বৃহস্পতিবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৫

মায়ের কাছে

একটি ভালো পাস করেছি। পৃথিবীর কাছে পাসটা খুব বড় ছিল কিনা জানি না কিন্তু গ্রামের মানুষের কাছে পাসটা বড়ই ছিল। নিজেকে সম্মান দিতে লাগলাম। মনে মনে সম্মানিতবোধ করছি। সিদ্ধান্ত নিলাম এলাকার কোনো কলেজে ভর্তি হবো না, মনটা তালগাছ হয়ে গেলে যেমন হয়।   সিদ্ধান্ত নিলাম কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে ভর্তি হবো। যেই সিন্ধান্ত সেই কাজের পেছনে দৌড়।

কুমিল্লায় তখন চেনাজানা লোক তেমন কেউ ছিল না। একজন মানুষকেই চিনতাম ,একজন মানুষের রুমেই একরাত যাপন করেছিলাম । চমৎকার মানুষ। চমৎকার তার আতিথেয়তা।

লিটন দা কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে ম্যাথমেটিক্সের ছাত্র। ম্যাথ সে ভালোই বুঝে। সকাল-সন্ধ্যা টিউশনি করে। তার জনপ্রিয়তা গন্ধময় হয়ে ওঠে। মাস শেষে পকেটে যথেষ্ট টাকা জমা হতে থাকে। বেশ চলে, বেশ পড়ায়, বেশ তার বেশভূষা।

নুরাইন তার কাছে পড়ে। ম্যাথ পড়ে। সাধারণত সে একজন করে পড়ায় না। তারপরও অবিভাবক মহল খুব করে লিটন দা'কে ধরেছেন, তাই সে না শব্দটি উচ্চারণ করতে পারে নি। প্রতি সন্ধ্যায় লিটন দা নুরাইনদের বাসায় যায়। ম্যাথ পড়াতে পড়াতে এক সময় জীবনের ম্যাথ নিয়ে কথা বলতে শুরু করে। (a+b)√ এর পরিবর্তে জীবন স্কয়ার নিয়ে আলোচনা চলে। অভিভাবক মহল বিষয়টি টের পান -- লিটন তো ভালো ছেলেই, দেখতে শুনতেও খারাপ না।

একদিন অভিভাবক তাদেরকে কোনো এক ঘনিষ্ঠ মুহুর্তে আবিষ্কার করেন। সুতরাং ঘনিষ্ট মুহুর্তের একটি সামাজিক স্বীকৃতি প্রয়োজন। তাদের বিয়ে করিয়ে দেয়া হয়। লিটন দা বিবাহিত।

লিটন দা'র জন্মের কয়েক বছর পর তার বাবা মারা যান। লিটন দা'র মা তার চেহারা দেখে দেখে দিনযাপন করতে থাকেন। লিটন দা বড় হয়, কলেজ পাশ করে, সম্মান পড়বে। মায়ের আঁচল ছেড়ে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে ভর্তি হয় সে।একটি কৈ মাছ জলের আশায় লাফ দিয়ে সাগরে পড়ে।

রাস্তার পাশে লিটন দা'দের বাড়ি। সোঁ সোঁ করে সিএনজি চলে যায়। মা দৌঁড় দিয়ে রাস্তায় যান, এই বুঝি আমার সোনা এলো, এই বুঝি আমার লিটন এলো। না, লিটন  আসেনি। লিটন নুরাইনকে নিয়ে সন্ধ্যাযাপন করছে, বাদাম খাচ্ছে, আর তার খোসা ছুড়ে ফেলে দিচ্ছে। অসহায় খোসা মৃত্যুকে মেনে নিয়ে ডাস্টবিনে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। বাড়ির আম গাছের চিকন ডালে বসে কাক কা কা করে। মার মন আনন্দ ভরে ওঠে। কা কা শব্দের পেছনে মা লিটনের আগমনবার্তা দেখতে পান। একদিন যায়, দুই দিন যায় তিন দিন যায়, কাকের কা কা ফুরিয়ে যায় ,লিটন তো আর আসে না। লিটন নুরাইন আর তার ছোট ভাইকে নিয়ে কুমিল্লা বার্ডে ঘুরেফিরে । তারা ফুচকা  খায়, হালিম খায়, জীবনের গল্প করে, নানা খুঁনসুটি আর রসিকতায় মগ্ন থাকে। মা  চকবাজারে যান। মোবাইলঘরে লিটনের ফোনের খোঁজ করেন। লিটন ফোন দিয়েছিল কিনা জানতে চান। কিন্তু মা জানেন না গ্রামের বুড়া মানুষটির কাছে ফোন করার সময় লিটনের নেই। সে এখন মহা ব্যস্ত মানুষ। সে এখন গোমতী নদী চিনে, সে এখন গোমতীর পাড়ে গোধূলী লগ্নে হাঁটতে জানে।

গভীর রাতে মা দুঃস্বপ দেখে লিটন লিটন বলে চিৎকার করে ওঠেন, মা আস্তে আস্তে টিউবওয়েলের কাছে যান, এক গেলাস পানি খেয়ে তৃষ্ণা মেটানোর চেষ্টা করেন।  লিটন তখন দেহের রন্ধনকলা শেষ করে আধুনিক লাইট জ্বেলে ওয়াশ রুমে নিজের শরীরে পরিষ্কার করে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিতে থাকে।

ইতিমধ্যে লিটন ভালো একটি এনজিওতে চাকরি পেয়েছে। ভালো বেতন। দাম্পত্য জীবন আরও রসালো হয়ে ওঠে।  মাঠে খাঁ খাঁ রোদ ফলে, রোদ ঘন হয়ে আসে মায়ের হৃদয়ের ক্যাম্পাসে, মা ছটফট করে।রোদের তীব্রতা বাড়ছে-কমছে, মা হৃদয়ের হাহাকার বাড়ছে বই কমছে না।

লিটন এখন নয়টা-পাঁচটা ডিউটি করা মানুষ। মায়ের কথা এখন তার মনে পড়ে। ফোন করার সাহস পায় না । মা কবিরাজের বাড়ি যান, তাবিজ নিয়ে আসে। চারটি তাবিজ। বাড়ির চারকোণার চারটি গাছে ঝুলিয়ে দেন। তাবিজ দুলে আর মা বিশ্বাস করতে থাকেন লিটনের মন এই বুঝি বাড়ির দিকে ঝুঁকছে, দুলছে।

লিটনের পায়ের ব্যথাটা আবার দেখা দিয়েছে। নুরাইন বলে টেনশন করো না, শীতকালে বাতের ব্যথা একটু বেড়েই থাকে। ব্যথা বাড়ছে। দিন যাচ্ছে। আরও ব্যথা বাড়ছে। অফিসে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে সে। ডাক্তার ব্যথানাশক ঔষধ দিয়েছে। ঔষধ খেলে আগে পায়ের ব্যথা থেমে যেতো। এখন থামছে না। ঢাকা শহরের বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাছে সিরিয়াল নেয় নুরাইন। ডাক্তার হাজারটা
চেকআপ দেয়। প্রতি চেকআপে হাজার হাজার টাকা। লিটনের জমানো টাকা প্রায় শেষ হয়ে আসে। লিটনের মনে জন্ম নেয়া বিন্দু বিন্দু ভয় ভয়ানক বৃত্ত তৈরি করে।

ডাক্তারের ফাইনাল রিপোর্ট। মাসল ওয়াস্টিং। ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশনের ফল। পা কেটে ফেলে দিতে হবে। মায়ের হাতের কাঁচের গ্লাসটি মাটিতে পড়ে ভেঙে যায়।

দুধ মিয়া ফোন নিয়ে আসে।

চাচি, লিটন ফোন করেছে....

মা বিশ্বাস করতে পারেন না। কাঁদো কাঁদো  গলায় লিটনের আম্মা ডাক মোবাইলের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ছিদ্র বেয়ে ভেসে আসে। মা কথা বলা ভুলে যান। লিটন মাকে তার অসুখের কথা জানায়।

লিটনকে মা বাড়ি নিয়ে আসেন।নুরাইন গ্রামের কাদামাটির ঘরে আসেনি। শহরের  দালান, ফাস্টফুডে অভ্যস্ত সে, এক শহুরে লিটনের প্রতি তার অভ্যাসগত টান ছিল। কিন্তু মা,
পৃথিবীতে মা-ই একমাত্র আত্মা যে সন্তানের কঙ্কাল নিয়ে ঘুমাতে পারেন। লিটল ব্যথায় অস্থির। মায়ের অস্তিরতা আরও বেড়ে যায়। পৃথিবীতে মা-ই একমাত্র নারী যিনি সন্তানের সহমর্মি হতে পারেন।

বাংলাদেশের ডাক্তার লিটনের পা কেটে ফেলার প্রস্তাব দেয়। মা তাতে রাজি হননি। বাড়ির পাশের জমিটুকু মা বিক্রি করে ফেলেন । লিটনকে ইন্ডিয়া নেয়া হয়। মাও সাথে যান। ইন্ডিয়ান ডাক্তাররা লিটন দা'র নিজয়েন্ট মেটাল দিয়ে পরিবর্তন করে দেয়। লিটন দা আর কোনোদিন বাম পা ভাঁজ করতে পারবে না, কোনোদিন না।



লিটন  দা এখন বাড়িতে। এখন আবার টিউশনি করানো শুরু করেছে। ভালোই টাকা আসে। এখনো সিএনজি সোঁ সোঁ করে চলে, কাক কা কা করে ডাকে। কিন্তু মা আর বিচলিত হন না।

লিটন দা আবার বিয়ে করেছে। মায়ের পছন্দে, লিটল দা এখনো পুরোপুরি সুস্থ হয়নি। মেয়েটি লিটন দা'র অসুস্থতার ভার একটু হলেও হালকা করার চেষ্টা করে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন