রবিবার, ৩১ আগস্ট, ২০১৪

গোধূলি

একতরফা বৃষ্টি হওয়ার কথা। বৃষ্টি হবে হয়তো। ভাদ্র মাস বলেই সন্দেহ। ভাদ্রের সূর্য, বৃষ্টি, ভ্যাপসা গরম অর্থাৎ তার কোনো  আচরণ নিয়ে নিশ্চিতভাবে  কথা বলা যায় না, ছন্দহীনের মতো ছন্দময়।

আমাদের গ্রামে এক আলোচিত সাবালক আছে। সাবালক মেয়ে। এখনো বিয়ে বসেনি। কোনো ছেলে হয়তো তাকে বিয়ে করতো।
 কিন্তু!
সে নিজেকে ব্যতীত অন্য কাউকে পরিচ্ছন্ন মনে করে না। সবার আচরণে, পোশাকে যেন ময়লা। সালুনি স্নান করতে যায় রাতে। স্নান শেষে ঘরে আসার আগ পর্যন্ত কেউ যেন তাকে দেখতে না পায়। মানুষের চোখেও ময়লা আছে তার ধারণা।
বাড়ি টু বাড়ি ঘুরাঘুরি তার দৈনিক ডিউটি। প্রত্যেক বাড়ির মুরুববী গিন্নির সাথে তার উঠা- বসা। প্রত্যেক বাড়িতে তার আলোচ্য বিষয় ময়লা। কার শরীরে, মনে কী পরিমাণ ময়লা লেগে আছে। গিন্নিরা ময়লার আলোচনা শুনতে বেশ সুখ পায়, এই সুখ যে অহংকারের।

হায়রে অহংকার!

মানুষ কত বিষয়  নিয়ে অহংকার করতে পারে।সাপলুডু খেলায় প্রতিটি চালই  অহংকারের, প্রতিটি চালই বিনয়ের, প্রত্যেক চালই হীনমন্নতার দীর্ঘশ্বাস।

সালুনির অহংকার সে সবাইকে ময়লার সমার্থক হিসাবে ভাবতে পারে, গিন্নীদের অহংকার তারা জানতে পায় সবাই ময়লাময়। আর সবার অহংকার তারা সালুনির মতো নয়।

আসলে অহংকারের আচরণও ভাদ্র মাসের মতো। তার স্থিরস্বভাব বলেই কিছু নেই।তবে অহংকার ভাদ্র মাসের চেয়ে একটু বেশী ভবঘুরে, বেশী তরল।

বৃষ্টির সম্ভাবনা বেড়ে গেলে মানুষ খোঁয়ারি হতে থাকে। সময়টাও খোঁয়ারে যাবার।
ভাদ্র মাস বলে বৃষ্টি পৃথিবীতে আসবে না, এমনটাই মনে করছে গোধূলি।
গোধূলির ধারণা ভুল। অবশ্যই গোধূলির অধিকাংশ ধারণায় ভুল হয়।

গোধূলি অসম্ভব সম্ভাবনাময়। চান্দের হাড়ের লাহান তার লকলকে শরীর। ভাঁজ করে পাঠ করা যায়। প্রতিটি পাঠে অনুভূতির নতুন অভিজ্ঞতা, সবুজ শিহরণ। গোধূলি নিজেও জানে দৃশ্যমান আম- কাডলরা তার গন্ধে মাতাল। সুন্দর বনের বাঘও তার চারপাশে ঘুরঘুর করে।
কতজন তার জন্য চোখের জল ফেলে, কত মহাপুরুষ শোনায় তাকে না পেলে আত্মহত্যা করার ভবিষ্যৎ রুডম্যাপ। বিশেষ এই কাহিনীগুলো গোধূলিকে অহংকারী করে। সে ভাবতো এই অহংকার তার মৌলিক, খাবারের মতোই মৌলিক।
কিন্তু না। তার অহংকার বাড়ন্ত  পুরান চালের  বিপরীতে  কমছে তো কমছে।
তার জৈবিক মনে প্রেমের ঝড় উঠে। আসলে উঠানো হয়। প্রভাবক হিসাবে কাজ করে পারিবারিক সম্পর্ক।

প্রযুক্তি গোধূলির মামা। দূর সম্পর্কের মামা। পরিচিত মেয়েদের সাথে প্রযুক্তির সম্পর্ক  কামের, কাউকে বলে, কাউকে বলে না। প্রযুক্তির জীবনে ভালো একটি পদবি ঝুলে আছে। আর তাহলো ইনজিনুয়াল এঞ্জিনিয়ার। ছেলেদের ভালো কেরিয়ার দেখলে মেয়েদের মাথা যতটুকু ঘোরে তার চেয়ে বেশি ঘুরে গার্ডিয়ানের মাথা। গোধূলির মা প্রযুক্তির হাতে মেয়েকে তোলে দিতে পারলেই যেন হাফ ছেড়ে বাঁচে!
প্রযুক্তিরও নতুন নতুন জলে স্নান করা বহুদিনের অভ্যস্ত। স্নান করার আগে কয়েকটি মুখস্থ গান শোনিয়ে ঢেউ তোলে নদীতে --

পড়ে না চোখের পলক
কি তোমার রূপের ঝলক
দোহাই লাগে,
মুখটি তোমার একটু আঁচলে ঢাকো
আমি জ্ঞান হারাবো, মরে যাবো
বাঁচাতে পারবে না কেউ

এই গানটি তার আদ্যোপান্ত মুখস্থ। মেয়েরা স্বভাবতই নিজের প্রসংশা শোনে মাতাল হয়ে যায়। পৃথিবী সম্পর্কে জ্ঞাত মেয়েরা জানে তাকে তোষামোদ করা হচ্ছে, তারপর বিশ্বাস করতে প্রস্তুত আসলে তা তোষামোদ নয়, প্রসংশা।
প্রযুক্তি এই গানটি দিয়ে মেয়েদের মনে প্রথমে নিজবিস্তারের নার্সারী তৈরি করে। তারপর হাসির বাক্স থেকে হাসির আর সম্ভাবনার জারবাতি। বেস! চলতে থাকে ফোনালাপ, ফেইসবুকচেট। মুখস্থ কথার অসম্ভব চক্রাকার আবর্তন। মেয়েরা তার ভাষিক ষরযন্ত্রের জালে আটকা পড়ে।
করুণা থেকে প্রেমের উৎপত্তি 'এই ধারণাটিও প্রযুক্তির হার্টডিস্কে জমা আছে। প্রয়োজন এই ডকট্রিনটি সে অনায়াসে ব্যবহার করতে জানে। নিজের কাছে সৎ থাকে এই বলে ` আমি প্রতি মুহূর্তে ভালো থাকতে চায়।'

কিন্তু কৃষ্ণের ভালো থাকার জন্য রাধাই কী অত্যাবশ্যক? চাতক কিংবা ইগল পাখির জীবনাচার একটু প্রাসঙ্গিক হতে  
পারে না?

হবে না, হওয়ার না। প্রযুক্তির আদর্শ স্নানের  আদর্শ, প্রযুক্তির আদর্শ ভোগের আদর্শ ( ইন্না মা আমালু বিন নিয়াত)।

গোধূলিও আজ পরিপূর্ণ ভাষিক ষরযন্ত্রের অধীন। গোধূলির গাঙে প্রযুক্তি অনেক বার স্নান করেছে। এখন গোধূলি পুরাতন। তাকে আর আগের মতো গান শোনায় না, রূপের কীর্তন করে না। এখন প্রযুক্তির মেজাজ সবর্দা সপ্তমাত্রিক। বলে না চলে যাও, চলে যাওয়ার অবস্থা তৈরি করে।

একটি শ্রুতকাহিনী মনে পড়লো। এক লোক নতুন বিয়ে করলো। তো, বেশ আনন্দে দিন কাটাচ্ছে। বছর খানেক অতিবাহিত হওয়ার পর বউডারে আর বাল লাগে না। তাই বউডারে হালি ফিডা। বউডা এলহা এলহা কান্দে। আরেকদিন জামাইরে জিগা,
` আচ্ছা তুমি যে আমারে এবাইতে মারো, তুমি কি আমারে লইয়া হাইতা না?'
জামাই ক,  `আ লো , ফুংডা বেডির জি, তরে কেরে ফিডাই, তুই এডাও বুজস না?'

গ্রামের সেই সহজ সারল্যেপূর্ণ  মেয়ের মতো গোধূলি এখন কাঁদে,বুঝে না ।
সে কেবলই বৃষ্টি খোঁজে। বৃষ্টির কান্না যত গভীর হয় তার কান্না ততই গভীর। বৃষ্টির কান্নার আওয়াজ শোনা যায় কিন্তু তার কান্নার আওয়াজ হয় না।
আজ বৃষ্টি হচ্ছে। ভাদ্রবৃষ্টি। কেউ জানে  না কখন থামবে তার রিমঝিম ঝিমুনি। গোধূলি আজ বৃষ্টিমুখী, তার চোখ দিয়ে অঝোরে ঝরছে লবণাক্ত পানি, যে পানি বৃষ্টিকে ভিজিয়ে যায়, আর বলে
Love me if you dare

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন