাশে সাইডৌলি জোছনা। হাওড়ের জলে ছিলান ঢেউ। চারপাশে মৃদুমন্দ বাতাস।এতো সৌন্দর্যের মাঝে আমার কথা বলতে ইচ্ছে করে না। ছাদ থেকে নিচে যাই।চোখ বন্ধ করি। চোখ খুলে দেখি পৃথিবীর রাজা সূর্য আমার চোখে। নৌকা গন্তব্যে ফেরার জন্যে যাত্রা করেছে। 


তুহিনের বাড়িতে গেলাম।দিলাম ঘুম।ঘুম আমার বরাবরই প্রিয়।ঘুম থেকে উঠে দেখি তুসার তার কবুতরকে নাস্তা করানোর কাজে ব্যস্ত।আন্টি আফালের মাছ বানাচ্ছে। আন্টিকে সহযোগিতা করছে আরও দুইজন। দুইজনই সনাতন ধর্মের। তুহিনদের বাড়ির সামনে সনাতন পরিবার, ডানে সনাতন পরিবার, পেছনে মুসলিম পরিবার।বাড়িতে ঢুকে কারো বুঝার ক্ষমতা নাই কে সনাতন ধর্মাবলম্বী আর কে মুসলিম ধর্মাবলম্বী। প্রতিবেশী সনাতন ধর্মের নতুন সন্তান পৃথিবীতে আসে। নতুন সন্তানের নাম রেখে দেয় তুসার। তুসার ঢাকার কোনো এক কলেজ ভর্তি হবে হয়তো। তখন সে শুনবে নাছিরনগরে হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা। তখন তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়বে। তখন সে ভাববে তাও কী সম্ভব!? আসলে সুবিধার রাজনীতির জন্যে অনেক অসম্ভব ব্যাপারকে সম্ভব করতে হয় নতুবা ঘোলা জলের মাছধরা কবিতা রচনা হয়না। তবে এই কথা পৃথিবীর জানা জরুরি যে চৈয়ারকুড়ি গ্রামে হিন্দু মুসলিম বলে কোনো সম্প্রদায় আমার চোখে পড়েনি যা চোখে পড়েছে তা হলো আত্মীয় আর প্রতিবেশী। কারন চৈয়ারকুড়িতে হিন্দু বাড়ি আর মুসলমান বাড়ি বলে আলাদা কোনো দেয়াল নেই, নেই কোনো ধর্মীয় পোস্টার। 


সকালের নাস্তা ছিডালরুডি পিডা।আমার অত্যন্ত প্রিয় পিডা এটা। মাংসের ঝুল দিয়ে খেতে বেশ ভালো লাগে।তবে ছিডালরুডি পিঠা খেয়েছি সবুজ ভাইয়ের বাড়িতে। সবুজ ভাইয়ের আম্মা, আমার মাঅই চমৎকার করে এই পিডা বানান যা পৃথিবী বিখ্যাত স্বাদের দাবিদার অন্তত আমার কাছে। 


নাস্তা খেয়ে বাজারের বটতলায় বসে আড্ডা দিলাম কিছুক্ষণ। আড্ডায় ছিলাম আমি, তানবীর, বয়াতি,রিফাত মামা,কামরুল উৎস। কামরুলের কাছ থেকে কিছু ইসলামি ফান শুনে ভালোই লাগলো। কামরুলের গল্প বলার স্টাইলটা মাওলানা তোফাজ্জল হোসেনের মতো। তিনি কয়েকদিন আগে মারা গেছেন। তিনি মানুষকে কাদাতে ও হাসাতে পারতেন। কামরুল কাউকে কাদাতে পারে না। কারন তার বেড়ে উঠা অনেকটা সোজা হও আরামে দাড়াও পদ্ধতিতে। 


জলিল ভাইয়ের সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করে আমরা চললাম হরিপুর জমিদার বাড়িতে। আল মাহমুদের মায়ের সোনার নোলক জমিদার বাড়ির সামনের তিতাস নদীতে হারিয়ে যায়। এখনো বাংলাদেশ সেই হারানো নোলক খুজে পায়নি।হুমায়ুন আহমেদ ঘেটুপুত্র কমলা সিনেমাটি এই জমিদার বাড়িতে ক্যামেরাস্থ করেছেন। এই জমিদার বাড়িটি হুমায়ুন আহমেদ মূলত আমার চোখস্থ করে তুলেছেন। এখন এই বাড়িটি দেখার জন্যে প্রচুর লোক আসে।


হরিপুরের জমিদারগণ ত্রিপুরার প্রভাবশালী জমিদারগণের উত্তরসুরী  ছিলেন। জনশ্রুতি আছে সুনামগঞ্জ, ছাতক, দোয়ারাবাজার ও আজমিরীগঞ্জের জনপদ কর প্রদান করতো এই জমিদারদের প্রভাবপ্রতিপত্তির কাছ। নাসিরনগর উপজেলাস্থ গুণীয়াউকের জমিদারগণের সহিত তাদের সুসম্পর্ক ছিল। দেশবিভাজনের পর ১৯৪৭ সালে প্রাসাদ ছেড়ে কলকাতায় চলে যান এখানকার জমিদারি ইতিহাস।  ঐতিহাসিক নৌকা বাইচ মুলতঃ এখান থেকেই শুরু হয়। প্রাসাদের অনেক স্থানে ক্ষয় হোয়ে গেলেও দ্বিতলের পাশা খেলার ঘরটি আজও রয়ে গেছে । বাইজীরা প্রতি রাতেই জমিদারগনের আমোদ-প্রমোদের উদ্দেশ্যে নৃত্য পরিবেশন করতো।


দ্বিতীয় তলার একটি রুম তালাবদ্ধ। কাউকে ঢুকতে দেয়া হয়না। কিন্তু আমি তো ঢুকতে চাই।কিন্তু ঢুকতে দেয়া হবে না। তারপর পরিচয় দিতে বাধ্য হলাম।পরিচয় পেয়ে আর নিষেধ করার ক্ষমতা ছিল না দায়িত্বরত লোকটির। দ্বিতীয় তলায় গিয়ে দেখি জমিদার কৃষ্ণপ্রসাদ রায় চৌধুরী কুমিরের মতো পেট ফুলিয়ে ঘুমাচ্ছে। পাশে চেয়ার-টেবিল নিয়ে তিনজন মহিলা বসা। জমিদারের হুকুম তামিল করার জন্যে প্রস্তুত। পরে জানতে পারি তিনি জমিদার নন,তিনি এই অঞ্চলের চেয়ারম্যান। ভাবলাম, আমরা কী জমিদার বাড়িতে আসলাম না চেয়ারম্যান সাহেবের ইউনিয়ন বোর্ড অফিসে চলে আসলাম।বাংলাদেশ আসলে এমনই-- বুঝার ক্ষমতা নাই যে কোনটা জমিদার বাড়ি আর কোনটা পীরবাড়ি বা চেয়ারম্যান বাড়ি বা অফিস।


বাড়ি যেতে হবে। তাই নাসির নগরের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করি। মাধবপুর (উত্তরে হবিগঞ্জ সদর উপজেলা ও লাখাই উপজেলা, দক্ষিণে বি-বাড়ীয়া জেলা, পূর্বে চুনারুঘাট উপজেলা ও ভারত এবং পশ্চিমে বি-বাড়ীয়া জেলা) হয়ে বিশ্বরোড যাওয়া যায়, আবার নাসির নগর দিয়ে মিনি কক্সবাজার হয়ে বিশ্বরোড যাওয়া যায়। আমরা চায়না গাড়ি বা মিশুক নিয়ে নিলাম। চায়না গাড়ি চলছে। দুনিয়ামুখী জমিদার কায়কোবাদের বাগানবাড়ি হয়ে আমরা চলছি নাসির নগর উপজেলার পথে। রাস্তার দুই পাশে ধান আর ধান।বর্ষাধান। বর্ষাধানের পাশ দিয়ে, বুক দিয়ে বয়ে চলছে কোসা নৌকার আয়েসি ঢল।পাটের গন্ধহৃদয় শৈশব জীবনের মেমোরি সেল যেনো জীবন্ত করে তুলছে। প্রকৃতি এখানে স্বাধীন, আরও স্বাধীন এখানে মানুষের প্রাত্যহিক বয়েচলা বোধধন। শহরের মানুষ এখানে সভ্যতার থিউরি শেখাতে আসে না, এখানকার মানুষকে শিখতে হয় না চোখে ঘুম নামানোর দশ রকম ফর্মুলা। সহজিয়া জীবন এদের শিখতে হয় না, এরা বর্ষাধানের মতো সহজ-- প্রয়োজনে প্রয়োজনে বেড়ে উঠে। জীবনের প্রয়োজনে আমাকেও বাড়ি ফিরতে হয়।