শুক্রবার, ৩১ অক্টোবর, ২০২৫

জাহাজ জলে চলে চলে

জলের আরেক নাম জীবন আমরা সবাই জানি কিন্তু জীবনকে কেমন করে ব্যবহার করতে হবে তা নিয়ে আমাদের গবেষণা নাই। জল খাবারের ব উৎস— এই নিয়ে সুন্দর গবেষণা হতে পারতো— গবেষণা হলে নদীকে কেন্দ্র  করে দারুণ অর্থনৈতিক এলাকা গড়ে উঠতো বাংলার— গবেষণা হয়নি বিধায় নদীর উপযোগিতা আমাদের কাছে পরিষ্কার না— নদী কেবল মাছের উৎস এমন না— নদী ফসলেরও যোগ্য জায়গা যা নদীর পাড়ের মানুষ জানে না— আমাদের জাহাজ নদীর দুপারের মাঝ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে আপন গতিতে— আমাদের জাহাজ শীতলক্ষ্যার চিকন শরীর দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে— এগিয়ে যাচ্ছে মেঘনা নদীর দিকে— দুপাশে উঁচু উঁচু দালান মিলফ্যাক্টরি— ঢাকার শীতলক্ষ্যার দুপাশ মানে আলোর ঝলকানিতে মুখরিত।


রাতের এখন শিশুকাল— একটু আগে এশার নামাযের আযান কানে আসে দূর মসজিদ থেকে— মুয়াজ্জিন বলতেছেন কল্যানের পথে আসো— حي على الصلاة (Ḥayya ʿalaṣ-ṣalāh)— অথচ শীতলক্ষ্যার যত অকল্যাণ করা যায় যতভাবে ক্ষতি করা যায় সবই আমরা করে ফেলেছি! তাই ক্ষয়ক্ষতির জাবেদা রেওয়ামিল করতে করতে চূড়ান্ত হিসাবের ব্যালেন্স জের মিলানোর সময় এখন জাতির হাতে নাই!


আমরা এখন জাহাজের হাতে, আমাদের জাহাজকে মনে হচ্ছে একটি পরিপূর্ণ দ্বীপ— দ্বীপ এগিয়ে যাচ্ছে দ্বীপ দেখতে দেখতে।  আমাদের জাহাজ শীতলক্ষ্যা হয়ে মেঘনা হয়ে বলাই নদী হয়ে ঘোড়াউত্রা নদী হয়ে ধনু নদী হয়ে ধর্মপাশার জয়শ্রীর পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া সুরমা নদীকে কিছুটা স্পর্শ করে তাহেরপুরের  ডাম্পের বাজারের শরীরপার্শ্ব জলশহরে নোঙর করবে—জাহাজের যাত্রা দক্ষিণপন্থী— দক্ষিণ দিকে কয়েকদিন আমাদের বসবাস। 


দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউনের উপকূল থেকে প্রায় সাত কিলোমিটার দূরে আটলান্টিক মহাসাগরের বুকে এক নিঃসঙ্গ দ্বীপ—রোবেন আইল্যান্ড— আয়তনে মাত্র ছয় বর্গ কিলোমিটারের এই দ্বীপটি শুধু একটি ভৌগোলিক স্থান নয়; এটি বর্ণবাদ, কারাবাস ও মানবাধিকারের জন্য সংগ্রামের এক জীবন্ত স্মারক। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে রোবেন আইল্যান্ডকে ব্যবহার করা হয়েছে বন্দীশালা হিসেবে— দ্বীপটির চারপাশে সুনিপুণভাবে ছড়িয়ে থাকা প্রবল স্রোতের কারণে এটি ছিল প্রায় অব্যর্থ কারাগার। বন্দীরা একবার এখানে পৌঁছালে আর ফিরে আসার পথ ছিল না। এই কারণেই এটি ‘মরণফাঁদ’ নামে পরিচিত হয়ে উঠেছিল। 


এই দ্বীপেই শুরু হয় এক মহান নেতার দীর্ঘ নিঃসঙ্গতার অধ্যায়। ১৯৬৪ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম প্রধান নেতা নেলসন ম্যান্ডেলাকে রোবেন আইল্যান্ডে বন্দী করা হয়। তিনি এখানে কাটিয়েছেন জীবনের ১৮টি বছর—একটি ছোট্ট কক্ষে, যেখানে জানালা দিয়ে দেখা যেত কেবল দেয়াল আর কঠোর পাহারা।


কারাগারের ভিতর ম্যান্ডেলাকে শুধু নিপীড়নই সহ্য করতে হয়নি, তাঁকে কঠোর শারীরিক শ্রমও করতে হতো। প্রতিদিন চুনের খনি থেকে পাথর কাটতে পাঠানো হতো তাঁকে এবং তাঁর সহবন্দীদের। কৃষ্ণাঙ্গ বন্দীদের জন্য খাবার বরাদ্দ ছিল সবচেয়ে কম। যোগাযোগের সুযোগ ছিল সীমিত—চিঠি আসত ছয় মাসে একবার, সেটিও সেন্সরের ছেঁটে দেওয়া কপি।


তবুও, এই বন্দীদশার মধ্যেও ম্যান্ডেলা থেমে থাকেননি। তিনি অন্যান্য বন্দীদের মাঝে শিক্ষা ছড়িয়ে দেন, আলোচনার মাধ্যমে তৈরি করেন রাজনৈতিক চেতনা, নিজের ভেতরে গড়ে তোলেন অটল সহিষ্ণুতা ও ক্ষমাশীলতার এক দীপ্তিমান চরিত্র— A Long Walk to Freedom. 


১৯৮২ সালে তাকে অন্য একটি কারাগারে স্থানান্তর করা হয়—১৯৯০ সালে তিনি মুক্তি পান— ১৯৯৪ সালে তিনি হন দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট— একটি ঐতিহাসিক পালাবদলের নায়ক।


আজ, রোবেন আইল্যান্ড আর কোনো বন্দীশালা নয়— এটি এখন একটি জাদুঘর ও UNESCO বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান। প্রতিবছর হাজার হাজার পর্যটক আসেন এখানে, ম্যান্ডেলার কারাকক্ষটি দেখেন, সাবেক বন্দীদের কাছ থেকে শোনেন ইতিহাসের জবানবন্দি।


এই দ্বীপ আমাদের শেখায় সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ালে কঠিনতম বন্দীত্বও একটি জাতিকে জাগিয়ে তুলতে পারে। নেলসন ম্যান্ডেলা তাঁর জীবন দিয়ে প্রমাণ করে গেছেন, স্বাধীনতা শুধু বাহ্যিক নয়, এটি আত্মিক সাহসের প্রতিফলন।

রোবেন আইল্যান্ড তাই কেবল এক দ্বীপ নয়, এটি একজন মানুষের অমর আত্মত্যাগের স্মারক, একটি জাতির মুক্তিযাত্রার প্রতীক।


দ্বীপজাহাজে পায়চারি করতে করতে রোবেন দ্বীপের কথা মনে আসে— জাহাজে করে এই রোবেন আইল্যান্ডে কবে যাবো ভাবতে ভাবতে রাত দুটো বেজে গেছে এবং আমাদের টাইগার জাহাজ শীতলক্ষ্যা ছেড়ে মেঘনাতে পতিত হয়েছে। আমার হাতে তখন কফির পিয়ালা— কেউ জেগে নেই— জেগে আছে নদী মেঘনা আর আমি, আর আমাদের বন্ধুযান টাইগার জাহাজ। ইতিমধ্যে আমরা অনেকগুলো ব্রিজ অতিক্রম করেছি— কাঞ্চন ব্রিজ থেকে আমাদের যাত্রা শুরু— তারপর ব্রিজ আর ব্রিজ— শীতলক্ষ্যা যেনো ব্রিজের স্বীকৃতি দেয়ার জন্যে জন্ম নিয়েছে। 


ঢাকার শীতলক্ষ্যা, আরও নির্দিষ্ট করে বললে নারায়নগঞ্জের শীতলক্ষ্যা যখন মেঘনাতে এসে নিজের শরীর রাখে ঠিক তখনই মুন্সিগঞ্জের ধলেশ্বরী মেঘনা নামে নিজের পরিচয় জানান দেয়। 


বালুয়াকান্দি— মুন্সীগঞ্জ জেলার গজারিয়া উপজেলার একটি ইউনিয়ন। মেঘনা সেতু পেরিয়ে কিছুদূর গেলে বালুয়াকান্দি ইউনিয়নে প্রবেশ করা যায়। গজারিয়া হচ্ছে মুন্সীগঞ্জ জেলার একটি প্রশাসনিক উপজেলা। মেঘনা ব্রীজের আগে (ঢাকা থেকে গেলে) গাজীপুর ইউনিয়নের (সোনারগাঁ/নরসিংদী) অংশে মেঘনা ঘাট। মেঘনা ঘাট পণ্যবাহী ট্রাক, নৌযান, ফেরি ও ট্রলার চলাচলের এলাকা। মেঘনা ঘাটে অনেক সময় পণ্য লোড-আনলোড, জেলে কার্যক্রম ইত্যাদি চলে। মেঘনা সেতু (মেঘনা ব্রীজ)— এটি ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগের সংযোগকারী গুরুত্বপূর্ণ একটি সেতু। তবে আশুগঞ্জ এবং ভৈরব সেতুকে কিন্তু মেঘনা ব্রিজ বা সেতু হিসাবে ভাবার কোনো কারন নেই— এই সেতুর নাম সৈয়দ নজরুল ইসলাম সেতু যতটুকু আমার ধারনায় আছে। 


শীতলক্ষ্যা নদীর আশেপাশে ব্যাপক পরিমানে শিল্পায়ন হয়েছে— মেঘনা কিছুটা রেহাই পেয়েছে কিন্তু কতদিন পাবে আমরা জানি না। শীতলক্ষ্যা নদীর মাথার উপরে আমার কাছে ফিল হলো ব্যাপকভাবে ব্রিজের উঠানামা হয়েছে। রাতের যাত্রাদৃশ্যে শীতলক্ষ্যা একেবারে পার্লারে সজ্জিত কোনো এক হোটেল বালিকা— কোথাও গ্রামীণ বা প্রাকৃতিক অন্ধকারে স্পর্শ বলার মতো করে দেখতে পাইনি— যা পেয়েছি তাতে কেবল কষ্ট বাড়ে। কাঞ্চন ব্রিজে এখনো দূষণথাবা ততটা তীব্র হয়নি— কাঞ্চন ব্রিজ থেকে কাচপুর ব্রিজে যাওয়ার পথটায়  দেখেছি নদীর কান্না— কাচপুর ব্রিজে এসে দেখেছি নদী ও বাতাসের কান্না— শিল্পায়নের নামে দৈত্যায়ানের ভয়াল ভয়ঙ্কর অবয়ব! তখন আরও স্পষ্ট হয়ে স্পর্শ করে নেলসন ম্যান্ডেলার সংগ্রাম ইতিহাস— নেলসন ম্যান্ডেলা বন্দী ছিলেন রোবেন দ্বীপে আর আমরা বন্দী আছি দূষণদ্বীপে— সবপাশে দূষণ আর দূষণ, ভেজাল আর ভেজাল— খাবারে ভেজাল, খবরে ভেজাল, কলমে ভেজাল, চলনে ভেজাল— ভেজাল আর ভেজাল! পদ্মা যেমন করে সবকিছু ভেঙে নিয়ে যায় শীতলক্ষ্যা তেমন করে ভাঙে না তার পাড়— তাই শীতলক্ষ্যার উদারতার সুযোগ নিয়েছে উদার নিষ্ঠাবান নিষ্ঠুর মানুষ! 


আপনি বলতে পারেন মিল ফ্যাক্টরি না হলে আমরা খাবো কী?  ভাইরে ভাই, আপনি চোখখুলে মনের তালা ওপেন করে দেখুন, মিল ফ্যাক্টরি আমাদের খাবার কেড়ে নিয়েছে— তারা আমাদের দিয়েছে এক, নিয়েছে অনেক। আজকে বাংলাদেশের মা— নদী: হুমকির মুখে। বাংলাদেশের প্রধান শক্তি— কৃষি: হুমকির মুখে! তারপরও মিলফ্যাক্টরি করার কুড়কুড়ি থাকলে আপনি করেন— সামগ্রিক নিয়ম মেনে করেন। নিয়ম তো মানবেন না— নিয়ম না মেনে মান্যবরদেরকে টেবিলের নিচ দিয়ে কতিপয় সুবিধাজনক তরল দিয়ে দিবেন আর কি!  আর কি লাগে!! চলছে নিয়ম সিসিমপুরে!! অথচ আমাদের পাঠ্যবইয়ের সাদা সাদা পাতায় কালো কালো অক্ষরে লেখা ছিলো— Every citizen owes allegiance to  the state to which he belongs. This implies the duty of defending the state in case of war and service and loyalty to the state to maintain its integrity. Its the duty of every citizen to defend the state against all enemies and danger and to assist in the maintenance of peace and order. The state can call upon any citizen to take up arms in its defence. 


অথচ আমরা যারা মহান নাগরিক আছি বা আছে— আমরাই  হয়ে উঠেছি দেশের ভেতরে সুবিধাময় দেশ যা সামষ্টিক জনগণকে অসুবিধায় ফেলছে। নট বাই চয়েজ বাট বাই চান্স নীতিতে কোনো পতাকা পেলে এমনটা হওয়া স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়ায়!


ঘুম থেকে উঠে দেখি আমাদের জাহাজ আশুগঞ্জে— একপাশে নরসিংদীর তুলাতুলি গ্রাম আরেকপাশে বা পূর্ব পাশে অলসচর। অলসচর পানসে নদী ও মেঘনা নদীর মাঝখানের একটি চর। এই অলসচর দারুণ উর্বর এবং সম্ভাবনাময় এবং এটি চট্রগ্রাম বিভাগের সর্বশেষ চর অথচ একে উপযোগী করে তুলার মতো সুন্দর দক্ষ মানসিকতা আজও দেখতে পাওয়া যায়নি— বন্যা না হলে বর্ষার জলে এই চর ডুবে যায় না।১৯৯৫ সাল থেকে দুই হাজার দশ সাল পর্যন্ত দেখতাম এই অলসচরে দারুণ তরমুজ এবং আলু চাষ হতো— দারুণ মানে আসলেই দারুণ! আর এখন শিয়ালের আবাসভূমি— রাতে ওঠে থেকে থেকে শেয়ালের হাঁক! এই চরে বেলেমাটির প্রভাব বেশি— তবে এটেল মাটির দেখাও মিলে। যেহেতু এটেল মাটির প্রভাব কম তাই মিশ্র মাটির চর হিসাবে তাকে ধরা যায় না। অলসচরে এখন একেবারে চাষটাস হয় না এমন না, হিরা চাষ করে, কুমড়া চাষ করে, ডালের চাষ হয় কিন্তু খুবই অল্প পরিমানে— মানে গল্প করার মতো না।  মালদ্বীপের মাফুশি দ্বীপের প্রায় তিনগুণ আশুগঞ্জের এই অলসচরের শরীর এলাকা। ছোটো ছোটো কটেজ করে, বাগান করে, খেলার মাঠ করে, আরও সুন্দর নানন্দিকতার ছাপময় পরিবেশের আয়োজন করে এই অসলচর থেকে বছরে এক হাজার কোটি টাকা খুব সহজেই সম্ভব আয় করা— নতুন কিছু করার মানসিকতা আমাদের নেই— আমাদের আছে পুরাতন মানসিকতা— হামলা মামলা, কামলা হামলা! 


অলসচরের পাশেই আশুগঞ্জ ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেডের বিশাল কোলোনি, অলসচর যখন পার হচ্ছি তখন পশ্চিম দিকে চোখ পড়াতে দেখতে থাকি কোহিনূর জোট মিল— বিশাল এলাকা নিয়ে গড়ে উঠেছিল এই পাটকল— এখন এখানে আগাছাপরগাছার ঘরবসতি— বাংলাদেশের পাটকল শিল্পকে দিনের পর দিন তিলে তিলে হত্যা করা হয়েছে, বলতে পারেন, আগের মতো তো বর্ষা হয় না, পাট চাষ করে কৃষক করবে কি? পাট থেকে তার আশকে আলাদা করার জন্যে তো পানির প্রয়োজন। কথা সত্য। আরেকটি সত্য কথা কি জানেন, মানুষ তার প্রয়োজনে আবিষ্কার করতে শিখেছে, সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে নতুন নতুন আবিষ্কার করে মানুষ হয়েছে স্বনির্ভর— আগে মানুষ দই খেতো, এখনো খায়, আগে মাটির পাত্রে দই পাততো, এখন অনেক ভার্সন আবিষ্কার হয়েছে দুধ থেকে দই পাওয়ার জন্যে কিন্তু পাটের চাষের সময়নিষ্ঠ সময়নির্ভর ফর্ম এখনো আবিষ্কার হয় নাই! হয়েছে বটে, তবে আমাদের তটে তার সাক্ষাৎ নাই— তাই পাটকল মারা যায়— অর্জন বর্জ্যে যায়!


আর আশুগঞ্জ ফার্টিলাইজার লিমিটেড কোম্পানির কথা কি বলবো— বারো মাসের মধ্যে নয় মাসই সার উৎপাদন বন্ধ থাকে— যন্ত্রপাতি পুরাতন হতে হতে ক্ষয় হয়ে ক্ষয়সাগর হয়ে যাওয়ার অবস্থা— বাজেট আসে বাজেট খায় কিন্তু আশুগঞ্জ ফার্টিলাইজার কোম্পানির মুমূর্ষু অবস্থার কোনো পরিবর্তন নজরে আসে না। 


নাস্তার ডাক আসে— প্রথম দিনের প্রথম নাস্তা। নাস্তা করছি আর দেখছি আশুগঞ্জ চর সোনারামপুর— এটি একটি দ্বীপগ্রাম— এখানে মাজারও আছে মসজিদও আছে, আছে মন্দির, মুসলমান পরিবারের সংখ্যা কম, আর্থিকভাবে স্বচ্ছল পরিবারের সংখ্যাও কম— এখানে প্রকৃতির অবস্থান অধিক। একপাশে আশুগঞ্জ নদী বন্দর, আরেকপাশে ভৈরব বাজার। এই দ্বীপের অধিকাংশ মানুষ জেলে ছিলেন— এখন তো নদীতে আর তেমন মাছ নাই— তাই তারা বেছে নিয়েছে বিকল্প। আমাদের নাস্তা তে একটা দারুণ মাছ দিয়েছে আয়োজকরা— লইট্টা মাছ— লইট্টা মাছ (ইংরেজি: Bombay Duck, বৈজ্ঞানিক নাম: Harpadon nehereus) মাছ মূলত সামুদ্রিক মাছ— মেঘনা নদীতে ভাসমান জাহাজে বসে বসে এই মাছ খেতে খেতে ভাবছি এই মাছটা কি জানে বা জানতো আমার খাবারের থালায় পরিবেশিত হবার জন্যে তার মৃত্যু হয়েছে!? তবে মাছ খেতে খেতে এই কথা বুঝি অনায়াসে— মাছের চোখে যে কথা লেখা আছে সেই কথা অনুধাবনে আসে আমার— মাছ বেচে চলে জলের ভেতরে আর আমি ভেসে চলি জলের উপরে— উপর আর নিচের যে পার্থক্য, এপার আর ওপারের যে বিস্তর ফারাক সেখানে কোনো প্রকার অনুধাবন নেই, নেই কোনো উপলব্ধির আস্তানা।

 

জাহাজে আমরা একাত্তর জন পর্যটক যে আস্তানা গড়েছি তাতে আমাদেরকে বেদে মনে হচ্ছে না— মনে হচ্ছে খুবই উপরের স্থরের মানুষ আমরা— ভেসে চলছি নদী বেয়ে বেয়ে— আমাদের শরীর যাপনের সামগ্রিক আয়োজন প্রস্তুত এখানে।  বর্ষার চাঁদও প্রস্তুত আমাদেরকে দেখা দেয়ার জন্যে— আমরা যেখানে আছি সেটাকে জাহাজ না বলে ডুপ্লেক্স বাড়ি বললে ভালো হবে— শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ডুপ্লেক্স বাড়ি নদীর উপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে আপন মনের আনন্দে— বাড়ির ছাদটি অনুপম অসাধারণ যেখান থেকে ক্ষনে ক্ষনে বদলে যায় পারিপার্শ্বিক আকাশ— আকাশের রঙিলা মুখছবি। 


দুপুর হওয়ার আগেই আমরা পৌঁছে যায় ইটনা মিঠামইনের সেই আলোচিত রাস্তায়। কেউ কেউ চলে যায় শুক্রবারের সেই পবিত্র আহবানে— আমার মতো অপবিত্র মানুষ চলে যায় রাস্তার জনপদে যেখানে বসেছে সামাজিক সাংস্কৃতিক অর্থনৈতিক মেলা— কেবল রাস্তা দেখার জন্যে পৃথিবীতে এমন লোকের সমাগম হয় কিনা আমার জানা নাই— রাস্তাকে ছোট করে দেখার কোনো সুযোগও নাই— বাংলাদেশের মানুষ রাস্তাকে সড়গ বলে যা স্বর্গ শব্দের রূপান্তরিত উচ্চারণ— শব্দ থেকে বুঝতে পারি রাস্তার একপ্রকার সাংস্কৃতিক অর্থনৈতিক গুরুত্ব এই অঞ্চলের মানুষের কাছে খুব ভালো করেই আছে— মহান জাপানের জাইকার মহার্ঘ্য অবদানে আমরা আরও ভালোভাবে বুঝতে পারছি— হয়তো অদূর ভবিষ্যতে আমরা আরও উত্তম উপায়ে বুঝতে পারবো জলযোগের সাথে বিমাতৃসুলভ আচরণের কারনে জীবনের মান সচলায়তনের দেয়াল পার হয়ে অচলায়তনে বাঁধা পড়ে গ্যাছে কিনা!


এই রাস্তাতেই আমাদের কেটে গ্যাছে চারপাচ ঘন্টা— তারপর জাহাজ আসে— জাহাজ আসে নাই— আমরা ইঞ্জিন নৌকা করে জাহাজের কাছে যাই— যেতে যেতে দেখি বর্ষালি ঈর্ষালু ধান— ধানের ফাকে ফাকে শাপলা শালুকের স্টল— যেখানে পানকৌড়ি বকেরা আড্ডা দিতে আসে শিকার নীতিচার ভুলে— আমিও ভুলে যাওয়া শৈশবের পকেট থেকে শাপলা-শালুকস্মৃতি টান মেরে বের করি আনি রোমন্থন জিকিরের হাতিরে— হঠাৎ চোখ পরে মোস্তফা স্যারের দিকে— দেখি উদাসিন চোখে পানকৌড়ি বকের দিকে দৃষ্টি আরোপিত করে কি যেনো ভাবছেন তিনি— সারাদিনের ক্লান্ত চোখেও নেমে এসেছে স্মৃতিস্মরণ শান্তি প্রশান্তি— মানুষকে ভেতর থেকে শান্ত করার ক্ষমতা প্রকৃতির মেজাজে থাকে— কিন্তু হায়— মানুষের মেজাজ আজ প্রকৃতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে যা মানুষের জন্যেই ক্ষতি বয়ে আনছে— আনবে!


আজকে আমরা আছি গজারিয়ায়। মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ার কথা বলছি না— বলছি সুনামগঞ্জের গজারিয়ার কথা। যেখানে আমাদের জাহাজ আছে সেখান থেকে আকাশভরা এই চাদকে বিশাল বড় দেখাচ্ছে— মনে হচ্ছে রাতকে এখুনি বুঝি দিন বানিয়ে ফেলবে সে।  খুব ভোরে জাহাজ যাত্রা করবে হাওরের উদ্দেশ্যে। কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দিলেন আমরা যেনো ভোরে সকাল থেকে ঘুম থেকে উঠি এবং মূল হাওড়ে যাওয়ার পথে ছোটো ছোটো দ্বীপগ্রামগুলো দেখে নিতে পারি। যারা সড়কপথে টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমণ করে তারা হাওরপথের এমন সৌন্দর্য উপলব্ধি করতে পারে না। 


যেখানে আমাদের জাহাজ নোঙর করেছে সেখান থেকে নদীর দুপাশ তালগাছের মতো দুপায়ে স্পষ্ট হয়ে দাড়িয়ে আছে— খুব দূরে না— খুবই কাছে। নদীর একপাড়ের পরপারে জমি আর জমি এবং জমিতে ছোপ ছোপ পানি— পানিতে নবীন শাপলা শালুক। জোছনার আলো শালুকময়— জোছনার আলো শাপলাময় হয়ে বিস্তার হয়ে আছে কোমলতার নরম পাতায় পাতায়। নদীর অন্যপাড়ের হালকাদূর পর থেকেই গ্রামের শুরু— গাছের অলঙ্কারে গ্রামখানি সেজে বসে আছে জোছনার কুলে। বিভিন্ন পোকামাকড়ের চলাচলি বিভিন্ন জলজ প্রানের ডাকাডাকি প্রকৃতির আহবানকে আরও প্রানবন্ত করে তুলছে— এমন সময় চোখে ঘুম নামতে চায় না— শরীর যেতে চাই না রুমের গহীন কোণে। জাহাজে পায়চারি করে, ছাদে হাটাহাটি করে রাতটাকে সকাল করে দেয়া যেতো কিন্তু গেলো না। সকালে হাওরযাত্রা দেখার প্রয়াসে বিছানায় যেতে হলো। বিছানার পাশেই জানালা। জানালা দিয়ে জোছনা আসছে রুমের ভেতর আমার চোখের বেডরুমে— ঘুমাবো কেমন করে? জলের মিউজিক কানে আসছে— ঘুমাবো কি করে? ঘুমাতে তো হবে। প্রেমিকা জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে যাওয়ার দারুণ অভ্যাস আমার নাই। কিন্তু আজকে এমন তুলতুলে  চাদের জোছনাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাতে সক্ষম হলাম। কখন যে ঘুমিয়ে গেলাম!


ঘুম থেকে উঠে দেখি বিশাল এক ভোর— ভোর পিলপিল পায়ে সকালের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে— জাহাজ এগিয়ে যাচ্ছে টাঙ্গুয়ার হাওরের দিকে— সবাই জেগে গেছেন— ভোরের হাওরযাত্রা দেখার জন্যে— আমিই সবার পরে ভোরসঙ্গ হাওরঅঙ্গ বিহারি। যেদিক দিয়ে বয়ে যাচ্ছে আমাদের জাহাজ সেইদিকে ছুটে আসছে মানুষ— জাহাজ দেখার জন্যে— মোবাইল হাতে নিয়ে ভিডিও করছে— তাতে অনুধাবন হলো এমন দৃশ্য দ্বীপবাসীর জন্যে খুব স্বাভাবিক ঘটনা না। জাহাজ সামনের দিকে যাচ্ছে আর ছোট ছোট দ্বীপাঞ্চল পেছনে যাচ্ছে — বনগুলা দেখে ভালো লাগলো— জয়শ্রী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় দেখে ভালো লাগলো— এই স্কুলের ছাদ থেকে আমার এক কবি ভাই আমাকে ভিডিও কল দিয়েছিলেন— আজ স্বচক্ষে দেখছি এই স্কুল— জাদুকাটা নদী দিয়ে বয়ে যাচ্ছে আমাদের জাহাজ। অনেকগুলো দ্বীপমানুষ  এক জায়গা বাজার করতে যায়— সেটাও একটা দ্বীপ— নৌকাই একমাত্র বাহন— এখানে সবাই নৌকা চালাতে পারে— প্রয়োজন তাদেরকে এই জলযানটি চালানোতে দক্ষ করেছে। 


এদের স্কুলে যেতে হয় নৌকা করে। মাছ ধরতে হয় নৌকা করে। বাজারে যেতে হয় নৌকা করে। কবরে যেতে হয় নৌকা করে। দেখলাম কবরটাও প্রায় জলের নিচে ডুবে আছে।  এই দ্বীপগ্রামে নব্বই ভাগ জল আর একভাগ স্থল।  তারপরও তাদের জীবন যাচ্ছে বয়ে জীবনের প্রয়োজনে।  তাদের জীবনকে আরও সহজলভ্য করে তুলার জন্যে রাষ্ট্র নামক মহান যন্ত্রের চেষ্টালন ঘুমরোগে আক্রান্ত। রাষ্ট্র চেষ্টা করে না এমন না— চেষ্টা করে কিন্তু রাষ্ট্রের চেষ্টা তাদের জীবন পর্যন্ত পৌছায় না— রাষ্ট্র মহোদয়ের সমগ্র চেষ্টা মোবারক জল খেয়ে ফেলে।


টাঙ্গুয়ার বউলাই নদীতে দেখা গাঢ় খয়েরি মাথার শ্বেতশুভ্র পাখিটি এ দেশের সচরাচর দৃশ্যমান পরিযায়ী পাখি গঙ্গাকৈতর। গঙ্গা কবুতর নামেও পরিচিত। পশ্চিমবঙ্গে বলে কালাশির গাংচিল। ইংরেজি নাম ব্ল্যাক-হেডেড গাল। ল্যারিডি গোত্রের পাখিটির বৈজ্ঞানিক নাম Larus ridibundus। লন্ডনসহ ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা ও মধ্য এশিয়ার আবাসিক পাখিটি শীতে বাংলাদেশসহ এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে পরিযায়ী হয়। এই কবুতরটি দেখে মন কেমন যেনো উতলা শান্ত হয়ে উঠলো— শীতকালে রোদ ভেদ করে কুয়াশা দেখলে আমার যেমন লাগে— মন আর মন থাকে না— মন যেনো দ্বারাবতী চলমান জল। ডাম্পের বাজার যাওয়ার পথে এই সুন্দরতম কৈতরটি দেখতে পাই— সারা শরীরে ঘন শুভ্র আভা— ঠোঁটে সূর্যলাল রঙের বাহার— পায়েও লাল রঙের যৌথ বাহিনি। তার উড়ালপথ না সোজা না বক্র— বাতাস তার কথা শুনে যেনো। 


আমরা কর্তৃপক্ষের কথা শুনে ছোট নৌকায় উঠার জন্যে রেডি — যারা গোসল করবে তারা এক নৌকায়, আর যারা গোসল করবে না তারা আরেক নৌকায়। আমরা উঠি গোসল না করা নৌকায়— নৌকা যাচ্ছে ওয়াচ টাওয়ারের দিকে যেখান থেকে টাঙুয়ার হাওর বড় চোখে দেখা যায়।  ওয়াচ টাওয়ারের কাছে গিয়ে দেখি হিজল আর কড়চ গাছের আশ্রম— তাদের আশ্রয়ে মানুষের বাজার— নৌকা সেই বাজারের একমাত্র বন্ধু। প্রতিটি নৌকায় গানের আসর— স্থানীয় শিশুশিল্পীরা দেশে প্রচলিত জনপ্রিয় গান করছে মনের আনন্দে— কন্ঠে রেওয়াজের প্রভাব ব্যাপক পরিসরে না থাকলেও, আছে পর্যাপ্ত ভাবাবেগ— ফলে তাদের গান হৃদয়ের কোথায় যেনো একটা সুকুমার আকর্ষন নির্মাণ করে— খুশি হয়ে অনেকে টাকা দেয়— এটাই তাদের আয়ের একমাত্র উৎস।


তখন গরম ছিলো প্রচন্ড কিন্তু হিজলের ছায়াশরীর  গরম যেনো শোষণ করে নিয়েছে পুরোদমে— বলতে পারি এই গাছগুলো সমগ্র গরম পান করেছে শিবের বিষ পানের মতো। তাড়াহুড়ো তো থাকেই। তাড়াহুড়ো করে নৌকা আমাদেরকে নিয়ে গেলো গোসলের জায়গায়। শীতল জলের আহবানে মোস্তফা স্যার আর নৌকায় বসে থাকতে পারেননি, বসে থাকতে পারেননি ডক্টর আনোয়ার এবং তিনার স্ত্রী। আমিও নেমে পড়ি হিজল কড়চ ছায়াশরীরের আশ্রয়ে লালিত এবং পালিত জলে। এই জলের একটা মারাত্মক জাদুকরী শক্তি আছে। আমি সেইদিন টের পেলাম। প্রত্যেক  ইয়াং ওল্ডম্যান এন্ড উইমেন জলের ডাকে শিশুর অধিক শিশু হয়ে যান— তাদের মধ্যে আমিই একটু মুরুব্বি মুরুব্বি ভাব ধরে থাকি— যদিও আমার ভাব বেশিক্ষণ টিকে না— কি আর বলবো!  খুবই আনন্দঘন জলমগ্ন জলমিশ্রিত জলমুহূর্ত!! 


জলপাই জলপর্ব শেষ হওয়ার পর আমরা ভেজা কাপড়ে আবার যাত্রা করি জাহাজের দিকে— জাহাজে গিয়ে স্নান করি ভদ্র জলে— তারপর দুপুরের খাবার। আহা সে কি মজার খাবার— প্রকৃতির সাথে শরীরের সম্পর্ক হওয়াতে খাবারের সাথে জিহবার সম্পর্ক হলো খুবই স্বাদের। খাবার খাচ্ছি আর জাহাজ চলছে। জাহাজ চলছে ডাম্পের বাজারের দিকে— খেতে খেতে দেখছি বিশাল বিশাল পাহাড়। এই পাহাড় থেকে নেমে আসছে রাশি রাশি সবুজ। এই পাহাড় থেকে নেমে আসছে বড় বড় সীমানা আর কাটাতারের কথা যেখানে বড় হয়ে উঠে প্রশ্ন— মানুষ বড়— না, বড় মানুষের বানানো নীতি!?


কে যেনো বলেছিল— অজ্ঞান আর ব্রহ্মের মাঝখানে একটি শক্তিশালী দেয়াল আছে— যোগ-অভ্যাসের মাধ্যমে সেই দেয়াল পাতলা হতে থাকে— ওপারের নানা শব্দ, গন্ধ, দৃশ্য, অনুভব হতে থাকে। যিনি যত উচ্চস্তরের যোগী তিনার দেয়াল তত পাতলা। একসময় সেই দেয়াল স্ফুটিকের মতো স্বচ্ছ হয়ে যায়— পরিপূর্ণ প্রতিফলন হয়! একদম শেষে আর দেয়াল থাকে না— একেবারে মিশে যায়!  We 'all' have this same purpose— nothing else!!  


আরেকজন এসে বলবেন— কোনো দেয়াল নেই। এটা একটা ভাবনা মাত্র। আসলে সামনের দিকে দেখি আলো আর পিছনে অর্থাৎ ভিতরে দেখি অন্ধকার। বাহ্যিক চোখে বাইরের দর্শন সেখানে চোখ অনেকটা pinhole ক্যামেরার মতো কাজ করে— এর ফলে চেতন আর অবচেতন মনে ভিড় করে ভাবনা। ভিতরে অন্ধকার তাই হঠাৎ দেখলে কিছু দেখা যায় না। অন্ধকারে যখন দৃষ্টি স্থির হয় তখন অন্ধকারেও অনেক কিছু দৃশ্যমান হয়।  ত্রিনয়ন হলো ভেতরে দেখার চোখ। এর জন্য পথ হলো ধ্যান। কেন ধ্যান?  ধ্যান কথাটির মধ্যে এর উত্তর লুকিয়ে আছে। অভিভাবক এবং শিক্ষক বলতো ধ্যান দাও। মানে ফোকাস করো।  দেহ দিয়ে কি ফোকাস করা যায়? যায় না, যুগ যুগ ধরে সাধকেরা ভুল পথে এগিয়েছে অথবা স্থির থেকেছে। আসল হলো মন এবং তার সংযোগ বা মনোযোগ।  অর্থাৎ মনকে বাধতে পারলে এক জন্মে সব পাওয়া যায়। 

মনের মাঝে রক্ষা কবচ 

মনটারে তুই জাদু কর 


খুব ভালো কথা। খুবই ভালো কথা— মন নিয়ন্ত্রণ করে এক জীবনে সব পেয়ে যাবো— তাহলে প্রশ্নটা থেকে যায়— পাবো কি একটা পাসপোর্ট ভিসামুক্ত পৃথিবী যেখানে থাকবে না কোনো বর্ডার নীতি— বার্ডের মতো উড়ে বেড়ানো যাবে কি  লোকান্তরে দেশ হতে দেশ দেশান্তরে! 


তিনার জন্মস্থান রংপুর। পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানিতে। তারপর চলে যান জাপান মাইক্রোবায়োলজি নিয়ে গবেষণার কাজে। তারপর দেশে এসে ১৯৮০ সালে আনবিক শক্তি কমিশনে বৈজ্ঞানিক হিসাবে দশবছর সার্ভ করেন। তারপর চাকরি ছেড়ে চলে যান নিউইয়র্ক— সেখানে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন গবেষণার সাথে যুক্ত ছিলেন। ২০১০ সালে তিনি এবং তিনার নায়ক চাকরির জগৎ থেকে নিজেদেরকে পরিত্রাণ দিয়ে বিশ্বভ্রমণকালীন সময়ে আছেন— দেশবিদেশ ঘুরে বেড়ান। 


তিনার নাম ডক্টর আনোয়ারা বেগম এবং তিনার নায়কের নাম ডক্টর সালাউদ্দিন। আমার এবং মোস্তফা স্যারের আড্ডাসঙ্গী তিনারা দুজন— আমার অধিক কথাবলাবাহিত সময় ডক্টর সালাউদ্দিন  সাহেবের সাথে— তিনিও আমার সাথে বেশ আরাম করে কথা বলেছেন— তিনার নায়িকা খুবই মিশুক আত্মা— জাপানিদের সংস্কৃতি তিনার কাছে খুব ভালো লাগে। তিনি খুবই অল্প সময়ে সবার সাথে কথা বলে বলে আমাদের জাহাজকে কথাবলা গ্রামে পরিনত করেন। সালাউদ্দিন সাহেব আবার সবার সাথে কথা বলেন না হৃদয় খুলে— তিনার হৃদয়কে রুচিবোধের চাবি দিয়ে খুলতে হয়, তারপর তিনি কথা বলেন। ডক্টর আনোয়ারা সবার সাথে কথা বলেন প্রান দিয়ে— প্রানের সাপোর্টার হিসাবে থাকে ব্রেইন আর তিনার নায়ক কথা বলেন ব্রেইন দিয়ে— ব্রেইনের সাপোর্টার হিসাবে থাকে প্রান।  একটা দৃশ্য কিন্তু চোখে লেগে আছে— বাচ্চাদের মতো তিনি নৌকা থেকে নেমে যান হাওরজলে উদাম গতরে— আমরা কেউ কিন্তু উদাম গতরে জলে নামতে পারিনি— তিনি পারলেন— তাতেই তার চোখেমুখে কাচ্চাবাচ্চা আনন্দ স্পষ্ট হয়ে উঠে— কে যেনো বলেছিল— ইচ্ছে করলে শিশুর বাবা হওয়া যায় কিন্তু শিশু হওয়া যায় না!


মোস্তফা স্যার আর ডক্টর আনোয়ারা যখন কথা বলছে, আমার তখন মনে হয়েছে কলেজের ক্লাস শেষে নীরব রুমে বসে বসে গল্পকরা দুটি সজীব প্রান যারা জীবন উপভোগে ব্যস্ত— অভিযোগে না! ডক্টর আনোয়ারা কিন্তু তার স্বামীকে বন্ধু হিসাবে যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত এবং মানবিক চোখে দেখে— দুজনের বোঝাপড়া খুবই সুন্দর এবং গোছানো— তাছাড়া রংপুরের মেয়েরা ভালোবাসা কিংবা ঘৃণা দুটোই মন থেকে করে— অভিনয় কিংবা নাটক থেকে নয়। এর পেছনে সামাজিক কারণ যেমন আছে তেমনি সার্বিকভাবে বৈজ্ঞানিকভাবে পরীক্ষিত পদ্ধতি আচার্যের অবদানের কথাও আমরা অস্বীকার করতে পারিনি এবং পারবো না— বিজ্ঞানের পাঠে আমরা শিখেছি— বেশি ঘনত্ব থেকে পদার্থ নিজে থেকেই ছড়িয়ে পড়ে কম ঘনত্বের দিকে। রান্নাগন্ধ তাই দরজা পেরিয়ে চলে যায় উঠোনে, একফোঁটা ফুলের সুবাস ছড়িয়ে পড়ে পুরো বিকেলে— কিন্তু এই নিয়ম শুধু পদার্থের নয়— মানুষের হৃদয়েরও। ভালোবাসা কখনো সমান সমান থাকে না, তা প্রবাহিত হয় এক অসমান ঢালে— যেখানে একপাশে শক্তি, অন্যপাশে প্রয়োজন। একটি শিশুর দিকে আমাদের মমতা, একটি আহত প্রাণীর দিকে স্নেহ, অসহায় বৃদ্ধের প্রতি নিঃশব্দ সহানুভূতি— সবই সেই অদৃশ্য ঢাল বেয়ে নামা প্রবাহের ফল। আমরা যাদের দিকে ঝুঁকে যাই, তারা আসলে কম নয়, বরং এমন এক ফাঁকা স্থান— যেখানে আমাদের সত্তা গিয়ে পূর্ণতা পায়। ভালোবাসা, তাই, শেষ পর্যন্ত একটি ব্যাপন— ঘন আত্মা থেকে হালকা আত্মার দিকে নিঃশব্দে ছড়িয়ে পড়া এক অনন্ত গন্ধ। তারপরও প্রেমের জয় ✌ হোক এই প্রার্থনা থেকে আমাদের ভোরকে মুক্ত রাখতে পারিনা— যদিও একটি ভোর একটি অন্ধকারের অনিবার্য পরিনতি।


আজকের দিনটি শনিবার— যাত্রার পরিনতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সময়। ছোটো নৌকা করে আমরা তাহেরপুর রাস্তায় উঠি— চান্দের গাড়ি করে আমরা যাবো নীলাদ্রি লেক, জাদুকাটা নদী, লাকমাছড়া এবং শিমুলবাগান।


যাদুকাটা নদীর ধারে মেঘালয়ের পাহাড় ছায়া ফেলে— সেখানেই মানিগাঁওয়ের বুকে দাঁড়িয়ে আছে এক লাল স্বপ্ন— শিমুল বাগান: শিমুল বাগানের দেহগত সৌন্দর্য প্রকট হয়ে উঠে ফাল্গুন ও চৈত্র মাসে। যাদুকাটা নদীতে আসলেই যাদু আছে। এই যাদুর প্রধান উপাদান মেঘালয়ের পাহাড়। সূর্যের ☀ আর পাহাড়ের সবুজ গাছের রঙে জাদুকাটা নদী রঙিন— ফলে যাদুকাটা নদী বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কালার ধারন করে। 


সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার মানিগাঁও গ্রামে প্রায় ১০০ বিঘা জমি জুড়ে গড়ে উঠেছে অসাধারণ এই শিমুল বাগান, যা প্রকৃতির প্রেমিক ও পর্যটকদের জন্য এক আরাধ্যভূমি। এক পাশে ভারত, মাঝে নীল-সবুজের খেলা যাদুকাটা নদী, আর এপারে রক্তিম ফুলে ঢাকা শিমুল বন— এক কাব্যের ভেতরে আরেক মহাকর্ষ আন্দোলিত ম্যাজিক রিয়েলিজম। 


২০০২ সালে বাদাঘাট ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও দূরদর্শী স্বপ্নদ্রষ্টা জয়নাল আবেদিন নিজ উদ্যোগে প্রায় ৩ হাজার শিমুল গাছ রোপণ করেছিলেন নিজের ২,৪০০ শতক জমিতে। তার এই শৌখিন উদ্যোগই এখন হয়ে উঠেছে সিলেট অঞ্চলের এক অনন্য প্রাকৃতিক নিদর্শন— শিমুল বাগানের জগৎ। 


আজ সেই বাগানে শিমুলের পাশাপাশি লেবু বাগানও ফুটে উঠেছে, আর পাখির কলতানে মুখরিত এই পরিবেশ যেন জীবনের প্রশান্তি খুঁজে পাওয়ার এক ঠিকানা— মানুষ আসে, মানুষ যায় কিন্তু শিমুল বাগান তার বন্ধু জাদুকাটা নদীকে নিয়ে বিকশিত হতে থাকে আপন মনের নিপুণ আনন্দে। 


আমার শরীরে লাল টিশার্ট— জানি যেহেতু এখন শিমুল ফুল নেই গাছে গাছে— তাই শরীরগাছে লাল রঙের পোশাকি বাহার— শিমুল ফুলের ❀ বাহিনির কাছে নিজের চোখের সাক্ষাৎ ঘটাতে  পারলে ভালো লাগতো— কিছু ভালো লাগা তুলে রাখতে হয় অনাগত সময়ের জন্যে।


জাদুকাটা নদী চলে গ্যাছে রক্তি নদীর কাছে, ব্রিজ পার হয়ে রক্তি নদী ডাম্পের বাজারের কাছে হয়ে উঠেছে বোলাই নদী— এই বোলাই নদীতে আমাদের জাহাজ। শিমুলবাগানের কাছে যে জাদুকাটা নদী সেখানে পাথরের আবাসভূমি কিন্তু পাথরতুলা নিষিদ্ধ। 


লাকমাছড়া ইন্ডিয়ার পাহাড় থেকে নেমে আসা জলের ধারা— পাহাড় থেকে যে জল নেমে আসে তা সাধারণত শীতলই হয়— তাই শীতল জলের ঝর্না বলে আজাইরা মার্কেটিং করার কিচ্ছু নাই। রাস্তাঘাটের অবস্থা খুবই বাজে— আগে জানলে— আগে জানলে তোর ভাঙা রাস্তায় চান্দের গাড়িতে উঠতাম না।   একটা হেছা কতা বলি, হুনেন— শিমুলবাগান বলেন, লাকমাছড়া বলেন, কিংবা নীলাদ্রি লেকের কথা বলেন, প্রকৃতির হিসাব আলাদা, পারিপার্শ্বিক পরিবেশ আমার কাছে একদম ভালো লাগেনি— তবে জাদুকাটা নদীকে কি যেনো এক আশ্চর্য জাদু আছে— চোখ আটকে রাখে— পড়ে না চোখের পলক— আশ্চর্য এক রূপের ঝলক, ঝলক ঠিক নয়, ঠিক যেনো ঝলমল।


তাহেরপুরে পর্যটন স্পট এবং রাস্তাগুলোকে ধুলাবালি দিয়ে ধূলিসাৎ করার জনগণ এবং তার সরকারের কথা মনে হয়ে আমার একটা কৌতুক মনে পড়লো। 


এক লোক ঘন ঘন পতিতালয়ে যায়— তাকে কোনোভাবে ফেরানো যাচ্ছে না— অনেক ধর্মের কাহিনি, সমাজের কাহিনি, সুন্দর জীবনের কাহিনি শুনানো হলো— সে ফিরছে না। জ্ঞানী বাবার পরামর্শ অনুযায়ী তাকে বিয়ে করানো হলো— সুন্দর চোখধাঁধানো রূপসী কন্যা— রূপকথার কন্যার মতো সুন্দরী বলা যায়। বাসর রাতে যথারীতি গেলো সে। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে অভ্যাসবসত একশো টাকা দিয়ে দিলো বউকে। টাকা দেয়ার সাথে সাথে জিহব্বার কামর দিলো, আমি একি করলাম— মেয়েটিও পঞ্চাশ টাকা ফেরত দিলো কাস্টমারমূল্য অনুযায়ী— বলতে হবে খুবই সৎ!  


এইভাবে দারুণ সরকার আর দারুণ সৎ জনগণ নিয়ে বয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের জীবন— আপনি বলতে পারেন পৃথিবীর যেকোনো দেশের চেয়ে বাঙালি বুদ্ধিমান— আমি বলবো আপনি ঠিকই বলেছেন— তবে আমার দ্বিমত আছে— কারন অসুস্থ বেগকে আমি আবেগ বলি না প্রিয়— যে জ্ঞান তার পারিপার্শ্বিক আবহাওয়ার মন্ডলে কাজে লাগে না তাকে অন্তত বুদ্ধি বা জ্ঞান বলা যায় না। ইংরেজি একটি শব্দ আছে render, এই শব্দটা আমার খুবই প্রিয়। render মানে গড়ে তোলা অর্থাৎ কোনো কিছু সকল অনুমিত শর্ত মেনে গড়ে তোলা। যেমন চায়ের কাপ— চা খাওয়ার সকল অনুমিত শর্ত মেনে গড়ে তোলা হলো। আমাদের বাঙালি সমাজকে একত্রে সুন্দর উপায়ে বসবাসের সকল অনুমিত শর্ত মেনে বিকাশ লাভ করানো হয়নি।  তার জন্যে পারিবারিক বিদ্যাকেন্দ্র দায়ী— তার জন্যে দায়ী আমাদের অভাব, টাকা উপার্জনের জন্যে অর্জিত শিক্ষাপদ্ধতি। অভাব এবং অস্থিরতা একসঙ্গে যুক্ত হলে মানসিক অবস্থা একেবারে মাশাল্লাহ হয়ে যায় যেখান থেকে হতাশা আর হিংসা প্রতিনিয়ত প্রতিনিধি হয়ে যায় ব্যক্তি মানুষের। ফলে সুন্দর পরিবেশ আর সুন্দর রাখতে পারে না সেই ব্যক্তি মানুষ— বিকৃত করাই যেনো তার স্বাভাবিক স্বভাব। 


নীলাদ্রি লেকের পরিবেশও আর স্বাভাবিক নাই— ক্যামেরার চোখে দেখানো হয়েছে বিকৃত উপায়ে— তারপরও সন্ধ্যা আসার প্রাক্কালে কেমন যেনো ভালো লাগা কাজ করলো। মোস্তফা স্যারের ইচ্ছা নৌকাতে চড়া— চড়া হলো— নৌকাতে করে নীলাদ্রি লেকে দিন গিয়ে রাতের আগমন দেখি— চুনাপাথর প্রথম দেখি সরাসরি এই লেকে। মানে নীলাদ্রি লেকে— তাও নৌকা দিয়ে ঘুরতে গিয়ে। জানতে পারি এর ইতিকথা,অতিহার কিংবা ইতিহাস— এটি মূলত এক সময়কার চুনাপাথরের (লাইমস্টোন) খনি ছিল। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে প্রচুর চুনাপাথর পাওয়া যায়, যার অন্যতম কেন্দ্র ছিল টেকেরঘাট অঞ্চল। এখান থেকে বহু বছর ধরে চুনাপাথর উত্তোলন করা হতো— সিমেন্ট কারখানা ও নির্মাণ শিল্পে ব্যবহারের জন্য। খনি খনন শেষে পরিত্যক্ত গর্তগুলোতে ধীরে ধীরে পাহাড়ি পানি জমে যায়। পাহাড়ি ঝরনা ও বৃষ্টির পানিতে পূর্ণ হয়ে তৈরি হয় আজকের নীলাদ্রি লেক। লেকের পানির রঙ নীলচে-সবুজ, যা সূর্যালোক ও পাথরের প্রতিফলনে ভিন্ন ভিন্ন আভা নেয়। এই নীলচে রঙের কারণেই এর নাম রাখা হয় “নীলাদ্রি”— অর্থাৎ “নীল পর্বত” বা “নীলের দেশ”। চুনাপাথরের গঠন এখনো লেকের আশপাশে দেখা যায়। লেকের তলদেশেও চুনাপাথরের স্তর বিদ্যমান।


তবে বর্তমানে এখানে আর কোনো উত্তোলন কার্যক্রম চলে না। খনিটি বহু আগেই বন্ধ হয়ে গেছে, এখন এটি একটি পর্যটন কেন্দ্র। স্থানীয় মানুষ একে “টেকেরঘাট লেক” বা “চুনার লেক” বলেও ডাকে। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত ঘেঁষা এই স্থানটি সীমান্তরক্ষী বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। লেকের চারপাশে পাহাড়, নদী ও মেঘের মিলনে সৃষ্টি হয়েছে এক অনন্য দৃশ্য। চুনাপাথরের অবশিষ্ট খণ্ড, পাহাড়ের ধূসর দাগ ও নীল পানির ঝলক মিলে এক অপূর্ব দৃশ্যরচনা করে। এখানে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের দৃশ্য বিশেষভাবে মোহনীয় বলে শুনে আসছি— পাইনি যদিও— তবে মানুষের বিকৃত আচরণের প্রভাব না থাকলে এই জায়গাটি যে মোহনীয় তা তো বলার অবকাশ রাখে না— দুই স্তনের উপত্যকার ঠিক নিচের জায়গাটির মতো মোহনীয় লাবন্যধারী হতো এই জায়গাটি।


পর্যটকেরা সাধারণত নৌকায় করে শ্রীপুর, যাদুকাটা ও বারিক টিলা ঘুরতে যান এখান থেকে। এশার নামাযের আযানের সাথে সাথে আমরা ছুটে চলি আমাদের জাহাজের দিকে। আজকে জাহাজে গানসন্ধ্যা। জাহাজে গিয়ে দেখি গায়করা উপস্থিত— ফ্রেশ হতে না হতে গান শুরু হয়ে যায়— গান পরিবেশন করছে তাহেরপুর আঞ্চলিক শিল্পীগোষ্ঠী গানপুর। তারা হাসন রাজা, আব্দুল করিম এবং লালনের মজার মজার গান করেন— জাহাজের বসার রুমের দুর্দান্ত সাউন্ড সিস্টেম এবং আপডেটেট এসিব্যবস্থাপনা। বাইরে তাপমাত্রা বেশি থাকলেও আমরা তা মোটেও টের পাচ্ছি না। গান শুনে সবার সারাদিনের ক্লান্তি যেনো শেষ হয়ে গেলো ম্যাজিকের মতো। গান চলাকালীন সময়ে একটা দারুণ খাবার আসে সবার সামনে— মুড়ি, সাথে ঝাল মরিচ এবং চানাচুর এবং মুড়িতে হালকা সরিষার তেল। বাহ! দারুণ দারুণ!!


গান শেষে যথারীতি মজার মজার খাবার। কর্তৃপক্ষের খাবার ব্যবস্থাপনা ফাইবস্টার মানসিকতার মতো— সবকিছু সুন্দর গোছানো। এক মাসের জন্য এমন একটি ভ্রমনব্যবস্থাপনা হলে ভালো হতো— শিরোনাম থাকতো— জলপথে বাংলাদেশ। 


সবশেষে আজকের জন্যে সবাই চলে গেলো সবার শীতাতপনিয়ন্ত্রক কামরায়। আমি কেবল একা একা ছাদে দাঁড়িয়ে দেখছি মিশকালো সবুজবীথি পাহাড়কে যার পেট থেকে বের হয়ে আসছে টাঙুয়ার হাওর— মা আর সন্তান আজ আলাদা আলাদা অথচ তারা একসঙ্গে এক পতাকা তলে থাকতে পারতো। মোস্তফা স্যার অনেক আগেই চলে গ্যাছে রুমে। আমি কেবল ছাদে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছি মিশকালো পাহাড়ের শরীরভঙ্গি যার নৃত্য দেখা যায় কিন্তু স্পর্শ করতে ভিসা লাগে— হায়রে ভিসা তুমি কতই না শক্তিশালী— মানুষ আর প্রকৃতির মাঝে রচনা করেছো দেয়াল! 

রুমে গেলাম। স্যার জেগে আছেন। ঘুমিয়ে যাবেন। প্রস্তুতি নিচ্ছেন। হেরমেন হেসের সিদ্ধার্থ বইটি পড়ছিলেন এতোক্ষণ। আমিও পড়ে শেষ করেছি বইটি এই ভ্রমনে। এই বইটিতে জীবনের গভীর অর্থ সিদ্ধার্থ খুজে পায় নদীর কাছে, যে নদী ধারণ করে সবকিছু এবং তা বয়ে নিয়ে যায় সমুদ্রে। ঘুমিয়ে যাওয়ার আগে একটি চিঠি লিখি এক মহান আত্মার কাছে— 


প্রিয় বন্ধু— হে আমার সোনাপাখি! 


তুমি সেদিন জানতে চেয়েছিলে— ভৈরব-আশুগঞ্জের মাঝ দিয়ে যে রাজকীয় নদী মেঘনা বয়ে চলে, সে এসেছে কোথা থেকে?

তখন হুট করে বলা হয়নি, কারণ তার উত্তর কেবল তথ্য দিয়ে হয় না— লাগে গল্প, লাগে ভ্রমণ, লাগে নদীর ধ্যানে ডুবে থাকার সাধনা। আজ সেই সাধনার কথা বলি। শোনো, অনেকে বলে মেঘনা নাকি বাংলাদেশের মূল নদী। কেন!? কারন মেঘনা বঙ্গোপসাগরে নিজের উপস্থিতি জানান দিয়েছে অথবা নিজের অস্তিত্ব অসাধারণ জলরাশির সাথে লীন করতে পেরেছে। 


এই যে বিশাল মেঘনা, সে জন্মায় এক আশ্চর্য নদীজ চক্র থেকে— শুরুটা সিলেটের সুরমা ও কুশিয়ারা দিয়ে— এই দুই নদী প্রেমের মতো পাশাপাশি চলে, তারপর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বালিখোলার কাছে এসে তারা মিলিত হয় কালনী নামে।

কিন্তু মেঘনা কেবল কালনী নয়, তার আরও সঙ্গী আছে, আছে  অন্য স্রোতধারা— এখন আসি সেই ঢেউগুলোর গল্পে—

ঘোড়াউত্রা নদী — এক নিবিড় ও গম্ভীর জলস্রোত— তার সাথে মিশেছে ধনুনদী। ঘোড়াউত্রা আবার বলাই নদীর পাশ ঘেঁষে বয়ে যায়— বলাই এসেছে সোজা জাদুকাটা নদী থেকে। তাদের স্রোত একাকার না হলেও, লক্ষ্য এক— মেঘনার দিকে। এই ঘোড়াউত্তরা-ধনুনদী-বলাই-জাদুকাটার যৌথচিত্র যেন একেকটা নদী-বাঁশির সুর। 


ঘোড়াউত্রা বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কিশোরগঞ্জ জেলার একটি নদী— নদীটির দৈর্ঘ্য ৩৩ কিলোমিটার, গড় প্রস্থ ৪৩৯ মিটার এবং নদীটির প্রকৃতি সর্পিলাকার। ঘুরে ঘুরে উঠে আসতো জলের পাক— জলের পাক দেখে হাওর অঞ্চলের মানুষ ভয় পেয়ে যেতো সেই থেকে এই নদীর নাম ঘোড়াউত্রা। 

যেহেতু আমি মেঘনার সন্তান সেহেতু ছোটোকাল থেকে একটি কিসসা শুনতে শুনতে আমাকে বড় হতে হয়— কিসসাটি হলো তিন নদীর এই মোহনায় নাকি জ্বিন আছে এবং সেই জ্বিনেরা প্রায়ই নৌকা একেবারে টান দিয়ে নিজেদের রাজ্যে নিয়ে যায়। তাই ঘোড়াউত্রা, কালনি এবং মেঘনা নদীর এই মোহনায় এলে যার যার ধর্ম অনুযায়ী ধর্মের প্রভুকে ঢেকে ঢেকে হয়রান হয়ে যেতো মানুষ! এখন এমন ঘটনা আর ঘটে না— নদীর স্রোত কমে গ্যাছে, নৌকাও হয়ে গেছে অনেক আধুনিক।  


তুমি জানো, এই ঘোড়াউত্রার কোল ঘেঁষেই আছে এক চমৎকার সাজানো গোছানো চর— ছাতিরচর— প্রাকৃতিক চর। 

লোকেরা একে বলে ‘মিনি রাতারগুল’। কল্পনা করো— ১৬ হাজার মানুষের বসতি, ঘন জলের ভেতরে ভেসে থাকা তিনটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, তিনটি মাদ্রাসা, একটি মাধ্যমিক স্কুল।


তাহলে তাদের একমাত্র বাহন? 

জলযান!


শব্দ নেই, গাড়ির হর্ন নেই, কেবল দাঁড় আর বৈঠার শব্দে জীবন চলে— যদিও ইঞ্জিনের আধুনিক শব্দ শুনতে পাওয়া যায় আজকাল। তবু এই চর যেন এক জলজ সভ্যতার হীরকখণ্ড।


তো, প্রিয় বন্ধু, মেঘনা একটাই না— সে এক সমুদ্রমুখী মহাযাত্রা, যার শরীরে জড়িয়ে আছে সুরমা, কুশিয়ারা, কালনী, ঘোড়াউত্রা, ধনুনদী, বলাই আর জাদুকাটার আলাদা আলাদা গল্প।


ভৈরব-আশুগঞ্জের মাঝ দিয়ে যে মেঘনা চলে গেছে— সে আসলে বহু নদীর মিলনের ফল, অনেক চর, অনেক গ্রামের গল্প।


তোমাকে কথাটি তখন বলা হয়নি। আজ বললাম। নৌকায় বসে যদি কখনো ছাতিরচর দেখতে যাও, মনে করো— প্রতিটি ঢেউ একেকটা গল্প বইছে।

ভালো থেকো। আবার কথা হবে নদীর পাশে বসেই।

তোমার বন্ধু,

এমরানুর রেজা


চিঠি লেখা শেষে ঘুমিয়ে যাই— ঘুম থেকে উঠে দেখি জাহাজ চলছে। জাহাজ চলছে ঢাকার দিকে। আসামের পাহাড় এখনো চোখে আসছে, বলতে চায় সে আমাকে কতিপয় কথা বিদায়বেলা। তার কথা না শুনেও বুঝে নিতে হয়, বুঝে নিতে  হয়েছে। জাহাজ চলছে— যথারীতি নাস্তা করে আবারও একটা ঘুম দেই— এক ঘুমে দুপুরের খাবারের সময় হয়ে যায়। খাবার শেষে চলে ম্যারাথন আড্ডা— বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেন ডক্টর সালাউদ্দিন সাহেব আর গোলাম মোস্তফা মিয়া স্যার। আমি চুপ করে শুনতে থাকি। মাঝে মাঝে আমিও যুক্ত হয় টীকাটিপ্পনীসহ। যথারীতি সন্ধ্যা আসে। সন্ধ্যার নাস্তা শেষে চলে পরিচয় পর্ব। চলে নিজেদের গানের আয়োজন। এখন শিল্পী নিজেরা নিজেরা। আমাদের মাঝে অনেকে আছেন ভালো গান করেন। বারবার আমাকে বলা হলো গান করার জন্যে। আমার চুল বড় দেখে সবাই মনে করছেন আমি বিরাট এক গানওয়ালা লোক অথচ আমি যে গানের বালও জানি না তারা তা জানে না, জানেন না। রাতের খাবার পর্ব আসে। আমাদের জাহাজ চলছে। আজকেই খাবারপর্বের শেষ অধ্যায়। ঢাকা পৌঁছাতে পৌঁছাতে সকাল হয়ে যাবে। খাবার পর্বের শেষে চলে অনুভূতিপর্ব— অনুভূতি পর্বে মাইক আমার হাতে আসে। আমি কোনো কথা বলতে চাইনি, তারপরও চাপাচাপিতে কিছু বলতে হলো। আমার কথা শেষে ঘটে গেলো এক অবিশ্বাস্য কান্ড। আমি বিশাল এক সিলিব্রিটি বনে গেলাম— দয়াল আমাকে ক্ষমা করো— বাংলাদেশের বড় বড় ডাক্তার গবেষক ইঞ্জিনিয়ার সচিব আমাকে ঘিরে ধরলো, ছবি তুললো নিজস্ব ক্যামেরা দিয়ে— এতো ভালোবাসা স্নেহ কোথায় রাখি প্রভু! 


তবে সবাই দারুণ শৃঙ্খলাঘনিষ্ঠ মানুষ— শৃঙ্খলাঘনিষ্ঠ মানুষের সাথে যে কটা দিন জাহাজে জলে ছিলাম সে কটা দিন আমি পেয়েছি জীবনের সুস্থ সঙ্গের প্রশান্তি— এটাকেই সাধুসঙ্গ বলে কিনা আমি জানি না— অনেককিছু না জেনে চলেছি এক অজানা গন্তব্যের মাতৃগর্ভে যেখান থেকে আমার জন্ম সেখানে— সেখানে পৌছানোর অল্প আগেও আমি এক মুসাফির— পথই আমার আদিম অনিবার্য বন্ধু— বন্ধুবর!


বন্ধুবর এই জলপথে চার রাত ধরে আছি— জলপথে ভ্রমণযাত্রা  বিমানের চেয়ে আরামদায়ক। বাংলাদেশের জলপথে যোগাযোগ একসময় খুবই জনপ্রিয় ছিলো— আস্তে আস্তে শেষ হয়ে যাচ্ছে— শেষ করা ঠিক হচ্ছে না— চালু করা উচিত পুরোদমে— বাজেট বরাদ্দ করা এবং বরাদ্দকৃত বাজেট বর্ধিত করা দরকার জলযোগাযোগের কথা মাথায় রেখে। নদী খনন দরকার— নদী খননের টাকা যেনো কুমির খেয়ে না ফেলে সেই দিকে কড়া নজর রাখতে হবে। আন্তর্জাতিক জলযোগাযোগের ব্যবস্থা করতে হবে— জল নিজেই একটা শক্তি— এই শক্তি বাংলার আছে মানে অপশক্তি বাংলাকে পরাস্ত করতে পারবে না। বাংলার জল এবং জলাশয় এবং জলাকর বাংলার প্রতিরক্ষা বাহিনীর চেয়ে শক্তিশালী। এই যে ভ্রমণ, তাও জলপথে, এটি আমার জীবনের একটি শক্তিশালী ভ্রমণ এবং জলপথে কাঞ্চনব্রিজ থেকে মেঘালয়ের পাদদেশ পর্যন্ত যা দেখলাম তা অভিজ্ঞতার অদৃশ্য পাতায় জমা থাকবে স্মৃতিময় জীবনের পাতায় পাতায় কাল থেকে কালে, পাল থেকে পালে।


আমরা প্রায় সাড়ে সাতশো কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়েছি এই জলপথে— আসা যাওয়া মিলে। আজ রাতটি এই জাহাজে আমাদের শেষ রাত। সবাই ঘুমিয়ে গ্যাছে। আমিও ঘুমিয়ে যাবো। রাত জেগে জেগে দেখছি রাতের জেলেদের, যারা মাছ ধরে জীবিকার প্রয়োজনে— আর আমি জীবনের প্রয়োজনে ভ্রমণ করি। জোনাক আলোর মতো দেখায় তাদের নৌকা— নৌকা করে সারারাত তারা মাছ ধরে— সকালে বাজারে যায় সেই মাছ— বাজারের মাছ যায় ফ্রিজে এবং রান্নায়— আর জেলে যায় ঘুমাতে। আমিও ঘুমাতে যাই যখন আমাদের জাহাজ সেই পার্লারে সজ্জিত শীতলক্ষ্যায়। ঘুম থেকে উঠে দেখি— নতুন এক সকাল— আবার জাগিনু আমি— রাত্রি হল ক্ষয়— পাপড়ি মেলিল বিশ্ব— এই তো বিস্ময়— অন্তহীন এই বিষ্ময়কর সকালে দেখি সমগ্র জাহাজ নীরব— জাহাজে রয়ে গেছি কেবল আমি আর গোলাম মোস্তাফা মিয়া স্যার। কর্তৃপক্ষ তো আছেই। ফ্রেশ হয়ে বিদায় নিলাম আমাদের প্রিয়তম সঙ্গী রুমের কাছ থেকে— সবার কাছ থেকে। সবাই বলতে ম্যানেজমেন্টে যারা আছে  তাদের কাছ থেকে।  ছোটো নৌকা করে ডাঙায় উঠি। ডাঙায় উঠে জাহাজের দিকে ফিরে তাকাই— একটা করুন দৃষ্টি নামে চোখে— করুন দৃষ্টিতে দেখি টাইগার জাহাজটির শরীরে লেগে আছে মেঘালয় পাহাড়ের মিশকালো সবুজবীথি— আর আমার শরীরে লেপ্টে আছে বাংলাদেশের নদী ও হাওড়ের মা মা জলগর্ভ গন্ধ!

বুধবার, ২২ অক্টোবর, ২০২৫

ওয়ান ব্যাটল আফটার অ্যানাদার


স্টার সিনেপ্লেক্সে ওয়ান ব্যাটল আফটার অ্যানাদার" (One Battle After Another) সিনেমাটি দেখছি। সিনেমা শুরু হওয়ার আগে পর্দায় বাংলাদেশের পতাকা পতপত করে উড়তে দেখে পতাকার সম্মানে আমরা উঠে দাড়ালাম। পতাকার সাথে বাজছে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত— আমার সোনার বাংলা/আমি তোমায় ভালোবাসি।


পতাকা পর্দা থেকে চলে যাওয়া মাত্র একজন দর্শক বলে উঠে— জয় বাংলা ✌!


আরেকজন দর্শক বলে উঠে— কে রে?


দর্শক সারি থেকে আরেকজন বলে উঠে— জিয়ার সৈনিক!


তারপর আর কোনো শব্দ নাই— তারপর সুন্দর গোছানো হলরুমে সুন্দর গোছানো নীরবতা নেমে আসে। 


সিনেমা শেষ হলে আমি ভাবতে থাকি পল টমাস অ্যান্ডারসনের পরিচালনায় এবং লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিও, টেয়ানা টেলর, রেজিনা হল, শেন পেন ও বেনিও ডেল টোরোর মতো তারকাদের অভিনীত এই  সিনেমায় বিপ্লব কত মিহি আলোর মতো হিহিহি করে হাসতে থাকে সময়ের আয়নায়— আর আমাদের সময় কার ঘরে যেনো গভীর রাতে ঘুমাতে যাই শরীর বেচার ধান্দায়!!

রবিবার, ১২ অক্টোবর, ২০২৫

ইঙ্গিত

 ভুলে যাওয়া পাখি

  আলো ঝিকিমিকি 

    সন্ধ্যা রাতের কথা 

      মনে পড়ে কী 

       একা তারে বসে 

         হাওয়া খেতে খেতে 

           কার কথা ভাবো 

            অতীতে অতীতে 

             যাকে তুমি চাও 

               নাপেয়ে পেয়ে যাও 

              জোছনার মতো জল 

            আলোতে আলোতে 

           মনের গহীনে

         আরও গোপনে

      প্রকাশ হলে ভালো 

     চলিতে চলিতে

   অচেনা অজগর বোধ 

  চোখের পেছনে রোদ 

ফিরিতে ফিরিতে

ক্লিয়ার হলে ভালো 

যতসব কর্ম

মান অভিমান বর্ম 

বলিতে বলিতে

রবিবার, ৫ অক্টোবর, ২০২৫

তরল

 


না করলে মনে হয় 

আকাশ যেনো আমার উপর ভেঙেপড়া রোদ

করলে মনে হয় 

মেঘ যেনো বৃষ্টি হয়ে তরল প্রতিরোধ

শুক্রবার, ৩ অক্টোবর, ২০২৫

কাচুলি সন্ধ্যা



কাচুলি সন্ধ্যা উদাম করো উদার অন্ধকারে 

সুরকি মানুষ তোমার জলে বাতাস নড়েচড়ে 

হাওয়া ওগো হাওয়া ওগো আঘাত কেন করো 

ঘুমপাড়ানির প্রজা সকল কুয়াশা গল্প ধরো

ভূত নামবে 

জ্বিন নামবে 

নামবে রাতের ফুল

সাগর কোমড় খুজতে খুজতে পেছনে যাচ্ছে কূল

কূল নাই 

কিনার নাই— সর্বনাশা ডাক

লোভের নিচে লোভ লাগালো অলস দুপুর কাক

ধানের বীজ গানের বীজ কোথায় যেনো যাচ্ছে 

নূপুরপরা সন্ধ্যাতারা ☆ হাওয়ায় আলো মাখছে 

অমলধবল শাড়ির ভাজ অতীত গিলে খাচ্ছে 

এক মাঘে চেতনাশীত দারুণ অরুণ নাচছে 

ম্যাসাকারে আষাঢ়গীত রক্তবীজে বাজছে

একলা পাখি একলা আকাশ একা নীড়ে ফিরছে

সোমবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

কৈবর্ত থেকে গাবর



বেরজাল। এই জালকে আমরা বেরজাল বলি। বেরজাল হলো এক ধরনের বড় জাল, সাধারণত নদী, খাল, বিল বা পুকুরে টেনে টেনে মাছ ধরার জন্য ব্যবহার করা হয়। বেরটানা মানে হলো অনেক মানুষ মিলে বড় জাল ফেলে ধীরে ধীরে টেনে এনে মাছ ধরা। বের মানে আটকানো— সবদিক থেকে কোনোকিছুকে আটকিয়ে ফেলাকে বের বলে— সহজে বললে, বন্দী করে ফেলা। বেরজাল মানে মাছকে বন্দী করে ফেলার জন্যে জলে যে জাল ফেলা হয় তাই বেরজাল। 


ছোটোকালে দেখতাম খুব সকালে এবং সন্ধ্যায় বেরজাল দিয়ে পানসে নদী থেকে মাছ ধরছে জেলে। যারা মাছ ধরে তাদেরকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া অঞ্চলের মানুষ গাবর বলে। গাবরের বহুবচন গাবরা বা গাবরারা। গাবর শব্দটা এসেছে ধীবর থেকে। ধীবর শব্দটা এসেছে সংস্কৃত धीवर থেকে। 


ব্রাহ্মণবাড়িয়া  অঞ্চলে গাবর শব্দটা অপরিচ্ছন্ন মানুষকে বুঝাতেও ব্যবহার হয়ে থাকে।  হে একটা গাবর— অর্থাৎ তার শরীরে ময়লা আবর্জনা লেগেই থাকে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া কিশোরগঞ্জ নরসিংদী নারায়ণগঞ্জ এবং সিলেটের কিছু অংশে গাবর, চামার, মেথর শব্দের ব্যবহার অত্যন্ত তুচ্ছতাচ্ছিল্য অর্থে, নিচুস্তর অর্থে উচ্চারিত হয়ে থাকে। গাবরের স্ত্রীলিঙ্গ গাবরনি। গাবরনি মানে গাবরের বউ। আমি কখনো কোনো মেয়ে জেলের দেখা পাইনি। মহিলা মেথর দেখেছি।


ব্রাহ্মণবাড়িয়া অঞ্চলে মেথর বলে না, বলে মেতর। মেতরের স্ত্রীলিঙ্গ মেতরনী। চামারের স্ত্রীলিঙ্গ চামারনি। মহিলা সম্প্রদায়ে চামারনী শব্দটা খুবই জনপ্রিয়। শুনে অবাক হবেন, আবার অবাক নাও হতে পারেন, বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে সবচেয়ে জনপ্রিয় শব্দ 'শয়তান',  শয়তানের পরে জনপ্রিয় শব্দ ফাজিল। ব্রাহ্মণবাড়িয়া কিশোরগঞ্জ অঞ্চলে শয়তানের উচ্চারণ হুইতান, হইতান। হইতানের স্ত্রীলিঙ্গ হইতাননি। বাওনবাইরাবাসী খইকে হই বলে— সই, আইসো লাইতে, তোমারে লইয়্যা হই হামু!


এখন নদীতে বেরজাল দেখলে মোটামোটি অবাক হই— কারন নদীতে আগের মতো মাছ পাওয়া যায় না— আমি নিজে বাড়ির পাশের ডোবা থেকে ফিলুন বা পিলুন দিয়া পুটিমাছ ধরতাম। ফিলুন মানে তিনটি বাশ ত্রিভুজ আকৃতিতে একসঙ্গে হয়, মাঝখানে জাল। ফিলুইয়া মানে পরশ্রীকাতর মানসিকতা— এটা একটা গালি, বলতে গেলে মার্জিত গালি। পুটিমাছকে বাংলাদেশের অনেক অঞ্চলে পুডিমাছ উচ্চারণ করতে শুনি। পুডিমাছের আত্মা মানে খুবই দুর্বল চিত্তের মানুষ— অবিভক্ত ত্রিপুরা জেলার দারুণ মশকরা উচ্চারণ এটি। কই মাছের প্রাণ শব্দগুচ্ছটি আবার সমগ্র বাংলা সাহিত্যের প্রমিত উচ্চারণ। কইডা ব্রাহ্মণবাড়িয়া অঞ্চলের বিশেষ সবজি— চিচিঙ্গা বা কইডা বা দুধকুুুশি বা মধুকুশি বা কুশি বা হইডা (Snake gourd) অপেক্ষাকৃত নরম সবজি— এটি ঝিঙে, লাউ, শশা, কুমড়ো ইত্যাদির মতই কিউকারবিটেসি পরিবারের সদস্য। কইডাতে পটাসিয়াম ম্যাগনেসিয়াম ভিটামিন-সি ভিটামিন বি৬সহ আরও অনেক পুষ্টিমান এ্যাবেইলএ্যাবল।


বরিশাল–পটুয়াখালী–ভোলা অঞ্চলের লোকভাষায় “কায়দা” শব্দটিই বদলে “কইডা” হয়ে গেছে।

যেমন:

“এই কাজের কইডা শিখছিস?”

“তুই বড় কইডাবাজ।”


কয়ডা বা কইডা শব্দটি বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলে কয়টি(How many) শব্দের পরিবর্তে উচ্চারিত হয়ে থাকে। কয়টা বা কইডার বহুবচন 'কতলা' শব্দটি উচ্চারিত হয়। 


'পুডিমাছের আত্মা' এখন বলে, একযুগ আগেও বলতো পুডিমাছের কইলজা। পুডিমাছের কইলজা কেউ দেখেছে কিনা আমার জানা নেই। মাছের মধ্যে সবচেয়ে ছোট্ট মাছ কিচকি— কিছকি মাছের কইলজা বললে পারফেক্ট হতো। কলিজা খাওয়া মানে জ্বালাতন করা— সকাল থেইক্কা হে আমার কইলজা হাইয়্যালাইতাছে।  কলিজাকে কইলজা উচ্চারণ করা ত্রিপুরা মহকুমার স্বাভাবিক স্বভাব উচ্চারণ।


কিছকি মাছের কইলজা না বলে ব্রাহ্মণবাড়িয়াবাসী কেনো পুডিমাছের কইলজা বলে নরম গালি দেয় তা জানার চেষ্টা করি। কিছকি মাছ ছোট হলেও তা ততটা সহজলভ্য নয় যতটা সহজলভ্য পুডিমাছ। আর বাঙালি কমিউনিটি সহজে যা কিছু পায়, যদি স্বর্নও হাতে পায় তার মূল্যায়ন করতে শক্তিশালীভাবে অপারগ! অর্থাৎ পুটিমাছের সহজলভ্যতার কারনে তার একটি দুর্বল দিক আবিষ্কার করে বাংলার মানুষ— মানে জল থেকে উঠে আসার পর বা তুলে আনার পর পুটিমাছ বেশিক্ষণ বাচে না— প্রতিকূল পরিবেশে পুটিমাছ নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্যে লড়াই করতে পারে না— তাই সমাজের যেসব মানুষ প্রতিকূল পরিবেশে নিজের অস্তিত্ব জানান দিতে অক্ষম অথবা ভয় পায় তাদের কলিজাকে পুটিমাছের কইলজার সাথে তুলনা করা হয়েছে। 


তবে কিছকি মাছ নিয়ে ইদানিং একটি গালি বিখ্যাত হয়েছে— কিছকিবান্দি— যে বান্দি মর্যাদার দিক থেকে খুবই ছোট— কিছকিবান্দির পুত= মর্যাদার দিক থেকে খুবই হীন দাসীর ছেলে। পুত্রকে পুত বলার প্রবণতা কিশোরগঞ্জ ব্রাহ্মণবাড়িয়া নরসিংদী নারায়ণগঞ্জ অঞ্চলের মানুষের উচ্চারণে রয়েছে। গাবরা যেমন গালি এবং তাচ্ছিল্য অর্থে উচ্চারিত হয় তেমনি গাবরা বাড়ি শব্দটাও।  ভদ্রসমাজে গাবরা বাড়িকে বলে জেলেপাড়া— আঞ্চলিক উচ্চারণ জাইল্লা পাড়া  অর্থাৎ এদের বাড়ির নামকরণ হয়েছে এদের কর্মের উপকরণ দিয়ে— জাল থেকে জাইল্লা। গাবর বাড়িকে কেউ কেউ কইবত বাড়িও বলে— শব্দটা মূলত কৈবর্ত— সংস্কৃত মূল: কৈবর্ত → "কো" (জল) + "বর্ত" (চলাফেরা করে/আচরন করে)। অর্থাৎ, যারা জলে চলে বা জলে বাস করে। 


কৈবর্ত  শব্দটা কিন্তু কইমাছের প্রানের মতো অনেক শক্তিশালী এবং ইতিহাসধারী। কৈবর্ত বিদ্রোহ ইতিহাসের এক মহান আলোচনার বিষয়— 


পাল সাম্রাজ্যের শাসনামলে ব্রাহ্মণ্যবাদী জমিদার ও সামন্তরা সাধারণ কৃষক ও মৎস্যজীবী শ্রেণিকে শোষণ করত। বরেন্দ্র অঞ্চলে প্রচুর কৈবর্ত (মৎস্যজীবী/কৃষক) বাস করত।

তাদের উপর অত্যাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু হয়।

দিব্য কৈবর্ত প্রথমে বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন এবং পালরাজা গোপাল তৃতীয়কে পরাজিত করে উত্তরবঙ্গে ক্ষমতা দখল করেন। পরে দিব্যের উত্তরসূরিরা কয়েক প্রজন্ম পর্যন্ত বরেন্দ্র অঞ্চলে শাসন চালায়। অবশেষে পাল রাজারা আবার শক্তি সঞ্চয় করে বিদ্রোহ দমন করে।


কৈবর্ত বিদ্রোহ ছিল বাংলার আদি মধ্যযুগের ইতিহাসে একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এটি সাময়িকভাবে পালদের তাদের পৈতৃক অঞ্চল বরেন্দ্র থেকে বিতাড়িত করে এবং অধস্তন শাসকদের উপর তাদের নিয়ন্ত্রণ চিরস্থায়ীভাবে দুর্বল করে দেয়। এর ফলে পরবর্তীতে পাল শক্তির পতন হয় এবং সেনদের উত্থানের পথ প্রশস্ত হয়।


কৈবর্ত বিদ্রোহকে বাংলার ইতিহাসে কৃষক ও শ্রমজীবী শ্রেণির প্রথম বড় ধরনের বিদ্রোহ হিসেবে ধরা হয়। এখানে কৈবর্তরা শুধু সামাজিক, অর্থনৈতিক শোষণের বিরুদ্ধে নয়—রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলেরও চেষ্টা করেছিল— ইতিহাসবিদরা একে “কৃষক বিদ্রোহ” বলেও আখ্যা দেন—আসলে নামটা একটু বিভ্রান্তিকর মনে হতে পারে। কারন বিদ্রোহ করেছে কৈবর্তরা—যারা মূলত মৎস্যজীবী সম্প্রদায়। তবু ইতিহাসে একে অনেক সময় কৃষক বিদ্রোহ বলা হয়।


কারণ কৈবর্তদের সামাজিক অবস্থান — তারা শুধু মাছ ধরা নয়, জমিতে চাষও করত। বরেন্দ্র অঞ্চলের বিশাল অংশে কৈবর্তরা কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত ছিল—অর্থাৎ, তারা ছিল কৃষক–মৎস্যজীবী—উভয় পরিচয়ের ধারক। 

তাছাড়া শোষণ–বঞ্চনার মূল বিষয় কৃষিজমি— পাল শাসকেরা আর জমিদার–ব্রাহ্মণ শ্রেণি কৃষিজমির উপর নিয়ন্ত্রণ নিত। কৃষকদের থেকে অতিরিক্ত কর আদায় করা হতো। বিদ্রোহের মূল টার্গেট ছিল এই জমির ওপর শোষণ।


বরেন্দ্র মানে গঙ্গা ও করতোয়ার মধ্যবর্তী অঞ্চল। বিশেষ করে রাজশাহী, নওগাঁ, বগুড়া ও দিনাজপুর জেলার অংশবিশেষ। 


কৈবর্ত শব্দটা এখন বাংলার মুখে উচ্চারিত হয় না বললেই চলে— গাবরাও এখন আগের মতো নাই। এখন মাছ চাষ করে অনেক টাকাওয়ালা মানুষ— টাকা কামানোর জন্যে না— কামানো টাকাকে বৈধ করার জন্যে।

যাত্রী যাত্রা

 এইখানে বসে 

চোখের ভেতরে নদীর মতো মাঝি একে 

এইখানে বসে 

ঢাকা শহরের সমগ্র আলো মেখে 

নীরব হয়ে যাই চলো 

চোখের সাগরে একটা ছোট্ট কোলাহলও থাকবে না 

মানুষের বানানো মাংসের দুনিয়া 

মাংসের বানানো রাজনীতির খায় খায় স্বভাব 

অন্ধকারে যেমন আলোর অভাব 

আলোতে যেমন আলোচনার লবনাক্ত হাবভাব 

সবকিছু ছেড়ে 

সবকিছু রেখে 

সবার একজন হয়ে 

একজনের সবার হয়ে 

চলো পালাই— আরও আরও লোকালয়ের ভেতর 

চলো পালাই— আরও আরও কোলাহলের উপর 

অনেক শব্দের ভেতর তুমি ঘুড়ি 

তোমার ঘুড়ির পাখায় উড়ি— এই আমি উড়ি 

এখন উড়ি 

তখন উড়েছি 

উড়তে থাকবো আরও আরও বহুবার 

যতবার আকাঙ্ক্ষা জন্মাবে তোমার 

ততবার তুমি আমার কেবলই আমার

শনিবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

তোমার স্মরণ স্বর্গ স্বরূপ

 


কোরানে তোমারে খুজি না প্রিয় 

তোমাতে আমি কোরান খুজি 

দূরে ঠেলে সব ফতোয়াবাজি 

আমার ধ্যানে তোমারে পুজি 

তোমার প্রেম আমার রোজি 

তোমার স্মরণ স্বর্গ স্বরূপ 

আর বাকি সব হালুয়া সুজি

বদনামের আচার

 বদনামের আচার যদি না পায় মানুষ 

    কথার খাবার জমে না আড্ডায় 

      বাতাসে উড়ে না যাত্রাপালার আনন্দ ফানুস 

        এই নদী সাগরে যাবে মিষ্টি হবে তার জল 

          এই সাগর নদীকে খাবে নোনতা হবে তার ফল

            গাছের কোনো ঘর নেই 

              জলের আছে চর 

                কথাতে আপন তুমি 

                  কথাতেই পর 

                    কাকে মানুষ করছে আপন 

                      কাকে মানুষ বলছে অপর

                       পাতাতে পাখির সংসার 

                         পাতাতে হচ্ছে জমি আশ্চর্য উর্বর 

                          একই সূর্য তোমার আমার 

                            মানুষ মায়ের সন্তান 

                          এই সমাজই বানাচ্ছে প্রিয়

                        সাধু ভন্ড মাস্তান

                     ফুল থেকে ফলকে আলাদা করো যদি

                  প্রকাশ পাবে কেবলই তোমার কথার বাহাদুরি

                বাহাদুরি রুচির শত্রু সাদা মোড়কে ত্রাস 

              বদনামের কপাল খেয়ে বাশি হচ্ছে বাশ 

           সময়ের স্রোত হয়ে রেজা চলে বয়ে 

         সুরের সাথে ঘরসংসার 

       অসুর যায় ক্ষয়ে

সোমবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

ছিটকিনি

রুমের সামনে জটলা— সেকেন্ড ফ্লোর— আমি আরও উপরে উঠবো— দাড়াই এবং কারন জানতে চাই। দরজার বাইরে সবাই— ভেতরে একটা  শিশু— চার বছরের শিশু। শিশুকে ভেতরে রেখে তারা পাশের রুমে আড্ডা দিতে যায়— সবাই। শিশু একা একা আনন্দ খেলা খেলতে খেলতে হাতের নাগালে থাকা ছিটকিনি দিয়ে ফেলে— কিন্তু খুলতে পারছে না। জানালা দিয়ে অনেক ইন্সট্রাকশন দিচ্ছে মুরুব্বিরা শিশুকে— কাজ হচ্ছে না— প্রায় দুই ঘন্টা চলে যায়। 


রুমের সামনে জটলা— কারন জানার পর বুঝতে পারি উপায় একটাই আছে— ছিটকিনি ভেঙে ফেলা— ভাবলাম একটা লাথি দিয়ে দরজার ছিটকিনি ভেঙে ফেলি— ভেবে দেখলাম  তাতে সমস্যা আছে— সুন্দরী মেয়েরা আবার ক্রাশট্রাস খেয়ে যেতে পারে— পরে আবার পড়বো অন্য ঝামেলায়! 


বাড়ির ছোটো সর্দার সুমনকে বলি ছাদ থেকে সিমেন্টের ছোটো পিলারটা আনার জন্যে— সে বাহুবলির মতো তা দ্রুত নিয়ে আসে— তারপর সেনাবাহিনী স্টাইলে দুজনে মিলে ছিটকিনি বরাবর একটা ফার দেই— এক ফারে দরজা খুলে যায়— শিশু মুক্ত হয়ে আনন্দে তার মায়ের কুলে ঝাপিয়ে পড়ে! 


আমিও শিশুকে মুক্ত করার আনন্দে উপরে উঠছি আর ভাবছি— শিশুরা ছিটকিনি লাগাতে পারে কিন্তু খুলতে পারে না!

বৃহস্পতিবার, ৭ আগস্ট, ২০২৫

ইতরবাহার

 কত দেখলাম ইশতেহার 

আগে চলে কথার ভার 

নেতা ভাঙে প্রজার ঘাড় 

কথার কথা আর কত 

দিনে দিনে বাড়ছে ক্ষত

কথা কমাও 

বাড়াও কাজ 

ডক নাই তাইনের অধিক সাজ 

বাহাদুরি কমাও মিয়া 

নেতা হও কাজ দিয়া

সোমবার, ৪ আগস্ট, ২০২৫

রাধাগো আমার



রাধা— রাধাগো আমার 

রাধাস্নাত শ্রাবণ মাসের বুক ভাসালে তুমি 

রাত গেলো— ভোর এলো— এলো ভোরের বাহার 

ভোরশাড়ির ভাজ ভাঙলে না— সকাল হলো তোমার 

রাধাস্নাত রাত শেষে ভোরের আলো চোখে 

ঘাসফুলের মতো প্রিয়া

  প্রিয়া আমার ভালো— নন্দ চন্দ মুখে


আলো নাচে 

     আকাশ মেঘে ☁— নদীর জলে ঢেউ

তোমার মতো আমার ক্ষত দেখেনি আর কেউ


চুলউড়ানো বাতাস আমি— তোমার ঠোঁটের ফুল 

       ভাসতে ভাসতে রাধাকিস্তি চিনছে রেজাকুল

অচেনার ঘরে দেখো প্রিয়— চেনা চোরের বাড়ি 

      সংসারের উঠোনহাটে বাড়ছে পুলিশ ফাড়ি

লোহা নহে 

কাস্তে নহে 

সাগর হয়ে এসো 

তোমার জন্যে আমার হৃদয়— জলপালঙ্কে বসো

বুধবার, ৩০ জুলাই, ২০২৫

এক গাধার গল্প

এক গাধা এসে বাঘকে বললো— আপনি ঘোষণা দেন যে আজ থেকে জঙ্গল স্বাধীন— তাতে আপনার পাশে কাউকে না পেলেও আমাকে পাবেন। 

বাঘ চুপ। 

পরের দিন গাধাকে সিংহ দৌড়ানি দিলো।

তারপর থেকে গাধাকে আর খুজে পাওয়া যায় না। 

জঙ্গল এখন গাধামুক্ত। 

মানুষের মঙ্গলে গাধারা এখন মানুষের সমাজে মানুষের মতো হুবহু চেহারা ছুরত নিয়ে দিনরাত ঘাম ঝরায়।

বৃহস্পতিবার, ২৪ জুলাই, ২০২৫

আ ফা লে র মা ছ

 ০১

হাল কেটে যারা প্রেম আনলেন তারাই হয়ে উঠলেন কুমির🐊


০২

ডাকাত তাড়ানোর পর আপনি যখন ডাকাত হয়ে উঠেন তখন কিন্তু আমরা বলতে বাধ্য— ডাকাতই ভালো ছিলো! মানুষ মাস্টারি পছন্দ করে না— মানুষ যাকে মাস্টার মানে তাকে মাস্টারি করা লাগে না। যোগ্যতার একটা নিজস্ব ক্ষমতা আছে— ক্ষমতার নিজস্ব যোগ্যতা নাই: আজ আছে কাল নাই!


০৩

বাঙালি মেয়েরা অলঙ্কার পছন্দ করে— তবে সারাদিন অলঙ্কার পরে বসে থাকে না— বয়ফ্রেন্ড, বাঙালি মেয়েদের কাছে অলঙ্কারের মতো— বিশেষ কারন ছাড়া মেয়েরা বয়ফ্রেন্ডকে  পাবলিকলি ওপেন করে না।


০৪

যে যাকে যত ভালোবাসে সে তাকে তত সুন্দর দেখে— আমার কাছে কথাডা সত্য নয়— সুন্দর ইজ অলয়েজ সুন্দর— চান্দের জোছনাকে আপনি ভালো না বাসলেও জোছনার কোনো যায় আসে না—তবে খাবার হিসাবে কাডল পাতা ছাগল পছন্দ করে, মানুষ করে না—রুচির জায়গা আলাদা— আলাদা রুচি আলাদা আলাদা পছন্দতালিকা নির্মাণ করতেই পারে— ফলে ভালোবাসার প্রায়োরিটি আলাদা হতেই পারে। 


দূরত্ব বাড়ালে গুরুত্ব বাড়বে বিষয়টা এমন না— গুরুত্ব দিয়ে দূরত্ব কমাতে হয়।


০৪

পিপড়া কাডাল খাইতে গিয়া কোমড়ে ব্যথা জমাইছে— অহন, ব্যায়ামবিদরে জিগাই— কোমড়ের ব্যায়াম কি আমারে কহো!


০৫

শোনো— জনগণকে নির্মুল করে দাও— আরও ছোট করে আনো তাদেরকে—জনগনের সামনে এমন আদেশ আনো যাতে তারা চুপ হয়ে যেতে বাধ্য হয়— কারন তোমাদের কাছে জনগণের চেয়ে রাজনীতি বড়!


০৬

তার হাসির রোদ দেখে বুঝা যায় তার প্রেমিকের তাপমাত্রা কত।


০৭ 

দুনিয়াডা  চলছে কথার উফরে— কথাতে জঙ্গল কথাতে মঙ্গল।


০৮

যে বিপদ নিয়ে তুমি বিষন্ন সেই বিপদ আশীর্বাদ হয়ে যাবে— তুমি টেরও পাবে না— যে আশীর্বাদ নিয়ে তুমি আনন্দিত সেই আশীর্বাদ বিপদ হয়ে যাবে—তুমি টেরও পাবে না। যা তোমার টের পাওয়ার সীমানার মধ্যে নেই তা কেনো তোমার মনে কুতকুত খেলে যাচ্ছে— তাকে বিদায় দাও— এই পৃথিবী থেকে একদিন তোমাকে বিদায় হতেই হবে! 


০৯

আপনি যখন সবার হয়ে যাবেন— একজনের সবটুকু হতে পারবেন না।


১০

আসন চায় যোগ্য মানুষ তার উপরে বসুক— যোগ্য মানুষ যখন আসনে বসে না তখন আসন চিল্লাচিল্লি করে— আসনের এই চিল্লাচিল্লির নাম আন্দোলন। আন্দোলন একটি রাষ্ট্রকে শেষ করে দিতে পারে— আন্দোলন একটি শেষ হওয়া রাষ্ট্রকে পৃথিবীর শ্রদ্ধাসম রাষ্ট্রতে পরিনত করতে পারে। আন্দোলনকারী সৎ ও জ্ঞানী না হলে রাষ্ট্র মূর্খতার শেষ পর্যায়ে যেতে খুব বেশি সময় লাগে না!


১১

বাংলাদেশের প্রত্যেক ঘরে ঘরে বিদ্যুতের মতো ঔষধ পৌঁছে গ্যাছে— বিদ্যুৎ আসা যাওয়া করে— ঔষধ একবার যে ঘরে ঢুকছে সেই ঘরকে কবরে ঢুকানোর পর মিস্টার ঔষধ বাড়ি ফিরে!


১২

মাথার ভেতর যখন আকাশ থাকে না— তোমার দেহকে কেবলই মেঘ মনে হয়।


১৩

তারা বলে— আইন সবার জন্যে সমান— সমান শব্দটা আইনে সমানভাবে নাই জনাব— দেখুন না— ভালো করে দেখুন— প্রয়োজন হলে পাওয়াফুল চশমা দিয়ে দেখুন।


১৪

ভেগে যাওয়ার আগে দৌড়াতে শিখো প্রিয়— মিথ্যা বলার আগে জেনে নাও সত্য বলার কৌশল— মানুষ তো হবাই— আগে চিনে নাও নিজের ভেতরের সক্রিয় অমানুষটারে— যাকে পছন্দ করো অধিক— জেনে নাও সবকিছুর আগে তার অপছন্দের তালিকা


১৫

নদী ডুবে যায় ডরে— নদী মরে যায় চরে। 


১৬

বাংলাদেশের দিন চলে যায় মাস্টারবেশন আর অবজারভেশনে।


১৭

কথাকে রান্না করতে আগুন লাগে।


১৮

জলের কোনো রাজনীতি নেই— জলের সোজানীতি হচ্ছে তার পথে সে যাবেই।


১৯

মূল সার্ভিসের খবর নাই— ফ্রি সার্ভিসের ঘুম নাই।


২০

বিশ্বাস আপনাকে করতেই হবে— ধন দিয়ে। জন দিয়ে। মন দিয়ে। বিশ্বাস আপনাকে করতেই হবে কাউকে না কাউকে। বিশ্বাস করে যখন এই বাংলায় আপনার বিশ্বাস ভঙ্গ হবে না— বুঝতে হবে আপনার জীবনে একটা মিরাকল ঘটে গ্যাছে। এই বাংলায় মিরাকলের জন্যে আসমানের দিকে তাকাতে হয় না— মানুষের আচরণ অথবা আপনি মানুষের সাথে যে আচরণ করেন তার দিকে তাকালেই চলে।


২১.

উড়ার জন্যে পাখির মতো একটা ডানা হলে কেবল চলে না— উড়ার মতো একটা সক্রিয় মনও থাকা চায়। হে বন্ধু, তোমার ডানা না থাকুক— মন তো আছে। মনের মধ্যে একটা স্বপ্নধরা ডানা বসিয়ে নাও— দেখবে স্বপ্নের ডানা দৃশ্যমান ডানার চেয়ে অনেক অনেক শক্তিশালী।


To soar high, merely having wings like a bird isn’t enough—you need a mind ignited with purpose. My friend, even if you don’t have wings, your mind holds limitless potential. Attach the wings of dreams to your thoughts, and you’ll find that dream wings are far more powerful and boundless than any physical ones. 


২২.

We go this way bonded in our human experience and when we face it all, we see beyond, we begin to share our heart, this fountain which knows no borders, this endle source of joy. 


আমাদের অভিজ্ঞতা আমাদেরকে দেখতে শুনতে চলতে ফিরতে অন্ধকার রাতে আলোর মতো কাজ করে— যখন আমরা আমাদের অভিজ্ঞতার সবটা উপলব্ধিতে নিয়ে আসতে পারি তখন শুরু হয় ভিন্ন এক যাত্রা যেখানে রাজত্ব করে কেবল হৃদয় যেখানে অভিজ্ঞতা সূর্যের ☀ আলোর সামনে মোমবাতি যেমন ঠিক তেমন হয়ে পড়ে— যেখানে একমাত্র রাজা হৃদয় যার কোনো সীমানা নেই— আর সেখানেই জীবনের অন্তহীন আনন্দযাত্রা।


২৩.

পুরো পৃথিবীকে সামনে নিয়ে বড়ভাবে আমাদের জেগে উঠতে হবে— আগে জানতে হবে, তারপর শক্তিশালী উপায়ে মানতে হবে, দ্যান, সমৃদ্ধির পথে লেগে থাকতে হবে সামষ্টিকভাবে— কাড়াকাড়ি নয়— কড়াকড়িভাবে মানুষের পথে মানুষের জন্যে বাচতে হবে— কেবল একে অন্যের সঙ্গে নয়— একে অন্যের জন্যে পথ চলাই সত্যিকারের সমৃদ্ধি এনে দেবে।


We must awaken with a grand vision, embracing the whole world before us— First, we must learn; then, we must believe with unshakable strength— And finally, we must walk the path of prosperity together—not in rivalry, but with unwavering dedication to humanity.


Not by mere coexistence, but by standing for one another—this is the way to true abundance. Only when we journey not just with each other, but for each other, will we find the richest fulfillment of all.


24

Moderate system will survive and old system will be deteriorated— tradition is beautiful only in the jungle. 


২৫

সূর্য আর গাছ চিরদিন একসঙ্গে থাকে— গাছ কেবল উপরে উঠতে চায়— গাছ তার প্রয়োজনের কাছে যেতে চায়— গাছ তার বন্ধুর কাছে যেতে চায়— এই যে গাছ উপরে উঠতে চায় সেটাই গাছের নত হওয়া বা সমর্পিত হওয়া— প্রয়োজনের কাছে যে নত হতে জানে না সেই অপ্রয়োজনীয় জীবন যাপন করে— গাছ উপরে উঠে কিন্তু শেকড় থাকে মাটির গভীরে— মাটি তাকে লালন করে কিন্তু সূর্য তাকে পালন করে।  যারা আপনার লালনের সাথে জড়িত— যারা আপনার পালনের সাথে জড়িত তাদের থেকে কতদিন দূরে থাকা যায় বন্ধু!? 


২৬

তরকারি রান্না করতে হলে একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রা দরকার— আগুন বাড়িয়ে তাপমাত্রা বাড়ানো হলে পাত্র পুড়ে যাবে—কাউকে যখন  শাস্তি দেয়া হয় মাত্রার বাইরে সেটা আর শাস্তি থাকে না— সেটা হয়ে যায় অত্যাচার বা নিপীড়ন— অত্যাচারীর ধ্বংস  অনিবার্য। 


প্রিয় এমরানুর রেজা ভাই, মনে রেখো— ইনসাফ করতে গিয়ে  জুলুম যেনো না করে ফেলো!


সর্তকতা পবিত্রতার একটি ডিপার্টমেন্ট— ভয় রোগের একটি শক্তিশালী ডিপার্টমেন্ট— সর্তকতা যখন মাত্রা অতিক্রম করে তখন তাকে ভয় বলে।


There is a fine line between justice and oppression— When punishment exceeds its limits, it is no longer justice—it becomes tyranny. And history has shown that the downfall of the oppressor is inevitable.


Dear Emranor Reja Bhai, be careful that in seeking justice, you do not commit injustice!


Caution is a branch of purity, while fear is a form of mental illness— When caution crosses its limits, it turns into fear.


২৭.

কবিতায় সংসদ এলে কবি তুমি হয়ে উঠো মানুষের—সংসদে কবিতা গেলে মানুষ হয়ে উঠে কবিতার। 


২৮.

জান্নাতে যাওয়ার আশায় দুনিয়াকে যারা জাহান্নাম বানায় তারা যেনো ভুলে না যাই পরীক্ষার কেন্দ্রে তারাই অরাজকতা সৃষ্টি করে যারা আসলে পাশ করার ক্ষমতা ন পায়। 


২৯

দুধের বাটি খোলা রাখলেই বিড়ালের জিব্বা বের হয়ে আসতে চায় মানে বিড়ালের বিড়ালত্ব জেগে উঠে— আহারে বিড়াল! তুমি আর মানুষ হয়ে উঠলে না যেখানে দৃষ্টি সংযত করার কথা আছে তোমার জন্যে!! 


If a bowl of milk is left open, a cat's tongue can't help but come out—its feline instincts awaken. Alas, dear cat! You never learned to be a rational human, even when you were supposed to restrain your ravenous eyes!!


৩০

দান করে যে জাহির করে সে জাহেরি— বাতেনিভাবে নিশ্চয়ই তার কোনো গরীবি হালত আছে।


৩১

আপনি কবিতাও করবেন, আবার ক্ষমতাও চায়বেন— হবে না আক্কাস, হবে না ওহে আকাশি, হবে না— কবিতা সব সময় ক্ষমতার বিরুদ্ধে কথা বলে। তবে হ্যাঁ— কবিতার একটা নিজস্ব ক্ষমতা রয়েছে যা সিংহাসনে বসা লোকটিকে মাটিতে থাকা লোকদের কথা মনে করিয়ে দেয়— মাটিতে থাকা লোকদের মনে করিয়ে দেয় ভূমি যার অধিকার তার। ক্ষমতা আপনার মাথায় হাত রাখছে মানে আপনি শেষ— সকালে বিকালে শেষ, রাইতে সকালে শেষ! 


You may write poetry, but you also seek power— this won't work, Akkas, it won’t work, hay Akashi, it won’t work— poetry always speaks against power. However, yes— poetry has its own power, which reminds those sitting on the throne of the voices of those on the ground— it reminds those on the ground that the land belongs to those who have the right to it. When power places its hand on your head, it means you’re finished— in the morning or in the evening, finished; in the night or in the morning, finished!"


৩২

রেজা ভাই, অন্ধকার হয়ে অন্ধকারকে গালি দিয়ো না, সূর্য অন্ধকারকে গোল টেবিলে বসে গালি দেয় না— সূর্য তার কাজটা দেখায় কেবল— সূর্য না হতে পারো রেজা ভাই— অন্তত মোমবাতির আলো হও— তাতেও তুমি কোনো না কোনো টেবিলের অন্ধকার দূর করবে।


Reja Bhai, do not curse the darkness while being in the dark. The sun does not sit at a round table to curse the darkness—it simply does its work. If you cannot be the sun, Reja Bhai, at least be the light of a candle. Even that will dispel the darkness from some table. 


৩৩

এখানে মানুষের চেয়ে হিংসা বড়ো— আরও বড়ো মূর্খতা। 


৩৪

চাতাল কলে মাতাল হয়ে লাভ নাই জনাব— গুড় ঠিকই জানে পিপড়ার শক্তি। 


৩৫.

রিস্ক নিবেন না জনাব— তাহলে জেনে রাখুন আপনি রিস্কে আছেন। 


৩৬

মানুষকে সাহায্য করা শুধু অন্যের জন্য নয়, বরং মানুষের নিজস্ব পরিপূর্ণতারও একটি অংশ— একে অপরকে সহায়তা করলে সমাজ ও পৃথিবী আরও সুন্দর হয়ে উঠবে— মনে রেখো সংগ্রামী আত্মারা আমার, ফুল যদি আপনার বাগানে ফুটতে পারে, সেই ফুলই আপনার ক্ষেতের ফসল বৃদ্ধি করবে। 


আগাম প্রস্তুতি নিচ্ছি মানে ভয় নয়— কারণ সচেতন থাকা দায়িত্ব, দুশ্চিন্তা নয়।


Helping others is not only for the benefit of others— but also a part of one’s own completeness— when we assist each other, society and the world become more beautiful.


Remember, my struggling souls, if a flower blooms in your garden, that very flower will enhance the yield of your field.


Preparing in advance doesn’t mean fear—it’s because being aware is a responsibility, not a worry.


৩৭

জোর করে ভোর ফোটানো যায় না রেজা ভাই— হুল ফোটানো যায় মামু— তবে জোর করে হুল ফোটাতে গিয়ে কত বুমরা মারা গ্যাছে!


৩৮.

সাংবাদিকরা ব্যবসায়ীদের বিবেক। 


৩৯.

নারীর শক্তি নিয়া কথা বলো বেটা!? একবার বড় চুল রাইখ্যা দেখো— কেবল চুল গোছানো রাখতে কি পরিমাণ শক্তি লাগে!


৪০

ইন্দুর যতই মাতামাতি করুক— সে জানে বিড়ালের রাজ্যে সে লিডার হতে পারবে না।


৪১

সূর্যের ☀ জয় অনিবার্য— রাতেও সূর্য চাঁদের ছদ্মবেশে আসে।


৪২

যেখানে মানুষ হারিয়ে যাচ্ছে সেখানেই আমরা হাততালি দিচ্ছি!


৪৩

When a fisherman catches a fish, he certainly doesn’t have to become a fish himself; and when the police catch a criminal, they don’t have to be one either. Dear uncle, we can quite well understand the cawing of a crow in our own way — mistakes can happen, after all.


৪৪

আপনি একটি সিনেমা দেখছেন। আপনার ঘরের বিছানার উপরে— ল্যাপটপে। মনিটরের সমগ্র এলাকা ভরে একটি নায়িকা সর্পিল ভঙ্গিতে নাচ করছে। আপনি সেই নাচ দেখছেন। আপনি নিজেও জানবেন না আপনাকে দেখছে আরেকটি সত্তা। না না— আমি আমলনামা লেখা ফেরেশতার কথা বলছি না। ফেরেশতা বাদেও আরেকজন আছে আপনার ঘরে যিনি আপনার আমলনামা লিখতেই থাকে এবং লিখতেই থাকে। তিনি আপনার স্ত্রী। সিনেমার নায়িকার সেই সর্পিল নৃত্য দেখার কারনে আপনার জীবনের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত আলিফ লায়লা হয়ে গেলো এবং আপনি তা টেরও পাবেন না। আপনাকে কিচ্ছু বলবে না কিন্তু ডট ডট ডট। এই ডট ডট ডটের ভেতরে প্রথম যে জাতীয় নারী বাক্যের জাতীয় বাক্যটি মনে মনে বার বার বলতে থাকবে তা হলো— সব পুরুষরা এক!


৪৫

পরিবার হলো সূর্য আর রাষ্ট্র হলো তারই অবিচ্ছেদ্য আলো।


৪৬

একজনের বৃষ্টিসময়ে আমার একমাত্র ছাতাটা দিয়েছিলাম— সে ফেরত দেয়নি— আজকে আমার বৃষ্টিসময়ে ছাতা পাচ্ছি না— কাউকে নিজের একমাত্র কোনোকিছু দিয়ে সহযোগিতা করো না রেজা ভাই— কারন তোমার একমাত্র সময়ে তাকে নাও পেতে পারো এবং সেটাই হয়।


৪৭

কেউ যখন আমার প্রশংসা করে আমার ব্রেইন সেটাকে পিক করে আক্রমণ হিসাবে— প্রসংশার আক্রমণ। আমি তখন শরীয়তী স্টাইলে সাথে সাথে তার একটি প্রসংশা খুজে বের করি এবং তার মনের সামনে ছুড়ে দেই। আমি জানি, গাছ কেবল জলে বাচে না, রোদেও বাচে এবং বাতাসও তার দরকার হয়। এবং আমি জানি, আমার ঘুমানোর সময় যিনি আমার জেগে থাকার শক্তি নিয়ে প্রসংশা করেন তিনি আসলে চান না আমি সেই সময়টাই ঘুমাতে যাই। 


৪৮

অন্যায়ভাবে আপনি যদি কারো দিকে একটি ফুলও ছুড়ে দেন— ন্যায়ভাবে সেটা আপনার দিকে পাথর হয়ে ফিরে আসবে— আসবেই!


৪৯

যাদের আচরণ পশুর মতো— তারা পশু কোরবানি দিয়ে মানুষ হতে চায়— চেষ্টা চলছে সেই পশুর যুগ থেকে। 


৫০

বাঘের গর্ভে কখনো ছাগল জন্মাতে আপনারা দেখেছেন? সবাই বলবেন " না, অবশ্যই না'। কিন্তু মানুষের গর্ভে অমানুষ জন্মে, অমানুষের গর্ভে জন্মে মানুষ। আপনারা সবাই বলবেন— ঠিক ঠিক, একদম ঠিক। অমানুষও দেখতে ঠিক মানুষের মতো—কিন্তু বাঘ দেখতেও ছাগলের মতো হয় না, ছাগল দেখতেও বাঘের মতো হয় না। 


৫১

দেশি, হুগা মারে বিশি— আসসালামু আলাইকুম— আপনারা কেমন আছেন? আমরা বাঙালি— আমরা সবাই মিলে ভালো আছি ☺।

ভুলের জঠরে: অস্তিত্ব, বিস্মৃতি ও আত্মপরিচয়ের অনির্বচনীয়তা


ভুলের জঠরে 

বায়তুল্লাহ্ কাদেরী


বলিঘোড়া খুব কাছে এসে হ্রেষা ডাকে:

উঠুন, সম্ভ্রান্ত। উঠুন এ পৃষ্ঠদেশে।

ভাবলাম, এই আরোহণ যদি হয় নদী-মদিরার দেশে

আর না ফেরার ? যদি হয় ভুলে-যাওয়া ঋণের চারণভূমি

তাহলে কি ঘোড়া স্থির হবে ঘূর্ণন রেখায় ?

আবহমানের কোল ঘেঁষে আমিও দাঁড়াই

ছিলাম, রয়েছি, রবো- এইভাবে মর্ত্যময় একজন ভাবে,

অন্যজন খুব ভোরবেলা অপরজনের কাছে এসে বলে

পৃথিবীতে যে লোকের জন্য দম বন্ধ হতে যাচ্ছিল রুহের ফেরেশতার 

তারও প্রশ্ন ছিল: ছিলাম, রয়েছি, রবো- এসবের মানে কি বলুন?

জনাব, জবাব দিয়েই তবে নিয়ে নিন আমার রুহের তোহফা।

ফেরেশতাটি থ' মেরে তাজ্জব! বলে কি এ গোয়ালার পুত !

ঝিয়ের পেটেই কি না মায়ের জন্ম! তাহলে ঝিটা

কার? কোথায় সে ছিল, রয়েছে কোথায়, কিংবা রবে

                                           কোন ভুলের জঠরে ?



কবিতাটি এক অস্তিত্ববাদী ভ্রমণ। বলিঘোড়া এখানে নিয়তির রূপক, যেটি মানুষকে টেনে নেয় অজানা গন্তব্যে। “ছিলাম, রয়েছি, রবো”—এই পুনরাবৃত্তি প্রশ্ন তোলে আত্মপরিচয়ের, সময়ের এবং জন্মের বোধ নিয়ে।


কবিতায় রুহ ও ফেরেশতার প্রসঙ্গ ইসলামী ভাবনায় মৃত্যু-পরবর্তী জিজ্ঞাসাকে জাগিয়ে তোলে, যেখানে উত্তর নেই, শুধু বিস্ময়। শেষদিকে “গোয়ালার পুত” বা “ঝিটা কার?” জাতীয় ভাষা ব্যবহারে কবি প্রচল সমাজের শ্রেণিবিভক্তি ও জন্মপরিচয়ের অন্ধতা নিয়ে রূঢ় কটাক্ষ করেছেন।


এটি এক ভাষাদায়ক বেদনাবোধকে স্পর্শ করে এবং স্পষ্ট করে  অথচ গভীর দর্শনকেলি কবিতা এটি—যেখানে মানুষ নিজের উৎস আর ভবিষ্যৎ দুটোকেই “ভুলের জঠর” বলে মনে করে।


একটি জটিল, গভীর দর্শনচিন্তায় আচ্ছাদিত কবিতা এটি—যা বাংলা কবিতার গতানুগতিক রোমান্টিকতা বা আবেগ-নির্ভর ধারা থেকে অনেক দূরে। বায়তুল্লাহ্ কাদেরীর এই কবিতা সময়, মৃত্যু ও আত্মপরিচয়ের প্রশ্নকে তীব্র অস্তিত্ববাদী ব্যঞ্জনায় তোলে— "ভুলের জঠরে” কবিতাটি পড়ে মনে হয়, কবি বুঝাতে চেয়েছেন—আমরা এমন এক বাস্তবতায় বাস করি যেখানে আমাদের ‘ভুলে’ রাখা হয়েছে। এই ভুল শুধুই বুদ্ধিবৃত্তিক নয়, বরং জুলুমের একটি কৌশল। একজন অস্থির মানুষ শিকড় খোঁজে না, সে স্থির হতে চায়। আর শাসকগোষ্ঠী ঠিক এটাই চায়—আপনি যেন স্থির হতেই ব্যস্ত থাকেন, উৎস না খোঁজেন। কবিতায় ফেরেশতা ও রুহের কথাও যেন সেই অস্থিরতাকে চিহ্নিত করে—শুধু অস্তিত্ব নয়, প্রশ্নও হারিয়ে ফেলা হয়েছে।


কবিতাটি মুক্তছন্দে লেখা, যা একে মুক্ত ভাবপ্রবাহে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে। ভাষায় সুর রয়েছে, কিন্তু তা নিয়ন্ত্রিত নয়—এটাই তার শক্তি। চিত্রকল্প জটিল, বহুবোধ্য। “থ’ মেরে তাজ্জব”, “গোয়ালার পুত”, “ঝিয়ের পেটেই কি না মায়ের জন্ম”—এইসব পঙ্‌ক্তি কাব্যিক অভিঘাতকে রূপান্তরিত করে।


ভুলের জঠরে” কবিতাটি মূলত এক ধরনের নিরাসক্তি ও নিঃশব্দ আত্মপরিচয়হীনতার কবিতা। এখানে নেই আবেগের বিস্ফোরণ, নেই ভালোবাসা বা ঘৃণার প্রকাশ—আছে শুধু এক অন্তর্গত উদাসীনতা, যা Anagapesis-এর চূড়ান্ত রূপ। কবির “ছিলাম, রয়েছি, রবো” পঙ্‌ক্তিটি যেন এক আত্মার নিঃসাড় পুনরাবৃত্তি—যেখানে অস্তিত্বের স্বীকৃতিও ক্লান্ত।

ফেরেশতার মুখে বিস্ময়, মানুষের মুখে প্রশ্ন, আর গোয়ালার পুত—সব মিলে গড়ে ওঠে এমন এক জগৎ, যেখানে সম্পর্ক, শোক, শ্রেণি বা জন্ম—সবকিছুই অনুভূতিহীন ব্যঞ্জনায় রূপান্তরিত। কবিতাটি বলে না “ভালোবাসা হারিয়েছে”, বরং বলে, “তা হারিয়ে যাওয়ার পরও যা থাকে না—সেই শুন্যতাই চূড়ান্ত— বলিঘোড়া”: এটি ভাগ্য, প্রলোভন বা মৃত্যুর দূত রূপে এসেছে, যেখানে আরোহনের ডাক রয়েছে— “নদী-মদিরার দেশ”: বিস্মৃতি বা চিরতরে হারিয়ে যাওয়া কোন জগৎ।



বায়তুল্লাহ্ কাদেরীর কবিতার একটি মজার দিক হলো সূচনালাইন যা বোধের রচনা অর্থাৎ একধরনের ভাব ও ভাষার আরোহন এবং অবরোহন প্রক্রিয়ায় যুক্তযুদ্ধ কিংবা মিলন কাতরতা— "বলিঘোড়া খুব কাছে এসে হ্রেষা ডাকে: উঠুন, সম্ভ্রান্ত। উঠুন এ পৃষ্ঠদেশে।" বায়তুল্লাহ্ কাদেরীর কবিতার শেষে থাকে দার্শনিক সংশয় আলাপ তবে আলাদা আলাপ যা ভাবকে ভাষা থেকে আলগা করে— এখানেও তার ব্যতিক্রম হয়নি—

''কোথায় সে ছিল, রয়েছে কোথায়, কিংবা রবে কোন ভুলের জঠরে?" 


মঙ্গলবার, ১৭ জুন, ২০২৫

তারপর গাধা

গাধাকে সিংহাসনে বসতে দিলাম। 

— তারপর 

গাধা সিংহাসনকে পীঠে নিলো। 

— তারপর 

সিংহাসনকে পীঠে নিয়ে গাধা হাটতে লাগলো। 

— তারপর 

সিংহাসনকে পীঠে নিয়ে হাটতে হাটতে গাধা দেশের বাইরে চলে গেলো। 

—তারপর 

সিংহাসনকে গাধা দেশের বাইরে রেখে আসলো। 

—তারপর 

তারপর গাধা আরেকটি বোঝাভার খুজতে লাগলো।

সত্য বলতে সত্যিই কিছু আছে!?

 সিনেমা বিনোদনের মাধ্যম— বিনোদনের মাধ্যমে সিনেমা  সমাজ, বিচার, নীতি ও মানবমনের জটিলতা অন্বেষণের এক শক্তিশালী রূপ— ব্যতিক্রমী এবং গভীর চিন্তনমূলক চলচ্চিত্র সৃজিত মুখোপাধ্যায় পরিচালিত “সত্যি বলে সত্যি কিছু নেই”। ২০২৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এই বাংলা চলচ্চিত্রটি একটি আইনি থ্রিলার, যা মূলত আমেরিকান ক্লাসিক 12 Angry Men এবং তার হিন্দি রূপান্তর Ek Ruka Hua Faisla-র আধুনিক ও প্রাসঙ্গিক বাংলা পুনরায় নির্মাণ।


চলচ্চিত্রটির কেন্দ্রে রয়েছে একটি বিচারপ্রক্রিয়া, যেখানে বারো জন জুরি সদস্য এক তরুণের বিরুদ্ধে খুনের মামলায় রায় দিতে বসেন। শুরুতে সবাই ছেলেটিকে দোষী বলে মনে করলেও, একজন সদস্য যুক্তির মাধ্যমে অন্যদের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে থাকেন। এই ধাপে ধাপে যুক্তি, তর্ক ও মানবিক বিবেচনার উত্তরণই চলচ্চিত্রটির আসল সৌন্দর্য। ঘটনাটি ঘটতে থাকে স্বপ্নের মাধ্যমে। এক ঘুমে বিচার শেষ— তাও মাতাল ঘুম। কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় অভিনয় করেছেন ব্রজেশ্বর দত্ত চরিত্রে—তিনি প্রধান বিচারপতি— তার বাড়িতে একটি পার্টির সময় একটি খুনের মামলার আলোচনা শুরু হয়। তারই ঘুমেই বিচারের কাজটা চলে।   


"সত্যি বলে সত্যি কিছু নেই" নামটিই চলচ্চিত্রটির দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির ইঙ্গিত দেয়। এখানে 'সত্য' আপেক্ষিক—যা আমরা চোখে দেখি, তা হয়তো পূর্ণ সত্য নয়। প্রত্যেক মানুষের অভিজ্ঞতা, সামাজিক অবস্থান ও মানসিক অবস্থা ‘সত্য’কে ভিন্নভাবে উপলব্ধি করে। এই চলচ্চিত্র আমাদের শেখায়, কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর আগে নিরপেক্ষ ভাবনায় এবং সহানুভূতিশীল দৃষ্টিতে বিষয়টি দেখা জরুরি।


চলচ্চিত্রটির সবচেয়ে বড় শক্তি এর অভিনয়— অভিনয়টা চলে থিয়েটার মোডে— সংলাপের আলাপ এখানে মুখ্যত আলোচনার দাবি রাখে।


কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়, পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়, ঋত্বিক চক্রবর্তী, অর্জুন চক্রবর্তীসহ প্রথিতযশা শিল্পীদের অভিনয়ে প্রত্যেক জুরি সদস্য এক একটি জীবন্ত চরিত্র হয়ে উঠেছে। সংলাপভিত্তিক দৃশ্যগুলিতে তাদের চোখের চাহনি, কণ্ঠস্বরে ওঠানামা, ছোট ছোট অঙ্গভঙ্গিতে ফুটে উঠেছে চরিত্রের গভীরতা।

সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের পরিচালনায় একঘেয়ে সেটিংও দর্শককে বেঁধে রাখে। একই ঘরে পুরো সিনেমা চললেও সংলাপ ও চরিত্রের মধ্যেকার উত্তেজনা কখনোই ক্লান্তি এনে দেয় না। চিত্রগ্রহণ, সম্পাদনা এবং আবহসংগীত অত্যন্ত সংযত ও অর্থবহ। সিনেমার সেট বানানো হয়েছে ছয়টি জায়গায়, ঠিক সিনেমার সেট নয়— বলতে গেলে আলোচনার সেট— রুমে, মাঠে, মাঠে মানে গল্ফ ⛳ মাঠে, সিনেমার হলে, ওভারব্রিজে, সাগরে এবং শেষে জঙ্গলে। জঙ্গল মানে মঙ্গল। জঙ্গলে বুঝতে পারে প্রত্যেকেই এই আলোচনাটা শুরু হওয়ার দরকার ছিলো সাতচল্লিশের আগে, তাহলে হিসাবটা অন্যরকম হতে পারতো। 


আজকের বিশ্বে যেখানে দ্রুত বিচার, গণমাধ্যমের চাপ এবং পক্ষপাতদুষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি বিচারব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছে, সেখানে এই চলচ্চিত্রটি এক সতর্কবার্তা। আমাদের মনে করিয়ে দেয়, প্রতিটি অভিযুক্ত ব্যক্তির পেছনে একটি জীবন, একটি গল্প থাকে—আর সেই গল্প শোনার দায় আমাদের।

পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় – চরিত্রের নাম সত্য, যিনি একমাত্র ব্যক্তি যিনি অভিযুক্তকে নির্দোষ মনে করেন এবং বাকিদের মত পরিবর্তনে প্রভাব ফেলেন। সত্যের এন্ট্রিতেই একধরনের চমক খেলে যায় মনে— তার কস্টিউম এতো সুন্দর লাগছিলো, বিশেষ করে চোখের চশমাটা— মনে হলো পরমব্রত নিজেকে যেনো খুজে পেলো। 


"সত্যি বলে সত্যি কিছু নেই" একটি সিনেমা এবং সিনেমার আদলে একটি  আয়না যা সমাজের বিচারব্যবস্থা, ব্যক্তিগত পক্ষপাত এবং নৈতিক দ্বন্দ্বগুলিকে প্রকাশ্যে আনে। এটি এমন একটি চলচ্চিত্র যা শেষ হওয়ার পরও দর্শকের মনে প্রশ্ন তোলে, আলোচনার জন্ম দেয় এবং আত্মবিশ্লেষণের সুযোগ তৈরি করে। এই চলচ্চিত্রটি শুধু ভাল সিনেমা প্রেমীদের জন্য নয়, বরং শিক্ষার্থী, বিচারপতি, আইনজীবী, শিক্ষকসহ সকল সচেতন মানুষের জন্যে— কারণ এখানে প্রশ্ন করা হয়েছে, “আমরা যা সত্য ভাবি, তা আসলেই কতটা সত্য?”


"সত্যি বলে সত্যি কিছু নেই" সিনেমাটি যদি 12 Angry Men এবং Ek Ruka Hua Faisla–র বাংলা রূপান্তর হয়, তবে এটির কাহিনি ও সংলাপ কি হুবহু মিলেছে?— উত্তর হল: আংশিক মিল রয়েছে, তবে এটি নিছক অনুবাদ নয়—বরং একটি সৃজনশীল পুনরায় নির্মাণ (creative adaptation)।


তাহলে মিল কোথায়?


মূল কাঠামো ঠিক রাখা হয়েছে— বারো জন জুরি—এক তরুণের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ— প্রাথমিকভাবে সবাই ছেলেটিকে দোষী বলে ধরে নেওয়া— এবং একজন সদস্য ধাপে ধাপে সন্দেহ জাগিয়ে বাকিদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দেওয়া—এই প্রেক্ষাপটটি মূল ছবির (12 Angry Men) মতোই।


কিছু গুরুত্বপূর্ণ যুক্তি ও নাটকীয় মুহূর্তও মূল সিনেমার ছায়া বহন করে। যেমন—

প্রত্যক্ষদর্শীর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন।

প্রমাণভিত্তিক সন্দেহের গুরুত্ব (reasonable doubt)।

সামাজিক ও মানসিক পক্ষপাত।


তাহলে এই সিনেমার পার্থক্য বা নতুনত্ব কোথায়?


বাংলার সংস্কৃতির উপযোগী করে সংলাপ রচিত হয়েছে। ব্যবহৃত শব্দ, ভঙ্গি, সামাজিক টানাপোড়েন— সবকিছুই আধুনিক কলকাতার প্রেক্ষিতে রূপান্তরিত— প্রতিটি জুরি সদস্যের পেছনে আছে ভিন্ন পেশা, শ্রেণি, এবং জীবন অভিজ্ঞতা, যা সৃজিত নিজস্ব ভঙ্গিতে পুনর্গঠন করেছেন— কিছু চরিত্রে নতুন মনস্তত্ত্ব যোগ করা হয়েছে। অনেক সংলাপ নতুনভাবে লেখা হয়েছে, যাতে বাংলা ভাষার নিজস্ব রস ও শৈলী বজায় থাকে— হুবহু অনুবাদ নয় বরং ভাবানুবাদ ও রূপান্তর ঘটেছে— সৃজিত মুখোপাধ্যায় নিজেই একাধিক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, এটি Ek Ruka Hua Faisla-র ‘রিমেক’ হলেও তিনি এটি “রিমিক্স নয়, রিইমাজিনেশন” হিসেবে তৈরি করেছেন।


রিইমাজিনেশন (Reimagination) শব্দটি মূলত একটি সৃজনশীল ধারণা, যার মাধ্যমে পূর্ব-বিদ্যমান কোনো সাহিত্য, সিনেমা, নাটক বা গল্পকে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি, নতুন প্রেক্ষাপট, এবং নতুন ব্যাখ্যায় পুনর্গঠিত করা হয়। এটি রিমেক বা রিমিক্স থেকে ভিন্ন, কারণ এখানে কেবল গল্পটি পুনরাবৃত্ত হয় না—বরং গল্পটির অন্তর্নিহিত ভাবনা বা থিমটিকে নতুনভাবে কল্পনা করা হয়। Reimagination = পুরনো গল্প + নতুন চোখে দেখা + নতুন বাস্তবতায় রূপান্তর।


১৯৮০–৯০ দশকের দিকে এই শব্দটি জনপ্রিয় হতে শুরু করে, বিশেষ করে চলচ্চিত্র ও সাহিত্য বিশ্লেষনে—হলিউড ও ব্রিটিশ ফিল্ম থিওরিস্টরা প্রথমে “reimagining” বা “reimagination” শব্দটি ব্যবহার শুরু করেন, যখন পুরোনো ক্লাসিক চরিত্র (যেমন: শার্লক হোমস, ব্যাটম্যান, সুপারম্যান, রোমিও-জুলিয়েট ইত্যাদি) আধুনিক ভাষা, প্রেক্ষাপট ও দর্শনে ফিরে আসতে শুরু করে। তাই বলছি, Reimagination শব্দটি ভাষাবিজ্ঞান বা অভিধানের নির্দিষ্ট আবিষ্কার নয়— শিল্প ও সংস্কৃতির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে বই, চলচ্চিত্র ও নাটকের জগতে জন্ম নিয়েছে এই শব্দটি। 


এই সিনেমাটি যে একটি রিইমাজিনেশন তার প্রমাণ আমরা পাই যখন দেখি ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের সীমানা পেরিয়ে কোনো চরিত্র সিদ্ধান্ত দিতে পারছে না ঠিক তখন। আমাদের বাঙালিরদের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা জাতিগত উপলব্ধির  জায়গায় আমরা খুব গরীব এবং কৃপন।  জাস্ট কোপন বা লটারি দিয়ে এই জাতির মননে লোভ জাগ্রত করা যায়। আমাদের পার্সোনাল দ্বন্দ্ব জাতিগত দ্বন্দ্ব উস্কানিতে রাখে— আহারে আমাদের কোনো সামষ্টিক ঘৃণা বা ভালোবাসা নেই! 


"সত্যি বলে সত্যি কিছু নেই" সিনেমাটির নামকরনে মনে হয় যেনো এটি একটি দার্শনিক জার্নি। সিনেমা দেখতে দেখতে মনে হতে থাকে  আলোচনাটা হালকা অতীত রাজনৈতিক, আরেকটু সামনে গিয়ে মনে হয় আলোচনাটা সামাজিক লুচিমাংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, সবশেষে গিয়ে বুঝতে পারি সিনেমাটা আসলে একজন মাতালের জেগে উঠার গল্প— ঘোরগ্রস্ত বাঙালির ঘুম শেষে সকালের খবর যেনো চেতনার আলো নিয়ে এলো।  তবে একটি কথা আমাকে বলতে হবে— কাওয়ালি গানটার টাইম অব ইন্টারেস্ট দারুণ ছিলো কিন্তু ডট ডট ডট!  কিন্তু কাওয়ালি গানটি আরও সুন্দর করে উপস্থাপন করা যেতো, সেট আরও ভালোভাবে সাজানো যেতো, গান নির্বাচন আরও দারুণ হতে পারতো। কিন্তু হলো না।  


সিনেমা শুরু হচ্ছে বাতাসের শব্দ দিয়ে কিন্তু প্রথম দৃশ্যে নাস্তার টেবিল। নাস্তায় ভাত নেই,আলুর ভর্তাও নেই, লুচিকুচিও নেই— আছে ব্রেড,আছে জেলি, আছে জুসের গ্লাস। আর চরিত্রের সংলাপে গার্হস্থ আলোচনা— কলকাতার একেবারে উঁচু শ্রেনির আলাপ— বিয়ে না করা, সিনেমা নির্মাণ এবং ক্যারিয়ার, অফিস পলিটিক্স অথবা ইদুরদৌড় ইত্যাদি ইত্যাদি। তারা আবার রুটি কাটে, সরি, ব্রেড— চামচ দিয়ে কেটে খায়। আর পার্টিতে হাবুল দা আসতে পারবে না— কারন তার শরীরটা মেজমেজ করতেছে। কিন্তু একজন হাবুল দার জন্যে পার্টি তো আর থেমে থাকে না। উঁচু শ্রেণির পার্টি সারাবছর লেগেই থাকে। হাবুল দা পার্টিতে না আসতে পারলেও বিচারপতির স্বপ্নে কিন্তু ঠিকই আসে— শুধু আসে না, এসে একেবারে বিচার জমিয়ে তুলে। বিচারের মোড় ঘুরিয়ে দেয় একজন মাত্র ব্যক্তি— সত্য। সত্য বারবার বলতেছে একটি কথা— ছেলেটিকে গিল্টি বলার আগে আমাদের মগজ ব্যবহার করা প্রয়োজন। এবং একের পর এক প্রশ্ন তুলতে থাকে, তার প্রশ্ন উঠতে থাকে, ক্যামেরার কোলাজ শট দারুণভাবে উঠানামা করতে থাকে— বিষয়টি সুন্দর। সিনেমার কালার যথেষ্ট স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করা হয়েছে এবং চেষ্টা অপচেষ্টার অবয়ব না পেয়ে প্রচেষ্টার নাম নিয়েছে বলা যায়। সত্যিই সিনেমাটি বহুদিক থেকে আলোচনা সমালোচনা পণ্যোৎপাদন-পর্যালোচনা করার মতো একখান সিনেমা।

এই সিনেমা একটা ম্যাসেজ দিতে চেয়েছে— তা হলো স্বাভাবিক বিচার প্রক্রিয়ায় স্বাভাবিক মানুষ থাকা জরুরি বিচারক হিসেবে। কোনো ট্রমায় আক্রান্ত মানুষ সুস্থ হওয়ার দাবি রাখে— সমাজকে সুস্থ করার দায়িত্ব নিতে পারে না— একজন ট্রমায় আক্রান্ত মানুষ তার সাথে ঘটে যাওয়া অন্যায় বা অস্বাভাবিক আচরণ দিয়ে পৃথিবীর তাবৎ আচরণের গতিবিধি জাজ করতে থাকে— সে তখন নিজেই একটা কমেন্টবক্স যেখান থেকে একই দৃষ্টিকোন বারবার বের হতে থাকে— ফলে বহুচলক পথের মধ্যে দিয়ে স্বাভাবিক সত্য আবিষ্কার করা যায় না। তাই সিনেমাটি একটি প্রতীকধর্মী মেজাজে গল্পের শরীরে লাইট ক্যামেরা এ্যাকশন হয়ে কাজ করেছে। প্রকৃতির একটা সুন্দর দিক হলো তাকে বহুদৃষ্টিকোন থেকে ব্যাখ্যা করা যায়, তারপরও মনে হয় আরও আরও ব্যাখ্যা করা যায় আরও আরও দৃষ্টিভঙ্গির জায়গা থেকে।  এই সিনেমাটি যাপিত জীবনের প্রকৃতিকে ধরতে পেরেছে— ফলে এই সিনেমাটিকে বহুদূর পথচলা মুসাফির মনে হচ্ছে যার ঝুলিতে লেগে আছে লেপ্টে আছে অনেক অভিজ্ঞতা, প্রজ্ঞা ও সত্যজিজ্ঞাসার ছাপ।

মঙ্গলবার, ২৭ মে, ২০২৫

ত্যাগানন্দ


আমার জন্যে প্রথম শাড়ি পরেছিলে যখন 

আমার মনে তখন পাঞ্জাবি ইদ 

তোমার শরীরে নামায পরে পালন করি ইদ উল ফিতর 

একবার ডুবে যাই আমি 

একেবারে ডুবে যাই আমি তোমার রক্তের ভেতর 

শাদা শাদা রক্তের ভেতর প্রেমের আযান 

রক্তনদী পারি দিয়ে চুপ করে বসে থাকি 

জলের শব্দে দিন আসে না 

ঢেউ উঠে না স্থলে 

কামের ঢেউয়ে প্রেম ভাঙে 

ইলমুল ইয়াকিন

আইনুল ইয়াকিন

হাক্কুল ইয়াকিন— একবার বুক দেখায় 

                          একবার পীঠ দেখায় 

আমার হৃদয়ে বয়ে যাওয়া মরুভূমির গাঙে 

তোমার ভরা গাঙে ভোগের তুফান 

আমার মনে তখন ইদ উল আযহা

নিজের ভেতরে 

নিজের সাথে 

নিজেরে দিয়েছি প্রভুর নামে কোরবান

রবিবার, ২৫ মে, ২০২৫

ট্রেন নিয়ে ভাবনা

 আমরা যখন ট্রেনে চড়ি, যাত্রাপথের সময়টা অনেকেই কাটাই মোবাইল স্ক্রলে, আলাপচারিতায়, কিংবা নিছক অবসর কাটিয়ে— কিন্তু এই সময়টাই হতে পারে পাঠচর্চা আর মননের নতুন জানালা। কল্পনা করুন, প্রতিটি ট্রেনে যদি থাকে একটি ছোট্ট লাইব্রেরি! বইয়ের সুবাস, শান্ত পরিবেশ, আর কিছু জ্ঞানতৃষ্ণু সহযাত্রী — একটা ট্রেনভ্রমণ তখন হয়ে উঠবে একেবারে ব্যতিক্রমী অভিজ্ঞতা।


যাত্রা মানেই যেন শুধু গন্তব্য নয় — নতুন জ্ঞান, নতুন ভাবনার শুরু।


তবে শুধু উদ্যোগ নিলেই হবে না, রক্ষা করতে হবে এর মৌলিক উদ্দেশ্যকে। যেমন আজকের ক্যান্টিন বা ক্যাটারিং সার্ভিসে দেখা যায় — দালালচক্রের দখলে যায় সব, সাধারণ যাত্রীরা বঞ্চিত থাকেন। তাই প্রস্তাব, লাইব্রেরি ও ক্যান্টিন ব্যবহারের অধিকার থাকবে শুধু টিকিটধারী যাত্রীদের জন্য— টিকিট ছাড়া কেউ প্রবেশ করতে পারবে না। ডিজিটাল এনফোর্সমেন্ট ব্যবস্থা থাকলে এই নিয়ম বাস্তবায়ন কঠিন হবে না।


শুধু ট্রেন নয়, প্রতিটি বড় রেলস্টেশনেও থাকতে পারে একটি ঘর — লাইব্রেরি, একটি স্বাস্থ্যকর কফিশপ বা চা স্টল, আর প্রার্থনার জায়গা যেমন থাকবে, তেমনি থাকবে "জ্ঞানঘর" — যেখানে মানুষ জানতে পারবে কেন প্রার্থনা করে, কার জন্য করে, কীভাবে চিন্তা ও অনুভব গভীর হয়— আধুনিক সময় কেমন করে বিজ্ঞানের উপর ভর করে আছে। 


শুধু অবকাঠামো নয়, আমাদের দরকার চিন্তার পরিবর্তন। লাইব্রেরি গড়ে তোলার সাথে সাথে আমাদের গড়তে হবে পাঠকও।


কল্পনা করুন, আপনি বসে আছেন ট্রেনের মাঝামাঝি ছোট্ট এক সবুজ বাগানে— চারপাশে পাতার ফিসফাস, হাওয়ার মৃদু দোলা, হাতে ধরা এক কাপ গরম কফি বা লাল চা — আর হৃদয়ের গভীরে শুরু হয় এক নিঃশব্দ ভাবনা— এই বাগানেই আছে ছোট্ট একটি কফিশপ, যেখানে প্রতিটি চুমুক মানে আত্মার আরাম।


কিছু দূরে, ট্রেনের বুকে একটি সাউন্ডপ্রুফ থিয়েটার রুম— যেখানে বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ সিনেমা টিকিট কেটে দেখা যায় যাত্রাকালে । শঙ্খচিলের কান্না, পদ্মার ডাক, কিংবা একালের কোনো সাহসী গল্প — বড়পর্দায় জীবন্ত।


প্রত্যেক বগিতে রয়েছে একটি ডিজিটাল স্ক্রিন, প্রতি এক ঘণ্টা পর পর ভেসে ওঠে — বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, নদী, পাহাড়, শেকড় আর গান। গল্পের মতো করে বলা হয়, “এই যে তুমি যাচ্ছো — জানো কি এই পথের পাশেই জন্মেছিল এক কবি?” “এই স্টেশনেই একদিন নেমেছিলেন এক বীর যোদ্ধা!”


শিশু, কিশোর, প্রবাসী, বৃদ্ধ — সবার চোখে নতুন আলো।

আর ট্রেনের এক কোণে  একটি প্রার্থনালয়— একেবারে পরিচ্ছন্ন, তেলাপোকার বাসাবিহীন। তার পাশেই একটি ডিসপেনসারি, আছে একজন অভিজ্ঞ ডাক্তার, একজন সেবাপরায়ণ নার্স — যেন যাত্রাপথে হঠাৎ অসুস্থতাও পায় মমতার ছোঁয়া।


বাংলাদেশ রেলওয়ে, আমরা চাই এমন এক ট্রেন — যেখানে শুধু গন্তব্য নয়, থাকে চিন্তা, পাঠ, সিনেমা, সেবা ও সংস্কৃতির গভীর ছায়া।

আমরা চাই, এই স্বপ্নট্রেন বাস্তব হোক।

চলন্ত বাংলাদেশ হোক সৌন্দর্যে পূর্ণ এক যাত্রা।


এটা কেবলই স্বপ্ন নয় — এটা হতে পারে বাস্তব, যদি আমরা সকলে চাই।


আরিনা পেমি — এক পাহাড়ি মেয়ে, চাকমা বাবার আর বাঙালি মায়ের মেয়ে। ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, কিন্তু মন পড়ে থাকে পাহাড়েই। এবার সে ফিরছে নিজের শিকড়ে — "স্বপ্নট্রেন"-এ চড়ে।


ট্রেনটা যখন চট্টগ্রাম পেরিয়ে পাহাড়ে ঢুকে পড়ে, জানালার কাঁচে মুখ রাখে আরিনা। তার চোখে তখন আলোয় ধোয়া সবুজ পাহাড়, যেন মায়ের আঁচলের মতো কোমল। জুমের ক্ষেতগুলো নিচে ঝুঁকে আছে, যেন পাহাড় নিজেই প্রণাম করছে যাত্রীদের।


ট্রেনের ভেতরের স্ক্রিনে ভেসে ওঠে এক কাব্যিক ভাষ্য:

"এই যে ডান পাশে যে গ্রামটা দেখছেন, ওখানে জন্মেছিলেন রাখাইন বয়নশিল্পী মামা থোয়াই। তাঁর হাতে তৈরি একখানা গামছা আজও জাদুঘরে রক্ষিত..."


আরিনা হঠাৎ চমকে ওঠে। সে তো এই গল্প জানত না! নিজের মাটির এমন ইতিহাস সে কখনও জানেনি — শহরের পাঠ্যপুস্তকেও না, লোকমুখেও না।


ট্রেনের মাঝখানে ছোট্ট সেই বাগান আর কফিশপে বসে সে এক কাপ লাল চা খায়। পাশে বসে থাকা বৃদ্ধ এক মারমা দাদু তাকে বলেন বান্দরবানের লোকগান, আর ট্রেনের থিয়েটার রুমে শুরু হয় "মনপুরা" সিনেমা। কাচের ভেতর জ্বলজ্বলে পর্দা, আর বাইরের প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম সে দৃশ্যপট — আরিনা কখনো কেঁদে ফেলে, কখনো হেসে ওঠে।


একটা ছোট ছেলেকে হঠাৎ পায়ে ব্যথা পেয়ে কাঁদতে দেখে সে নিয়ে যায় ডিসপেনসারিতে, যেখানে সেবিকা তাকে স্নেহভরে সেবা দেন।

আরিনা ভাবে,

"এটা কি সত্যি? আমি কি স্বপ্নে আছি?"


রাঙামাটি পেরিয়ে খাগড়াছড়ি, বান্দরবান হয়ে যখন ট্রেন কক্সবাজারে এসে দাঁড়ায়, তখন সূর্য অস্ত যাচ্ছিল সমুদ্রের মুখে।

আরিনা ট্রেন থেকে নামবার আগে জানালায় একবার চোখ রাখে — পাহাড়ের সেই কুয়াশায় ঢাকা মুখ যেন তাকে বিদায় জানায়।


তার চোখে জল, কিন্তু ঠোঁটে হাসি।

এই ট্রেন তার কাছে শুধু একটা বাহন নয় —

এ এক চলন্ত পাঠশালা, এক বাগান, এক সিনেমা হল, এক ছোট্ট বাংলাদেশ।

আর সে বুঝে যায়, "বাংলাদেশকে জানার সবচেয়ে সুন্দর পথ হতে পারে এমনই এক ট্রেনজার্নি।"