মুসলমানরা এই সহজিয়া মাটিতে যেভাবে জায়গা করে নিয়েছে ওস্তাদ শব্দটি সেইভাবেই জায়গা করে নিয়েছে । ওস্তাদ শব্দটি ফারসি শব্দ। 'ওস্তাদ' যখন বিশেষ্য তখন শব্দটির অর্থ দাঁড়ায় গুরু, শিক্ষক, প্রভু।
দাউদ নবীর আবৃতি শুনে সাগর থেকে মাছ চলে আসতো। সপ্তাহে একদিন তিনি তার ধর্মগ্রন্থ আবৃতি করতেন। আবৃতির দিন মাছ ধরা নিষিদ্ধ। মাছধরা নিষিদ্ধ-- কারন মাছেরা সম্মোহিত -- সম্মোহিত প্রানিকে ধরতে নেই। আমিও সম্মোহিত প্রানি ছিলাম,আছি, হয়তো থাকবো। বারবার সম্মোহিত হয়ে আমি ধরা পড়েছি। সম্মোহনের স্থান, সময় ভিন্ন থেকে ভিন্নতর হয়েছে। কিন্তু সম্মোহিত হয়েছি এই আকাশের নিচে, চোখের সামনে কিংবা মনের ভেতর-- কতবার যে সম্মোহিত হয়েছি আর বুকের ভেতর পানি শুকিয়ে যাওয়া নদীর মতো রেখা চিহ্ন রয়ে গেছে তার দিকবাল বা স্মরনসভা আমার স্মৃতির আয়োজন সভায় এতটুকু মনে পড়ে না --
"ব্যথা দিয়ে কবে কথা কয়েছিলে
পড়ে না মনে,
দূরে থেকে কবে ফিরে গিয়েছিলে
নাই স্মরণে।"
আজ যখন সমস্ত স্মৃতিভ্রম বিশ্বাসকে অবিশ্বাস করে মনকম্পিউটারের সাথে স্মরনপ্যানড্রাইভ সংযোগ করলাম তখন নতুন এক পৃথিবী আমার চোখের সামনে,মনের সামনে আস্তে আস্তে লোডিং হচ্ছে --
"বুঝেছি আমার নিশার স্বপন
হয়েছে ভোর।
মালা ছিল, তার ফুলগুলি গেছে,
রয়েছে ডোর।"
প্রথমবার সম্মোহিত হয়েছিলাম জনাব প্রকৃতির উপর। জনাব প্রকৃতি যদ্যপি আমার গুরু,যদ্যপি আমার প্রেরনা। শৈশব-তারন্যে সাঁতার কাটার মতো তেমন কোন পাত্র ছিল না-- প্রকৃতি ছাড়া। প্রকৃতির বিশাল আয়োজনে আমার তারন্য নগন্যই ছিল। সবুজ শ্যামলিমা প্রকৃতি আমার প্রেমিকা, আমার মা,আমার নিভৃতচারী পিতা-- আবার আমার আন্তরিক বন্ধু।
আমার এখনকার বন্ধুটি মহসিন হলে থাকে। আমি থাকি জিয়া হলে।রাত বারোটার পর আড্ডা শুরু হয়। আমাদের আড্ডায় তৃতীয়পক্ষ নট অ্যালাউড।কত কথা বলি আমরা,কত জীবন করি রচনা, কত দীর্ঘশ্বাস উড়াই ঢাকা শহরের জান্তব কোলাহলে-- অন্ধকারের তথাকথিত ভার্জিন মোহনায়। একসময় মসজিদ থেকে আযান আসে-- তখনই মনে হয় রুমে যাওয়া প্রয়োজন, প্রয়োজন চোখের বিশ্রাম। শুরু হয় এগিয়ে দেয়ার পালা-- আমাকে এগিয়ে দেয় জিয়া হলের গেইট পর্যন্ত,আমি তখন ভাবি বন্ধুটা একা একা যাবে-- আমিও এগিয়ে দিয়ে আসি। তখন আমি তাকে এগিয়ে দিয়ে আসি মহসিন হলের গেইট পর্যন্ত। তখন সে আবার ভাবে আমি কি করে একা একা যাবো-- সে আবার এগিয়ে দিতে আসে জিয়া হলের গেইট পর্যন্ত। এগিয়ে দেয়া-নেয়া চলতে চলতে সকাল হয়ে যায়-- সূর্য এসে চোখের কোনায় শুভসকাল বলে নিজের উপস্থিতি জানান দেয়। তখন মলচত্বরের প্রকৃতির সজীবসন্তান চিরযৌবনা গাছগুলো মিটিমিটি তারার মতো হাসতে থাকে-- আমরা লজ্জা পেয়ে যাই-- তখন হয় দুজনে দ্রুত দুই হলে চলে যাই নয় একরুমে একসাথে ঘুমাই।
আমাদের এই আন্তরিকতা কিন্তু আমাদের না-- যদ্যপি আমার গুরু প্রকৃতির কাছ থেকে আংশিক ধার নেয়া। এই প্রকৃতি আমার শৈশবের মেঘনা নদী।
মেঘনা মানুষকে জীবন দেয়,মেঘনা জীবন পালন করে,এই মেঘনা আবার জীবন থেকে জীবন তুলে নেয়।এক মেঘনা অথচ কত বিচিত্র তার চরিত্র।নদীর তীরের মানুষগুলো সহজে হাসতে পারে,সহজে কানতে পারে,সহজে ভালোবাসতে পারে,আবার সহজে হত্যা করতে পারে তরুনপ্রান জীবন--
আমার গ্রামের ছেলে সাইফুল। চমৎকার সৌখিন ছেলে। বাড়িতে তার কবুতর খামার,নানা প্রকারের কবুতর।মুখে তার মোলায়েম হাসি-- হৃদয়ভরা ভালোবাসা।তবে নাগরিক ভালোবাসা। গ্রাম্য আবেগে,বংশীয় স্বার্থপীঠে সাইফুলের বুকের বাম পাশে বসিয়ে দেয়া হয় নারকীয় ছুড়ি।তরুন সাইফুল আজ মৃত-- তরুন সাইফুল আর হাসে না কবুতরের বাকবাকুম বাকবাকুম ডাহের সাথে। আমার প্রভু প্রকৃতির লালিত নদী কিন্তু ঠিকই হাসে আগের মতো, চিক চিক করে সূর্যের সাথে,চান্দেন ভরা জোছনার লগে। আর সাইফুল মাটির মতো ঘুমিয়ে আছে মাটির বিছানায়। নদীর কোন দুঃখ নেই, মেঘনা নদীর কোন আবেগ-বিবেক নেই। যত আবেগ আর বিবেকের খেলা আমাদের-- আমাদের এই সামাজিক মানুষের।
হরিনের পাল থেকে যখন থাবা দিয়ে একটি হরিনকে দলছুট করে ফেলে শিকারি বাঘ-- বাকি হরিনগুলো পালাও পালাও রবে রবাহত -- শোকাহত হৃদয় হরিনের নেয়-- শোকাহত হৃদয় মানুষের আছে-- নদীর কোন শোকাহত হৃদয় নেই-- নদী তো আমার শৈশবের হিরো শাহ্ শওকত আলী।
শাহ্ শওকত আলী মারফতি মানুষ। পীর সাহেব।তাঁর অনেক ভক্ত- মুরীদ।আমি তাঁর মুরীদ ছিলাম না-- ভক্ত ছিলাম। মনের ভেতর থেকে তাঁর জন্য মনের দরজাটা খোলা ছিল- তাঁর কাছ থেকে সুফিতত্ত্বের শিক্ষা লাভ করি সেই ছোট্ট কালে-- কাউকে ভালোবাসলে তাঁর বলার ভঙ্গি কত ভালো লাগে তা আমি জানি-- তাঁর বলার ভঙ্গি-- তাঁর বাক্য থেকে বাক্যের নিরাপদ দূরত্ব-- তাঁর চোখের অব্যক্ত কথা আজোও হৃদয়ের সেই অরক্ষিতঘরে জায়গা করে আছে। তিনি বলতেন এবং বলতেন--
বাদশা রাজদরবারে রাজকীয় আমেজে ঘুমাচ্ছেন। চারপাশে পরিমিত প্রদীপ-আলো-- যা ঘুমে নিয়ে আসে রাজকীয় আনন্দ।তাঁর ঘুম ভেঙ্গে গেল।ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ার কারন আছে। ছাদে জোড়ে জোড়ে পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। বাদশা ছাদে গেলেন।গিয়ে দেখেন পাগড়ি পড়া সাদা পোশাকধারী এক লোক হাঁটছেন। বাদশা প্রথমে অবাক হলেন।কারন সৈন্য-সামন্ত-প্রহরীর চোখ ফাঁকি দিয়ে ছাদে দরবেশের মতো এই লোক আসলো কি করে! তারপরও বাদশা বাদশার মতো ভয় ভেতরে চাপা দিয়ে লোকটিকে জিজ্ঞেস করলেন
'আপনি কে,কি চায়?'
লোকটি বলল
'আমি কে আমি যেমন জানি না,তুমি কে তাও তুমি জান না;
আর এই ছাদে এসেছি ঘোড়া খোঁজতে,আমার ঘোড়াটা হারিয়ে গেছে তো তাই।'
বাদশা হাসি দিয়ে বললেন 'ঘোড়াকে কি ছাদে পাওয়া যাবে? তারপর লোকটি আস্তে করে বাদশার চোখের দিকে তাকালেন।কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন 'ছাদে যেমন ঘোড়া পাওয়া যায় না তেমনি রাজকীয় আরাম আয়েশে থেকেও আল্লাকে পাওয়া যায় না।কথাটি শোনার সাথে সাথে বাদশার মনে ঝড় শুরু হয়ে যায়,বাদশা পাগলের মতো এদিক-ওদিক ছুঁটতে থাকে।রাজ্য ছেড়ে দেয়-- যেখানে গেলে মাশুকের খোঁজ পাওয়া যাবে সেখানে ছুঁটতে থাকে-- বাদশা খোঁজছে তো খোঁজছে-- মাশুকের খোঁজ আর পায় না।আর আমি শাহ শওকত আলীর চোখে মাশুকের খোঁজ পাই,তাঁর কথা বলার ভঙ্গির মধ্যে মাশুকের খোঁজ পাই -- তাঁর কথা বলার ভঙ্গির মধ্যে যদ্যপি আমার প্রেরনা মেঘনা নদীর খোঁজ পাই-- যে নদী ভাঙতে জানে, চর তৈয়ারি করতে জানে,সে নদী।
নদী কেন পারাপার করে গতিশীল ঢেউ। ঢেউয়ের লগে চান্দের হাতির, ঢেউয়ের লগে সাগর-মহাসাগরের হাতির। ঢেউ এক হাতিরের নাম। যে নদীতে ঢেউ থাহে না সে নদী দ্রুত মারা যায়।নদী মারা গেলে ডোবা, জলাশয়, পুকুর তার নাম-- মানুষ তাদেরকে কত অত্যাচার করে-- মৃত কিছুর উপর ওস্তাদগিরি দেখানো মানুষের কারবার।
'ওস্তাদ' শব্দটি যখন বিশেষন হয় তখন এর অর্থ দাঁড়ায় 'দক্ষ','যোগ্য', 'ন্যায়শীল' ; নেগেটিভ অর্থে 'কপট'।
এই জীবনে দক্ষতার কোনো সীমানা পাইনি।এই জীবনে দক্ষতার কোনো ডাকনাম পাইনি।তবে দক্ষতার এক সুনিপুন কারিগর দেখেছি আমার জীবনযাপনের সামনে,আমার বেড়ে উঠার সামনে। সে কারিগরের নাম আমার মা,আমার আম্মা,আমার মম।
ছয় বোন,আমি,আমার আব্বাকে নিয়ে আমাদের পরিবার। নিঃসন্দেহে আমি অনেক আদরের এবং আরাদ্ধ।কিন্তু কোনো দিন তাঁর আচরনে আমি আদরের একমাত্র বোধটুকু জেগে উঠতে দেখিনা-- না খাবার টেবিলে,না বাইরে যাওয়ার ব্যাপারে,না মার্কেট করার ব্যাপারে।
আব্বা কৃষক,নিতান্ত সহজিয়া মানুষ-- আমাকে কোনোদিন কোনো উপদেশ দেননি। বাবা হয়ে উপদেশ দেয়ার লোভ সামলাতে পাড়লেন কীভাবে আমি আজ অবাক হই।হয়তো তিনি আমার ওস্তাদ হতে চাননি,নাকি ওস্তাদ না হওয়ার নির্মোহ আচরনই তাকে আমার কাছে জীবনবাদী ওস্তাদ করে তুলেছে।
দাউদ নবীর আবৃতি শুনে সাগর থেকে মাছ চলে আসতো। সপ্তাহে একদিন তিনি তার ধর্মগ্রন্থ আবৃতি করতেন। আবৃতির দিন মাছ ধরা নিষিদ্ধ। মাছধরা নিষিদ্ধ-- কারন মাছেরা সম্মোহিত -- সম্মোহিত প্রানিকে ধরতে নেই। আমিও সম্মোহিত প্রানি ছিলাম,আছি, হয়তো থাকবো। বারবার সম্মোহিত হয়ে আমি ধরা পড়েছি। সম্মোহনের স্থান, সময় ভিন্ন থেকে ভিন্নতর হয়েছে। কিন্তু সম্মোহিত হয়েছি এই আকাশের নিচে, চোখের সামনে কিংবা মনের ভেতর-- কতবার যে সম্মোহিত হয়েছি আর বুকের ভেতর পানি শুকিয়ে যাওয়া নদীর মতো রেখা চিহ্ন রয়ে গেছে তার দিকবাল বা স্মরনসভা আমার স্মৃতির আয়োজন সভায় এতটুকু মনে পড়ে না --
"ব্যথা দিয়ে কবে কথা কয়েছিলে
পড়ে না মনে,
দূরে থেকে কবে ফিরে গিয়েছিলে
নাই স্মরণে।"
আজ যখন সমস্ত স্মৃতিভ্রম বিশ্বাসকে অবিশ্বাস করে মনকম্পিউটারের সাথে স্মরনপ্যানড্রাইভ সংযোগ করলাম তখন নতুন এক পৃথিবী আমার চোখের সামনে,মনের সামনে আস্তে আস্তে লোডিং হচ্ছে --
"বুঝেছি আমার নিশার স্বপন
হয়েছে ভোর।
মালা ছিল, তার ফুলগুলি গেছে,
রয়েছে ডোর।"
প্রথমবার সম্মোহিত হয়েছিলাম জনাব প্রকৃতির উপর। জনাব প্রকৃতি যদ্যপি আমার গুরু,যদ্যপি আমার প্রেরনা। শৈশব-তারন্যে সাঁতার কাটার মতো তেমন কোন পাত্র ছিল না-- প্রকৃতি ছাড়া। প্রকৃতির বিশাল আয়োজনে আমার তারন্য নগন্যই ছিল। সবুজ শ্যামলিমা প্রকৃতি আমার প্রেমিকা, আমার মা,আমার নিভৃতচারী পিতা-- আবার আমার আন্তরিক বন্ধু।
আমার এখনকার বন্ধুটি মহসিন হলে থাকে। আমি থাকি জিয়া হলে।রাত বারোটার পর আড্ডা শুরু হয়। আমাদের আড্ডায় তৃতীয়পক্ষ নট অ্যালাউড।কত কথা বলি আমরা,কত জীবন করি রচনা, কত দীর্ঘশ্বাস উড়াই ঢাকা শহরের জান্তব কোলাহলে-- অন্ধকারের তথাকথিত ভার্জিন মোহনায়। একসময় মসজিদ থেকে আযান আসে-- তখনই মনে হয় রুমে যাওয়া প্রয়োজন, প্রয়োজন চোখের বিশ্রাম। শুরু হয় এগিয়ে দেয়ার পালা-- আমাকে এগিয়ে দেয় জিয়া হলের গেইট পর্যন্ত,আমি তখন ভাবি বন্ধুটা একা একা যাবে-- আমিও এগিয়ে দিয়ে আসি। তখন আমি তাকে এগিয়ে দিয়ে আসি মহসিন হলের গেইট পর্যন্ত। তখন সে আবার ভাবে আমি কি করে একা একা যাবো-- সে আবার এগিয়ে দিতে আসে জিয়া হলের গেইট পর্যন্ত। এগিয়ে দেয়া-নেয়া চলতে চলতে সকাল হয়ে যায়-- সূর্য এসে চোখের কোনায় শুভসকাল বলে নিজের উপস্থিতি জানান দেয়। তখন মলচত্বরের প্রকৃতির সজীবসন্তান চিরযৌবনা গাছগুলো মিটিমিটি তারার মতো হাসতে থাকে-- আমরা লজ্জা পেয়ে যাই-- তখন হয় দুজনে দ্রুত দুই হলে চলে যাই নয় একরুমে একসাথে ঘুমাই।
আমাদের এই আন্তরিকতা কিন্তু আমাদের না-- যদ্যপি আমার গুরু প্রকৃতির কাছ থেকে আংশিক ধার নেয়া। এই প্রকৃতি আমার শৈশবের মেঘনা নদী।
মেঘনা মানুষকে জীবন দেয়,মেঘনা জীবন পালন করে,এই মেঘনা আবার জীবন থেকে জীবন তুলে নেয়।এক মেঘনা অথচ কত বিচিত্র তার চরিত্র।নদীর তীরের মানুষগুলো সহজে হাসতে পারে,সহজে কানতে পারে,সহজে ভালোবাসতে পারে,আবার সহজে হত্যা করতে পারে তরুনপ্রান জীবন--
আমার গ্রামের ছেলে সাইফুল। চমৎকার সৌখিন ছেলে। বাড়িতে তার কবুতর খামার,নানা প্রকারের কবুতর।মুখে তার মোলায়েম হাসি-- হৃদয়ভরা ভালোবাসা।তবে নাগরিক ভালোবাসা। গ্রাম্য আবেগে,বংশীয় স্বার্থপীঠে সাইফুলের বুকের বাম পাশে বসিয়ে দেয়া হয় নারকীয় ছুড়ি।তরুন সাইফুল আজ মৃত-- তরুন সাইফুল আর হাসে না কবুতরের বাকবাকুম বাকবাকুম ডাহের সাথে। আমার প্রভু প্রকৃতির লালিত নদী কিন্তু ঠিকই হাসে আগের মতো, চিক চিক করে সূর্যের সাথে,চান্দেন ভরা জোছনার লগে। আর সাইফুল মাটির মতো ঘুমিয়ে আছে মাটির বিছানায়। নদীর কোন দুঃখ নেই, মেঘনা নদীর কোন আবেগ-বিবেক নেই। যত আবেগ আর বিবেকের খেলা আমাদের-- আমাদের এই সামাজিক মানুষের।
হরিনের পাল থেকে যখন থাবা দিয়ে একটি হরিনকে দলছুট করে ফেলে শিকারি বাঘ-- বাকি হরিনগুলো পালাও পালাও রবে রবাহত -- শোকাহত হৃদয় হরিনের নেয়-- শোকাহত হৃদয় মানুষের আছে-- নদীর কোন শোকাহত হৃদয় নেই-- নদী তো আমার শৈশবের হিরো শাহ্ শওকত আলী।
শাহ্ শওকত আলী মারফতি মানুষ। পীর সাহেব।তাঁর অনেক ভক্ত- মুরীদ।আমি তাঁর মুরীদ ছিলাম না-- ভক্ত ছিলাম। মনের ভেতর থেকে তাঁর জন্য মনের দরজাটা খোলা ছিল- তাঁর কাছ থেকে সুফিতত্ত্বের শিক্ষা লাভ করি সেই ছোট্ট কালে-- কাউকে ভালোবাসলে তাঁর বলার ভঙ্গি কত ভালো লাগে তা আমি জানি-- তাঁর বলার ভঙ্গি-- তাঁর বাক্য থেকে বাক্যের নিরাপদ দূরত্ব-- তাঁর চোখের অব্যক্ত কথা আজোও হৃদয়ের সেই অরক্ষিতঘরে জায়গা করে আছে। তিনি বলতেন এবং বলতেন--
বাদশা রাজদরবারে রাজকীয় আমেজে ঘুমাচ্ছেন। চারপাশে পরিমিত প্রদীপ-আলো-- যা ঘুমে নিয়ে আসে রাজকীয় আনন্দ।তাঁর ঘুম ভেঙ্গে গেল।ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ার কারন আছে। ছাদে জোড়ে জোড়ে পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। বাদশা ছাদে গেলেন।গিয়ে দেখেন পাগড়ি পড়া সাদা পোশাকধারী এক লোক হাঁটছেন। বাদশা প্রথমে অবাক হলেন।কারন সৈন্য-সামন্ত-প্রহরীর চোখ ফাঁকি দিয়ে ছাদে দরবেশের মতো এই লোক আসলো কি করে! তারপরও বাদশা বাদশার মতো ভয় ভেতরে চাপা দিয়ে লোকটিকে জিজ্ঞেস করলেন
'আপনি কে,কি চায়?'
লোকটি বলল
'আমি কে আমি যেমন জানি না,তুমি কে তাও তুমি জান না;
আর এই ছাদে এসেছি ঘোড়া খোঁজতে,আমার ঘোড়াটা হারিয়ে গেছে তো তাই।'
বাদশা হাসি দিয়ে বললেন 'ঘোড়াকে কি ছাদে পাওয়া যাবে? তারপর লোকটি আস্তে করে বাদশার চোখের দিকে তাকালেন।কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন 'ছাদে যেমন ঘোড়া পাওয়া যায় না তেমনি রাজকীয় আরাম আয়েশে থেকেও আল্লাকে পাওয়া যায় না।কথাটি শোনার সাথে সাথে বাদশার মনে ঝড় শুরু হয়ে যায়,বাদশা পাগলের মতো এদিক-ওদিক ছুঁটতে থাকে।রাজ্য ছেড়ে দেয়-- যেখানে গেলে মাশুকের খোঁজ পাওয়া যাবে সেখানে ছুঁটতে থাকে-- বাদশা খোঁজছে তো খোঁজছে-- মাশুকের খোঁজ আর পায় না।আর আমি শাহ শওকত আলীর চোখে মাশুকের খোঁজ পাই,তাঁর কথা বলার ভঙ্গির মধ্যে মাশুকের খোঁজ পাই -- তাঁর কথা বলার ভঙ্গির মধ্যে যদ্যপি আমার প্রেরনা মেঘনা নদীর খোঁজ পাই-- যে নদী ভাঙতে জানে, চর তৈয়ারি করতে জানে,সে নদী।
নদী কেন পারাপার করে গতিশীল ঢেউ। ঢেউয়ের লগে চান্দের হাতির, ঢেউয়ের লগে সাগর-মহাসাগরের হাতির। ঢেউ এক হাতিরের নাম। যে নদীতে ঢেউ থাহে না সে নদী দ্রুত মারা যায়।নদী মারা গেলে ডোবা, জলাশয়, পুকুর তার নাম-- মানুষ তাদেরকে কত অত্যাচার করে-- মৃত কিছুর উপর ওস্তাদগিরি দেখানো মানুষের কারবার।
'ওস্তাদ' শব্দটি যখন বিশেষন হয় তখন এর অর্থ দাঁড়ায় 'দক্ষ','যোগ্য', 'ন্যায়শীল' ; নেগেটিভ অর্থে 'কপট'।
এই জীবনে দক্ষতার কোনো সীমানা পাইনি।এই জীবনে দক্ষতার কোনো ডাকনাম পাইনি।তবে দক্ষতার এক সুনিপুন কারিগর দেখেছি আমার জীবনযাপনের সামনে,আমার বেড়ে উঠার সামনে। সে কারিগরের নাম আমার মা,আমার আম্মা,আমার মম।
ছয় বোন,আমি,আমার আব্বাকে নিয়ে আমাদের পরিবার। নিঃসন্দেহে আমি অনেক আদরের এবং আরাদ্ধ।কিন্তু কোনো দিন তাঁর আচরনে আমি আদরের একমাত্র বোধটুকু জেগে উঠতে দেখিনা-- না খাবার টেবিলে,না বাইরে যাওয়ার ব্যাপারে,না মার্কেট করার ব্যাপারে।
আব্বা কৃষক,নিতান্ত সহজিয়া মানুষ-- আমাকে কোনোদিন কোনো উপদেশ দেননি। বাবা হয়ে উপদেশ দেয়ার লোভ সামলাতে পাড়লেন কীভাবে আমি আজ অবাক হই।হয়তো তিনি আমার ওস্তাদ হতে চাননি,নাকি ওস্তাদ না হওয়ার নির্মোহ আচরনই তাকে আমার কাছে জীবনবাদী ওস্তাদ করে তুলেছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন