মঙ্গলবার, ১০ নভেম্বর, ২০১৫

এমন বাংলাদেশ

বাংলাদেশের প্রধান প্রধান সড়কে ভ্যান চলে, বাস চলে, রিক্সা চলে, মোটর বাইক চলে, চলে আরো বিলাসবহুল গাড়ি। জগাখিচুড়ি রাস্তা। রাস্তা দেখেই বাংলাদেশের মানুষের মানসিকতা অনুধাবন করা যায়।জগাখিচুড়ি মানসিকতা। অর্থাৎ এখানে আদর্শের কোনো ঐক্য নেই। এখানকার মেয়েরা বোরখাও পড়তে চায়, আবার পার্কের অন্ধকারাচ্ছন্ন গাছের নিচেও বসতে চায়। আর ছেলেরা টুপি পড়বে, সারারাত ধর্মের কাহিনি শুনবে কিন্তু সকালে সালাত কায়েম করবে না।

জনাব পীর সাহেব মোনাজাত ধরেন মানুষের মুক্তির জন্য যতটুকু তার চেয়ে বেশি নিজস্ব দল ভারী করার জন্য। পীর সাহেবদের মধ্যে শত শত গ্রুপ। হযরত মাওলাদের মধ্যেও শত শত গ্রুপ। এক গ্রুপ আরেক গ্রুপকে ফতোয়ার উপর ফতোয়াবর্ষণ করতে থাকে, কাফের ফতুয়া।

এখানে আছে সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থা, ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা। ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা অনেক ভাগে বিভক্ত। সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থা অনেক ভাগে বিভক্ত। এখানে নারীদের জন্য আছে আলাদা স্কুল- কলেজ, বিত্তবানদের জন্য আলাদা স্কুল-কলেজ। ভিআইপিদের জন্য রাস্তায় কোনো সময় যানজট থাকে না। ফলে জ্যামে আটকে পড়া শিশুটির অসহায় চোখ কেবল দেখতে থাকে কেমন করে সা সা করে চলতে থাকে ভিআইপিবাহন।

বিভিন্ন উপায়ে যখনই নদীর পানি দূষিত হতে থাকে তখন দূষণ দূর করার কোনো সক্রিয় চেষ্টা থাকে না, চেষ্টা থাকে পানি দূষণকে  কাজে লাগিয়ে কীভাবে বিজনেস করা যায়। ফলে মার্কেটিং বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেন পানি বাজারজাতকরণের প্রক্রিয়া।

নদী শুকিয়ে গেলে আনন্দে মিলাদ মাহফিল পড়ান দেবতা কুবের। কারণ শুকনো নদীর উপর তিনি  গড়ে তুলেন বহুতল ভবন।

আর তিনি এসি বাড়িতে ঘুমান, এসি গাড়িতে চড়েন, এসি শপিং কমপ্লেক্সে মার্কেট করেন। তিনিই তৈরি করেন এসি রেস্তোরাঁর তুলতুলে পরিবেশ। গ্রাম থেকে আসা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্রটি তখন গণরুমের গিঞ্জি পরিবেশে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে এসি রুমের স্বপ্ন দেখে। টিউশনি থেকে মাসিক টাকা আসলে এক বেলার জন্য এসিরেস্তোরাঁয় যায় আর দীর্ঘশ্বাসের ঢেকুর তুলে।

এখানে একদল মানুষ  রাজাকার রাজাকার বলে চিৎকার করে প্রমাণ করতে চায় আমরা দেশপ্রেমিক, আমরা প্রগতিশীল। কিন্তু দেশপ্রেমিক, প্রগতিশীলদের যখন  হত্যা করে অরাজকতা তৈরির চেষ্টা করা  হয় তখন তারা নিশ্চুপ।

এখানে তামাক চাষের নামে ধবংস করা হয় হাজার বছরের ভূমিউর্বরতা, তৈরি হয় পাটকলের জাদুঘর। সোনালি আঁশ , রূপালী শস্যকে রূপকথার গল্প হিসাবে উপস্থাপন করা হয়। নদীতে বজ্র ফেলে ধবংস করা হয় মাছের খামার, প্রাকৃতিক মাছের খামার ধবংস করে তৈরি করা হয় ব্যক্তিগত মাছের ফার্ম।

গ্রামের খোদাভীরু, সহজ সরল মানুষ গাছের দুটি কাঁঠাল থেকে একটি কাঁঠাল নিয়ে যায় পীরে কামেলের দরবারে। কাঁঠাল পেয়ে পীরে কামেল মহাখুশি। পীরে কামেলের তরতাজা চোখ একবারও দেখে না সরল মানুষটির অপুষ্টিকর মুখ। হযরত মাওলানা তিন ঘণ্টা আসমানের ওয়াজ করে তিরিশ থেকে চল্লিশ হাজার টাকা পকেটে ভরে। অথচ একবারও ভেবে দেখেনি গ্রামের রিক্সাচালক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, জেলে, প্রান্তিক কৃষক কোথা থেকে সংগ্রহ করলো এতোগুলো টাকা।

এখানে সাহিত্য মানে দলবাজি। এখানকার সাহিত্যের নাম হোসেন মিয়া, হুজুর কেবলা, মজিদ,ভিখু। তালেব মাস্টারের চোখের জল কেবল দুদণ্ড করুণা পায়, কখনো পরিবর্তনের স্লোগান হয়ে ওঠে না।

এখানকার সিনেমায় পুলিশ আসে দৃশ্যের শেষ পর্যায়ে। গান, সেক্সুয়াল দৃশ্য, ফাইটিং প্রভৃতি পর্ব সামনে রেখে সাজানো হয় মুভির প্লট, উপাখ্যান। নায়িকাকে প্রথমে অভিনয় করতে হয় প্রোডিউসারের সাথে একান্ত গোপনে কোনো এক আলো- আধাঁরি রুমে। তারপর মডেল বিট দেখেন এমন কিছু জার্নালিস্টের সাথে।

গ্রাম্য মোড়ল বছরের পর বছর ঝুলিয়ে রাখে সমস্যা। এক পক্ষকে বলে তোমার সাথে আছি, কোনো চিন্তা করো না। আরেক পক্ষকে বলে আমরা আছি না, দেখবো তো কী হয়। এইভাবে সমস্যাকে সামনে রেখে তারা আদায় করে মোড়লফায়দা।

এখানকার যৌনশিল্পীরা সবচেয়ে অসামাজিক, নিচু জাতের মানুষ। অথচ সকালে মর্নিং ওয়াকের নাম করে তাদের কাছে হাজিরা দিয়ে আসে সমাজের সবচেয়ে সামাজিক মানুষটি।

টেলিভিশনে প্রোগ্রাম সাজানোর নামে চলে বিজ্ঞাপন প্রদর্শনী। বিজ্ঞাপনের ফাঁকে ফাঁকে প্রোগ্রাম দেখানো হয়। প্রোগ্রামেও আস্তে করে পাখি পোশাকের বিজ্ঞাপন করা হয়।

যে রান্নাশ্রমিক ঘরের ভেতর কাজ করে সে হয়ে ওঠে মনিবের সেক্সুয়াল দাস। মনিবের পাশাপাশি সদ্য যৌবন প্রাপ্ত ছেলেটিও যখন তার আঁচল টেনে ধরে সে তখন ঘৃণা, লজ্জায় চাকরি ছেড়ে দিয়ে রাস্তায় রাস্তায় চকলেট বিক্রি করে। শহরের ভদ্র মানুষটিও তখন চকলেট ক্রয়ের নামে তার হাত চেপে ধরে। একসময় বাধ্য হয়ে মেয়েটি নেমে পড়ে দেহ ব্যবসায়। তাদের দেহ ব্যবসার কাহিনির পেছনের ইতিহাস নিয়ে তবুও এখানে লেখা হয় না রিজারেকসন উপন্যাস।

ক্লাসের সব চেয়ে মেধাবী ছাত্রটি এখানে পেছনের বেঞ্চের মেম্বর। ধীরে ধীরে তাকে করে দেয়া হয় স্রোতহীন। স্রোতে থাকা তেলাপোকার ছানা হয়ে ওঠেন আমাদের স্মরণীয় সালাম বাবু।

এখানে সড়কদুর্ঘনার নামে সম্পূর্ণ করা হয় রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড। লাশের উপরে টিকে থাকে ক্ষমতার লড়াই। ঘটনার পর ঘটনা সাজিয়ে চাপা দেয়া হয় দুর্ঘটনার নিউজ।

এখানকার খাবার মাথাকে স্বাস্থ্যকর করে না, বুড়িকে স্বাস্থবান করে তোলে। মাথার আগে বুড়ি সামনে চলে আসে। পৃথিবীর সমান গোল বুড়ি নিয়ে তারা ফুটবল খেলে, আর গলা ফাটিয়ে বলতে থাকে আমিও কিন্তু আন্তর্জাতিক খেলোয়াড়।

এখানে কেবল দেয়াল গড়ে উঠে,
এখানে কেবল গর্ত আর গর্ত। তবুও ফুল ফোটে, পাখি গায় গান, নদীর বুকে জাগে সাগরের টান।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন