ক্লাস ফাইভে পড়ি। মুকসুদ স্যার বাংলা পড়ান। তিনি অসম্ভব ভালো মানুষ। আমার জীবনে একজন মানুষকে দেখার সুযোগ হয়েছে।
তিনি আমার চোখে মানুষ, একজন মানুষ।
সকাল আটটায় বাড়ি থেকে স্কুলের উদ্দেশ্য তিনি রওয়ানা দেন, জাস্ট আটটা পঁয়তাল্লিশ মিনিটে স্কুলের দরজা খুলেন। স্কুলে অবস্থান করেন সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত। কোনো প্রকার প্রাকৃতিক দূর্যোগ তাঁর দায়িত্বে নূন্যতম প্রতিকূল প্রভাব ফেলতে পারে নি।
ক্লাসের সবাই তাঁকে স্যার' সম্বোধন করলেও আমি পারি না। কারণ সম্পর্কে তিনি আমার ফুফা। স্যারও বলতে পারি না, ফুফাও বলতে পারিনা। জটিল এক সমস্যা। সম্বোধন প্রশ্ন আসলেই স্বর আকস্মিকভাবে নিচু হয়ে আসে। এই সম্ভোধন সমস্যা থেকে উদ্ধার পাওয়ার কোনো পরিকল্পনাই বাস্তবতার মুখ দেখেনি। তাই গ্রাম্য বধূর মতো লাজুক মনে মেনে নেওয়া ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। প্রতিদিনের মতো আজো তিনি সঠিক সময়ে ক্লাসে আসেন, কোনোদিন আমাকে প্রশ্ন করেন না, আজ কেন যেন প্রশ্ন করলেন --
দাঁড়াও,
বল, শিক্ষা কী?
আমি দাঁড়ালাম।
কিন্তু উত্তর কেন দাঁড়িয়ে দিতে হবে? প্রশ্নটা আমার মনে মনে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মনে রচিত প্রশ্নের উত্তর নিয়ে ভাবছি।
স্যার,
সরি,
ফুফা হয়তো ভাবছেন আমি তাঁর প্রশ্নের উত্তর খুঁজে হয়রান।
কী হল? বল
জ্বি বলছি শিক্ষা মানে জ্ঞান।
তিনি বলেন, আমিও তা জানতাম। এখন আর আমি তা জানিনা, জানলেও মানিনা। এখন আমি জানি শিক্ষা মানে আচরণের পরিবর্তন।
তারপর তিনি মাওলানা রুমী আর শামস্-ই তাবরিজের ঘটনা বলতে শুরু করেন --
মাওলানা জালালুদ্দিন রুমীর জন্ম ১২০৫ সালের (মতান্তরে ১২০৭) ২৯ সেপ্টেম্বর, ৬০৪ হিজরীর ৬ রবিউল আউয়াল, আফগানিস্তানের বালখে। তাঁর প্রকৃতনাম মুহাম্মদ। জালালুদ্দিন ছিল তাঁর উপাধি। সুলতান মুহাম্মদ বাহাউদ্দীন ওয়ালাদ ছিলেন মওলানা রুমীর পিতা। ইসলামের প্রথম খলিফা আবু বক্কর ছিলেন মাওলানা রুমীর পিতৃকুল থেকে নবম বংশধর এবং মাতৃকূল থেকে ছিলেন ইসলামের চতুর্থ খলিফা আলীর বংশধর। তাঁর দাদা হোসাইন ইবনে আহম্মদ বালখীও ছিলেন একজন উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন সৌভাগ্যবান ও আধ্যাত্মিক সাধক।
১২১১ সালে মাত্র ছয় বৎসর বয়সে মাওলানা রুমী তাঁর সঙ্গে পিতার আধ্যাত্মিক ওস্তাদ খাজা ফরিদুদ্দিন আক্তারের সাথে সাক্ষাৎ করতে যান। তিনি রুমীকে দেখে অত্যন্ত খুশি হন। তিনি শিশু রুমীর বুদ্ধিদীপ্ত সুরত দেখে মন্তব্য করেন-- অদূর ভবিষ্যতে এই শিশু সন্তান সমাজের একজন বিদ্বান হবে ও বিজ্ঞ লোকদের সচেতন আত্মাকে আলোকিত করবে। ওস্তাদ খাজা সাহেব শিশু রুমীকে তাঁর রচিত ‘গহের নামা’ কিতাবটি উপহার দেন।
মাওলানা রুমী ছিলেন একজন আলেম পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। তাঁর পিতৃ মাতৃকুল ছাড়াও তাঁর বিবাহ হয় সমরখন্দের এক বিশিষ্ট আলেমকন্যার সাথে। তাঁর দাম্পত্য জীবনে প্রথমা স্ত্রীর মৃত্যুর পর তাঁর দ্বিতীয় বিবাহ হয়। সে শ্বশুর কুলও ছিলেন বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন। যৌবনের প্রারম্ভেই মওলানা রুমী জ্ঞানার্জনের লক্ষ্যে তৎকালীন বিভিন্ন মুসলিম দেশ সফরে বেরিয়ে পড়েন। সফরের এক পর্যায়ে তিনি মক্কা নগরীতে উপস্থিত হন এবং হজ্বব্রত পালন করেন। মক্কা থেকে ফিরে তিনি তুরস্কের আনাতোলিয়া কৌনিয়ায় পৌঁছে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করেন।
রুমির জীবনের সবচেয়ে বড় পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে ১২৪৪ সালে, অর্থাৎ তার বয়স যখন ৪০ বছর। এ বছর তিনি কনিয়ায় একজন অতি আশ্চর্যজনক ব্যক্তিত্বের সংস্পর্শে আসেন। তার নাম শামস আল-দীন তাবরিজ বা শামস-ই তাবরিজ। তাদের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব হয়। শামস রুমিকে আধ্যাত্মিকতার বিষয়ে এমন উন্নত ধারণা দেন যা তিনি ইত:পূর্বে কল্পনাও করতে পারেননি।
হঠাৎ করে এক দিন শামস নিরুদ্দেশ হয়ে যান। শামস নিহত হয়েছেন বলে গুজব শোনা গেলেও রুমী নিজে তা বিশ্বাস করতেন না। শামসের নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ার পরই রুমির কলম দিয়ে ঝরনা ধারার মতো কবিতা বেরোতে থাকে।
তারপর মুকসুদ স্যার অথবা ফুফা বললেন চল্লিশ বছরের আগেও মাওলানা রুমির অগাধ জ্ঞান ছিল কিন্তু ঐ জ্ঞান তাঁর আচরণের কোনো পরিবর্তন ঘটাতে পারেনি। তাই আমরা মাওলানা রুমির চল্লিশ বছরের আগের অর্জিত শিক্ষাকে শিক্ষা বলব না এবং আগে যারা তাকে পাঠদান করেছে তারাও তাঁর শিক্ষক ছিল না। মাওলা রুমি শিক্ষা লাভ করেন শামস- ই তাবরিজের কাছ থেকে, তাই তাবরিজই তাঁর শিক্ষক।
এখন বুঝলে শিক্ষা মানে কী?
হুম ( মাথা নাড়লাম, কোনো শব্দ বের হয়নি)।
তিনি আর কোনো ক্লাস নেননি । আমাদের ছুটি হয়ে যায়, বাড়ি চলে আসি। বাড়ি এসে দেখি ইমাম সাহেব বসে আছেন। ইমাম সাহেব আমাকে আরবি পড়ান। চমৎকার কণ্ঠ। তিনি যখন আয়াত তিলওয়াতের সময় গুন্না করেন তখন বাতাসে গুম গুম আওয়াজ শুরু হয়। অযু করে নামাযি কায়দায় ইমাম সাহেবের সামনে আল্লাহর আয়াত নিয়ে বসি। আমার পাঠ আরবি হরফ শিক্ষা। হুজুর প্রথমে বলে দেন, তারপর আমি তাঁর অনুসরণ করি --
আলিফ খালি
বা এর নিচে এক নুক্তা
তা এর উপর দুই নুক্তা
পাঠ আমার মুখস্থ হচ্ছে না। অনেক চেষ্টা করছি। কিন্তু হচ্ছে না। মনোযোগ স্থাপন করতে পারছি না। মনোযোগ পড়ে আছে রাস্তার পাশে দোকানটির টিভিস্কিনে, স্কুল থেকে বাড়ি আসার পথে যেখানে বিরতি নিয়েছিল আমার চোখ। মনোযোগ টিভিস্কিনের নায়িকার প্রতি
যায় পেট খালি
পীঠ খালি
কপালে একটা টিপ
তিনি আমার চোখে মানুষ, একজন মানুষ।
সকাল আটটায় বাড়ি থেকে স্কুলের উদ্দেশ্য তিনি রওয়ানা দেন, জাস্ট আটটা পঁয়তাল্লিশ মিনিটে স্কুলের দরজা খুলেন। স্কুলে অবস্থান করেন সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত। কোনো প্রকার প্রাকৃতিক দূর্যোগ তাঁর দায়িত্বে নূন্যতম প্রতিকূল প্রভাব ফেলতে পারে নি।
ক্লাসের সবাই তাঁকে স্যার' সম্বোধন করলেও আমি পারি না। কারণ সম্পর্কে তিনি আমার ফুফা। স্যারও বলতে পারি না, ফুফাও বলতে পারিনা। জটিল এক সমস্যা। সম্বোধন প্রশ্ন আসলেই স্বর আকস্মিকভাবে নিচু হয়ে আসে। এই সম্ভোধন সমস্যা থেকে উদ্ধার পাওয়ার কোনো পরিকল্পনাই বাস্তবতার মুখ দেখেনি। তাই গ্রাম্য বধূর মতো লাজুক মনে মেনে নেওয়া ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। প্রতিদিনের মতো আজো তিনি সঠিক সময়ে ক্লাসে আসেন, কোনোদিন আমাকে প্রশ্ন করেন না, আজ কেন যেন প্রশ্ন করলেন --
দাঁড়াও,
বল, শিক্ষা কী?
আমি দাঁড়ালাম।
কিন্তু উত্তর কেন দাঁড়িয়ে দিতে হবে? প্রশ্নটা আমার মনে মনে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মনে রচিত প্রশ্নের উত্তর নিয়ে ভাবছি।
স্যার,
সরি,
ফুফা হয়তো ভাবছেন আমি তাঁর প্রশ্নের উত্তর খুঁজে হয়রান।
কী হল? বল
জ্বি বলছি শিক্ষা মানে জ্ঞান।
তিনি বলেন, আমিও তা জানতাম। এখন আর আমি তা জানিনা, জানলেও মানিনা। এখন আমি জানি শিক্ষা মানে আচরণের পরিবর্তন।
তারপর তিনি মাওলানা রুমী আর শামস্-ই তাবরিজের ঘটনা বলতে শুরু করেন --
মাওলানা জালালুদ্দিন রুমীর জন্ম ১২০৫ সালের (মতান্তরে ১২০৭) ২৯ সেপ্টেম্বর, ৬০৪ হিজরীর ৬ রবিউল আউয়াল, আফগানিস্তানের বালখে। তাঁর প্রকৃতনাম মুহাম্মদ। জালালুদ্দিন ছিল তাঁর উপাধি। সুলতান মুহাম্মদ বাহাউদ্দীন ওয়ালাদ ছিলেন মওলানা রুমীর পিতা। ইসলামের প্রথম খলিফা আবু বক্কর ছিলেন মাওলানা রুমীর পিতৃকুল থেকে নবম বংশধর এবং মাতৃকূল থেকে ছিলেন ইসলামের চতুর্থ খলিফা আলীর বংশধর। তাঁর দাদা হোসাইন ইবনে আহম্মদ বালখীও ছিলেন একজন উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন সৌভাগ্যবান ও আধ্যাত্মিক সাধক।
১২১১ সালে মাত্র ছয় বৎসর বয়সে মাওলানা রুমী তাঁর সঙ্গে পিতার আধ্যাত্মিক ওস্তাদ খাজা ফরিদুদ্দিন আক্তারের সাথে সাক্ষাৎ করতে যান। তিনি রুমীকে দেখে অত্যন্ত খুশি হন। তিনি শিশু রুমীর বুদ্ধিদীপ্ত সুরত দেখে মন্তব্য করেন-- অদূর ভবিষ্যতে এই শিশু সন্তান সমাজের একজন বিদ্বান হবে ও বিজ্ঞ লোকদের সচেতন আত্মাকে আলোকিত করবে। ওস্তাদ খাজা সাহেব শিশু রুমীকে তাঁর রচিত ‘গহের নামা’ কিতাবটি উপহার দেন।
মাওলানা রুমী ছিলেন একজন আলেম পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। তাঁর পিতৃ মাতৃকুল ছাড়াও তাঁর বিবাহ হয় সমরখন্দের এক বিশিষ্ট আলেমকন্যার সাথে। তাঁর দাম্পত্য জীবনে প্রথমা স্ত্রীর মৃত্যুর পর তাঁর দ্বিতীয় বিবাহ হয়। সে শ্বশুর কুলও ছিলেন বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন। যৌবনের প্রারম্ভেই মওলানা রুমী জ্ঞানার্জনের লক্ষ্যে তৎকালীন বিভিন্ন মুসলিম দেশ সফরে বেরিয়ে পড়েন। সফরের এক পর্যায়ে তিনি মক্কা নগরীতে উপস্থিত হন এবং হজ্বব্রত পালন করেন। মক্কা থেকে ফিরে তিনি তুরস্কের আনাতোলিয়া কৌনিয়ায় পৌঁছে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করেন।
রুমির জীবনের সবচেয়ে বড় পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে ১২৪৪ সালে, অর্থাৎ তার বয়স যখন ৪০ বছর। এ বছর তিনি কনিয়ায় একজন অতি আশ্চর্যজনক ব্যক্তিত্বের সংস্পর্শে আসেন। তার নাম শামস আল-দীন তাবরিজ বা শামস-ই তাবরিজ। তাদের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব হয়। শামস রুমিকে আধ্যাত্মিকতার বিষয়ে এমন উন্নত ধারণা দেন যা তিনি ইত:পূর্বে কল্পনাও করতে পারেননি।
হঠাৎ করে এক দিন শামস নিরুদ্দেশ হয়ে যান। শামস নিহত হয়েছেন বলে গুজব শোনা গেলেও রুমী নিজে তা বিশ্বাস করতেন না। শামসের নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ার পরই রুমির কলম দিয়ে ঝরনা ধারার মতো কবিতা বেরোতে থাকে।
তারপর মুকসুদ স্যার অথবা ফুফা বললেন চল্লিশ বছরের আগেও মাওলানা রুমির অগাধ জ্ঞান ছিল কিন্তু ঐ জ্ঞান তাঁর আচরণের কোনো পরিবর্তন ঘটাতে পারেনি। তাই আমরা মাওলানা রুমির চল্লিশ বছরের আগের অর্জিত শিক্ষাকে শিক্ষা বলব না এবং আগে যারা তাকে পাঠদান করেছে তারাও তাঁর শিক্ষক ছিল না। মাওলা রুমি শিক্ষা লাভ করেন শামস- ই তাবরিজের কাছ থেকে, তাই তাবরিজই তাঁর শিক্ষক।
এখন বুঝলে শিক্ষা মানে কী?
হুম ( মাথা নাড়লাম, কোনো শব্দ বের হয়নি)।
তিনি আর কোনো ক্লাস নেননি । আমাদের ছুটি হয়ে যায়, বাড়ি চলে আসি। বাড়ি এসে দেখি ইমাম সাহেব বসে আছেন। ইমাম সাহেব আমাকে আরবি পড়ান। চমৎকার কণ্ঠ। তিনি যখন আয়াত তিলওয়াতের সময় গুন্না করেন তখন বাতাসে গুম গুম আওয়াজ শুরু হয়। অযু করে নামাযি কায়দায় ইমাম সাহেবের সামনে আল্লাহর আয়াত নিয়ে বসি। আমার পাঠ আরবি হরফ শিক্ষা। হুজুর প্রথমে বলে দেন, তারপর আমি তাঁর অনুসরণ করি --
আলিফ খালি
বা এর নিচে এক নুক্তা
তা এর উপর দুই নুক্তা
পাঠ আমার মুখস্থ হচ্ছে না। অনেক চেষ্টা করছি। কিন্তু হচ্ছে না। মনোযোগ স্থাপন করতে পারছি না। মনোযোগ পড়ে আছে রাস্তার পাশে দোকানটির টিভিস্কিনে, স্কুল থেকে বাড়ি আসার পথে যেখানে বিরতি নিয়েছিল আমার চোখ। মনোযোগ টিভিস্কিনের নায়িকার প্রতি
যায় পেট খালি
পীঠ খালি
কপালে একটা টিপ
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন