রবিবার, ৩০ অক্টোবর, ২০১৬

কালা নানা

এই মুহূর্তে আমার কালা মিয়ার কথা মনে পড়ছে। কালা মিয়া মানে কালা নানা। কালা নানা মানে আমাদের স্কুলের দাপ্তরিক কাজের একজন। সে দেখতে নাকি কালো ছিল, তাই তার নাম কালা মিয়া। কিন্তু আমার চোখে এখন তার যে রং ভাসতেছে তা মোটেও কালো নয়, কফি কালারের সাথে মেটে মেটে একটি রং।

প্রতিটি ঘন্টার নীরব স্বাক্ষী ছিল সে। তার দুটি হাত এবং দুটি মুখ ছিল। হাত ও মুখ যখন কারো সমান সমান হয় ব্যক্তিটি তখন বাঁকাপন্থী। বাঁকাপন্থী মানুষ ভালো বা খারাপ এমন কোনো মন্তব্য করতে রাজি না। তবে বলতে পারি ঘটনাকে বাঁকা করে দেখা এবং বলার মধ্যে তাদের সুখ।

এখন আসি কাজের কথায়। স্কুলে  একজন ভদ্র  ছাত্র এবং একজন ভদ্র ছাত্রীকে  পুরষ্কার দেয়া হবে। খেলাধূলা, ভালো ছাত্রের পুরস্কার ততদিনে আমার হাতে চলে আসছে। এখন যদি ভদ্র ছাত্রের পুরষ্কার নিতে পারি তাহলে তো হলোই-- বাংলা সিনেমার নায়ক রুবেলের যে পার্ট আমার গতরে এমন একখান পার্ট নাইম্মা আইবো।

তারপর সব দুষ্টুমির মুখে লাগাম দিলাম। ক্লাস শুরু হবার আগে স্কাউটের নিয়মমাফিক ব্যায়াম করানো হতো, ব্যায়াম  শুরু হবার আগে কোরআন তেলাওয়াত হতো। জনাব তোফাজ্জল স্যার আমাদের স্কাউট টিচার।

রেজা কোথায়?

জ্বি স্যার।

সারির একেবারে পেছনে আমি দাঁড়াতাম। পেছনে দাঁড়ানোর একটি রাজনৈতিক কারন আছে। পেছন থেকে সামনে আসতে আসতে সময় লাগতো তো দুইএক মিনিট। দুইএক মিনিটের পুরো সময়টাই সবার অপেক্ষামন ছিল আমার দিকে। এই বিষয়টি খুব ইনজয় করতাম।


কোরআন তেলাওয়াত শুরু করতাম। আমি প্রথম স্কুলে তেলাওয়াতের পর বাংলা অনুবাদ করতাম। মাঝেমাঝে প্রথমে কোরআন তেলাওয়াত, তারপর তেলাওয়াতকে ইংরেজিতে অনুবাদ, তারপর বাংলা অনুবাদ। আমাদের স্কুলে কোনো বিদেশি ছাত্র বা শিক্ষক ছিল না। তাহলে কেন আমি ইংরেজিতে অনুবাদ করতাম? করার একটাই উদ্দেশ্য ছিল-- নিজেকে জাহির করা-- সবাই জানুক আমি ইংরেজিতে পারদর্শী। জাহির করার পেছনের কারন হলো ভদ্র পুরষ্কার। অর্থাৎ এমনভাবে তৈরি হচ্ছি যেন ভদ্র পুরস্কার আমার দিকে আসতে কোনো বাধাই না থাকে।

আব্বা কোনোদিনই অভিভাবকগিরি দেখানোর জন্য স্কুলে যায় নাই। অথচ তার প্রত্যেক সন্তান স্কুলের মেধাবীদের একজন ছিল। সেদিন হেডস্যার আব্বাকে কেন যেন ডাকলেন। আব্বাকে স্কুলে দেখে আমি রীতিমত বিস্মিত।

কালা নানা আব্বাকে দেখামাত্র আমাকে বলে 'লাক, আজকে তোর নামে বিচার দিমু। আমি তো জানি আমার নামে বিচার দেয়ার কিছু নেই। তারপরও সে হেডস্যারের সামনে আব্বার কাছে আমার সম্পর্কে বিচার দিয়েছিল। কী বিচার দিয়েছিল আব্বা আমাকে কোনোদিন বলেনি। আম্মার কাছ থেকে জানতে পারি আমার নামে কালা মিয়ার পক্ষ থেকে অভিযোগ দাখিল হয়েছিল।

তিনচার দিন পর ভদ্র পুরস্কার ঘোষনা করা হয়। ভদ্র পুরষ্কারে আমার নাম নেই! এতো আলোময় সূর্যটা হঠাৎ করে নিবে যায়, রাতের আকাশে অনেক তারা থাকার কথা কিন্তু কোনো তারা নেই, কার্তিক মাসের অনবরত বৃষ্টি আমার হৃদয়ে বয়ে যেতে লাগলো।

বাড়ি গেলে কালা মিয়ার সাথে দেখা হয়। এখন আর সে স্কুলে নেই। তাকে স্কুল থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। স্কুল থেকে বের করে দেয়ার কারন জানতে চাই। কালা মিয়া কারন জানে না। স্কুলের কথা বললেই তার অধর আর ওষ্ঠের মাঝপথ দিয়ে একটি চিকন দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে, আমি তখন তাকে একটি মালবরো এডবান্স সিগারেট কিনে দেই। সে তখন আস্তে আস্তে সিগারেট টানে। সিগারেটের ধোঁয়ার সাথে সাথে তার গরম দীর্ঘশ্বাস আরও দীর্ঘ হতে থাকে 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন