প্রিয় শান্তিনিকেতন,
কেমন আছো? ভালো আছো জানি।তোমাকেই তো ভালো থাকতে হবে, তুমি ভালো থাকলে যে পৃথিবী ভালো থাকে। প্রকৃতির মাদকতা আর প্রজ্ঞার প্রভা নিয়ে তুমি ঘুমাতে যাও, ঘুম থেকে ওঠে দেখো নিশ্চুপ সকাল, আনমনে সূর্য, রবীন্দ্রনাথের ভক্তিপ্রাণ গানের নিকুঞ্জ।প্রত্যেকের একটি অদৃশ্য হৃদয় আছে, হৃদয়ে হৃদয়ে অদৃশ্য যোগাযোগ অব্যাহত থাকে নিত্যনিয়ত। তাই বিশ্বাস করি তুমি- আমি এক প্রাণ, প্রাণের পরমা। প্রাণের সেই মোলায়েম জায়গা থেকে তুমি আমার প্রাণের বন্ধু।
বন্ধু, একটি গোপন কথা ছিল বলবার, সময় হবে কী তোমার?
প্রদেশ কাকু। বাড়ি ময়মনসিংহ। পুলিশের চাকরি করেন। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে তাঁর সাথে দেখা। মৈত্রী এক্সপ্রেসে উঠবো, কাকু ক্যান্টনমেন্টে কর্তব্যরত। ট্রেন প্লাটফর্ম ছেড়ে যাবে আটটা দশ মিনিটে। এখনো এক ঘন্টা হাতে আছে। আশেপাশে চেনামানুষ কেউ নেই। সব মানুষ যখন অচেনা তখন প্রদেশ কাকুর চোখটি খুব চেনা মনে হল। প্রত্যেকের চোখ একটি মহাসাগর। চোখের কোনো দেশ- কাল নেই, চোখের কোনো বর্ডার নেই, চোখের কাছেই কেবল নিরাপদবোধ করি। কাকুর আর আমার চোখাচোখি। কেমেস্ট্রি মিলে গেল। বেস, শুরু হল কথা। সামাজিক সম্পর্কের বাইরে পারিবারিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে কেবলই প্রাণের জায়গা থেকে। প্রাণের কথা প্রাণকে স্পর্শ করে। প্রাণে প্রাণে স্পর্শখেলায় বয়ে গেল একটি ঘন্টা। কাকু আমাকে সিট পর্যন্ত রেখে গেলেন এবং বাবার মতো ছোট একটি বাক্য আমার মনে রেখে দিলেন --
``তোমরা বাংলাদেশের সম্পদ, ভালোভাবে দেশে ফিরে এসো।
বড় ধরনে ধাক্কা খেলাম। দেশে ফিরে এসো " কথাটি সাধকটাইপের কথা মনে হলো। অন্তর যাঁরা পড়তে পারেন তারাই এমন কথা বলতে পারেন।
অন টাইম বলতে যা বুঝায় সেই টাইমে ট্রেন যাত্রা শুরু করে। আমার পাশের সিটে যিনি বসে আছেন এক বাক্যে বললে very fine young man। আস্তে আস্তে কথা বলেন কিন্তু আমাকে ব্যস্ত হয়ে শুনতে হয়--
This is Bangladesh, that is India, it is an egotist problem, not more than. whatever আমরা যদি বর্ডার না মানি!
ত্রিশ- পঁয়ত্রিশ বয়সের এই ভদ্র লোকটি পৃথিবীর অনেক দেশে ভ্রমণ করেছেন। কিন্তু চমৎকার শামুকটাইপের মানুষ। তার কাছ থেকে অভিযান চালিয়ে কথা উদ্ধার করতে হয়। গেদা চেক পোস্টে তার কাছ থেকে জানতে পারি, ভারতীয়রা বিস্কুট পছন্দ করে। দশ রুপি দিয়ে বিস্কুট কিনলাম। দারুণ টেস্ট।
ট্রেনের n1 কামড়াটি আমাদের, আলোচনার সভাকক্ষে পরিনত হলো। আলোচনার বিষয় প্রশাখামাতৃক। বাংলাদেশীরা কারনে -অকারনে অনেক কথা বলতে পারে। এক একজন মানুষ কথা বলার এক একটি ননস্টপ মেশিন। কুসুম কুমারী দাশের কথা খুব মনে পড়ল ( কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হও)।
ট্রেনে হুজুর আঙ্কেল নাস্তা খাচ্ছেন। আমিও কিছু একটা খাচ্ছি। আঙ্কেল আমার সাথে কলা শেয়ার করলেন। আমি কলাটি সংরক্ষণে রাখি। চিতপুর স্টেশনে ল্যান্ড করবো, পৌঁছাতে মিনিট দশেক লাগবে। হুজুর আঙ্কেলকে কলাটি ফেরত দিলাম। আঙ্কেল যা বোঝার বুঝে গেলেন, আমি যা বোঝাতে চেয়েছি তিনি হয়তো তা বুঝতে পারেন নি।
চিতপুর স্টেশন থেকে বাসে করে হাওড়া স্টেশনে । সব চোখ অচেনা। আমার একটি চোখও আরেকটি চোখকে দেখে না। হাওড়া স্টেশনে অপেক্ষা করছে গোপীনাথ। আমি তাকে আদুরে ডাকি `ছোট'। হাওড়া স্টেশনে পৌঁছানোর পর নতুন দৃশ্য চোখে আসে। জলের মতো জনতার স্রোত। মাছিকুঞ্জবনে যেন হাঁটছি।
ছোট আমাকে আগে দেখেনি, আমিও। তারপরও আমি তাকে সনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছি। অবশ্যই মোবাইলমিডিয়ার অবদান স্বীকার্য। ট্রেনে করে আমরা চলে গেলাম চাতরা, শ্রীরামপুর। জীবনে প্রথম কোনো ট্রেনে যাত্রা করলাম যে ট্রেনের কামড়ায় কোনো ক্লাস নেই। সিট খালি থাকা সাপেক্ষে বসানীতি।
মাসি আমাদের জন্য খাবার নিয়ে বসে আছেন। তখন শীতলাপূজা চলছে। তাই ঝাল- ভাত হবে না। আমরা লুচি খেলাম। বন্ধু, সুপ্রিয় বারবার খোঁজ নিচ্ছে।
সুপ্রিয়ের বাসায় দুদিন থাকলাম। স্নেহের সঠিক অর্থ মাসীর কাছ থেকে জানতে পারি। নদীর মতো করে পরিবারের প্রত্যেক সদস্য আমার পরিসেবায় ব্যস্ত। আমিও অবশ্যই বার বার বলেছি, ``গেস্ট হতে আমার ভালো লাগে না, মেম্বার হয়ে থাকতে চাই, যে কটা দিনই থাকি।"
সুপ্রিয় হাওড়াফুলী স্টেশন থেকে টিকেট সংগ্রহ করে ট্রেনে তুলে দিল আমাকে। বীরভূম যাচ্ছি। রাজা বীর সিং বেঁচে থাকলে ভালো হতো। সুপার ফাস্ট ট্রেন। বসার সিট খালি নেই। দাঁড়িয়ে আছি। দাঁড়িয়ে থাকাও একধরনের বসে থাকা। কিন্তু আমার চোখ কোথাও ঠাঁই খুঁজে পাচ্ছে না। কোনো চোখে প্রেম নেই। কেবল যন্ত্রের হাহু শব্দ। একজন বেশধারী সাধকের দিকে দৃষ্টি পড়ে। ভেবেছি তার চোখে প্রেম থাকবে। ও মা! তার চোখে প্রেম নেই। প্রেমহীন আমি যে জলহীন মাছের মতো। প্রেমই আমার কাছে বেঁচে থাকার অক্সিজেন।
বীরভূম রেলওয়ে স্টেশন থেকে রিকসা নিলাম। বাংলা মদের কাঁচা গন্ধ। মাতাল হয়েও রিকসা চালানো যায়! কথা বলার চেষ্টা করলাম। অবাক বেবাক কথা শুনি। তাই কথা বলা আগ্রহ চাপা দিলাম।
রিকসা চলে আসে International boys hostel এর সামনে।
তখনও বুঝতে পারেনি আমি তোমার কাছে চলে এসেছি, তোমার কাছে।
স্নান করে ঘুম দিলাম। ঘুম থেকে ওঠে নতুন জীবন পেলাম, প্রথমবার তোমার চোখে সত্যিকারের প্রেম পেলাম। বাই গড তোমার চোখে আমার প্রেম খুঁজতে হয়নি। বরং প্রেমের মাঝে যেন সমর্পিত হয়েছি কোনো এক মেঘবলাকার সরল টানে। তোমার প্রতিটি দৃষ্টি উপলব্ধি করেছি আমার সমস্ত অনুভূতি নিয়োগ করে। তোমার প্রতিনিধি বিনয় ভবনের দেবদারু বৃক্ষের নিচস্থানটি অকহতব্য অনুভূতির জন্মস্থান। সৃজনী শিল্পগ্রাম হৃদয়স্মৃতির সহজিয়া গান। তোমার দেহের ভাঁজে ভাঁজে যে সুর তা যেন বাংলা মদের লাহান, ভুলেভালে একবার খেলে আর ভুলা যায় না। মনকানা শুধু গাছের শুন্যতায় রূপালি চাঁদ খুঁজে যেখানে তোমার লাবণ্য ফাদ পেতে রাখে। লাল মাটির তুমি যেন স্বলাজ কুমারী, তুমি যেন স্বপ্নের হাসি।
সাগরের ঢেউও সৈকতে কিছু বালি দিয়ে যায়,
কিছু নিয়ে যায়, আমার স্মৃতিঢেউ কেবল তোমার সৈকতে ভাসে, কিছুই তোমাকে দিতে পারে না, আমি এমনই অক্ষম,
বলো, অক্ষম হওয়া কী অপরাধ?
তুমি সক্ষম বলেই আমার অক্ষমতা সামাজিক। আজও লেপ্টে আছি পূর্বপল্লী, অরশ্রী মার্কেট, রতন পল্লী, ফাস্ট গেইটের কানায় কোনায়।
ভুলে যেও না প্রিয়,
প্রিয়তার ভুল শুদ্ধতার সর্বনাম।