বুধবার, ১২ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

গল্পগুলো ঝরা পাতার

পৃথিবীতে কঁচিপাতা রাত। আকাশে কোনো রাত নেই। চোঁখে কেবল আলো মাখে তারা। আলোতে বসবাসে তারাদের দুঃখযন্ত্রনা কেমন যেন আনমনে। টিটার রোমান্টিক। ঘুমায় না। ঘুমের সাথে কথা বলে।
অদ্ভুত চাঁপা স্বভাবের। মানুষ ব্যতিত স্বভাবতই সকল পুরুষপ্রানী দেহের প্রতি যত্নশীল। নারীপ্রানীদের আকর্ষন করার জন্য। তখন টিটার তার সম্প্রদায় থেকে ভিন্ন। একটি তারা অন্য তারাকে প্রেম নিবেদন করে। দৌড়াদৌড়ি খেলা খেলে। টিটার প্রেম বিষয়টি এখনো ধারণ করতে পারেনি। সময়ের কোনো এক মাঠে টিটার অদ্ভুত অবাক। তার চোখ সৌন্দর্য শিকার করতে সক্ষম। মনের ধরাধরি খেলায় তার মনও পটু হতে চায়।

বিনীত সৌন্দর্যের তিতলী। টিটারের মনে পুবালি বাতাসের জোয়ার আনে। জোয়ারের গতি বিপরীতমুখী। বিপরীতমুখী মনে ও মানে। তিতলী টিটারের জোয়ারে ভাসে। দুই মন এক মোহনার আকুম-বাকুম। সময়ের পাশে সময় কেটে যায়। মনের কাছে আসা, দেহের কাছে আসা নয়। বয়সী প্রেম এখন দেহপ্রেম চায়। কিন্তু কোনো অজানা বাঁধায় তিতলী, টিটার দূরাদেহে বসবাস।
টিটারঃ তোমার হৃদয়ের স্পর্শে আমি তো পালতোলা মাঝি। তোমার দেহ আমাকে জল বানাতে পারে।
তিতলীঃ হৃদয় তো দেহের মাহাজন। আমার মালিক তোমার কাছে।
টিটারঃ তাহলে বাধা কোথায়?
তিতলীঃ বাধা না আছে আমাদের মনে, না আছে আমাদের দেহে। বাধা কেবলই বৈষয়িক বাস্ত্ববতায়। নাটাই কার হাতে আমাদের জানা নেই। চলো পৃথিবীতে যাই। মানুষ হয়ে জন্মায়। বীজ বপনে আমাদের প্রতিনিধি রেখে আসি। উত্তরপ্রজন্ম যেন তারাদের মাঝে নিজের অস্ত্বিত্বের খোঁজ পায়। আমাদের রহস্য যেন তাদেরই রহস্য।
দিনরাত সখিনা বেগমের প্রার্থনা। মাথার বন্ধু বালিশও তার প্রার্থনায় শরীক হয়। মিষ্টিময় চোখের জলেরও প্রার্থনা যেন একটা ছেলে হয়। গ্রাম এলাকায় ছেলের বড়ই কদর। বংশের চেরাগ।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া এলাকার মানুষ পীরপ্রাণ। পীরবাবার মান্য আল্লার চেয়েও কম নয়। পীরের হাত নবীর হাত,নবীর হাত আল্লার হাত। পীরবাবা যখন মারা যায়, তখন তার মাজার আল্লার দরগা। অসংখ্য আল্লার দরগার মধ্যে খরমপুরের কেল্লা শার মাজার একটি। সখিনা বেগম কেল্লা শার মাজারে এসেছে।
‘বাবা আমার বংশের একটা চেরাগ দাও। তোমার দরবার থেকে বাবা কেউ খালি হাতে ফেরে না। আমাকেও ফিরাইয়ো না।’
বাবা দোয়া কবুল করেছে। ফাল্গুন মাসের ফুলেল রাতে জন্মগ্রহণ করে প্রণাম। সখিনা বেগমের মুখে হাসি, মনে হাসি। প্রণামের নাকটা উঁচিয়ে আছে। অন্য কোন চোখ আকর্ষনের জন্যে।
বাবা স্কুল মাস্টার। স্কুল মাস্টার বুদ্ধিজীবী তৈরি করে। পরে বুদ্ধিজীবী টক-শোজীবী। টক-শোজীবী  কখনো স্কুল মাস্টারের দুঃখময় জীবন নিয়ে মাথা চালাতে ব্যস্ত নয়। জীবনভর টক-শোজীবীগুলো বুদ্ধিজীবী হিশেবে নাম কাটে। আসলেই যারা বুদ্ধিজীবী তাঁরা দুঃখের প্লাবনে ভাসে।
‘বাবারে, আমরা গরীব। টাহা-পয়সা নাই। তবে হুন,আল্লা মাথাডা দিছে। ইডারে কাজে লাগাইতে অইব।’
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার প্রণাম। সুহিলপুর গ্রাম। গ্রাম হলেও শহরের প্রাচুর্য বিদ্যমান। সে বাম-রাজনীতীর কর্মী। দেশ উদ্ধার করার নেশায় মাতাল। পুঁজিবাদী আগ্রাসন বিভেদ তৈরি করেছে। বিভেদ আর বেঁচে থাকা একসাথে হতে পারে না। প্রণামের গুরু জয়দুল হোসেন। মেধার উর্বর মননে যিনি সঠিক বীজ বপণ করতে জানেন। মৌসুম সনাক্ত করতেও তার ভুল হয় না। পাকা মানুষ।
প্রণাম চেতনাভর কবিতা চাষ করে। নাট্যদল গঠন করে কর্মী তৈরিতে ব্যস্ত। জ্ঞানীগন যখন নিজেকে জানতে ব্যস্ত। প্রণাম তখন নিজেকে জানাতে ব্যস্ত। তবে প্রকাশের ভুমিকায় নয়। সমাজকে উদ্ধারের ভুমিকায়।
হঠাৎ প্রণাম অন্যরকম!
আজ আট অক্টোবর। তারিখটি আট অক্টোবর উনিশশো সাতাশি সালের বিপ্লবী চেতনার তাৎপর্য বহন করে। উনিশশো আটাশ সালের চৌদ্দই জুন আর্জেন্টিনার রোজারিওতে জন্মগ্রহণ করেন সময়োপযোগী মুক্তির চেতনা, ছাত্রাবস্তায় যে ঘুরে বেড়িয়েছেন পুরো লাতিন আমেরিকায়। যে কন্ঠ বলতে পারে—
‘জয়ী না হওয়া পর্যন্ত লড়াই করে যাও’
যাকে গুলি করতে মদের সহযোগীতা চেয়েছিল মারিও তেরান; অস্ত্রহাত যার বারবার কৃপণ হয়ে আসে। সেই আনেস্তো গুয়েভারার; আর্জেন্টিনার সম্মানী শব্দে চে’গুয়েভারার বিদায়ী উৎসব।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাহিত্য একাডেমী নাটক মঞ্চস্থ করবে। ছয়টা দশ। নাটক শুরু। শিল্পকলা একাডেমীতে আলোআঁধারি মিতালী। নাটক চলছে। বিপ্লবী কলবে বসে আছে প্রণাম। সে হঠাৎ আনমনে। প্রনামের মনপোকা নুরাইনের আলোর পাশে কিলবিল-তিলবিল। নুরাইন। কুচকুচি কালো। কালো সুন্দর মেয়ে। কৃষ্ণকলি, কৃষ্ণফুলি। বিপ্লবী মনে প্রেমের বাতাসঝড়। শোঁশোঁ শব্দে মনের আস্তানা তুলকালাম।  কবিতার পালা ঘুরে গেছে। নারী সৃষ্টিতে আটকে গেছে কবিমন। বনের ছায়া ঘরে আসল। প্রণাম হারুন স্যারের একটি কবিতা সন্তানের ভক্ত,
‘আজ আর মাছ ধরে কাজ নাই সই
অধর বড়শি করো আমি মাছ হই।’

প্রণাম কল্পনাও করেনি হারুন স্যারেরই রক্তসন্তান তার ছায়ামনে কায়া হয়ে ধরা দিবে। নুরাইন হারুন স্যারের একমাত্র মেয়ে। অস্থির রুচিবোধে তার বেড়ে ওঠা। তার কালো সুন্দর দেহ, অদৃশ্য সুন্দর ব্যক্তিত্বের স্পর্শে কে না আসতে চায়।
কালো শরীরের ইলেকট্রন প্রনামের স্মৃতিকণায় জিকির তোলে। যে জিকিরের স্বর কেবল অঙ্গ থেকে অঙ্গানু অনুধাবন করতে পারে। প্রণামের বুকের ভেতর নদীর জল উথাল-পাতাল। বয়সের বাধা। সমাজের বাধা। লতার মতো আশ্রয় খুঁজেও আশ্রয় পায় না। ধুক করে উঠে চেতনার পাঁজর। বাবা স্কুল মাস্টার। মানসম্মানের ব্যাংকে ডেবিট কার্ড রাখতে হবে।
হায়রে সমাজ...আরে মানসম্মান...
সমাজ এতো ব্যবসায়ী কেন। ছাপানো কাগজের কাছে মনের মানমুল্য উঠে না। শান্তির কলকারখানা মন। আর মনের চাওয়া-পাওয়া সামাজিক নিয়মকানুনে গৃহপালিত। বাজার পদ্ধতি মনের উর্ধে মনটাও মনের কাছে রাখতে দেয় না
‘বাজারে যাচাই করে দেখি নি তো মান
সোনা কিনিলাম নাকি রুপা কিনিলাম।
ভালোবেসেছো বলে ভালোবাসিলাম।’

সময়ের প্রথম মাসিকের পর...
প্রণাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্র। তার চেহারায় সাহিত্য। কবিতার সময় নির্ভর কৃষক। টি.এস.সি, মধুর ক্যান্টিন, হাকিম চত্বর, ডাকসু, মল চত্বর তাকে মুখরা রমনীর মতো আকর্ষন করে। লাইব্রেরীতে অধ্যয়নরত ছেলেদের দেখে তার করুনা হয়। সরস জীবন অধ্যয়নে তাদের বিমুখতা, তাদের ব্যর্থতা প্রণামকে ক্লান্ত করে। সময়যাপন করাই আসল কথা। হায় চিলের রসনাই, বিনোদিনীর বাসনায় প্রণাম সময়ঘোড়াকে বেশ দৌড়াচ্ছে। ইদের ছুটিতে বাড়িতে যাবে। কমলাপুর রেলস্টেশনে পুর্বপরিচিত আন্টির সাথে দেখা। দেখা হয় হৃদয় খুড়ে বেদনা জাগানো ভালোবাসার সাথে। সেই নুরাইন। জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস চলছে। তার সাথে পাল্লা দিয়ে চলছে চোখের সাথে চোখের কথোপকথন। অদৃশ্য মনের দৈহিক মিলন। যেখানে দুটি মনের দৃশ্য দুটি মনের কাছে স্পষ্ট। কিলবিল করা অন্য মুখ থেকেও নাই। তবু দেহসুলভ আবেদন অনুপস্থিত। পুরাতন স্মৃতি মাথা চাড়া দিয়ে উঠে। দুরাগত স্বপ্ন কথা বলতে শুরু করে।
না...আর না... আমরা মানুষ হয়েছি, বীজ পৃথিবীতে রেখে যাবই! কোনো বাধাই আমাদের উদ্দেশ্যসমান গুরুত্ব রাখে না। স্বপ্নে সমান বাস্ত্ববতায় প্রনামের পাশে এসে বসল নুরাইন। সময় হাজার মাইল বেগের দ্রুতযান। ভালোবাসার প্রশিক্ষণ পৃথিবীর সমান সত্যকে চুঁমু দেয়। উদ্দেশ্যগুলো কতকালের মতো জয়তু শব্দের ফানুস উড়ায়।
তারপরও...
সময় কাঠামোর কাছে নীহারিকা হয়ে বেসে পালাল প্রণাম। নুরাইন পৃথিবীর আদিমাতা। তারা জন্মের প্রবীনতর উৎস!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন