পোস্টমাস্টার জীবনের গভীরতর আয়াত অনুবাদ করে আমাদের শোনাতে পারে। কারন তিনি জেনে গেছেন পৃথিবীতে কেউ কারো না। পরিষেবা পাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা তার মনে, পরিষেবা দেয়ার জন্য রতনই তখন তার একমাত্র নৈকট্য মানুষ। প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে পোস্টমাস্টারের নৌকা আর থামতে চায় না, শাঁ শাঁ করে পালে বাতাস লাগতে থাকে, পোস্টমাস্টারের মন তখন উতলা হওয়ার অভিনয় করে।
জনাব রবীন্দ্রনাথ, পাঠক কিন্তু এতো বোকা না -- আপনি করুণ রসের আবহ তৈরি করবেন আর পাঠকেরা চোখের জল, নাকের জল একসাথে করে ফেলবে। একদম না। পাঠক চিনে নপুংসক অপুকে ; একরাত্রির বেনামী মাস্টার আর সুরবালা কে(?) তা পাঠক ভালো করেই জানে। তার জন্য পাঠককে রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুইসাইড নোট পড়তে হয় না।
রহিত ভেমুলার সুইসাইড নোট পড়ে ভারতবর্ষের মিডিয়া তোলপাড়। জনাব অশোক বাজপেয়ি হায়দরাবাদ কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে ডি-লিট উপাধি ফেরত দিতে প্রস্তুত। কারন বিশ্ববিদ্যালয় ভেমুলার সাথে অমানবিক আচরণ করেছে। জনাব অশোক বাজপেয়ি আপনার দরদ আজকে উপচে পড়ছে কিন্তু রাধিকা ভেমুলা যখন সেলাই মিশনের সুই সুতার উপর ভর দিয়ে রহিতের খাতা কেনার ব্যবস্থা করেন তখন আপনার কালো কালো মাজা মাজা শরীরখানা কোথায় থাকে? তখন তো আপনার কোনো ভূমিকা থাকবে না। কারন তখন সিমপ্যাথির বাণিজ্য করার যেতো না, বাণিজ্য করার এই তো সময়।
জল পড়ছে। পোস্টমাস্টার ঘরের ভেতর একা। তার সাথে একটি মাত্র প্রাণি। তাও আবার মানুষ প্রাণি। মানুষটির নাম রতন। পোস্টমাস্টার জানেন জীবনের গনিত, রতন শিখে নিচ্ছে গনিতের জীবন। সচেতন আর অবচেতন মনের খেলা। রতন নিজেকে সমর্পণ করেছে, আর পোস্টমাস্টার জীবনের মন্দিরে প্রার্থনা না করে, সামাজিক মন্দিরের সভাপতি হলেন। প্রার্থনা নয়, পরের অর্চনা করাই পোস্টমাস্টারের দলিত উদ্দেশ্য।
সামাজিক মন্দিরের পুরোহিত আজকে রহিত ভেমুলার আত্মার শান্তির জন্য ভোগ উৎসর্গ করছেন, প্রতারক মেয়েটি প্রোফাইল পিকচারে ঝুলিয়ে দিয়েছে রহিত ভেমুলার ছবি, ভণ্ড গায়কও কবির কথায় বসাচ্ছেন সুর। কারন পুজোয় মন্ত্র পাঠ না করলে পুরোহিত হওয়া যায় না, মানবতার স্লোগান না তুললে পাপের বোঝা হালকা হয় না।
রতন বন্ধু আমার,
একা একটি বায়বীয় শব্দ। আমরা কেউ একা নয়। প্রত্যেক ব্যক্তি অসংখ্য ব্যক্তিকে ধারণ করে আছে। প্রত্যেক ব্যক্তির ভেতর আস্ত একটি মহাকাল, মহাকাশ আছে। যারা এই মহাকাশ, মহাকালের পথে হাঁটে তারাই একজন সত্যিকারের মানুষ, একজন রতন। একজন পোস্টমাস্টার রতনকে উপলব্ধি করতে পারেনি, তাতে কী? রতন বেঁচে থাকবে যুগ যুগ ধরে কালের মহিমায়।
রহিত ভেমুলা,
তুমি লেখক হতে চেয়েছিলে। লেখক শব্দটির সাথে সংগ্রাম শব্দটি খুব করে লেপ্টে আছে। তোমাকে জ্ঞান দিচ্ছি না। আর কয়েকটি দিন পৃথিবী থাকতে তো পারতে, তাহলে হয়তো জ্ঞান দেয়া-নেয়ার উপরে ওঠে আমরা নির্বাণগ্রামের দিকে এগিয়ে যেতে পারতাম।
আমাদের মুজিব ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। তিনি তোমার মতো লেখক হতে চাননি কিন্তু তোমার মতো মানুষের মুক্তি কামনা করতেন। চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী দাবি আদায়ের আন্দোলন করছে। মুজিব ভাই তাদের পক্ষে আন্দোলন করলেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মুজিব ভাইকে বহিষ্কার করে দিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় এমন সম্মাজনক কাজ প্রায় করে থাকেন। মুজিব ভাই কিন্তু সুইসাইড করেননি, তিনি এক কাপ চা খেলেন, একটি তরতাজা সিগারেটের প্রাণ নিলেন। তিনি বলতে পারতেন my birth is fatal accident কিন্তু না, তিনি তা বলেন নি। তিনি বললেন সাধারণ মানুষের কথা, তিনি বললেন বাংলার মানুষের মুক্তির কথা। তিনি হয়ে গেলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
বঙ্গবন্ধু মানুষের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখালেন পালিয়ে কখনো সমস্যার সমাধান করা যায় না।
ভেমুলা, আমার বন্ধু,
মানুষ তোমাকে কেন মনে রাখবে বলো! তুমি তো মানুষের মাঝে থাকতে চাওনি, তুমি চেয়েছো দুদণ্ড শান্তি। তাই মানুষ তোমাকে নিয়ে কিছুদিন বাণিজ্য করবে, তাতে তাদের বাণিজ্যিক রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ হবে, তারা তাদের শান্তি নিশ্চিত করার প্রয়াস পাবে। তারপর .....তারপর তারা তোমাকে ভুলে যাবে!