বাসে খুব একটা ভ্রমণ আমার করা হয়ে ওঠেনি। ভ্রমণযান হিসাবে নৌকা আর ট্রেন সবচেয়ে প্রিয়। নৌকার সাথে পরিচয় মায়ের পেট থেকে। যদিও নানাবাড়ি ঠাকুরদাদার বাড়ি থেকে অল্প দূরত্বের পথ তবুও মা আমার নৌকাযানে আসা-যাওয়া করতো। অবশ্যই বর্ষার সময়।
মাসির বাড়ি দুইভাবে যাওয়া যায়। পায়ে হেঁটে এবং নৌকাযানে। কখনো আমাদের বাড়ির ঘাট থেকে নৌকা রিজার্ভ করে সরাসরি মাসির বাড়ির ঘাটে, আবার কখনো লোকাল নৌকাযানে। লোকাল নৌকাযানটি বাইশ মৌজা বাজারে নোঙর করে। তারপর বাকি পথ পায়ে হেঁটে। বাকি পথ বলতে প্রায় ছয় সাত মাইল পথ।
আমি আর আম্মা হাঁটা ধরতাম। আম্মা অনেক দ্রুত হাঁটতে পারে। অনেক দ্রুত। প্রতিযোগিতা করে হাঁটতো। চোরা প্রতিযোগিতা। সামনের মানুষটাকে টার্গেট করে তার সামনে এগিয়ে যাওয়ার তীব্র চেষ্টা। তাতে আম্মা সফলও হতো। একটি লোককে অতিক্রম করার সাথে সাথে আম্মা আর আমি মিলে হাসতাম। মা ছেলের বিজয়ী হাসি। অবশ্যই এই হাসির কারন পৃথিবীর মানুষের জানবার কথা নয়।
নৌকা থেকে জলের দৃশ্য অসাধারণ। হযরত আলীর নৌকা। আমাদের ঘাট থেকে দুটি নৌকা বাইশ মৌজার উদ্দেশে ছেড়ে যায়। মলাই মিয়ার নৌকা আর হযরত আলীর নৌকা। হযরত আলীর নৌকা বামন টাইপের শক্তিশালী। তাই হযরত আলীর নৌকাটি আমাদের খুব প্রিয়। আমি ছাঁদে, টিনের ছাঁদে বসে জলের খেলা দেখি। মেঘনা নদীতে যদিও তেমন স্রোত নেই আজ মনে হয় কিন্তু তখন মেঘনা নদীর স্রোত মনে বিশেষ এক থ্রিলিং তৈরি করতো। তিমি মাছ লাফ দিয়ে দিয়ে নৌকার এক পাশ থেকে আরেক পাশ গিয়ে পড়তো। জলরং ঘেষা কালো তিমির।
মাছরাঙা, তাদের মাছশিকার। আকাশ থেকে হঠাৎ করে চিলের আক্রমণ। মাঝিনৌকা, তাদের মাছধরা। লালপুর গ্রাম থেকে ভেসে আসা শুঁটকি শুঁটকি গন্ধ। পালতোলা নৌকার জলে-বাতাসে ভেসে চলা। আন্ডার প্যান্ট পড়ে বের বাওয়া জেলেদের হাসির বিন্দু বিন্দু দৃশ্য। অনেক অনেক, আরো আরো মনমাতানো নয়নাভিরাম দৃশ্যকর্ম দেখে কখন যে বাইশ মৌজা বাজারে পৌঁছে যেতাম তা বলতেই পারতাম না। তারপর মাসির বাড়ি উদ্দেশে যাত্রা অর্থাৎ কৃষ্ণনগর গ্রাম। অসম্ভব সুন্দর গ্রাম। বাঁশঝাড় প্রচুর। বাঁশপাতার সাথে বাতাসের সম্পর্ক হলে একধরনের সুর উৎপন্ন হয়ে থাকে যেখানে কৃষ্ণের বাঁশি জীবন্ত। এক কথায় বললে গ্রামটি সবুজের সন্তান, মানুষ সবুজসন্তানের উপাদান। এই গ্রামেই আমি কৃষ্ণনামের সাথে পরিচিত হয়, পরিচিত হয় রাধার কান্নার সাথে।
বাসে খুব একটা ভ্রমণ আমার করা হয়ে ওঠেনি। ভ্রমণযান হিসাবে নৌকা আর ট্রেন।
ট্রেনে আমি বসা। আমার পাশে এক মুরুব্বি লোক। আমি তাকে বসতে দিলাম। আমি যেখানে দাঁড়ানো তার পাশে একটি সিট। শোভন চেয়ার। দুইজন একসাথে বসা যায়। দুইজনই বসা। একজন মেয়ে, একজন পুরুষ।
হঠাৎ দেখি মেয়েটি কী যেন খুঁজছে। নাকফুল খুঁজছে।
পুবাইল স্টেশন চলে গেল, ঘোড়াশাল চলে গেল, টঙ্গী স্টেশন চলে গেল। নাকফুল পাচ্ছে না তো পাচ্ছে না। আশেপাশের সবাই চেষ্টা করলো। সবার চেষ্টা বৃথা। আমি তখনও চেষ্টায় নামেনি। আমি চেষ্টা করার আগে মনে মনে মন্ত্রপাঠ করে নিলাম-- ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। মুকসুদুল মোমিন কিতাব থেকে মন্ত্রটি শেখা। এই কিতাবটি বাংলাদেশের নারী মুসলমানদের খুবই প্রিয়। আমার বড় দিদি বিশ টাকা দিয়ে ফেরিওয়ালার কাছ থেকে কিনেছিলেন। ফেরিওয়ালা হয়তো কোরআন শরীফ চিনে না কিন্তু মুকসুদুল মোমিনকে চিনে। কারন তাতে অর্থনৈতিক বেনিফিট আছে। মুকসুদুল মোমিনে শিখেছিলাম কোনো জিনিস হারিয়ে গেলে পাওয়ার জন্য কোন মন্ত্র পড়তে হয়, সম্মান বৃদ্ধির জন্য কোন মন্ত্র পড়তে হয়, কোনো নারীর সাথে প্রেম করতে হলে কোন মন্ত্র পড়তে হয়।
আমি মন্ত্রটি নিরানববই বার পড়ে নিলাম। তারপর মেয়েটিকে বললাম পা সরাতে। ও মা! পায়ের নিচে ছোট্ট নাকফুলটি।
মানুষ সকল অবাক!
মেয়েটি বিমানবন্দরে নেমে গেল। আমাকে একবার ধন্যবাদও দিলো না। শুধু নেমে যাওয়ার সময় একবার ফিরে তাকালো। দেখলাম তার চোখ থেকে বিন্দু বিন্দু জল আমার দিকে চলে আসতেছে। আমি সেই জল নেবার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। খোদার কসম, তার চোখের জল গ্রহণের ক্ষমতা আমার ছিল না!
অনেক দিন পর মেয়েটির সাথে আমার দেখা । আমাকে সে চিনতে পারেনি। আমার একটি সমস্যা আমি যা মনে রাখি তা ভুলতে পারি না। দাঁড়ি কমা বিন্দু বিসর্গ পর্যন্ত মনে থাকে। ঘটনা মনে করে দেয়ার পর সে চিনতে পারে। তারপর ছোট্ট একটি সূর্য তার মুখে উদিত হয়। সূর্যের তাপ অধিক ছিল না বলে আমি তৃষ্ণার্ত হইনি। কিন্তু তার মুখে সূর্য দেখবো বলে আমি ততদিন পর্যন্ত বেঁচে ছিলাম। এখনো বেঁচে আছি....
মাসির বাড়ি দুইভাবে যাওয়া যায়। পায়ে হেঁটে এবং নৌকাযানে। কখনো আমাদের বাড়ির ঘাট থেকে নৌকা রিজার্ভ করে সরাসরি মাসির বাড়ির ঘাটে, আবার কখনো লোকাল নৌকাযানে। লোকাল নৌকাযানটি বাইশ মৌজা বাজারে নোঙর করে। তারপর বাকি পথ পায়ে হেঁটে। বাকি পথ বলতে প্রায় ছয় সাত মাইল পথ।
আমি আর আম্মা হাঁটা ধরতাম। আম্মা অনেক দ্রুত হাঁটতে পারে। অনেক দ্রুত। প্রতিযোগিতা করে হাঁটতো। চোরা প্রতিযোগিতা। সামনের মানুষটাকে টার্গেট করে তার সামনে এগিয়ে যাওয়ার তীব্র চেষ্টা। তাতে আম্মা সফলও হতো। একটি লোককে অতিক্রম করার সাথে সাথে আম্মা আর আমি মিলে হাসতাম। মা ছেলের বিজয়ী হাসি। অবশ্যই এই হাসির কারন পৃথিবীর মানুষের জানবার কথা নয়।
নৌকা থেকে জলের দৃশ্য অসাধারণ। হযরত আলীর নৌকা। আমাদের ঘাট থেকে দুটি নৌকা বাইশ মৌজার উদ্দেশে ছেড়ে যায়। মলাই মিয়ার নৌকা আর হযরত আলীর নৌকা। হযরত আলীর নৌকা বামন টাইপের শক্তিশালী। তাই হযরত আলীর নৌকাটি আমাদের খুব প্রিয়। আমি ছাঁদে, টিনের ছাঁদে বসে জলের খেলা দেখি। মেঘনা নদীতে যদিও তেমন স্রোত নেই আজ মনে হয় কিন্তু তখন মেঘনা নদীর স্রোত মনে বিশেষ এক থ্রিলিং তৈরি করতো। তিমি মাছ লাফ দিয়ে দিয়ে নৌকার এক পাশ থেকে আরেক পাশ গিয়ে পড়তো। জলরং ঘেষা কালো তিমির।
মাছরাঙা, তাদের মাছশিকার। আকাশ থেকে হঠাৎ করে চিলের আক্রমণ। মাঝিনৌকা, তাদের মাছধরা। লালপুর গ্রাম থেকে ভেসে আসা শুঁটকি শুঁটকি গন্ধ। পালতোলা নৌকার জলে-বাতাসে ভেসে চলা। আন্ডার প্যান্ট পড়ে বের বাওয়া জেলেদের হাসির বিন্দু বিন্দু দৃশ্য। অনেক অনেক, আরো আরো মনমাতানো নয়নাভিরাম দৃশ্যকর্ম দেখে কখন যে বাইশ মৌজা বাজারে পৌঁছে যেতাম তা বলতেই পারতাম না। তারপর মাসির বাড়ি উদ্দেশে যাত্রা অর্থাৎ কৃষ্ণনগর গ্রাম। অসম্ভব সুন্দর গ্রাম। বাঁশঝাড় প্রচুর। বাঁশপাতার সাথে বাতাসের সম্পর্ক হলে একধরনের সুর উৎপন্ন হয়ে থাকে যেখানে কৃষ্ণের বাঁশি জীবন্ত। এক কথায় বললে গ্রামটি সবুজের সন্তান, মানুষ সবুজসন্তানের উপাদান। এই গ্রামেই আমি কৃষ্ণনামের সাথে পরিচিত হয়, পরিচিত হয় রাধার কান্নার সাথে।
বাসে খুব একটা ভ্রমণ আমার করা হয়ে ওঠেনি। ভ্রমণযান হিসাবে নৌকা আর ট্রেন।
ট্রেনে আমি বসা। আমার পাশে এক মুরুব্বি লোক। আমি তাকে বসতে দিলাম। আমি যেখানে দাঁড়ানো তার পাশে একটি সিট। শোভন চেয়ার। দুইজন একসাথে বসা যায়। দুইজনই বসা। একজন মেয়ে, একজন পুরুষ।
হঠাৎ দেখি মেয়েটি কী যেন খুঁজছে। নাকফুল খুঁজছে।
পুবাইল স্টেশন চলে গেল, ঘোড়াশাল চলে গেল, টঙ্গী স্টেশন চলে গেল। নাকফুল পাচ্ছে না তো পাচ্ছে না। আশেপাশের সবাই চেষ্টা করলো। সবার চেষ্টা বৃথা। আমি তখনও চেষ্টায় নামেনি। আমি চেষ্টা করার আগে মনে মনে মন্ত্রপাঠ করে নিলাম-- ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। মুকসুদুল মোমিন কিতাব থেকে মন্ত্রটি শেখা। এই কিতাবটি বাংলাদেশের নারী মুসলমানদের খুবই প্রিয়। আমার বড় দিদি বিশ টাকা দিয়ে ফেরিওয়ালার কাছ থেকে কিনেছিলেন। ফেরিওয়ালা হয়তো কোরআন শরীফ চিনে না কিন্তু মুকসুদুল মোমিনকে চিনে। কারন তাতে অর্থনৈতিক বেনিফিট আছে। মুকসুদুল মোমিনে শিখেছিলাম কোনো জিনিস হারিয়ে গেলে পাওয়ার জন্য কোন মন্ত্র পড়তে হয়, সম্মান বৃদ্ধির জন্য কোন মন্ত্র পড়তে হয়, কোনো নারীর সাথে প্রেম করতে হলে কোন মন্ত্র পড়তে হয়।
আমি মন্ত্রটি নিরানববই বার পড়ে নিলাম। তারপর মেয়েটিকে বললাম পা সরাতে। ও মা! পায়ের নিচে ছোট্ট নাকফুলটি।
মানুষ সকল অবাক!
মেয়েটি বিমানবন্দরে নেমে গেল। আমাকে একবার ধন্যবাদও দিলো না। শুধু নেমে যাওয়ার সময় একবার ফিরে তাকালো। দেখলাম তার চোখ থেকে বিন্দু বিন্দু জল আমার দিকে চলে আসতেছে। আমি সেই জল নেবার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। খোদার কসম, তার চোখের জল গ্রহণের ক্ষমতা আমার ছিল না!
অনেক দিন পর মেয়েটির সাথে আমার দেখা । আমাকে সে চিনতে পারেনি। আমার একটি সমস্যা আমি যা মনে রাখি তা ভুলতে পারি না। দাঁড়ি কমা বিন্দু বিসর্গ পর্যন্ত মনে থাকে। ঘটনা মনে করে দেয়ার পর সে চিনতে পারে। তারপর ছোট্ট একটি সূর্য তার মুখে উদিত হয়। সূর্যের তাপ অধিক ছিল না বলে আমি তৃষ্ণার্ত হইনি। কিন্তু তার মুখে সূর্য দেখবো বলে আমি ততদিন পর্যন্ত বেঁচে ছিলাম। এখনো বেঁচে আছি....
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন