শুক্রবার, ১০ এপ্রিল, ২০১৫

কয়েদি

জেগেই দেখি সকালটা নরম নরম। নরম নরম সকালে গরম পায়ে ক্লাসের দিকে গেলাম।
আটটায় ক্লাস। ঘুম থেকে উঠলাম আটটায়। দুই- তিন মিনিটের মধ্যেই  প্রাথমিক ফ্রেশ হওয়ার কাজটি শেষ । গিয়ে দেখি ক্লাস চলছে। তবে সামনের দরজা খোলা। অনুমতি না নিয়ে ঢুকে পরলাম।
অনুমতি নেয়নি। অনুমতি নেওয়াও একপ্রকার বিরক্তিকর কাজ। তবে টিচার ক্লাসে অনুমতি নিয়ে প্রবেশ করতে পারে, অনুমতি সাপেক্ষে প্রবেশ করলেই বিষয়টি নান্দনিক।
টিচার ক্লাস নেয়ার আগে আমাদের হাজিরা নেন। প্রতি হাজিরার জন্য টিচার  0.17 মার্কস বরাদ্দ রাখেন । আমরা তো মুনির জাত, তাই হাজিরা পেলেই সন্তুষ্ট। হাজিরা কি পরিমাণ দেওয়া হচ্ছে, কেন দেওয়া হচ্ছে, কী উপায়ে দেওয়া হচ্ছে -- এই বিষয়গুলো ভাবনার সময় আমাদের নেই।

ভাগ্যের সুযোগে  একবার কয়েদি হয়েছিলাম। কয়েদ মানে একটি জায়গা যেখানে থাকতে বাধ্য করা হয়; সকাল- সন্ধ্যা হাজিরা ডাকা হয়। তবে সেখানে হাজিরার জন্য কোনো মাইনে দেওয়া হয় না। কয়েদে থাকাকালীন সময়ে একটি উপলব্ধি আমার অনুভূতিতে আসে, আর তা হল প্রচলিত  প্রতিটি প্রতিষ্ঠান এক একটি কয়েদখানা।

টিচার ক্লাস নিচ্ছেন। আলোচ্য বিষয় শাম্ব উপন্যাস। শাম্ব পৌরাণিক একটি চরিত্র। তার  আচরণ ডালিমের দানার মতো আলাদা আলাদা তবে স্পষ্ট। আচরণের সাথে তাল রেখে তার চেহারাও যথেষ্ট কৃষ্ণময়। পৌরাণিক শাম্ব আর সমরেশ বসুর শাম্বের মধ্যকার পার্থক্য দৃশ্যমান। পৌরানিক শাম্ব খুব বেশি কাহিনিআক্রান্ত কিন্তু আলোচ্য শাম্ব দৃশ্যমান জগতের মানুষ। যে মানুষ সংগ্রাম আর বিশ্বাসকে পুঁজি করে মহামানব হয়ে উঠে। সংগ্রামী মানসিকতার বিবেচনায় সান্তিয়াগোর আর শাম্বুর অবস্থান এক সারিতে রাখলেও কাউকে  মহামানব"  অভিধায়  অভিযুক্ত করতে প্রস্তুত নই। শাম্বুর ব্যাপারে মহামানব " অভিধাটি টিচারের নাযিলকৃত শব্দ।
আমার অবশ্যই `মহামানব'  শব্দটির সাথে বিশেষ এলার্জি। তবে এলার্জি যে ডাইজেস্ট প্রক্রিয়ায় জন্য উপকারী তা অনেকে মানতে না চাইলেও আমি বিশ্বাস করি।

মানুষ, মানুষ হয়ে উঠবে!
 মহামানব কেন?

মহামানব'  শব্দটি তারাই তৈরি করে যারা ত্যাগের নয়, ভোগের নীতিতে বিশ্বাসী।

এক সময় ক্লাস শেষ হয়। ক্লাসরুমের বাইরে এসে প্রাণভরে অক্সিজেন নিলাম। অক্সিজেনে জলের গন্ধটা আলগা আলগা লাগছে। বৃষ্টির অভিসারলক্ষণ। রাধার মতোই হয়তো তার প্রশিক্ষণ চলছে। অনেক দিন হয়ে গেছে বৃষ্টি তার প্রেমিকপৃথিবীর কাছে আসে না। প্রেমিকা বিহনে পৃথিবী শুষ্ক, মৃতপ্রায়। ঘুম নেই তার দুটি চোখের পাতায়, মন আজ তার কেবল তারায় তারায়। আনমনে বেশীক্ষণ থাকতে পারেনি মেঘ। বৃষ্টি হয়ে তাকে পৃথিবীতে আসতেই হল। দৃষ্টিকুটুম মেঘ সৃষ্টি করল সৃষ্টিসুন্দর সুরলহরী।
আমি অবশ্যই বৃষ্টিকে রিসিভ করার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলাম না।  তাই বৃষ্টির আগমনে অনেকটা অপ্রস্তুত হতে হলো। অপ্রস্তুত আমাকে দেখে বৃষ্টি কত কী যে ভেবেছে, কে জানে। তবে আকাশের সাথে যেহেতু তার বন্ধুত্ব নারীর মনের মতো সংক্ষিপ্ত ভাবনা তার মনে আসবে না, আসবে না এটাই স্বাভাবিক। টুপ টাপ বৃষ্টির সাথে খেলা করে উষ্ণ মনটাকে শীতল করার বিশেষ ইচ্ছা ছিল। কিন্তু এখনি আবার বিশেষ ক্লাস।

জানালার পাশে বসলাম। জানালা দিয়ে বৃষ্টি দেখার মজাই আলাদা। ক্লাসের জানালা দিয়ে বৃষ্টি ততটা ভালোভাবে দেখা যায় না। দৃষ্টি সীমিত হয়ে আসে। আমার মন তখন ছুটে গেছে গ্রামের দিকে যেখানে জানালা দিয়ে তাকালে দৃষ্টি চলে যায় দূরে, বহুদূরে। গ্রামে খোলা মাঠে বৃষ্টির খেলা হৃদয়ের কথা বলে, যে কথা কান পেতে শুনতে হয় সেই কথা। নদীতে যখন বৃষ্টি পড়ে, আর তা যখন জানালা দিয়ে দেখা হয়, অসমাপ্ত ভালোলাগা তখন হৃদয়ের মর্মে মর্মে,  তখন ত্রিমাত্রিক এক শব্দ তৈরি হয় স্বাধীন, বাঁধনহারা মনের প্রাদেশিক এলাকায়।

আমার মন যে বৃষ্টি বৃষ্টি হয়ে গেছে টিচার বিষয়টি লক্ষ্য করে।

এই ছেলে দাঁড়াও,
জ্বি,
এটি ক্লাস রুম, খেলার মাঠ না, বের হও....
চুপ করে বের হতে লাগলাম। দরজার কাছে যেতেই আবার টিচার বলল,
দাঁড়াও....
দাঁড়ালাম।
প্রতিমার পাশে বস....
প্রতিমার পাশে বসলাম। টিচার ভেবেছেন বালিকার পাশে বসলে হয়তো ....

ক্লাসে মনোযোগী হওয়ার অভিনয় করলাম। কানে আসছে চিত্রা আর মৌলিনাথ প্রসঙ্গ। চিত্রাই পারে  পাখির মতো ঠুকরে- ঠুকরে মৌলিনাথকে উত্যক্ত করে সান্ত্বনা দিতে। হঠাৎ করে মন চিত্রার দিকে চলে আসে। সত্যিকারের মনোযোগী হয়ে গেলাম। টিচার হয়তো ভেবেছেন -- অপারেশন successful। কিন্তু আমি জানি চিত্রার আচরণকথা কেন কানের ভেতর দিয়ে মর্মে প্রবেশ করল।
টিচারের ক্লাসসময় শেষ। বের হবে এখনি।
 আমাকে আবার দাঁড় করালো।

জানো, কেন তোমাকে ক্লাস থেকে বের করেনি?

জ্বি না,

এই বৃষ্টির দিনে আমার মনও ক্লাসে ছিল না ....

টিচারের কথাটি ঝড়ে জলতরঙ্গে আমার সারা অঙ্গ নাচিয়ে তুলল। পথহারানোর ভাবনায় আমিও একটি সত্য উপলব্ধি করলাম, টিচারও আমার মতো কয়েদি! 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন