তখন আমি ছাত্র। তৃতীয় শ্রেনীর ছাত্র। আমার ক্রমিক নং চার। তিন ছিল আমারই মতো আরেকজন মানুষের। সেই মানুষটাকে আজও আমি ভুলতে পারিনা। পারিনা বললে ভুল হবে। ভুলতে চেষ্টা করিনা।
আমাদের গ্রামের পাশেই মেঘনা নদী। মেঘনা নদীর পাশে একটি বিদেশি এলাকা। বিদেশী এলাকাটিকে আমরা হাউজিং বলি। সেখানে যতসব ভদ্রলোকদের জায়গা। সেখানে সেই মানুষটি যার ক্রমিক নং তিন সে থাকে। বিকেল বেলা বাজার চারতলার মাঠ থেকে হাউজিংয়ের দিকে তাকিয়ে থাকি, কখনো খেয়া নৌকায় চলে যাই নদীর ঐপাড়ে যদি তাকে দেখা যায়। হাউজিং এলাকাটি দেয়াল দিয়ে বেষ্টিত, আমার মতো সাধারন মানুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ, তথাপি দেয়ালের উপর দিয়ে ছাঁদে তাকিয়ে থাকতাম যদি তার দেখা পাই। তাকে কখনো দেখা যেতো না, তার মতো করে অনেকের দেখা পাই। মতো করে পাওয়া মানুষ দিয়ে কী আর জীবন চলে! জীবনের জন্য চাই সরাসরি জীবন।
সে তৃতীয় শ্রেনীতে কোনো ক্লাস করতো না। প্রত্যেক বার স্যার যখন ক্রমিক নং তিন বলে সম্বোধন করতেন কোনো উপস্থিতিরব শোনা যেতো না। তৃতীয় শ্রেনীতে তিন ক্রমিক নাম্বারে একধরনের শুন্যতা ছিল, শুন্যতা ছিল আমার ভেতর।
কিন্তু সকল প্রকার শুন্যতা সে পূর্ন করে যেতো পরীক্ষা দিতে এসে। ছয়টা পরীক্ষা যেন ছয়টা ইদ। আমার এক বেঞ্চ সামনে সে বসতো। চমৎকার ওর হাতের লেখা। আমার জন্য ওর পক্ষ থেকে বরাদ্দ ছিল চমৎকার হাসি। ওর হাসি দেখে আমি কিছু সময়ের জন্য নায়ক সালমান শাহ হয়ে যেতাম -- শার্টের কালার খাড়া করে পড়া, শার্টের নিচ অংশ দিয়ে গিট্টু দেয়া, এক্কেবারে নায়ক। সেও হয়তো নিজেকে নায়িকা ভাবতো-- পরীক্ষা দিচ্ছে তো দিচ্ছে হঠাৎ হঠাৎ লেখা বন্ধ করে সে আমার দিকে তাকাতো । আমিও লেখা বন্ধ করে তার মৌনতার সমর্থন দিতাম।
আমরা কী করছি আমরা তখন জানি না, বয়সটা জানার ছিল না, বয়সটা ছিল কৌতূহলের। তার ফ্যালফ্যাল করে তাকানোর মাইদ্দে আমি একটা আস্তা জীবনের আস্তানা পেয়েছিলাম।
আমার সাথের বন্ধুরা রেজাল্ট ভালো করার জন্য প্রার্থনা করতো আর আমি প্রার্থনা করতাম আমার রোল যেন চার থাকে আর ওর তিন। যিনি মনের কথা পাঠ করতে পারেন তিনি আমার প্রার্থনা কবুল করেছিলেন। চতুর্থ শ্রেনীতে আমার রোল হয়েছিল চার আর ওর তিন।
চতুর্থ শ্রেনীতেও সে কোনো ক্লাস করতে আসেনি। কিন্তু তাকে দেখার জন্য মন ব্যাকুল হয়ে থাকতো, বাংলা সিনেমা দেখতে বসলে যে নায়িকাকে দেখা যেতো তার জায়গায় আমি ওকে ভাবতাম, আর নায়েকের জায়গায় আমি-- চলতো আমাদের অপেক্ষার পূর্নদৈর্ঘ বাংলা ছায়াছবি।
প্রথম সাময়িকী পরীক্ষা। আমি লাক্স সাবান দিয়ে গোসল করেছি যাতে শরীরে ভালো গন্ধ হয়, মাথায় দিয়েছি গানিভাঙা সরিষার তেল যাতে কচকচে কালো দেখায় চুল, মুখে মেখেছি ফেয়ার এন্ড লাভলী যাতে আমার কফি কালারের চেহারাখানা ধবধবে সাদা দেখায়, পরিধান করেছি ধবধবে সাদা শার্ট, আর ইংলিশ প্যান্ট।
পরীক্ষা চলছে। কয়েক মিনিট চলে গেলো। আমার সামনের বেঞ্চ ফাকাঁ। দেড় ঘন্টা চলে গেলো। সে এলো না। আমার মন এতো বিষন্ন দেখাচ্ছে যেন পরীক্ষায় একটি প্রশ্নও কমন পড়েনি। মনের ভেতরও যে একটি বিশাল ফাকাঁ জায়গা আছে আমি সেইদিন টের পেলাম।
পরীক্ষা শেষ।
সে এলো না। লজ্জায় কোনো স্যার ম্যাডামের সাথে কোনোদিন কথা বলার সাহস পাইনি। সেদিন মানে তার পরীক্ষায় না আসার দিন আমি হঠাৎ যেন সাহসী হয়ে উঠলাম। তার না আসার কারন জিজ্ঞেস করলাম স্যারদের। স্যার বললেন সে টি সি নিয়ে চলে গ্যাছে! তার চলে যাওয়া আমি মেনে নিতে পারেনি, নিজেকে পরিপূর্ন নায়ক মনে করতে লাগলাম। কারন বাংলা সিনেমায় তাই দেখতাম অর্থাৎ নায়িকা হঠাৎ করে হারিয়ে যায় কিংবা নায়িকার বাবা চাকরিসূত্রে অন্য কোথাও চলে যায়।
সারাটি বিকাল বিষন্ন এবং বিষন্ন। পশ্চিম আকাশে সূর্য চলে যাওয়ার দৃশ্য দেখা যাচ্ছে -- খুব লাল, খুবই লাল। আস্তে আস্তে সন্ধ্যা নেমে আসলো, হাউজবিল্ডিংগুলো ধীরে ধীরে লুকিয়ে ফেললো তার মুখ।
সে চলে গ্যাছে দেয়ালের ঐপাড়ের কোনো এক কনক্রিটের দালানে -- সেই হাউজিং -- ভদ্রলোকদের যেখানে আনাগোনা।
দেয়ালে ঔপাড়ে এখনো হয়তো সে পরীক্ষা দেয়, আমিও পরীক্ষা দেয় তবে দেয়ালে বাইরে মেঘনা নদীর পাড়ে কোনো এক ভাঙা ইস্কুলে -- আমার মন ভেঙে যে চলে গেলো তার জন্য না ও দায়ী, না আমি -- আমরা আমাদের জায়গায় দায়মুক্ত মানব মানবী....
আমাদের গ্রামের পাশেই মেঘনা নদী। মেঘনা নদীর পাশে একটি বিদেশি এলাকা। বিদেশী এলাকাটিকে আমরা হাউজিং বলি। সেখানে যতসব ভদ্রলোকদের জায়গা। সেখানে সেই মানুষটি যার ক্রমিক নং তিন সে থাকে। বিকেল বেলা বাজার চারতলার মাঠ থেকে হাউজিংয়ের দিকে তাকিয়ে থাকি, কখনো খেয়া নৌকায় চলে যাই নদীর ঐপাড়ে যদি তাকে দেখা যায়। হাউজিং এলাকাটি দেয়াল দিয়ে বেষ্টিত, আমার মতো সাধারন মানুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ, তথাপি দেয়ালের উপর দিয়ে ছাঁদে তাকিয়ে থাকতাম যদি তার দেখা পাই। তাকে কখনো দেখা যেতো না, তার মতো করে অনেকের দেখা পাই। মতো করে পাওয়া মানুষ দিয়ে কী আর জীবন চলে! জীবনের জন্য চাই সরাসরি জীবন।
সে তৃতীয় শ্রেনীতে কোনো ক্লাস করতো না। প্রত্যেক বার স্যার যখন ক্রমিক নং তিন বলে সম্বোধন করতেন কোনো উপস্থিতিরব শোনা যেতো না। তৃতীয় শ্রেনীতে তিন ক্রমিক নাম্বারে একধরনের শুন্যতা ছিল, শুন্যতা ছিল আমার ভেতর।
কিন্তু সকল প্রকার শুন্যতা সে পূর্ন করে যেতো পরীক্ষা দিতে এসে। ছয়টা পরীক্ষা যেন ছয়টা ইদ। আমার এক বেঞ্চ সামনে সে বসতো। চমৎকার ওর হাতের লেখা। আমার জন্য ওর পক্ষ থেকে বরাদ্দ ছিল চমৎকার হাসি। ওর হাসি দেখে আমি কিছু সময়ের জন্য নায়ক সালমান শাহ হয়ে যেতাম -- শার্টের কালার খাড়া করে পড়া, শার্টের নিচ অংশ দিয়ে গিট্টু দেয়া, এক্কেবারে নায়ক। সেও হয়তো নিজেকে নায়িকা ভাবতো-- পরীক্ষা দিচ্ছে তো দিচ্ছে হঠাৎ হঠাৎ লেখা বন্ধ করে সে আমার দিকে তাকাতো । আমিও লেখা বন্ধ করে তার মৌনতার সমর্থন দিতাম।
আমরা কী করছি আমরা তখন জানি না, বয়সটা জানার ছিল না, বয়সটা ছিল কৌতূহলের। তার ফ্যালফ্যাল করে তাকানোর মাইদ্দে আমি একটা আস্তা জীবনের আস্তানা পেয়েছিলাম।
আমার সাথের বন্ধুরা রেজাল্ট ভালো করার জন্য প্রার্থনা করতো আর আমি প্রার্থনা করতাম আমার রোল যেন চার থাকে আর ওর তিন। যিনি মনের কথা পাঠ করতে পারেন তিনি আমার প্রার্থনা কবুল করেছিলেন। চতুর্থ শ্রেনীতে আমার রোল হয়েছিল চার আর ওর তিন।
চতুর্থ শ্রেনীতেও সে কোনো ক্লাস করতে আসেনি। কিন্তু তাকে দেখার জন্য মন ব্যাকুল হয়ে থাকতো, বাংলা সিনেমা দেখতে বসলে যে নায়িকাকে দেখা যেতো তার জায়গায় আমি ওকে ভাবতাম, আর নায়েকের জায়গায় আমি-- চলতো আমাদের অপেক্ষার পূর্নদৈর্ঘ বাংলা ছায়াছবি।
প্রথম সাময়িকী পরীক্ষা। আমি লাক্স সাবান দিয়ে গোসল করেছি যাতে শরীরে ভালো গন্ধ হয়, মাথায় দিয়েছি গানিভাঙা সরিষার তেল যাতে কচকচে কালো দেখায় চুল, মুখে মেখেছি ফেয়ার এন্ড লাভলী যাতে আমার কফি কালারের চেহারাখানা ধবধবে সাদা দেখায়, পরিধান করেছি ধবধবে সাদা শার্ট, আর ইংলিশ প্যান্ট।
পরীক্ষা চলছে। কয়েক মিনিট চলে গেলো। আমার সামনের বেঞ্চ ফাকাঁ। দেড় ঘন্টা চলে গেলো। সে এলো না। আমার মন এতো বিষন্ন দেখাচ্ছে যেন পরীক্ষায় একটি প্রশ্নও কমন পড়েনি। মনের ভেতরও যে একটি বিশাল ফাকাঁ জায়গা আছে আমি সেইদিন টের পেলাম।
পরীক্ষা শেষ।
সে এলো না। লজ্জায় কোনো স্যার ম্যাডামের সাথে কোনোদিন কথা বলার সাহস পাইনি। সেদিন মানে তার পরীক্ষায় না আসার দিন আমি হঠাৎ যেন সাহসী হয়ে উঠলাম। তার না আসার কারন জিজ্ঞেস করলাম স্যারদের। স্যার বললেন সে টি সি নিয়ে চলে গ্যাছে! তার চলে যাওয়া আমি মেনে নিতে পারেনি, নিজেকে পরিপূর্ন নায়ক মনে করতে লাগলাম। কারন বাংলা সিনেমায় তাই দেখতাম অর্থাৎ নায়িকা হঠাৎ করে হারিয়ে যায় কিংবা নায়িকার বাবা চাকরিসূত্রে অন্য কোথাও চলে যায়।
সারাটি বিকাল বিষন্ন এবং বিষন্ন। পশ্চিম আকাশে সূর্য চলে যাওয়ার দৃশ্য দেখা যাচ্ছে -- খুব লাল, খুবই লাল। আস্তে আস্তে সন্ধ্যা নেমে আসলো, হাউজবিল্ডিংগুলো ধীরে ধীরে লুকিয়ে ফেললো তার মুখ।
সে চলে গ্যাছে দেয়ালের ঐপাড়ের কোনো এক কনক্রিটের দালানে -- সেই হাউজিং -- ভদ্রলোকদের যেখানে আনাগোনা।
দেয়ালে ঔপাড়ে এখনো হয়তো সে পরীক্ষা দেয়, আমিও পরীক্ষা দেয় তবে দেয়ালে বাইরে মেঘনা নদীর পাড়ে কোনো এক ভাঙা ইস্কুলে -- আমার মন ভেঙে যে চলে গেলো তার জন্য না ও দায়ী, না আমি -- আমরা আমাদের জায়গায় দায়মুক্ত মানব মানবী....
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন