বুধবার, ১২ নভেম্বর, ২০১৪

বাঁকসুন্দরীর কথা মনে পড়ে

``সিয়েন আনিয়োস দে সোলেদাদ"
উপন্যাসের  সূচনা অনেকটা কৌতূহলে,রহস্যে -- যেখানে প্রথম হোসে আর্কাদিয়ো একটি লোককে হত্যা করে আর এরপর সে প্রচণ্ড অনুশোচনায় ভোগে, ভয়ঙ্কর রকমের এক বিবেকের দংশন শেষ পর্যন্ত তাকে তার গ্রাম ছাড়তে বাধ্য করে এবং গ্রাম ছেড়ে পাহাড়-পর্বত ডিঙিয়ে সে পত্তন করে পৌরাণিক মাকোন্দোর।
``সিয়েন আনিয়োস দে সোলেদাদ"
উপন্যাসটির লেখক গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস। লাতিন আমেরিকার উপন্যাস নিয়ে বিশেষ করে গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস-এর লেখালেখির পেছনের কাহিনি নিয়ে  চমৎকার একটি কথোপকথনের [গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস এবং মারিয়ো বার্গাস ইয়োসা-এর মধ্যে কথোপকথন]  বই আমার হাতে আসে।
গোগ্রাসে গিলতে লাগলাম। ক্লাসের পেছনের বেঞ্চটি নির্বাচন করলাম যাতে আমার গিলাতে কোনো কাঁটা না লাগে। ক্লাস শেষে সোজা সেমিনার  লাইব্রেরীতে। সেমিনার লাইব্রেরীর বইগুলো চুপচাপ, কলহীন, শান্ত ; কুমারীও বলা যায়। কারণ আজ পর্যন্ত কোনো পাঠকের হাত তাদের শরীর স্পর্শ করেনি। বইয়ের দুংখ হয়তো ধূলিকণা বুঝতে পারে।
একদিন বইয়ের কুমারীভাব
নষ্ট করা জন্য অভিযান চালাই। সেইদিন ধূলিকণার সাথে আমার প্রচণ্ড যুদ্ধ করতে হয়। ফলাফল যে খুব ভালো হয়েছিল এমন না, আমি ডাস্ট এলার্জির  আক্রমণের কবলে পড়ি। সেইদিন থেকে তওবা করেছি আর কোনোদিন ধূলিকণা আর বইয়ের দাম্পত্য জীবনে তৃতীয় হাত প্রবেশ করাবো না।
তারপরও পড়াশোনা আমাকে করতে হয়। কারণ পড়াশোনা আমার কাছে জৈবিক কাজ।  বেঁচে থাকার জন্য যেমন খাই তেমনি বেঁচে থাকার জন্য পড়ি।
পড়তে পড়তে জানতে পারি, বোর্হেসের সাংঘাতিক রকমের রক্ষণশীল, প্রতিক্রিয়াশীল একটি মন আছে কিন্তু সৃষ্টিশীলতার প্রশ্নে একবিন্দুও প্রতিক্রিয়াশীল কিংবা রক্ষণশীল নন। বোর্হেসের রচনাকর্মে এমন কিছু পাওয়া যায়না যেটাকে বলা যেতে পারে সমাজ বা ইতিহাসের পরিপন্থী বা জগতের নিশ্চল কল্পদৃশ্য, অন্তহীন এক কল্পদৃশ্য যা ফ্যাসিবাদ বা সাম্রাজ্যবাদকে উসকে দেয় বা তার বন্দনা করে।
আরো জানতে পারি, গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস লেখালেখি শুরু করেন পনেরো বছর বয়সে এবং তিনি তখন মনে করতেন লেখালেখির কোনো মানে হয়না। তাঁর ইচ্ছা ছিল উকিল হওয়ার। কারণ তিনি চলচ্চিত্রে দেখেছিলেন উকিলরা ন্যায্য বিচারের জন্য কোর্টে লড়াই করে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পর তাঁর স্বপ্নের গতিপথ পরিবর্তন হয়। একধরনের ভালো লাগা থেকে গল্পসল্প লিখতে আরম্ভ করেন। গল্প ছাপানো অক্ষরে দেখে তাঁর  আরেক ধরনের ভালো লাগা কাজ করতে থাকে।
বেস, শুরু হয়ে গেল তাঁর লেখক জীবন। চলে আসে একধরনের দায়বদ্ধতা।
লেখক যেমন দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে লেখেন আমিও পাঠউদ্ধারের প্রেরণা নিয়ে পড়তে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। কোলাহলে সব কিছু হতে পারে কিন্তু পড়াশোনা হয়না। তাইতো সেমিনার লাইব্রেরীর এক কোণে বসে পড়ছি। লাইব্রেরীর বইগুলো এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। এমন মায়াময় দৃষ্টি যেকোনো পুরুষমনের মরুময় এলাকায় করুণার প্লাবন আনতে পারে। কিন্তু আমি জেনে গেছি ধূলিকণার সাথে তাদের গভীর প্রেম। যুদ্ধ করে নিজের বীরত্ব প্রকাশ করে প্রেমিকাকে জয় করবো এমন প্রাগৈতিহাসিক ছেলে আমি নই। আমার ব্যাগভর্তি বইতে আমি সন্তুষ্ট। তারপরও চোখের আবেদন যুক্তি মানে না।নিজের সাথে যুদ্ধ করেই নিজের মতকে শ্রদ্ধা জানাতে হয়। আমিও তাই করলাম।
আমার চোখ কালো কালো খাবার মগজে পাঠিয়ে দিচ্ছে। বাম দিক থেকে লাইব্রেরী আপার নাগ ডাকার শব্দ কানে আসছে। কানে অদৃশ্য তুলা স্থাপন করে কাজ চালিয়ে যাচ্ছি।
হঠাৎ কানে আসে এ শার্পের একটি কণ্ঠ,
 `পরীক্ষা?'
মগজ তার দিকে ফিরে তাকায়।

ঠোঁটে কালো তিল, চোখে কালো মেঘ, বাম হাতের তর্জনীতে জিরো ফিগারের আংটি, চোখের নিচে প্রশান্ত মহাসাগর, কানে স্লিম লতি, কোমড়ের বাঁক যেন স্রোতের স্নিগ্ধ মোহনা, দাঁতে যেন শরতের সফেদ মেঘ খেলা করছে, সব মিলিয়ে যেন চোখের ভেতর, স্বপ্নের ভেতর খেলা করা এক নারী।
আমি মৃদু কণ্ঠে উত্তর দেই,
`না'
সে চলে যায়, আমার মগজও চলে আসে কালো খাবারের দিকে। মনোযোগ স্থাপনের চেষ্টা করছি। কিছুতেই মন থাকছে না বইয়ের পাতায়।বারবার ভাবছি তার কথা, তার কথা মানে তারই উচ্চারিত ধ্বণি --
`পরীক্ষা?'
ছাত্র কী শুধু পরীক্ষার জন্য পড়ে?
আমি কী তাহলে ছাত্র হতে পারিনি?
প্রশ্ন করি কিন্তু উত্তর আসেনা। উত্তর যাঁরা দিবেন তারা ভদ্রতার টুপি পড়ে জ্যামিতিক হারে সালাম খরিদ করে যাচ্ছেন।
হয়তো এই কারনেই বাংলা বিভাগ লাবণ্যের দেখা পায়না। অমিতের সুরে কথা বলে না কোনো প্রাণ। অনন্তের মার দুংখের আয়তিকে টিস্যুপেপার আবেগের যৌথ খেলা মনে করে স্বস্তি পায়।

সাহিত্য পড়তে আসি চেতনাকে জাগ্রত করা জন্য। ভর্তি হওয়ার আগে ভেবেছিলাম রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, মানিক, শেক্সপিয়র বুঝি বাংলা বিভাগের করিডোর দিয়ে হাঁটাহাঁটি করে। তাঁদের স্পর্শ পেয়ে সমৃদ্ধ হবে আমার ইচ্ছার উড়ন্ত ঘুড়ি। ভাবতাম সাহিত্যধর যাঁরা আছেন তাঁরা শিখাবেন সাহিত্য মানে নিজের মতো চিন্তা করা, নিজের আয়নায় নিজেকে দেখা, অন্ধকারের ভেতর আলো,  আলোর ভেতরে অন্ধকার খোঁজ করা।  জীবনব্যাপ্তির  নিচে যে নৈপুণ্য থাকে তার সাথে আমাদের নবীন জ্ঞানের স্পর্শ ঘটানোর জন্য যে  পরিক্রমা তা আবিষ্কারের পথ দেখাবেন তাঁরা।

বাস্তবতা ভিন্ন, তাঁরা যেন আকাশের তারা। মহা মুশকিল আমাদের বামন ছাত্রদের। এমন কোনো মই আবিষ্কার হয়নি যার সরল সহযোগিতায় তারাদের কাছে পৌঁছানো যায়। ফলে তারা দেখে দেখে চোখের পুষ্টি সাধন হয় কিন্তু মনের অপুষ্টি থেকেই যায়।
তারারা মাঝে মাঝে জমিনে নেমে আসেন। এসে আমাদেরকে উন্নত প্যাকেজ সিস্টেমের উপহার দেন। জীবনকে যারা প্যাকেজের স্রোতে ভাসিয়ে দিতে পারে তাদের জন্য আমার জয়তু অভিনন্দন। প্যাকেজ সিস্টেম মেধাবীর পাহাড় তৈরি করতেছে যাদের সাথে প্রতিনিয়ত ধাক্কা খেয়ে আমার চেতন ফিরে। আর তখনই স্বপ্নের দেবী আমাকে বলে যায়,
``ওরে বাছা, মাতৃকোষে রতনের রাজি"
আমি এতো রতন লইয়া কেন শিট তৈরি করিতে পারি নাই , কেন আমার নাম মেধাবীদের তালিকায় আসিবে না।
বুঝলুম, আমার জন্ম মেধাবী হইবার জন্য নহে, আমার জীবন মেধাবীদের একরঙা শিটের ভেতর প্রবেশ করিবার নহে। আমার জীবন বাতাসের লগে বন্ধুত্ব করে, সময় ও নদীর কথা শুনতে ব্যাকুল। তবু বাঁকসুন্দরী কথা ভুলিতে পারিনা,

`কী, পরীক্ষা?'

২টি মন্তব্য: