শনিবার, ১৩ জুন, ২০১৫

ব্যক্তিগত ভাবনা

ট্রেনে দাঁড়িয়ে আছি। কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হবে কেউ জানে না, না লোকোমাস্টার, না রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।
প্রতিটি সময় উৎযাপন করার পক্ষে। তাই যেই অবস্থায় আছি শুকর আল হামদুলিল্লাহ। অসহ্যবোধ করা সহজ, কারণ তাতে চেষ্টা লাগে না। আমি তো মানুষ। চেষ্টার মধ্য দিয়ে আজকের মানুষ যুক্তিশাস্ত্রের মুক্তি দিয়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ছায়াতলে আশ্রয় নিয়েছে। তাই চেষ্টার দরজা- জানালা খুলে দিয়েছি।

আমার পেট বরাবর ষাট বছর বয়সী এক চাচা। তিনি চিপস খাচ্ছেন। দৃশ্যটি বেশ এটাকটিভ। হঠাৎ চাচুর ফোন আসে। তিনি বসা থেকে উঠে দাঁড়ালেন। চাচু দাঁড়ানোর সাথে সাথে তাঁর বুড়ি সমেত পেট মহাশয় আমার স্লিম পেটে ধাক্কা মারে। আমার পেট অসহায়। কারণ তার পেছনে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কিছুক্ষণ পেটে পেটে ঘষাঘষি খেলায় অনুভূতির নতুন মাত্রা যোগ হল অভিজ্ঞতার খাতায়।

চাচুর পাশে একজন পুরুষ। বয়স চল্লিশ হবে। তার পাশে তারই বউ। বউমেয়ের পাশে আরেকটি মেয়ে। বউ- স্বামী ঘুমাচ্ছে। ট্রেনে শোভন চেয়ারে ঘুমের ইনিংস সচরাচর দেখা যায় না। তবুও তাদের ঘুমের ইনিংস দেখতে হচ্ছে। রাতে হয়তো তারা ভালো ইনিংস উপহার দিয়েছে, তাই হয়তো পর্যাপ্ত ঘুম আসেনি চোখে।আর ঘুম তো আমেরিকার মতো নিজ প্রাপ্তি পুষিয়ে নেয় ষোলোকলায়।

বউমেয়ের পাশে যে মেয়েটি সেই মেয়েটির চেহারায় সাঁওতালী ছবিচিত্র। লাল রঙ্গের পোশাক। হাতে ঘুড়ি, ঘুড়ির প্রতিবেশী সাতটি চুড়ি। ডান হাত খালি। সে ডান হাতের কনুইয়ে ভর দিয়ে জানালার বাইরে তাকিয়ে আছে। চোখে তার ক্লান্তির ছাপ। মুখে হালকা প্রসাধনী। তবে ঠোঁট লিপস্টিকমুক্ত নয়। প্রত্যেক মেয়ে যেদিন থেকে জেনে যায় তার ঠোঁট নামক একটি অঙ্গ আছে সেইদিন থেকে লিপস্টিক ব্যবহার বাধ্যতামূলক।

আচ্ছা, ঠোঁট লাল হলে কী হয়?

ঠোঁটের পুষ্টিগুন বেড়ে যায়?

ঠোঁট কোনো কালেই সুষম খাবার ছিল না, ঠোঁট দিয়ে বরং সুষম খাবার গ্রহণ করা হয়।

মেয়েটির ফোন আসে। ফোন আসার সাথে সাথে ছবিচিত্রে সবুজ রঙ্গের ছড়াছড়ি। কী যেন বলতে চায়, মানুষের ভীড়ে যেন বলা যাচ্ছে না। দিনে দিনে আমরা কত্ত ব্যক্তিগত হয়ে উঠছি, ব্যক্তিগত রুমের ভেতর ব্যক্তিগত রুম।

আমার সরাসরি পেছনে তিনজন বসে আছেন। আমার নিতম্ব থেকে তাদের মুখের দূরত্ব পাঁচ ইঞ্চি কিংবা ছয় ইঞ্চি। হজম প্রক্রিয়া স্বাভাবিক না থাকায় ঘন ঘন পাত দিচ্ছি। আমার পাতে যেহেতু কোনো প্রকার কৃত্রিম পারফিউম মেশানো নাই সেহেতু তাদের কী অবস্থা হচ্ছে বুঝতে পেরে অসংখ্যবার মনে মনে সরি বলছি। আমার তো সরি বলা ব্যতীত কিচ্ছু করার নেই, তাই না?
বাংলাদেশে রানা প্লাজা ধ্বসের মতো ঘটনা ঘটে যায় তাতে সরি বলা তো দূরের কথা নিজের পোশাকে যে ময়লা আছে তা স্বীকার করার নূন্যতম অনুশোচনাবোধ কর্তৃপক্ষের আছে বলে মনে হয় না।  তার চেয়ে বরং দোষ অন্যের ঘাড়ে  চাপিয়ে দিতে পারলে বাঁচে। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে আমি তো যথেষ্ট মানবিক।

আজকের ট্রেনে কোনো প্রকার কোলাহল নেই। বাংলাদেশের মানুষ কথা না বলে থাকতে পারে?  সত্যিই অবিশ্বাস! একজন ভিক্ষুক অবশ্যই কিছুক্ষণ সুর দিয়ে কথা বলেছিলেন --

আল্লা নবীজীর নাম
জন্মের পরে ভাইজানেরা আমি চোখে দেখি না
আমার আল্লা নবীজীর নাম
দয়া করে কিছু টাকা করে যাবেন দান
আমার আল্লা নবীজীর নাম ....

আমার হাতের কাছে যখন ভিক্ষুকের থালাটি আসে তখন দুই টাকা পকেটে নিয়ে নিলাম। ভিক্ষুক টাকাওয়ালাদের করুণা জমা রাখার ব্যাংক। এরা যখন করুণা নিয়ে বেঁচে থাকতে চায়, আমি তাদেরকে উপহার দিতে চায় কঠোরতা। কঠোর আচরণ মানুষকে সাময়িক কষ্ট  দেয় সত্যি কিন্তু বৃহত্তর উপকার করে, দায়িত্ব ও অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে।

ও মা! ট্রেন কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে চলে আসছে।
 কখন?
আমি বুঝতেই পারিনি!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন