গ্রামের মানুষ ভয় পেতে ভালোবাসে। ভয় সমেত জীবনযাপনে বেশ আরামবোধ করে তারা। ভয় তাদের অভ্যাসগত, চেতনাগত। ভয়কে জয় করার মতো যে মনন, যে মেধা প্রয়োজন তা তাদের হয়ে উঠে না। অনন্ত প্রচেষ্টায় অসম্ভব সম্ভব হতে বাধ্য। হয়তো তাদের মধ্যে চেষ্টার ঘাটতি প্রবলভাবে, হয়তো ভয়কে লালন করা তাদের বেঁচে থাকার ম্যানিয়া।
ভয়ের উপকরণ, উপাদান তাদের গ্রাস করে ফেলে -- তাও তারা নিয়তির দান হিসাবে মেনে নেয়। আহারে, তৃপ্তিও কত অসাধারণভাবে অজ্ঞ হতে পারে!
সহজ, সরল মানুষের আজন্ম লালিত ভয়কে পুঁজি করে গড়ে উঠে এক শ্রেণির গ্রাম্য ডাক্তার। এই গ্রাম্য ডাক্তাররা ওঝা, কবিরাজ, পীরবাবা, হিরালী নামে পরিচিত।
যারা সাপের বিষ নামায় তাদেরকে বলা হয় ওঝা, আর যারা কঠিন শিলার আঘাত থেকে মন্ত্র বলে মাঠের ফসলকে রক্ষা করে তাদেরকে বলা হয় হিরালী।
কুন্দলাল হিরালী। মাঠকে যে দেশের লোক `আওর' বলে কুন্দলাল সে দেশের লোক।
বর্ষায় আওর এলাকায় চমৎকার বৃষ্টি হয়। বর্ষার আওর দেখতে নিষ্পাপ আর লাবন্যময়ী। আওর, পানি, ধানের যুবতী যুবতী শিষ যেন সৌন্দর্যের এক অনিন্দ্য মোহনা। একসময় আকাশ থেকে নাযিল হয় শিলাবৃষ্টি ,দুধেভরা যুবতী শিষগুলোর কুমারী দেহ রক্তাক্ত করে। সম্মান নিয়ে তারা আর আকাশের দিকে তাকাতে পারে না। আকাশকে বিয়ে করার যে তীব্র ইচ্ছা শিষগুলো ধারণ করে তা ভেঙে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়।
কুন্দলাল অনেক আওররাণীর ( ধানের শিষ) সম্মান রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছে। তাতেই তার কদর এলাকাতে প্রবল। কিন্তু সবচেয়ে বড় যে আওরটি ( শনির আওর) তার সম্মান রক্ষা সে করতে পারেনি। চাষীরাও তা কপাল বলে মেনে নেয় (There are two senses in which the term "luck" is used, the prescriptive, and the descriptive. Luck, in the descriptive sense, is merely a name we use in describing fortunate events after they have already happened. However, luck in the prescriptive sense is what is meant when one says they either have, or don't have, a belief in luck)। কুন্দলাল চুপচাপ বসে থাকে, চুপিচুপি চোখের জল বির্সজন দেয় আওরের মানুষ।
হতাশপ্রাণ আওরের মানুষের জীবনস্রোতে আশা নিয়ে আসে চৈতা। সে পূর্ব দেশের সুসং পাহাড়ের কাছ থেকে আসে। অল্প বয়স হলেও পাকা হিরালী।
বিশ্বাস করাও গ্রামের মানুষের জৈবিক কাজ। তারা চৈতাকে বিশ্বাস করে মনেপ্রাণে। লক্ষীও চৈতাকে বিশ্বাস করে। বিশ্বাস সংক্রামিত। চৈতাও লক্ষীকে বিশ্বাস করে। বিশ্বাসের বাজারে দেখা মেলে ভালোবাসার, দেখা মেলে প্রেমের।
চৈতা-লক্ষী প্রেমের আবডালে আড়ালে উড়াউড়ি করে। সবুজ ধানের সাথে মিশে যায় সবুজ লক্ষী, শুধু লাল কাপড়ের আঁচলটুকু দূর থেকে চৈতার চোখের কোণে খেলা করে। নতুন একটা পুলকে বিবশ হয়ে হয়ে যেতে চায় চৈতার সারা দেহমন।
ছোটবেলা থেকে চৈতা একা। এই প্রথম চৈতা সামাজিক। চৈতা আজ পরিপূর্ণ পুরুষ। লক্ষীর উদাম হাসি ( হাসতে হাসতে লক্ষী বলে, খুব রাগ করবাম, তোমার মতো মাইনষের লগে রাগ করবাম না তো কী করবাম? তুমি কী রকম বোকা) চৈতার আবেগের আনায় ফেনা তোলে। ফেনার ঢেউ লক্ষীর বাড়ির সবপাশ ঘুরপাক খায়।
একদিন আকাশ ফেটে বৃষ্টি নামে (এমনি দিনে তারে বলা যায়, এমন ঘন ঘোর বরিষায়! )। বৃষ্টির নৃত্য প্রেমিক মনকে উতলা করে। প্রেমিক মন ছুটে চলে কুন্দলালের বাড়ি ( লক্ষী কুন্দলালের একমাত্র কন্যা)। উঠানের মাঝে তখন ছড়া কেটে নাচতে নাচতে দুহাত দিয়ে বৃষ্টির জলকে জড়িয়ে ধরছে লক্ষী। মুগ্ধ হয়ে যায় চৈতা, বলে উঠে, লক্ষীরাণী। ঝড়ের মতো ছুটে এসে লক্ষী লুটিয়ে পড়ে চৈতার প্রশস্ত বুকে। নিবিড়ভাবে লক্ষীকে জড়িয়ে ধরে নিস্পন্দ পাথরের মতো নিশ্চল হয়ে যায় চৈতা।
ঠিক সেই মুহূর্তে উঠানে এসে দাঁড়াল সত্য প্রেমের শত বাধা `কুন্দলাল'।
বাবা, তাদের প্রণয়কাব্যকে স্বীকৃতি দেয়নি। গ্রামের মেয়েদের জীবন এমনই। তাদের স্বপ্ন নির্ধারণ করে স্বপ্নহীন অবিভাবক।
নতুনপুরের রতন দাসের সাথে লক্ষীর বিয়ে হয়।
লায়লী এখন ঘুরে মনের বনে আর মজনু ফুলের বাগানে। এক প্রেমে দুইজন মরা। শান্তি নেই মনে, প্রশান্তি নেই বাগানে।
এখন চৈতার মিশন ` শনির আওর ' রক্ষা। তাতে তার জীবনের ঝুঁকি প্রবল। তাতে কী? সে একা ছিল, দুজন হলো, আবার একা না হয়ে শুন্য হয়ে যাওয়া ভালো।
শুরু হয় চৈতার মন্ত্রপাঠ। আকাশে পুঞ্জীভূত পাথর অঝোরে চৈতার মাথার উপরে পড়তে থাকে। বাতাসে একটি এতিম শব্দ একবারে জন্য শোনা যায়। এরপরই সব চুপ।
চুপ হয়ে যায় নীলু দাসের ( 1930-2004) ``চৈতার খাল " গল্পটি।
গল্পটা সম্ভাব্য লেখকের প্রথম প্রকাশিত গল্প।এটি মাহে-নেও ( আবদুল কাদের সম্পাদিত) পত্রিকায় 1957 সালের আগষ্ট মাসে প্রকাশিত হয়।
এই গল্পে শেক্সপিয়ারসিনড্রোম স্পস্ট। স্পষ্ট বর্নাঢ্য বর্ণনা। বর্ণনার মানদণ্ড সময় নয়, স্মৃতি। বর্ণনা বিকশিত হতে থাকে বৃক্ষবিস্তারের মতো। প্রথমে গল্পকথক, তারপর জয়চরণ, আর জয়চরণের মুখে কিংবদন্তীর বুনন। গল্পকার এখানে নিছক ফটোগ্রাফার। ফলে আমরা পাই লোকায়িত জীবনের যাপিত জীনববোধের জাবরকাটা গরম ফোটেজ, এক অখণ্ড সৌন্দর্যবোধ।
ভয়ের উপকরণ, উপাদান তাদের গ্রাস করে ফেলে -- তাও তারা নিয়তির দান হিসাবে মেনে নেয়। আহারে, তৃপ্তিও কত অসাধারণভাবে অজ্ঞ হতে পারে!
সহজ, সরল মানুষের আজন্ম লালিত ভয়কে পুঁজি করে গড়ে উঠে এক শ্রেণির গ্রাম্য ডাক্তার। এই গ্রাম্য ডাক্তাররা ওঝা, কবিরাজ, পীরবাবা, হিরালী নামে পরিচিত।
যারা সাপের বিষ নামায় তাদেরকে বলা হয় ওঝা, আর যারা কঠিন শিলার আঘাত থেকে মন্ত্র বলে মাঠের ফসলকে রক্ষা করে তাদেরকে বলা হয় হিরালী।
কুন্দলাল হিরালী। মাঠকে যে দেশের লোক `আওর' বলে কুন্দলাল সে দেশের লোক।
বর্ষায় আওর এলাকায় চমৎকার বৃষ্টি হয়। বর্ষার আওর দেখতে নিষ্পাপ আর লাবন্যময়ী। আওর, পানি, ধানের যুবতী যুবতী শিষ যেন সৌন্দর্যের এক অনিন্দ্য মোহনা। একসময় আকাশ থেকে নাযিল হয় শিলাবৃষ্টি ,দুধেভরা যুবতী শিষগুলোর কুমারী দেহ রক্তাক্ত করে। সম্মান নিয়ে তারা আর আকাশের দিকে তাকাতে পারে না। আকাশকে বিয়ে করার যে তীব্র ইচ্ছা শিষগুলো ধারণ করে তা ভেঙে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়।
কুন্দলাল অনেক আওররাণীর ( ধানের শিষ) সম্মান রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছে। তাতেই তার কদর এলাকাতে প্রবল। কিন্তু সবচেয়ে বড় যে আওরটি ( শনির আওর) তার সম্মান রক্ষা সে করতে পারেনি। চাষীরাও তা কপাল বলে মেনে নেয় (There are two senses in which the term "luck" is used, the prescriptive, and the descriptive. Luck, in the descriptive sense, is merely a name we use in describing fortunate events after they have already happened. However, luck in the prescriptive sense is what is meant when one says they either have, or don't have, a belief in luck)। কুন্দলাল চুপচাপ বসে থাকে, চুপিচুপি চোখের জল বির্সজন দেয় আওরের মানুষ।
হতাশপ্রাণ আওরের মানুষের জীবনস্রোতে আশা নিয়ে আসে চৈতা। সে পূর্ব দেশের সুসং পাহাড়ের কাছ থেকে আসে। অল্প বয়স হলেও পাকা হিরালী।
বিশ্বাস করাও গ্রামের মানুষের জৈবিক কাজ। তারা চৈতাকে বিশ্বাস করে মনেপ্রাণে। লক্ষীও চৈতাকে বিশ্বাস করে। বিশ্বাস সংক্রামিত। চৈতাও লক্ষীকে বিশ্বাস করে। বিশ্বাসের বাজারে দেখা মেলে ভালোবাসার, দেখা মেলে প্রেমের।
চৈতা-লক্ষী প্রেমের আবডালে আড়ালে উড়াউড়ি করে। সবুজ ধানের সাথে মিশে যায় সবুজ লক্ষী, শুধু লাল কাপড়ের আঁচলটুকু দূর থেকে চৈতার চোখের কোণে খেলা করে। নতুন একটা পুলকে বিবশ হয়ে হয়ে যেতে চায় চৈতার সারা দেহমন।
ছোটবেলা থেকে চৈতা একা। এই প্রথম চৈতা সামাজিক। চৈতা আজ পরিপূর্ণ পুরুষ। লক্ষীর উদাম হাসি ( হাসতে হাসতে লক্ষী বলে, খুব রাগ করবাম, তোমার মতো মাইনষের লগে রাগ করবাম না তো কী করবাম? তুমি কী রকম বোকা) চৈতার আবেগের আনায় ফেনা তোলে। ফেনার ঢেউ লক্ষীর বাড়ির সবপাশ ঘুরপাক খায়।
একদিন আকাশ ফেটে বৃষ্টি নামে (এমনি দিনে তারে বলা যায়, এমন ঘন ঘোর বরিষায়! )। বৃষ্টির নৃত্য প্রেমিক মনকে উতলা করে। প্রেমিক মন ছুটে চলে কুন্দলালের বাড়ি ( লক্ষী কুন্দলালের একমাত্র কন্যা)। উঠানের মাঝে তখন ছড়া কেটে নাচতে নাচতে দুহাত দিয়ে বৃষ্টির জলকে জড়িয়ে ধরছে লক্ষী। মুগ্ধ হয়ে যায় চৈতা, বলে উঠে, লক্ষীরাণী। ঝড়ের মতো ছুটে এসে লক্ষী লুটিয়ে পড়ে চৈতার প্রশস্ত বুকে। নিবিড়ভাবে লক্ষীকে জড়িয়ে ধরে নিস্পন্দ পাথরের মতো নিশ্চল হয়ে যায় চৈতা।
ঠিক সেই মুহূর্তে উঠানে এসে দাঁড়াল সত্য প্রেমের শত বাধা `কুন্দলাল'।
বাবা, তাদের প্রণয়কাব্যকে স্বীকৃতি দেয়নি। গ্রামের মেয়েদের জীবন এমনই। তাদের স্বপ্ন নির্ধারণ করে স্বপ্নহীন অবিভাবক।
নতুনপুরের রতন দাসের সাথে লক্ষীর বিয়ে হয়।
লায়লী এখন ঘুরে মনের বনে আর মজনু ফুলের বাগানে। এক প্রেমে দুইজন মরা। শান্তি নেই মনে, প্রশান্তি নেই বাগানে।
এখন চৈতার মিশন ` শনির আওর ' রক্ষা। তাতে তার জীবনের ঝুঁকি প্রবল। তাতে কী? সে একা ছিল, দুজন হলো, আবার একা না হয়ে শুন্য হয়ে যাওয়া ভালো।
শুরু হয় চৈতার মন্ত্রপাঠ। আকাশে পুঞ্জীভূত পাথর অঝোরে চৈতার মাথার উপরে পড়তে থাকে। বাতাসে একটি এতিম শব্দ একবারে জন্য শোনা যায়। এরপরই সব চুপ।
চুপ হয়ে যায় নীলু দাসের ( 1930-2004) ``চৈতার খাল " গল্পটি।
গল্পটা সম্ভাব্য লেখকের প্রথম প্রকাশিত গল্প।এটি মাহে-নেও ( আবদুল কাদের সম্পাদিত) পত্রিকায় 1957 সালের আগষ্ট মাসে প্রকাশিত হয়।
এই গল্পে শেক্সপিয়ারসিনড্রোম স্পস্ট। স্পষ্ট বর্নাঢ্য বর্ণনা। বর্ণনার মানদণ্ড সময় নয়, স্মৃতি। বর্ণনা বিকশিত হতে থাকে বৃক্ষবিস্তারের মতো। প্রথমে গল্পকথক, তারপর জয়চরণ, আর জয়চরণের মুখে কিংবদন্তীর বুনন। গল্পকার এখানে নিছক ফটোগ্রাফার। ফলে আমরা পাই লোকায়িত জীবনের যাপিত জীনববোধের জাবরকাটা গরম ফোটেজ, এক অখণ্ড সৌন্দর্যবোধ।
''ভাটির অঞ্চলের রূপকার হিসেবে পরিচিত নীলু দাস ভাটির অঞ্চলের মানুষদের বাংলাদেশের বিশেষ করে সাতচলিস্নশ উত্তর বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে প্রথম আবিষ্কার করেন। ''- ড: আমিনুর রহমান সুলতান
উত্তরমুছুনগ্রামের মেয়েদের জীবন এমনি....
উত্তরমুছুনভালো লাগলো।
উত্তরমুছুন