চোখের পাতা আস্তে আস্তে নিভে আসে। লোকটি জানে সে ভুল করছে। তারপরও করে। অভ্যাস জনাব অভ্যাস। অভ্যাসের কারনে মানুষ খাবার খায়, প্রানি সঙ্গম করে, বাচ্চা উৎপাদন করে কতিপয় অনির্বান সেন। নকশাল কেবল খাবারের জন্য অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছে বলে আপনার মনে হতেই পারে। মনটা তো আপনার, মনের মুখোমুখি আপনি না হয়ে স্নো পাউডারও মাখতে পারেন। কিন্তু ততক্ষনে আমাদের শরীরের হাওয়া বদল হতে লাগলো। শরীরে শীত শীত ডাকাতের আক্রমন। ঘুম থেকে ওঠে দেখি কেউ আর ঘুমে নেই। আমিই ঘুমিয়ে আছি। দ্রুত নাকি রেডি হতে হবে। তারপর দিল্লী, তারপর চন্ডীঘর।
আমরা চন্ডীঘর নামবো। চন্ডীঘরে জনাব চন্ডাল আছে কিনা জানি না। অনেক কিছুই আমরা জানি না, তারপরও আমাদের মাস্তানি শেষ হয় না। শেভুকে মাস্তান মাস্তান লাগছে। ভদ্র মাস্তান। সব মাস্তানেরই ভেতরে একটা অসহায় ভাব থাকে। শেভুরও আছে তবে তা খুব গভীর চোখ দিয়ে দেখতে হয়।
পৃথিবী বড্ড বিদঘুটে জায়গা। সিস্টেমে চললে সিস্টেমবাজ, আতেল আবার একলা একলা কিংবা নিজের মতো থাকলে অসামাজিক, ক্ষেত ইত্যাদি গালি কপালে জুটে। মাঝামাঝি থাকলেও বলদ, বাঙালি সমাজে মধ্যবিত্ত তো এক বিশাল গালি।
আসল কথা কী জানেন তো, গালি না দিতে পারলে আমাদের পেটের ভাত হজম হয় না। গালি একটা দেয়াই লাগবে শালা। এই দেখো, আমিও গালি দিয়ে দিলাম। আসলেই বাজপাখি না খেলেও বাজপাখি পোষা বেশ আরামদায়ক এবং মানুষ এ কাজটি ভালোই পারে।
শেভু আমাকে ডাক দিলো। আমি গেলাম।
এই বল তুই, ভাই আসছে...
বল, বল
আমি কী বলবো? ফারিয়ার জবাব।
আমি বলি তাহলে।
ভাই, জানি আপনি অনেক বুদ্ধিমান, কিন্তু সে মজা নিতে পারে না, তাই ওর সাথে মজা করবেন না। (আমার চোখে চোখ রাখার চেষ্টা কিন্তু ব্যর্থ)
ঠিক আছে ভাই, আমি বললাম।
আমি শেভুর দুর্বলতার জায়গাটি ধরতে পেরেছি। নদীর পাড়ের মানুষ ভাঙন স্বপ্ন দেখে, সৃষ্টির মাঝেও দেখে ধবংসের ইতিকথা-- এমনটাই স্বাভাবিক।
পরে ওদের সাথে কোনো কথাই বলেনি। ফলে ফল হয়েছিল অন্যরকম। অন্যরকম ফল আবার আমাকেই মীমাংসা করতে হয়। কারন গ্রুপের কেউ ওদের পক্ষে ছিল না।
চন্ডীঘর তাহলে আরও এক ঘন্টার পথ। সব কিছু গোছাতে কিছু সময় লাগলো। তাতে কী, মনে বিশাল আনন্দ! জেল থেকে মুক্তি পাচ্ছি। সবার মনে আনন্দ। শীত বাড়তেই লাগলো। ব্যাগ থেকে শীতের কাপড় খুলে নিলাম। পলওয়েল মার্কেট থেকে দুই হাজার টাকা দিয়ে কেনা শীতের কাপড়টা আমার কোনো কাজেই লাগেনি সেই অর্থে। বাংলাদেশে শীতকাল যেন সাইবেরিয়ায় বেরাতে গ্যাছে। কারন তেল মাথায় তেল দেয়ার স্বভাব শীতের কেন থাকবে না? থাকতেই পারে। শীতের কাপড়টি পড়ে নিলাম। বাহ! দুই হাজার টাকায় কেনা শীতের কাপড়ের ক্ষমতা অস্বীকার করেও শীত শরীরে কুসুম কুসুম আক্রমন করছে। এখুনি নেমে যেতে হবে।
ট্রেন আস্তে আস্তে থামছে। অবশেষে ট্রেন থামলো। আমরা এক টন আনন্দ নিয়ে চন্ডীঘর স্টেশনে নামলাম। চমৎকার স্টেশন। জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর জেল হাজতের সামনের জায়গাটিকে মনে হয় পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর স্টেডিয়াম। চন্ডীঘর স্টেশন আসলেই সুন্দর। ভোর রাতের এই সময়টাতে আরও সুন্দর লাগছে। নীরব সুন্দর। প্রার্থনারত আমার নানিকে যেমন সুন্দর লাগতো তেমন সুন্দর। কষ্ট পেয়েছি যখন দেখলাম অনেক ভিক্ষুক এখানে ঘুমাচ্ছে।
আবার ভাবলাম এটাই সুন্দরের ক্ষত। যখন কোনো দেশ উন্নতির দিকে যেতে থাকে তখন তার ক্ষত থাকবেই প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ।
সবাই ট্রলি নিয়ে শাঁ শাঁ করে যাচ্ছে। দৃশ্যটি চমৎকার। সবাই সবার দায়িত্বে। আমাদের সবার দায়িত্বে শ্রাবন ভাই। আমরা তাকে অনুসরন করছি। যাবো কিন্তু সিমলায়। ট্রলি চলছে। কেমন একটা ট্রেনিং ট্রেনিং ভাব। টুরিস্ট বাস আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। আমরা বাসে ওঠে গেলাম। বাস চলছে। তখনো পৃথিবীতে সূর্য আসে নি। কিন্তু ভোরের আলো পৃথিবীতে নেমে এসেছে। গোল গোল পাহাড়ি রাস্তা। ভূমি থেকে হাজার হাজার ফুট উপরে সিমলা। প্রায় পাঁচ ঘন্টা আমরা বাসে। মানুষ পারে। মানুষ সব পারে। এমন বিশাল বিশাল পাহাড়ের বুকে সে স্থাপন করেছে রাস্তা, বসিয়ে দিয়েছে বাড়ি, বসিয়ে দিয়েছে মর্ডান দাবা। মানুষ পারে, সব কিছু পারে।
বাসে নিজেকে বড় মাপের সাপ মনে হলো -- আঁকাবাঁকা আঁকাবাঁকা। আমাদের সাথে কিন্তু বাকা স্যার আছেন।
বাংলা বিভাগে আকা, বাকা, ফাকা নামে আমাদের তিনজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষক আছেন। পৃথিবীর কোথাও এমন থ্রি টেম্পলেট অনুপ্রাস সমেত শিক্ষক পাওয়া যাবে না। এটা বাংলাদেশেই সম্ভব এবং বাংলা বিভাগে।
আকা মানে আকতার কামাল, বাকা মানে বায়তুল্লাহ কাদেরী, ফাকা মানে ফাতেমা কাওছার। আকতার কামাল আপা চমৎকার রবীন্দ্রনাথ পড়ান, একশত পার্সেন্ট মনোযোগ দিয়ে তাঁর ক্লাসে বসে থাকতে হয়, কারন কোন সময় কোন গুরুত্বপূর্ন কথা আবার চলে যায়।
যখনই আমরা শাহ আবদুল করীমের কুল বাঁকা, গাঙ বাঁকা গানটা ধরেছি তখনই স্যার আমাদের দিকে মুচকি হাসিতে তাকান। আমরা বিষয়টি খুব ইনজয় করি।
বড় মাপের সাপ মনে হয়েছে নিজেকে কারন সাপ কখনো সোজা চলে না, পাহাড়ি রাস্তাও সোজা চলে না। তাহলে যুক্তিবিদ্যা বলছে সাপ আগে পাহাড়ি রাস্তা ছিল। পাহাড় কিন্তু পিচ্ছিলও বটে তবে শ্যাওলার মতো অত পিচ্ছিল না। জীবনটা যদি শ্যাওলার মতো পিচ্ছিল থাকতো তাহলে বরং ভালো হতো। তবে ভালোই আছি।
একটা বিষয় খুব করে নোটিশ করলাম, জলরমন ভেতরকে বাইরে টেনে আনে, আর পাহাড়বিহার ভেতরকে আরও ভেতরমুখী করে তুলে। আমার কেন অত পিচ্ছিল হতে মন চায় তার জন্য অবশ্যই একখান বায়োলজিকেল রিদম জনিত কোনো ব্যাপার আছে।
কুফরি গিয়েছি বরফের জন্য। কুফরি থেকে ফাগু যেতে হয়। ফাগু মূলত বারফি এলাকা। ফাগুতে ঘোড়া দিয়ে যেতে হয়। প্রতিজন তিনশ টাকা। পাহাড়ি আঁকাবাঁকা রাস্তা-- ঘোড়া আস্তে আস্তে উপরে ওঠছে। ঘোড়াদের মেয়েদের মতো একটা সংসার সংসার মন আছে। তা ফাগু ওঠতে ওঠতে মনে হলো। ফাগুতে যখনই বরফ দেখলাম আমার মন আনন্দে নেচে ওঠলো। বারফি দেখে আমার মনে যেমন আনন্দ আসে তেমন কোনো আনন্দ আমার আসেনি যখন আমি সিমলার শেষ চূড়া হনুমানজির মন্দিরে ওঠেছিলাম। আমি বরং আরও চুপচাপ হয়ে যায়। তবে অন্যরকম আনন্দ পেয়েছি যখন আমার হাত থেকে হঠাৎ দেখি টুপিটা নাই।
টুপি কে নিল কে নিল?
বানর টুপিটা নিয়ে গেল।
এখন তাহলে কী করি?
যখনই পাশের দোকান থেকে বিশ টাকার খাবার কিনে দিলাম বানরটিকে তখুনি টুপিটা সুন্দর করে দিয়ে দিল সে।
সিমলার উপরতলার বানর আমাকে শিক্ষা দিল, নতুন এক শিক্ষা-- অধিকার কখনো কখনো আদায় করে নিতে হয়, অধিকার আদায় করে নিতে জানলেই ভালো থাকা যায়। আমি তো অধিকার আদায় করে নিতে জানি না। তারপরও তো ভালোই আছি।
হনুমানজির মন্দিরে ওঠতে ওঠতে আমি কিন্তু ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। কারন আমার শ্বাসপ্রশ্বাস প্রায় থেমে থেমে আসছে। এক মন বলছে নিচে নেমে যা রেজা, আরেক মন বলছে রেজা তোমার ক্ষমতা তুমি এতো সকালে ভুলে যাবা। দুই মন নিয়ে আমি পড়লাম মহা সংশয়ে। তারপর চোখ বন্ধ করলাম। শ্বাসপ্রশ্বাসের স্পষ্ট ডাক শুনতে পাচ্ছি, হার্টের কথা কান পেতে শুনতে পাচ্ছি। ভয় আরও বেড়ে গেলো।
ভয় চরম পর্যায়ে গেলে আমি আমার কাছে যাই। আমার কাছে গেলাম। গিয়ে দেখি সাহস আর সাহস, যে সাহস আমাকে বলছে রেজা চালিয়ে যাও অভিযান, বিপদ বলে কিছু নেই, যেখানে থেমে যাবে জীবন, সেটাই নতুন এক স্টেশন। স্টেশন বদল হলে আরও এক নতুন জীবন, নতুন এক আস্তিক প্রেমের বাড়ি। চোখ খুলে মনে বিশাল সাহস পেলাম। ওঠতে লাগি হনুমানজির মন্দিরে। ওঠেও গেলাম। মন্দির দেখছি দেখছি, ভয়ে ভয়েও আছি, কারন যেকোন সময় বানর আক্রমন চালাতে পারে। হঠাৎ দেখি সে ওঠে এলো।
সে গাড়ি নিয়ে আসে। যাক একজন চেনা মানুষের সাথে পরিচয় হলো। অচেনা জায়গায় একটা চেনা ফুলও হৃদয়ে আশা জাগায়, আর সে তো ফুলের মতো সুন্দর মনের এক নারী-- নীহারিকা। তার সাথে মন্দিরের ভেতরে গেলাম, মন্দিরের প্রসাদ খেলাম। নীহারিকা খুব অল্প কথা বলে। অল্প কথায় আমার কাছে জানতে চাইলো অনেক কিছু। আমি ত আর হিন্দি ততটা ভালো পারি না, তারপরও অধিক কিছু বলার চেষ্টা করেছি। তারপর তারা চলে গেল তাদের পথে আমি আস্তে আস্তে চলে আসি আমার পথে। নীহারিকা আমাকে সিকিম যাওয়ার দাওয়াত দিয়েছে, আমিও যাবো হয়তো, হয়তো আমাদের আবার দেখা হবে, হয়তো কোনোদিনই আমাদের দেখা হবে না। দেখা আর অদেখার মাঝে বেঁচে থাকি আমরা-- আমাদের জীবন-- জীবন নিয়ে ভালোই আছি।
আমরা চন্ডীঘর নামবো। চন্ডীঘরে জনাব চন্ডাল আছে কিনা জানি না। অনেক কিছুই আমরা জানি না, তারপরও আমাদের মাস্তানি শেষ হয় না। শেভুকে মাস্তান মাস্তান লাগছে। ভদ্র মাস্তান। সব মাস্তানেরই ভেতরে একটা অসহায় ভাব থাকে। শেভুরও আছে তবে তা খুব গভীর চোখ দিয়ে দেখতে হয়।
পৃথিবী বড্ড বিদঘুটে জায়গা। সিস্টেমে চললে সিস্টেমবাজ, আতেল আবার একলা একলা কিংবা নিজের মতো থাকলে অসামাজিক, ক্ষেত ইত্যাদি গালি কপালে জুটে। মাঝামাঝি থাকলেও বলদ, বাঙালি সমাজে মধ্যবিত্ত তো এক বিশাল গালি।
আসল কথা কী জানেন তো, গালি না দিতে পারলে আমাদের পেটের ভাত হজম হয় না। গালি একটা দেয়াই লাগবে শালা। এই দেখো, আমিও গালি দিয়ে দিলাম। আসলেই বাজপাখি না খেলেও বাজপাখি পোষা বেশ আরামদায়ক এবং মানুষ এ কাজটি ভালোই পারে।
শেভু আমাকে ডাক দিলো। আমি গেলাম।
এই বল তুই, ভাই আসছে...
বল, বল
আমি কী বলবো? ফারিয়ার জবাব।
আমি বলি তাহলে।
ভাই, জানি আপনি অনেক বুদ্ধিমান, কিন্তু সে মজা নিতে পারে না, তাই ওর সাথে মজা করবেন না। (আমার চোখে চোখ রাখার চেষ্টা কিন্তু ব্যর্থ)
ঠিক আছে ভাই, আমি বললাম।
আমি শেভুর দুর্বলতার জায়গাটি ধরতে পেরেছি। নদীর পাড়ের মানুষ ভাঙন স্বপ্ন দেখে, সৃষ্টির মাঝেও দেখে ধবংসের ইতিকথা-- এমনটাই স্বাভাবিক।
পরে ওদের সাথে কোনো কথাই বলেনি। ফলে ফল হয়েছিল অন্যরকম। অন্যরকম ফল আবার আমাকেই মীমাংসা করতে হয়। কারন গ্রুপের কেউ ওদের পক্ষে ছিল না।
চন্ডীঘর তাহলে আরও এক ঘন্টার পথ। সব কিছু গোছাতে কিছু সময় লাগলো। তাতে কী, মনে বিশাল আনন্দ! জেল থেকে মুক্তি পাচ্ছি। সবার মনে আনন্দ। শীত বাড়তেই লাগলো। ব্যাগ থেকে শীতের কাপড় খুলে নিলাম। পলওয়েল মার্কেট থেকে দুই হাজার টাকা দিয়ে কেনা শীতের কাপড়টা আমার কোনো কাজেই লাগেনি সেই অর্থে। বাংলাদেশে শীতকাল যেন সাইবেরিয়ায় বেরাতে গ্যাছে। কারন তেল মাথায় তেল দেয়ার স্বভাব শীতের কেন থাকবে না? থাকতেই পারে। শীতের কাপড়টি পড়ে নিলাম। বাহ! দুই হাজার টাকায় কেনা শীতের কাপড়ের ক্ষমতা অস্বীকার করেও শীত শরীরে কুসুম কুসুম আক্রমন করছে। এখুনি নেমে যেতে হবে।
ট্রেন আস্তে আস্তে থামছে। অবশেষে ট্রেন থামলো। আমরা এক টন আনন্দ নিয়ে চন্ডীঘর স্টেশনে নামলাম। চমৎকার স্টেশন। জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর জেল হাজতের সামনের জায়গাটিকে মনে হয় পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর স্টেডিয়াম। চন্ডীঘর স্টেশন আসলেই সুন্দর। ভোর রাতের এই সময়টাতে আরও সুন্দর লাগছে। নীরব সুন্দর। প্রার্থনারত আমার নানিকে যেমন সুন্দর লাগতো তেমন সুন্দর। কষ্ট পেয়েছি যখন দেখলাম অনেক ভিক্ষুক এখানে ঘুমাচ্ছে।
আবার ভাবলাম এটাই সুন্দরের ক্ষত। যখন কোনো দেশ উন্নতির দিকে যেতে থাকে তখন তার ক্ষত থাকবেই প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ।
সবাই ট্রলি নিয়ে শাঁ শাঁ করে যাচ্ছে। দৃশ্যটি চমৎকার। সবাই সবার দায়িত্বে। আমাদের সবার দায়িত্বে শ্রাবন ভাই। আমরা তাকে অনুসরন করছি। যাবো কিন্তু সিমলায়। ট্রলি চলছে। কেমন একটা ট্রেনিং ট্রেনিং ভাব। টুরিস্ট বাস আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। আমরা বাসে ওঠে গেলাম। বাস চলছে। তখনো পৃথিবীতে সূর্য আসে নি। কিন্তু ভোরের আলো পৃথিবীতে নেমে এসেছে। গোল গোল পাহাড়ি রাস্তা। ভূমি থেকে হাজার হাজার ফুট উপরে সিমলা। প্রায় পাঁচ ঘন্টা আমরা বাসে। মানুষ পারে। মানুষ সব পারে। এমন বিশাল বিশাল পাহাড়ের বুকে সে স্থাপন করেছে রাস্তা, বসিয়ে দিয়েছে বাড়ি, বসিয়ে দিয়েছে মর্ডান দাবা। মানুষ পারে, সব কিছু পারে।
বাসে নিজেকে বড় মাপের সাপ মনে হলো -- আঁকাবাঁকা আঁকাবাঁকা। আমাদের সাথে কিন্তু বাকা স্যার আছেন।
বাংলা বিভাগে আকা, বাকা, ফাকা নামে আমাদের তিনজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষক আছেন। পৃথিবীর কোথাও এমন থ্রি টেম্পলেট অনুপ্রাস সমেত শিক্ষক পাওয়া যাবে না। এটা বাংলাদেশেই সম্ভব এবং বাংলা বিভাগে।
আকা মানে আকতার কামাল, বাকা মানে বায়তুল্লাহ কাদেরী, ফাকা মানে ফাতেমা কাওছার। আকতার কামাল আপা চমৎকার রবীন্দ্রনাথ পড়ান, একশত পার্সেন্ট মনোযোগ দিয়ে তাঁর ক্লাসে বসে থাকতে হয়, কারন কোন সময় কোন গুরুত্বপূর্ন কথা আবার চলে যায়।
যখনই আমরা শাহ আবদুল করীমের কুল বাঁকা, গাঙ বাঁকা গানটা ধরেছি তখনই স্যার আমাদের দিকে মুচকি হাসিতে তাকান। আমরা বিষয়টি খুব ইনজয় করি।
বড় মাপের সাপ মনে হয়েছে নিজেকে কারন সাপ কখনো সোজা চলে না, পাহাড়ি রাস্তাও সোজা চলে না। তাহলে যুক্তিবিদ্যা বলছে সাপ আগে পাহাড়ি রাস্তা ছিল। পাহাড় কিন্তু পিচ্ছিলও বটে তবে শ্যাওলার মতো অত পিচ্ছিল না। জীবনটা যদি শ্যাওলার মতো পিচ্ছিল থাকতো তাহলে বরং ভালো হতো। তবে ভালোই আছি।
একটা বিষয় খুব করে নোটিশ করলাম, জলরমন ভেতরকে বাইরে টেনে আনে, আর পাহাড়বিহার ভেতরকে আরও ভেতরমুখী করে তুলে। আমার কেন অত পিচ্ছিল হতে মন চায় তার জন্য অবশ্যই একখান বায়োলজিকেল রিদম জনিত কোনো ব্যাপার আছে।
কুফরি গিয়েছি বরফের জন্য। কুফরি থেকে ফাগু যেতে হয়। ফাগু মূলত বারফি এলাকা। ফাগুতে ঘোড়া দিয়ে যেতে হয়। প্রতিজন তিনশ টাকা। পাহাড়ি আঁকাবাঁকা রাস্তা-- ঘোড়া আস্তে আস্তে উপরে ওঠছে। ঘোড়াদের মেয়েদের মতো একটা সংসার সংসার মন আছে। তা ফাগু ওঠতে ওঠতে মনে হলো। ফাগুতে যখনই বরফ দেখলাম আমার মন আনন্দে নেচে ওঠলো। বারফি দেখে আমার মনে যেমন আনন্দ আসে তেমন কোনো আনন্দ আমার আসেনি যখন আমি সিমলার শেষ চূড়া হনুমানজির মন্দিরে ওঠেছিলাম। আমি বরং আরও চুপচাপ হয়ে যায়। তবে অন্যরকম আনন্দ পেয়েছি যখন আমার হাত থেকে হঠাৎ দেখি টুপিটা নাই।
টুপি কে নিল কে নিল?
বানর টুপিটা নিয়ে গেল।
এখন তাহলে কী করি?
যখনই পাশের দোকান থেকে বিশ টাকার খাবার কিনে দিলাম বানরটিকে তখুনি টুপিটা সুন্দর করে দিয়ে দিল সে।
সিমলার উপরতলার বানর আমাকে শিক্ষা দিল, নতুন এক শিক্ষা-- অধিকার কখনো কখনো আদায় করে নিতে হয়, অধিকার আদায় করে নিতে জানলেই ভালো থাকা যায়। আমি তো অধিকার আদায় করে নিতে জানি না। তারপরও তো ভালোই আছি।
হনুমানজির মন্দিরে ওঠতে ওঠতে আমি কিন্তু ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। কারন আমার শ্বাসপ্রশ্বাস প্রায় থেমে থেমে আসছে। এক মন বলছে নিচে নেমে যা রেজা, আরেক মন বলছে রেজা তোমার ক্ষমতা তুমি এতো সকালে ভুলে যাবা। দুই মন নিয়ে আমি পড়লাম মহা সংশয়ে। তারপর চোখ বন্ধ করলাম। শ্বাসপ্রশ্বাসের স্পষ্ট ডাক শুনতে পাচ্ছি, হার্টের কথা কান পেতে শুনতে পাচ্ছি। ভয় আরও বেড়ে গেলো।
ভয় চরম পর্যায়ে গেলে আমি আমার কাছে যাই। আমার কাছে গেলাম। গিয়ে দেখি সাহস আর সাহস, যে সাহস আমাকে বলছে রেজা চালিয়ে যাও অভিযান, বিপদ বলে কিছু নেই, যেখানে থেমে যাবে জীবন, সেটাই নতুন এক স্টেশন। স্টেশন বদল হলে আরও এক নতুন জীবন, নতুন এক আস্তিক প্রেমের বাড়ি। চোখ খুলে মনে বিশাল সাহস পেলাম। ওঠতে লাগি হনুমানজির মন্দিরে। ওঠেও গেলাম। মন্দির দেখছি দেখছি, ভয়ে ভয়েও আছি, কারন যেকোন সময় বানর আক্রমন চালাতে পারে। হঠাৎ দেখি সে ওঠে এলো।
সে গাড়ি নিয়ে আসে। যাক একজন চেনা মানুষের সাথে পরিচয় হলো। অচেনা জায়গায় একটা চেনা ফুলও হৃদয়ে আশা জাগায়, আর সে তো ফুলের মতো সুন্দর মনের এক নারী-- নীহারিকা। তার সাথে মন্দিরের ভেতরে গেলাম, মন্দিরের প্রসাদ খেলাম। নীহারিকা খুব অল্প কথা বলে। অল্প কথায় আমার কাছে জানতে চাইলো অনেক কিছু। আমি ত আর হিন্দি ততটা ভালো পারি না, তারপরও অধিক কিছু বলার চেষ্টা করেছি। তারপর তারা চলে গেল তাদের পথে আমি আস্তে আস্তে চলে আসি আমার পথে। নীহারিকা আমাকে সিকিম যাওয়ার দাওয়াত দিয়েছে, আমিও যাবো হয়তো, হয়তো আমাদের আবার দেখা হবে, হয়তো কোনোদিনই আমাদের দেখা হবে না। দেখা আর অদেখার মাঝে বেঁচে থাকি আমরা-- আমাদের জীবন-- জীবন নিয়ে ভালোই আছি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন