বুধবার, ১৫ অক্টোবর, ২০১৪

তোরা যাও সেন

সামনে ইদ। কোরবানির ইদ। শিশুদের কাছে ইদ মানে জামাকাপড় কেনা, নতুন জামাকাপড় সমেত নিজেকে  প্রদর্শনী করা। আজকের শিশু আগামীকালের ভবিষ্যৎ। এই ভবিষ্যতের কাছে কোরবানীর ইদ মানেও প্রদর্শনী। তবে জামাকাপড় নয়, মোটামোটি চারপাওয়ালা হালাল জন্তু। কার গরু-মহিষ কত দামী, কেমন হৃষ্টপুষ্ট তাই ভবিষ্যতের কাছে গবেষণাময় অহংকারের কারণ, আলোচনার মূল কেন্দ্রবিন্দু। ইদের দিন সকালে শুরু হয় পশুনিধন অভিযান, শুরু হয় জীবিত পশুদের লাফালাফি, মাংসের বিপুলা আয়োজনে পূর্ণ হয় ঘরের ফ্রিজ!
কোরবানির ইদ বলেই বাড়ি যাবে গোধূলি।
গত রমজানের ইদে সে বাড়ি যায়নি। সারাদিন ঢাকা শহরের একটি নির্জন রুমে একা। চলে কেবল নিজের সাথে নিজের কথা।
কতক্ষণ জলের মতো একা একা কথা বলা যায়?
নিজেকে আড়াল করার অভিধান খুঁজে গোধূলি। ট্রিপটেন সেবন করে। চলে ঘুম-ঘুম খেলা। দুতলা বাড়ির সবটাই তার, তার একাকিত্বের একতলা। ঔষধের যৌবন ফুরিয়ে যায়, জেগে উঠে গোধূলির চৈতন্য। চেতনার চোখে সে দেখে --
 মা তার নতুন শ্বশুর বাড়িতে বেশ আমোদে আছে, বাবা তার নতুন বউয়ের সাথে পার করছে হানিমুন সময়। তাঁর খোঁজ নেয়ার আধটুকু সময় নেই তাদের খতিয়ানে। তাদের কাছে উৎসব আসে রঙ্গিলা সাজে আর গোধূলি দুংখের চুলায় সরবরাহ করে জ্বালানী।
গ্রামে জ্বালানী বেশ সস্তায় পাওয়া যায়। এই ইদে গোধূলি গ্রামের বাড়ি যাচ্ছে। তার বাবারও মমতার সদর দরজা হঠাৎ যেন খুলে গেল। ইদ উপলক্ষে স্পেশাল অফার। কোরবানির ইদ বলে কথা। বাবার গাড়ি করেই গোধূলির ইদের বাড়ি যাওয়া।
গোধূলির বয়স আঠারো। বয়স বৃদ্ধিতে দুংখের অবদান অনস্বীকার্য। তাইতো গোধূলির মানসিক বয়স কবেই আটাশের উপরে।
গ্রামের মাটিতে পা রাখার পর গোধূলির বয়স সাত-আটে নেমে আসে। শিশুবয়সী খেলায় মেতে উঠে। বউছি, কানামাছি, গোল্লাছুট, ক্রিকেট অর্থাৎ যখন যা সুযোগে আসে তাই নিয়ে ভেসে বেড়ায় চেনাজানা গ্রামের এপাশ-ওপাশ।
গোধূলি যখন প্রজাপতির ডানার মতো উড়তে থাকে তখন এক অচেনা তবুও চেনা দুটি চোখ করুণ রাগের ঘুড়ি উড়ায়। ঘড়িটা গোধূলির ডানায় আশ্রয় নিতে যায় কিন্তু বাস্তবতার নাটাই তাকে টেনে ধরে রাখে। আবেগমোড়ানো যে বোধ তা যে প্রবোধ মানে না! সামাজিক নিয়মকে কলা দেখিয়ে বন্যমন প্রকাশ করে চলমান সত্য--

-লিজা, শোন তো এনা
-হালা মোর সাথে আসে এত্তু কোনা পরে আস স, অক বাইত দিয়া আস
-না এলাই শোন
-তোরা ক্যাংকা আসেন?
-মুই ভালোই আসো, কিসু কবু?
-মুই যে তোমাক সারাদিন দেখ, তোরা কি স্যাটে জানেন না?
-হ জানয় তো, সবাই দেকে, তার কি হোসে?
-মুই ত সারাদিন দ্যাকো, কিশক তোরা বুজেন না?
-তোমাক মোর ভালো নাগে স্যাটে কি তোরা জানেন না?
-না জাননা, তুই দেকিস ক্যা?
-তোমাক মুই ভালোবাসো, সেই জন্য
-ভালা, তুই পড়িস?
-হ, মাদ্রেসাত যাও, বকরা ইদে সুটিত আইসো, আব্বা ফির জাবা মানা কসসেল, একন তোমার জন্য যাম
-ভালা, তুই যদি পড়া শ্যাস করি ঢাকাত ভালো চাকরি নিব্যা পারিস তাহলে তোক দি বিয়্যা বশিম
-ভালা, মোনে থোন কোল, পরে ফির ভুলি যান না
-ভালা, একন বাইত যা কুটকুট্যা আন্দার হোসে, ভয় নাগবি এ্যালা

লাটিম আনন্দে আনহা আনহা করতাছে। এতো কাল যার জন্য মনের জমানো কথাগুলো ছিল অকহতব্য, আজ তা সফল কুহুকথা। নদীর বয়ে চলা যেন আনন্দের ফুল্লুধারা। এতো সহজে বলা যায়নি সহজ কথাটি কিন্তু কী সহজে হয়ে গেল মানা!
লাটিম এখন পড়াশোনা করবেই। বনের পাখিকে খাঁচায় বন্দী করার ব্যাপারে সে প্রত্যয়ী। শহুরের খাঁচায় যে পাখি বন্দী থাকে সে পাখি যে পৃথিবীর খাঁচায় অমায়িক তা লাটিমের জানবার কথা নয়। আর সব কথা জেনে লাটিমরা জীবন চালনাও করে না, তাদের জীবন যন্ত্রের চেয়ে একটু নয় অধিকাংশ উপরে!

-আব্বা, মুই এ্যালাই কামত নাগব্যা নো, ফির পড়ব্যা যাম
-তাহালে তোক ভাত কাপড়া দিবি কে?
-মোরটা মুই করিম,তোমাক দিব্যা নাগব্যা লায়, তোরা যদি বেশী বিত্যাবিতি করেন তাহালে মুই কোল একবারে বাইত তে বাড়ে যাম, ব্যাটার মুক আর দেকপ্যা পাবা নেন, কয়া দিনু

গোধূলির সংক্ষিপ্ত সময় শেষ, শেষ জ্বালানী সংগ্রহের সময়। লাটিমের অসীম সময় শুরু। লাটিম রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে গোধূলিকে বিদায় জানাবে, স্মৃতিময়  শুদ্ধ চোখের জল গোধূলির পায়ে রাখবে, যে পা আস্তে আস্তে শহরের সেই জেলখানায় প্রবেশ করবে, প্রবেশ করবে চেনা তবুও অচেনা মানুষটির নিকোটিন রুমে!


-তোরা যাও সেন..? ফির কুন্দিন আস্মেন?
-আসিম.। ইস্কুল সুরটি দিলেই আসিম....

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন