শুক্রবার, ৩১ অক্টোবর, ২০২৫

জাহাজ জলে চলে চলে

জলের আরেক নাম জীবন আমরা সবাই জানি কিন্তু জীবনকে কেমন করে ব্যবহার করতে হবে তা নিয়ে আমাদের গবেষণা নাই। জল খাবারের ব উৎস— এই নিয়ে সুন্দর গবেষণা হতে পারতো— গবেষণা হলে নদীকে কেন্দ্র  করে দারুণ অর্থনৈতিক এলাকা গড়ে উঠতো বাংলার— গবেষণা হয়নি বিধায় নদীর উপযোগিতা আমাদের কাছে পরিষ্কার না— নদী কেবল মাছের উৎস এমন না— নদী ফসলেরও যোগ্য জায়গা যা নদীর পাড়ের মানুষ জানে না— আমাদের জাহাজ নদীর দুপারের মাঝ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে আপন গতিতে— আমাদের জাহাজ শীতলক্ষ্যার চিকন শরীর দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে— এগিয়ে যাচ্ছে মেঘনা নদীর দিকে— দুপাশে উঁচু উঁচু দালান মিলফ্যাক্টরি— ঢাকার শীতলক্ষ্যার দুপাশ মানে আলোর ঝলকানিতে মুখরিত।


রাতের এখন শিশুকাল— একটু আগে এশার নামাযের আযান কানে আসে দূর মসজিদ থেকে— মুয়াজ্জিন বলতেছেন কল্যানের পথে আসো— حي على الصلاة (Ḥayya ʿalaṣ-ṣalāh)— অথচ শীতলক্ষ্যার যত অকল্যাণ করা যায় যতভাবে ক্ষতি করা যায় সবই আমরা করে ফেলেছি! তাই ক্ষয়ক্ষতির জাবেদা রেওয়ামিল করতে করতে চূড়ান্ত হিসাবের ব্যালেন্স জের মিলানোর সময় এখন জাতির হাতে নাই!


আমরা এখন জাহাজের হাতে, আমাদের জাহাজকে মনে হচ্ছে একটি পরিপূর্ণ দ্বীপ— দ্বীপ এগিয়ে যাচ্ছে দ্বীপ দেখতে দেখতে।  আমাদের জাহাজ শীতলক্ষ্যা হয়ে মেঘনা হয়ে বলাই নদী হয়ে ঘোড়াউত্রা নদী হয়ে ধনু নদী হয়ে ধর্মপাশার জয়শ্রীর পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া সুরমা নদীকে কিছুটা স্পর্শ করে তাহেরপুরের  ডাম্পের বাজারের শরীরপার্শ্ব জলশহরে নোঙর করবে—জাহাজের যাত্রা দক্ষিণপন্থী— দক্ষিণ দিকে কয়েকদিন আমাদের বসবাস। 


দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউনের উপকূল থেকে প্রায় সাত কিলোমিটার দূরে আটলান্টিক মহাসাগরের বুকে এক নিঃসঙ্গ দ্বীপ—রোবেন আইল্যান্ড— আয়তনে মাত্র ছয় বর্গ কিলোমিটারের এই দ্বীপটি শুধু একটি ভৌগোলিক স্থান নয়; এটি বর্ণবাদ, কারাবাস ও মানবাধিকারের জন্য সংগ্রামের এক জীবন্ত স্মারক। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে রোবেন আইল্যান্ডকে ব্যবহার করা হয়েছে বন্দীশালা হিসেবে— দ্বীপটির চারপাশে সুনিপুণভাবে ছড়িয়ে থাকা প্রবল স্রোতের কারণে এটি ছিল প্রায় অব্যর্থ কারাগার। বন্দীরা একবার এখানে পৌঁছালে আর ফিরে আসার পথ ছিল না। এই কারণেই এটি ‘মরণফাঁদ’ নামে পরিচিত হয়ে উঠেছিল। 


এই দ্বীপেই শুরু হয় এক মহান নেতার দীর্ঘ নিঃসঙ্গতার অধ্যায়। ১৯৬৪ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম প্রধান নেতা নেলসন ম্যান্ডেলাকে রোবেন আইল্যান্ডে বন্দী করা হয়। তিনি এখানে কাটিয়েছেন জীবনের ১৮টি বছর—একটি ছোট্ট কক্ষে, যেখানে জানালা দিয়ে দেখা যেত কেবল দেয়াল আর কঠোর পাহারা।


কারাগারের ভিতর ম্যান্ডেলাকে শুধু নিপীড়নই সহ্য করতে হয়নি, তাঁকে কঠোর শারীরিক শ্রমও করতে হতো। প্রতিদিন চুনের খনি থেকে পাথর কাটতে পাঠানো হতো তাঁকে এবং তাঁর সহবন্দীদের। কৃষ্ণাঙ্গ বন্দীদের জন্য খাবার বরাদ্দ ছিল সবচেয়ে কম। যোগাযোগের সুযোগ ছিল সীমিত—চিঠি আসত ছয় মাসে একবার, সেটিও সেন্সরের ছেঁটে দেওয়া কপি।


তবুও, এই বন্দীদশার মধ্যেও ম্যান্ডেলা থেমে থাকেননি। তিনি অন্যান্য বন্দীদের মাঝে শিক্ষা ছড়িয়ে দেন, আলোচনার মাধ্যমে তৈরি করেন রাজনৈতিক চেতনা, নিজের ভেতরে গড়ে তোলেন অটল সহিষ্ণুতা ও ক্ষমাশীলতার এক দীপ্তিমান চরিত্র— A Long Walk to Freedom. 


১৯৮২ সালে তাকে অন্য একটি কারাগারে স্থানান্তর করা হয়—১৯৯০ সালে তিনি মুক্তি পান— ১৯৯৪ সালে তিনি হন দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট— একটি ঐতিহাসিক পালাবদলের নায়ক।


আজ, রোবেন আইল্যান্ড আর কোনো বন্দীশালা নয়— এটি এখন একটি জাদুঘর ও UNESCO বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান। প্রতিবছর হাজার হাজার পর্যটক আসেন এখানে, ম্যান্ডেলার কারাকক্ষটি দেখেন, সাবেক বন্দীদের কাছ থেকে শোনেন ইতিহাসের জবানবন্দি।


এই দ্বীপ আমাদের শেখায় সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ালে কঠিনতম বন্দীত্বও একটি জাতিকে জাগিয়ে তুলতে পারে। নেলসন ম্যান্ডেলা তাঁর জীবন দিয়ে প্রমাণ করে গেছেন, স্বাধীনতা শুধু বাহ্যিক নয়, এটি আত্মিক সাহসের প্রতিফলন।

রোবেন আইল্যান্ড তাই কেবল এক দ্বীপ নয়, এটি একজন মানুষের অমর আত্মত্যাগের স্মারক, একটি জাতির মুক্তিযাত্রার প্রতীক।


দ্বীপজাহাজে পায়চারি করতে করতে রোবেন দ্বীপের কথা মনে আসে— জাহাজে করে এই রোবেন আইল্যান্ডে কবে যাবো ভাবতে ভাবতে রাত দুটো বেজে গেছে এবং আমাদের টাইগার জাহাজ শীতলক্ষ্যা ছেড়ে মেঘনাতে পতিত হয়েছে। আমার হাতে তখন কফির পিয়ালা— কেউ জেগে নেই— জেগে আছে নদী মেঘনা আর আমি, আর আমাদের বন্ধুযান টাইগার জাহাজ। ইতিমধ্যে আমরা অনেকগুলো ব্রিজ অতিক্রম করেছি— কাঞ্চন ব্রিজ থেকে আমাদের যাত্রা শুরু— তারপর ব্রিজ আর ব্রিজ— শীতলক্ষ্যা যেনো ব্রিজের স্বীকৃতি দেয়ার জন্যে জন্ম নিয়েছে। 


ঢাকার শীতলক্ষ্যা, আরও নির্দিষ্ট করে বললে নারায়নগঞ্জের শীতলক্ষ্যা যখন মেঘনাতে এসে নিজের শরীর রাখে ঠিক তখনই মুন্সিগঞ্জের ধলেশ্বরী মেঘনা নামে নিজের পরিচয় জানান দেয়। 


বালুয়াকান্দি— মুন্সীগঞ্জ জেলার গজারিয়া উপজেলার একটি ইউনিয়ন। মেঘনা সেতু পেরিয়ে কিছুদূর গেলে বালুয়াকান্দি ইউনিয়নে প্রবেশ করা যায়। গজারিয়া হচ্ছে মুন্সীগঞ্জ জেলার একটি প্রশাসনিক উপজেলা। মেঘনা ব্রীজের আগে (ঢাকা থেকে গেলে) গাজীপুর ইউনিয়নের (সোনারগাঁ/নরসিংদী) অংশে মেঘনা ঘাট। মেঘনা ঘাট পণ্যবাহী ট্রাক, নৌযান, ফেরি ও ট্রলার চলাচলের এলাকা। মেঘনা ঘাটে অনেক সময় পণ্য লোড-আনলোড, জেলে কার্যক্রম ইত্যাদি চলে। মেঘনা সেতু (মেঘনা ব্রীজ)— এটি ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগের সংযোগকারী গুরুত্বপূর্ণ একটি সেতু। তবে আশুগঞ্জ এবং ভৈরব সেতুকে কিন্তু মেঘনা ব্রিজ বা সেতু হিসাবে ভাবার কোনো কারন নেই— এই সেতুর নাম সৈয়দ নজরুল ইসলাম সেতু যতটুকু আমার ধারনায় আছে। 


শীতলক্ষ্যা নদীর আশেপাশে ব্যাপক পরিমানে শিল্পায়ন হয়েছে— মেঘনা কিছুটা রেহাই পেয়েছে কিন্তু কতদিন পাবে আমরা জানি না। শীতলক্ষ্যা নদীর মাথার উপরে আমার কাছে ফিল হলো ব্যাপকভাবে ব্রিজের উঠানামা হয়েছে। রাতের যাত্রাদৃশ্যে শীতলক্ষ্যা একেবারে পার্লারে সজ্জিত কোনো এক হোটেল বালিকা— কোথাও গ্রামীণ বা প্রাকৃতিক অন্ধকারে স্পর্শ বলার মতো করে দেখতে পাইনি— যা পেয়েছি তাতে কেবল কষ্ট বাড়ে। কাঞ্চন ব্রিজে এখনো দূষণথাবা ততটা তীব্র হয়নি— কাঞ্চন ব্রিজ থেকে কাচপুর ব্রিজে যাওয়ার পথটায়  দেখেছি নদীর কান্না— কাচপুর ব্রিজে এসে দেখেছি নদী ও বাতাসের কান্না— শিল্পায়নের নামে দৈত্যায়ানের ভয়াল ভয়ঙ্কর অবয়ব! তখন আরও স্পষ্ট হয়ে স্পর্শ করে নেলসন ম্যান্ডেলার সংগ্রাম ইতিহাস— নেলসন ম্যান্ডেলা বন্দী ছিলেন রোবেন দ্বীপে আর আমরা বন্দী আছি দূষণদ্বীপে— সবপাশে দূষণ আর দূষণ, ভেজাল আর ভেজাল— খাবারে ভেজাল, খবরে ভেজাল, কলমে ভেজাল, চলনে ভেজাল— ভেজাল আর ভেজাল! পদ্মা যেমন করে সবকিছু ভেঙে নিয়ে যায় শীতলক্ষ্যা তেমন করে ভাঙে না তার পাড়— তাই শীতলক্ষ্যার উদারতার সুযোগ নিয়েছে উদার নিষ্ঠাবান নিষ্ঠুর মানুষ! 


আপনি বলতে পারেন মিল ফ্যাক্টরি না হলে আমরা খাবো কী?  ভাইরে ভাই, আপনি চোখখুলে মনের তালা ওপেন করে দেখুন, মিল ফ্যাক্টরি আমাদের খাবার কেড়ে নিয়েছে— তারা আমাদের দিয়েছে এক, নিয়েছে অনেক। আজকে বাংলাদেশের মা— নদী: হুমকির মুখে। বাংলাদেশের প্রধান শক্তি— কৃষি: হুমকির মুখে! তারপরও মিলফ্যাক্টরি করার কুড়কুড়ি থাকলে আপনি করেন— সামগ্রিক নিয়ম মেনে করেন। নিয়ম তো মানবেন না— নিয়ম না মেনে মান্যবরদেরকে টেবিলের নিচ দিয়ে কতিপয় সুবিধাজনক তরল দিয়ে দিবেন আর কি!  আর কি লাগে!! চলছে নিয়ম সিসিমপুরে!! অথচ আমাদের পাঠ্যবইয়ের সাদা সাদা পাতায় কালো কালো অক্ষরে লেখা ছিলো— Every citizen owes allegiance to  the state to which he belongs. This implies the duty of defending the state in case of war and service and loyalty to the state to maintain its integrity. Its the duty of every citizen to defend the state against all enemies and danger and to assist in the maintenance of peace and order. The state can call upon any citizen to take up arms in its defence. 


অথচ আমরা যারা মহান নাগরিক আছি বা আছে— আমরাই  হয়ে উঠেছি দেশের ভেতরে সুবিধাময় দেশ যা সামষ্টিক জনগণকে অসুবিধায় ফেলছে। নট বাই চয়েজ বাট বাই চান্স নীতিতে কোনো পতাকা পেলে এমনটা হওয়া স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়ায়!


ঘুম থেকে উঠে দেখি আমাদের জাহাজ আশুগঞ্জে— একপাশে নরসিংদীর তুলাতুলি গ্রাম আরেকপাশে বা পূর্ব পাশে অলসচর। অলসচর পানসে নদী ও মেঘনা নদীর মাঝখানের একটি চর। এই অলসচর দারুণ উর্বর এবং সম্ভাবনাময় এবং এটি চট্রগ্রাম বিভাগের সর্বশেষ চর অথচ একে উপযোগী করে তুলার মতো সুন্দর দক্ষ মানসিকতা আজও দেখতে পাওয়া যায়নি— বন্যা না হলে বর্ষার জলে এই চর ডুবে যায় না।১৯৯৫ সাল থেকে দুই হাজার দশ সাল পর্যন্ত দেখতাম এই অলসচরে দারুণ তরমুজ এবং আলু চাষ হতো— দারুণ মানে আসলেই দারুণ! আর এখন শিয়ালের আবাসভূমি— রাতে ওঠে থেকে থেকে শেয়ালের হাঁক! এই চরে বেলেমাটির প্রভাব বেশি— তবে এটেল মাটির দেখাও মিলে। যেহেতু এটেল মাটির প্রভাব কম তাই মিশ্র মাটির চর হিসাবে তাকে ধরা যায় না। অলসচরে এখন একেবারে চাষটাস হয় না এমন না, হিরা চাষ করে, কুমড়া চাষ করে, ডালের চাষ হয় কিন্তু খুবই অল্প পরিমানে— মানে গল্প করার মতো না।  মালদ্বীপের মাফুশি দ্বীপের প্রায় তিনগুণ আশুগঞ্জের এই অলসচরের শরীর এলাকা। ছোটো ছোটো কটেজ করে, বাগান করে, খেলার মাঠ করে, আরও সুন্দর নানন্দিকতার ছাপময় পরিবেশের আয়োজন করে এই অসলচর থেকে বছরে এক হাজার কোটি টাকা খুব সহজেই সম্ভব আয় করা— নতুন কিছু করার মানসিকতা আমাদের নেই— আমাদের আছে পুরাতন মানসিকতা— হামলা মামলা, কামলা হামলা! 


অলসচরের পাশেই আশুগঞ্জ ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেডের বিশাল কোলোনি, অলসচর যখন পার হচ্ছি তখন পশ্চিম দিকে চোখ পড়াতে দেখতে থাকি কোহিনূর জোট মিল— বিশাল এলাকা নিয়ে গড়ে উঠেছিল এই পাটকল— এখন এখানে আগাছাপরগাছার ঘরবসতি— বাংলাদেশের পাটকল শিল্পকে দিনের পর দিন তিলে তিলে হত্যা করা হয়েছে, বলতে পারেন, আগের মতো তো বর্ষা হয় না, পাট চাষ করে কৃষক করবে কি? পাট থেকে তার আশকে আলাদা করার জন্যে তো পানির প্রয়োজন। কথা সত্য। আরেকটি সত্য কথা কি জানেন, মানুষ তার প্রয়োজনে আবিষ্কার করতে শিখেছে, সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে নতুন নতুন আবিষ্কার করে মানুষ হয়েছে স্বনির্ভর— আগে মানুষ দই খেতো, এখনো খায়, আগে মাটির পাত্রে দই পাততো, এখন অনেক ভার্সন আবিষ্কার হয়েছে দুধ থেকে দই পাওয়ার জন্যে কিন্তু পাটের চাষের সময়নিষ্ঠ সময়নির্ভর ফর্ম এখনো আবিষ্কার হয় নাই! হয়েছে বটে, তবে আমাদের তটে তার সাক্ষাৎ নাই— তাই পাটকল মারা যায়— অর্জন বর্জ্যে যায়!


আর আশুগঞ্জ ফার্টিলাইজার লিমিটেড কোম্পানির কথা কি বলবো— বারো মাসের মধ্যে নয় মাসই সার উৎপাদন বন্ধ থাকে— যন্ত্রপাতি পুরাতন হতে হতে ক্ষয় হয়ে ক্ষয়সাগর হয়ে যাওয়ার অবস্থা— বাজেট আসে বাজেট খায় কিন্তু আশুগঞ্জ ফার্টিলাইজার কোম্পানির মুমূর্ষু অবস্থার কোনো পরিবর্তন নজরে আসে না। 


নাস্তার ডাক আসে— প্রথম দিনের প্রথম নাস্তা। নাস্তা করছি আর দেখছি আশুগঞ্জ চর সোনারামপুর— এটি একটি দ্বীপগ্রাম— এখানে মাজারও আছে মসজিদও আছে, আছে মন্দির, মুসলমান পরিবারের সংখ্যা কম, আর্থিকভাবে স্বচ্ছল পরিবারের সংখ্যাও কম— এখানে প্রকৃতির অবস্থান অধিক। একপাশে আশুগঞ্জ নদী বন্দর, আরেকপাশে ভৈরব বাজার। এই দ্বীপের অধিকাংশ মানুষ জেলে ছিলেন— এখন তো নদীতে আর তেমন মাছ নাই— তাই তারা বেছে নিয়েছে বিকল্প। আমাদের নাস্তা তে একটা দারুণ মাছ দিয়েছে আয়োজকরা— লইট্টা মাছ— লইট্টা মাছ (ইংরেজি: Bombay Duck, বৈজ্ঞানিক নাম: Harpadon nehereus) মাছ মূলত সামুদ্রিক মাছ— মেঘনা নদীতে ভাসমান জাহাজে বসে বসে এই মাছ খেতে খেতে ভাবছি এই মাছটা কি জানে বা জানতো আমার খাবারের থালায় পরিবেশিত হবার জন্যে তার মৃত্যু হয়েছে!? তবে মাছ খেতে খেতে এই কথা বুঝি অনায়াসে— মাছের চোখে যে কথা লেখা আছে সেই কথা অনুধাবনে আসে আমার— মাছ বেচে চলে জলের ভেতরে আর আমি ভেসে চলি জলের উপরে— উপর আর নিচের যে পার্থক্য, এপার আর ওপারের যে বিস্তর ফারাক সেখানে কোনো প্রকার অনুধাবন নেই, নেই কোনো উপলব্ধির আস্তানা।

 

জাহাজে আমরা একাত্তর জন পর্যটক যে আস্তানা গড়েছি তাতে আমাদেরকে বেদে মনে হচ্ছে না— মনে হচ্ছে খুবই উপরের স্থরের মানুষ আমরা— ভেসে চলছি নদী বেয়ে বেয়ে— আমাদের শরীর যাপনের সামগ্রিক আয়োজন প্রস্তুত এখানে।  বর্ষার চাঁদও প্রস্তুত আমাদেরকে দেখা দেয়ার জন্যে— আমরা যেখানে আছি সেটাকে জাহাজ না বলে ডুপ্লেক্স বাড়ি বললে ভালো হবে— শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ডুপ্লেক্স বাড়ি নদীর উপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে আপন মনের আনন্দে— বাড়ির ছাদটি অনুপম অসাধারণ যেখান থেকে ক্ষনে ক্ষনে বদলে যায় পারিপার্শ্বিক আকাশ— আকাশের রঙিলা মুখছবি। 


দুপুর হওয়ার আগেই আমরা পৌঁছে যায় ইটনা মিঠামইনের সেই আলোচিত রাস্তায়। কেউ কেউ চলে যায় শুক্রবারের সেই পবিত্র আহবানে— আমার মতো অপবিত্র মানুষ চলে যায় রাস্তার জনপদে যেখানে বসেছে সামাজিক সাংস্কৃতিক অর্থনৈতিক মেলা— কেবল রাস্তা দেখার জন্যে পৃথিবীতে এমন লোকের সমাগম হয় কিনা আমার জানা নাই— রাস্তাকে ছোট করে দেখার কোনো সুযোগও নাই— বাংলাদেশের মানুষ রাস্তাকে সড়গ বলে যা স্বর্গ শব্দের রূপান্তরিত উচ্চারণ— শব্দ থেকে বুঝতে পারি রাস্তার একপ্রকার সাংস্কৃতিক অর্থনৈতিক গুরুত্ব এই অঞ্চলের মানুষের কাছে খুব ভালো করেই আছে— মহান জাপানের জাইকার মহার্ঘ্য অবদানে আমরা আরও ভালোভাবে বুঝতে পারছি— হয়তো অদূর ভবিষ্যতে আমরা আরও উত্তম উপায়ে বুঝতে পারবো জলযোগের সাথে বিমাতৃসুলভ আচরণের কারনে জীবনের মান সচলায়তনের দেয়াল পার হয়ে অচলায়তনে বাঁধা পড়ে গ্যাছে কিনা!


এই রাস্তাতেই আমাদের কেটে গ্যাছে চারপাচ ঘন্টা— তারপর জাহাজ আসে— জাহাজ আসে নাই— আমরা ইঞ্জিন নৌকা করে জাহাজের কাছে যাই— যেতে যেতে দেখি বর্ষালি ঈর্ষালু ধান— ধানের ফাকে ফাকে শাপলা শালুকের স্টল— যেখানে পানকৌড়ি বকেরা আড্ডা দিতে আসে শিকার নীতিচার ভুলে— আমিও ভুলে যাওয়া শৈশবের পকেট থেকে শাপলা-শালুকস্মৃতি টান মেরে বের করি আনি রোমন্থন জিকিরের হাতিরে— হঠাৎ চোখ পরে মোস্তফা স্যারের দিকে— দেখি উদাসিন চোখে পানকৌড়ি বকের দিকে দৃষ্টি আরোপিত করে কি যেনো ভাবছেন তিনি— সারাদিনের ক্লান্ত চোখেও নেমে এসেছে স্মৃতিস্মরণ শান্তি প্রশান্তি— মানুষকে ভেতর থেকে শান্ত করার ক্ষমতা প্রকৃতির মেজাজে থাকে— কিন্তু হায়— মানুষের মেজাজ আজ প্রকৃতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে যা মানুষের জন্যেই ক্ষতি বয়ে আনছে— আনবে!


আজকে আমরা আছি গজারিয়ায়। মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ার কথা বলছি না— বলছি সুনামগঞ্জের গজারিয়ার কথা। যেখানে আমাদের জাহাজ আছে সেখান থেকে আকাশভরা এই চাদকে বিশাল বড় দেখাচ্ছে— মনে হচ্ছে রাতকে এখুনি বুঝি দিন বানিয়ে ফেলবে সে।  খুব ভোরে জাহাজ যাত্রা করবে হাওরের উদ্দেশ্যে। কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দিলেন আমরা যেনো ভোরে সকাল থেকে ঘুম থেকে উঠি এবং মূল হাওড়ে যাওয়ার পথে ছোটো ছোটো দ্বীপগ্রামগুলো দেখে নিতে পারি। যারা সড়কপথে টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমণ করে তারা হাওরপথের এমন সৌন্দর্য উপলব্ধি করতে পারে না। 


যেখানে আমাদের জাহাজ নোঙর করেছে সেখান থেকে নদীর দুপাশ তালগাছের মতো দুপায়ে স্পষ্ট হয়ে দাড়িয়ে আছে— খুব দূরে না— খুবই কাছে। নদীর একপাড়ের পরপারে জমি আর জমি এবং জমিতে ছোপ ছোপ পানি— পানিতে নবীন শাপলা শালুক। জোছনার আলো শালুকময়— জোছনার আলো শাপলাময় হয়ে বিস্তার হয়ে আছে কোমলতার নরম পাতায় পাতায়। নদীর অন্যপাড়ের হালকাদূর পর থেকেই গ্রামের শুরু— গাছের অলঙ্কারে গ্রামখানি সেজে বসে আছে জোছনার কুলে। বিভিন্ন পোকামাকড়ের চলাচলি বিভিন্ন জলজ প্রানের ডাকাডাকি প্রকৃতির আহবানকে আরও প্রানবন্ত করে তুলছে— এমন সময় চোখে ঘুম নামতে চায় না— শরীর যেতে চাই না রুমের গহীন কোণে। জাহাজে পায়চারি করে, ছাদে হাটাহাটি করে রাতটাকে সকাল করে দেয়া যেতো কিন্তু গেলো না। সকালে হাওরযাত্রা দেখার প্রয়াসে বিছানায় যেতে হলো। বিছানার পাশেই জানালা। জানালা দিয়ে জোছনা আসছে রুমের ভেতর আমার চোখের বেডরুমে— ঘুমাবো কেমন করে? জলের মিউজিক কানে আসছে— ঘুমাবো কি করে? ঘুমাতে তো হবে। প্রেমিকা জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে যাওয়ার দারুণ অভ্যাস আমার নাই। কিন্তু আজকে এমন তুলতুলে  চাদের জোছনাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাতে সক্ষম হলাম। কখন যে ঘুমিয়ে গেলাম!


ঘুম থেকে উঠে দেখি বিশাল এক ভোর— ভোর পিলপিল পায়ে সকালের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে— জাহাজ এগিয়ে যাচ্ছে টাঙ্গুয়ার হাওরের দিকে— সবাই জেগে গেছেন— ভোরের হাওরযাত্রা দেখার জন্যে— আমিই সবার পরে ভোরসঙ্গ হাওরঅঙ্গ বিহারি। যেদিক দিয়ে বয়ে যাচ্ছে আমাদের জাহাজ সেইদিকে ছুটে আসছে মানুষ— জাহাজ দেখার জন্যে— মোবাইল হাতে নিয়ে ভিডিও করছে— তাতে অনুধাবন হলো এমন দৃশ্য দ্বীপবাসীর জন্যে খুব স্বাভাবিক ঘটনা না। জাহাজ সামনের দিকে যাচ্ছে আর ছোট ছোট দ্বীপাঞ্চল পেছনে যাচ্ছে — বনগুলা দেখে ভালো লাগলো— জয়শ্রী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় দেখে ভালো লাগলো— এই স্কুলের ছাদ থেকে আমার এক কবি ভাই আমাকে ভিডিও কল দিয়েছিলেন— আজ স্বচক্ষে দেখছি এই স্কুল— জাদুকাটা নদী দিয়ে বয়ে যাচ্ছে আমাদের জাহাজ। অনেকগুলো দ্বীপমানুষ  এক জায়গা বাজার করতে যায়— সেটাও একটা দ্বীপ— নৌকাই একমাত্র বাহন— এখানে সবাই নৌকা চালাতে পারে— প্রয়োজন তাদেরকে এই জলযানটি চালানোতে দক্ষ করেছে। 


এদের স্কুলে যেতে হয় নৌকা করে। মাছ ধরতে হয় নৌকা করে। বাজারে যেতে হয় নৌকা করে। কবরে যেতে হয় নৌকা করে। দেখলাম কবরটাও প্রায় জলের নিচে ডুবে আছে।  এই দ্বীপগ্রামে নব্বই ভাগ জল আর একভাগ স্থল।  তারপরও তাদের জীবন যাচ্ছে বয়ে জীবনের প্রয়োজনে।  তাদের জীবনকে আরও সহজলভ্য করে তুলার জন্যে রাষ্ট্র নামক মহান যন্ত্রের চেষ্টালন ঘুমরোগে আক্রান্ত। রাষ্ট্র চেষ্টা করে না এমন না— চেষ্টা করে কিন্তু রাষ্ট্রের চেষ্টা তাদের জীবন পর্যন্ত পৌছায় না— রাষ্ট্র মহোদয়ের সমগ্র চেষ্টা মোবারক জল খেয়ে ফেলে।


টাঙ্গুয়ার বউলাই নদীতে দেখা গাঢ় খয়েরি মাথার শ্বেতশুভ্র পাখিটি এ দেশের সচরাচর দৃশ্যমান পরিযায়ী পাখি গঙ্গাকৈতর। গঙ্গা কবুতর নামেও পরিচিত। পশ্চিমবঙ্গে বলে কালাশির গাংচিল। ইংরেজি নাম ব্ল্যাক-হেডেড গাল। ল্যারিডি গোত্রের পাখিটির বৈজ্ঞানিক নাম Larus ridibundus। লন্ডনসহ ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা ও মধ্য এশিয়ার আবাসিক পাখিটি শীতে বাংলাদেশসহ এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে পরিযায়ী হয়। এই কবুতরটি দেখে মন কেমন যেনো উতলা শান্ত হয়ে উঠলো— শীতকালে রোদ ভেদ করে কুয়াশা দেখলে আমার যেমন লাগে— মন আর মন থাকে না— মন যেনো দ্বারাবতী চলমান জল। ডাম্পের বাজার যাওয়ার পথে এই সুন্দরতম কৈতরটি দেখতে পাই— সারা শরীরে ঘন শুভ্র আভা— ঠোঁটে সূর্যলাল রঙের বাহার— পায়েও লাল রঙের যৌথ বাহিনি। তার উড়ালপথ না সোজা না বক্র— বাতাস তার কথা শুনে যেনো। 


আমরা কর্তৃপক্ষের কথা শুনে ছোট নৌকায় উঠার জন্যে রেডি — যারা গোসল করবে তারা এক নৌকায়, আর যারা গোসল করবে না তারা আরেক নৌকায়। আমরা উঠি গোসল না করা নৌকায়— নৌকা যাচ্ছে ওয়াচ টাওয়ারের দিকে যেখান থেকে টাঙুয়ার হাওর বড় চোখে দেখা যায়।  ওয়াচ টাওয়ারের কাছে গিয়ে দেখি হিজল আর কড়চ গাছের আশ্রম— তাদের আশ্রয়ে মানুষের বাজার— নৌকা সেই বাজারের একমাত্র বন্ধু। প্রতিটি নৌকায় গানের আসর— স্থানীয় শিশুশিল্পীরা দেশে প্রচলিত জনপ্রিয় গান করছে মনের আনন্দে— কন্ঠে রেওয়াজের প্রভাব ব্যাপক পরিসরে না থাকলেও, আছে পর্যাপ্ত ভাবাবেগ— ফলে তাদের গান হৃদয়ের কোথায় যেনো একটা সুকুমার আকর্ষন নির্মাণ করে— খুশি হয়ে অনেকে টাকা দেয়— এটাই তাদের আয়ের একমাত্র উৎস।


তখন গরম ছিলো প্রচন্ড কিন্তু হিজলের ছায়াশরীর  গরম যেনো শোষণ করে নিয়েছে পুরোদমে— বলতে পারি এই গাছগুলো সমগ্র গরম পান করেছে শিবের বিষ পানের মতো। তাড়াহুড়ো তো থাকেই। তাড়াহুড়ো করে নৌকা আমাদেরকে নিয়ে গেলো গোসলের জায়গায়। শীতল জলের আহবানে মোস্তফা স্যার আর নৌকায় বসে থাকতে পারেননি, বসে থাকতে পারেননি ডক্টর আনোয়ার এবং তিনার স্ত্রী। আমিও নেমে পড়ি হিজল কড়চ ছায়াশরীরের আশ্রয়ে লালিত এবং পালিত জলে। এই জলের একটা মারাত্মক জাদুকরী শক্তি আছে। আমি সেইদিন টের পেলাম। প্রত্যেক  ইয়াং ওল্ডম্যান এন্ড উইমেন জলের ডাকে শিশুর অধিক শিশু হয়ে যান— তাদের মধ্যে আমিই একটু মুরুব্বি মুরুব্বি ভাব ধরে থাকি— যদিও আমার ভাব বেশিক্ষণ টিকে না— কি আর বলবো!  খুবই আনন্দঘন জলমগ্ন জলমিশ্রিত জলমুহূর্ত!! 


জলপাই জলপর্ব শেষ হওয়ার পর আমরা ভেজা কাপড়ে আবার যাত্রা করি জাহাজের দিকে— জাহাজে গিয়ে স্নান করি ভদ্র জলে— তারপর দুপুরের খাবার। আহা সে কি মজার খাবার— প্রকৃতির সাথে শরীরের সম্পর্ক হওয়াতে খাবারের সাথে জিহবার সম্পর্ক হলো খুবই স্বাদের। খাবার খাচ্ছি আর জাহাজ চলছে। জাহাজ চলছে ডাম্পের বাজারের দিকে— খেতে খেতে দেখছি বিশাল বিশাল পাহাড়। এই পাহাড় থেকে নেমে আসছে রাশি রাশি সবুজ। এই পাহাড় থেকে নেমে আসছে বড় বড় সীমানা আর কাটাতারের কথা যেখানে বড় হয়ে উঠে প্রশ্ন— মানুষ বড়— না, বড় মানুষের বানানো নীতি!?


কে যেনো বলেছিল— অজ্ঞান আর ব্রহ্মের মাঝখানে একটি শক্তিশালী দেয়াল আছে— যোগ-অভ্যাসের মাধ্যমে সেই দেয়াল পাতলা হতে থাকে— ওপারের নানা শব্দ, গন্ধ, দৃশ্য, অনুভব হতে থাকে। যিনি যত উচ্চস্তরের যোগী তিনার দেয়াল তত পাতলা। একসময় সেই দেয়াল স্ফুটিকের মতো স্বচ্ছ হয়ে যায়— পরিপূর্ণ প্রতিফলন হয়! একদম শেষে আর দেয়াল থাকে না— একেবারে মিশে যায়!  We 'all' have this same purpose— nothing else!!  


আরেকজন এসে বলবেন— কোনো দেয়াল নেই। এটা একটা ভাবনা মাত্র। আসলে সামনের দিকে দেখি আলো আর পিছনে অর্থাৎ ভিতরে দেখি অন্ধকার। বাহ্যিক চোখে বাইরের দর্শন সেখানে চোখ অনেকটা pinhole ক্যামেরার মতো কাজ করে— এর ফলে চেতন আর অবচেতন মনে ভিড় করে ভাবনা। ভিতরে অন্ধকার তাই হঠাৎ দেখলে কিছু দেখা যায় না। অন্ধকারে যখন দৃষ্টি স্থির হয় তখন অন্ধকারেও অনেক কিছু দৃশ্যমান হয়।  ত্রিনয়ন হলো ভেতরে দেখার চোখ। এর জন্য পথ হলো ধ্যান। কেন ধ্যান?  ধ্যান কথাটির মধ্যে এর উত্তর লুকিয়ে আছে। অভিভাবক এবং শিক্ষক বলতো ধ্যান দাও। মানে ফোকাস করো।  দেহ দিয়ে কি ফোকাস করা যায়? যায় না, যুগ যুগ ধরে সাধকেরা ভুল পথে এগিয়েছে অথবা স্থির থেকেছে। আসল হলো মন এবং তার সংযোগ বা মনোযোগ।  অর্থাৎ মনকে বাধতে পারলে এক জন্মে সব পাওয়া যায়। 

মনের মাঝে রক্ষা কবচ 

মনটারে তুই জাদু কর 


খুব ভালো কথা। খুবই ভালো কথা— মন নিয়ন্ত্রণ করে এক জীবনে সব পেয়ে যাবো— তাহলে প্রশ্নটা থেকে যায়— পাবো কি একটা পাসপোর্ট ভিসামুক্ত পৃথিবী যেখানে থাকবে না কোনো বর্ডার নীতি— বার্ডের মতো উড়ে বেড়ানো যাবে কি  লোকান্তরে দেশ হতে দেশ দেশান্তরে! 


তিনার জন্মস্থান রংপুর। পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানিতে। তারপর চলে যান জাপান মাইক্রোবায়োলজি নিয়ে গবেষণার কাজে। তারপর দেশে এসে ১৯৮০ সালে আনবিক শক্তি কমিশনে বৈজ্ঞানিক হিসাবে দশবছর সার্ভ করেন। তারপর চাকরি ছেড়ে চলে যান নিউইয়র্ক— সেখানে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন গবেষণার সাথে যুক্ত ছিলেন। ২০১০ সালে তিনি এবং তিনার নায়ক চাকরির জগৎ থেকে নিজেদেরকে পরিত্রাণ দিয়ে বিশ্বভ্রমণকালীন সময়ে আছেন— দেশবিদেশ ঘুরে বেড়ান। 


তিনার নাম ডক্টর আনোয়ারা বেগম এবং তিনার নায়কের নাম ডক্টর সালাউদ্দিন। আমার এবং মোস্তফা স্যারের আড্ডাসঙ্গী তিনারা দুজন— আমার অধিক কথাবলাবাহিত সময় ডক্টর সালাউদ্দিন  সাহেবের সাথে— তিনিও আমার সাথে বেশ আরাম করে কথা বলেছেন— তিনার নায়িকা খুবই মিশুক আত্মা— জাপানিদের সংস্কৃতি তিনার কাছে খুব ভালো লাগে। তিনি খুবই অল্প সময়ে সবার সাথে কথা বলে বলে আমাদের জাহাজকে কথাবলা গ্রামে পরিনত করেন। সালাউদ্দিন সাহেব আবার সবার সাথে কথা বলেন না হৃদয় খুলে— তিনার হৃদয়কে রুচিবোধের চাবি দিয়ে খুলতে হয়, তারপর তিনি কথা বলেন। ডক্টর আনোয়ারা সবার সাথে কথা বলেন প্রান দিয়ে— প্রানের সাপোর্টার হিসাবে থাকে ব্রেইন আর তিনার নায়ক কথা বলেন ব্রেইন দিয়ে— ব্রেইনের সাপোর্টার হিসাবে থাকে প্রান।  একটা দৃশ্য কিন্তু চোখে লেগে আছে— বাচ্চাদের মতো তিনি নৌকা থেকে নেমে যান হাওরজলে উদাম গতরে— আমরা কেউ কিন্তু উদাম গতরে জলে নামতে পারিনি— তিনি পারলেন— তাতেই তার চোখেমুখে কাচ্চাবাচ্চা আনন্দ স্পষ্ট হয়ে উঠে— কে যেনো বলেছিল— ইচ্ছে করলে শিশুর বাবা হওয়া যায় কিন্তু শিশু হওয়া যায় না!


মোস্তফা স্যার আর ডক্টর আনোয়ারা যখন কথা বলছে, আমার তখন মনে হয়েছে কলেজের ক্লাস শেষে নীরব রুমে বসে বসে গল্পকরা দুটি সজীব প্রান যারা জীবন উপভোগে ব্যস্ত— অভিযোগে না! ডক্টর আনোয়ারা কিন্তু তার স্বামীকে বন্ধু হিসাবে যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত এবং মানবিক চোখে দেখে— দুজনের বোঝাপড়া খুবই সুন্দর এবং গোছানো— তাছাড়া রংপুরের মেয়েরা ভালোবাসা কিংবা ঘৃণা দুটোই মন থেকে করে— অভিনয় কিংবা নাটক থেকে নয়। এর পেছনে সামাজিক কারণ যেমন আছে তেমনি সার্বিকভাবে বৈজ্ঞানিকভাবে পরীক্ষিত পদ্ধতি আচার্যের অবদানের কথাও আমরা অস্বীকার করতে পারিনি এবং পারবো না— বিজ্ঞানের পাঠে আমরা শিখেছি— বেশি ঘনত্ব থেকে পদার্থ নিজে থেকেই ছড়িয়ে পড়ে কম ঘনত্বের দিকে। রান্নাগন্ধ তাই দরজা পেরিয়ে চলে যায় উঠোনে, একফোঁটা ফুলের সুবাস ছড়িয়ে পড়ে পুরো বিকেলে— কিন্তু এই নিয়ম শুধু পদার্থের নয়— মানুষের হৃদয়েরও। ভালোবাসা কখনো সমান সমান থাকে না, তা প্রবাহিত হয় এক অসমান ঢালে— যেখানে একপাশে শক্তি, অন্যপাশে প্রয়োজন। একটি শিশুর দিকে আমাদের মমতা, একটি আহত প্রাণীর দিকে স্নেহ, অসহায় বৃদ্ধের প্রতি নিঃশব্দ সহানুভূতি— সবই সেই অদৃশ্য ঢাল বেয়ে নামা প্রবাহের ফল। আমরা যাদের দিকে ঝুঁকে যাই, তারা আসলে কম নয়, বরং এমন এক ফাঁকা স্থান— যেখানে আমাদের সত্তা গিয়ে পূর্ণতা পায়। ভালোবাসা, তাই, শেষ পর্যন্ত একটি ব্যাপন— ঘন আত্মা থেকে হালকা আত্মার দিকে নিঃশব্দে ছড়িয়ে পড়া এক অনন্ত গন্ধ। তারপরও প্রেমের জয় ✌ হোক এই প্রার্থনা থেকে আমাদের ভোরকে মুক্ত রাখতে পারিনা— যদিও একটি ভোর একটি অন্ধকারের অনিবার্য পরিনতি।


আজকের দিনটি শনিবার— যাত্রার পরিনতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সময়। ছোটো নৌকা করে আমরা তাহেরপুর রাস্তায় উঠি— চান্দের গাড়ি করে আমরা যাবো নীলাদ্রি লেক, জাদুকাটা নদী, লাকমাছড়া এবং শিমুলবাগান।


যাদুকাটা নদীর ধারে মেঘালয়ের পাহাড় ছায়া ফেলে— সেখানেই মানিগাঁওয়ের বুকে দাঁড়িয়ে আছে এক লাল স্বপ্ন— শিমুল বাগান: শিমুল বাগানের দেহগত সৌন্দর্য প্রকট হয়ে উঠে ফাল্গুন ও চৈত্র মাসে। যাদুকাটা নদীতে আসলেই যাদু আছে। এই যাদুর প্রধান উপাদান মেঘালয়ের পাহাড়। সূর্যের ☀ আর পাহাড়ের সবুজ গাছের রঙে জাদুকাটা নদী রঙিন— ফলে যাদুকাটা নদী বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কালার ধারন করে। 


সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার মানিগাঁও গ্রামে প্রায় ১০০ বিঘা জমি জুড়ে গড়ে উঠেছে অসাধারণ এই শিমুল বাগান, যা প্রকৃতির প্রেমিক ও পর্যটকদের জন্য এক আরাধ্যভূমি। এক পাশে ভারত, মাঝে নীল-সবুজের খেলা যাদুকাটা নদী, আর এপারে রক্তিম ফুলে ঢাকা শিমুল বন— এক কাব্যের ভেতরে আরেক মহাকর্ষ আন্দোলিত ম্যাজিক রিয়েলিজম। 


২০০২ সালে বাদাঘাট ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও দূরদর্শী স্বপ্নদ্রষ্টা জয়নাল আবেদিন নিজ উদ্যোগে প্রায় ৩ হাজার শিমুল গাছ রোপণ করেছিলেন নিজের ২,৪০০ শতক জমিতে। তার এই শৌখিন উদ্যোগই এখন হয়ে উঠেছে সিলেট অঞ্চলের এক অনন্য প্রাকৃতিক নিদর্শন— শিমুল বাগানের জগৎ। 


আজ সেই বাগানে শিমুলের পাশাপাশি লেবু বাগানও ফুটে উঠেছে, আর পাখির কলতানে মুখরিত এই পরিবেশ যেন জীবনের প্রশান্তি খুঁজে পাওয়ার এক ঠিকানা— মানুষ আসে, মানুষ যায় কিন্তু শিমুল বাগান তার বন্ধু জাদুকাটা নদীকে নিয়ে বিকশিত হতে থাকে আপন মনের নিপুণ আনন্দে। 


আমার শরীরে লাল টিশার্ট— জানি যেহেতু এখন শিমুল ফুল নেই গাছে গাছে— তাই শরীরগাছে লাল রঙের পোশাকি বাহার— শিমুল ফুলের ❀ বাহিনির কাছে নিজের চোখের সাক্ষাৎ ঘটাতে  পারলে ভালো লাগতো— কিছু ভালো লাগা তুলে রাখতে হয় অনাগত সময়ের জন্যে।


জাদুকাটা নদী চলে গ্যাছে রক্তি নদীর কাছে, ব্রিজ পার হয়ে রক্তি নদী ডাম্পের বাজারের কাছে হয়ে উঠেছে বোলাই নদী— এই বোলাই নদীতে আমাদের জাহাজ। শিমুলবাগানের কাছে যে জাদুকাটা নদী সেখানে পাথরের আবাসভূমি কিন্তু পাথরতুলা নিষিদ্ধ। 


লাকমাছড়া ইন্ডিয়ার পাহাড় থেকে নেমে আসা জলের ধারা— পাহাড় থেকে যে জল নেমে আসে তা সাধারণত শীতলই হয়— তাই শীতল জলের ঝর্না বলে আজাইরা মার্কেটিং করার কিচ্ছু নাই। রাস্তাঘাটের অবস্থা খুবই বাজে— আগে জানলে— আগে জানলে তোর ভাঙা রাস্তায় চান্দের গাড়িতে উঠতাম না।   একটা হেছা কতা বলি, হুনেন— শিমুলবাগান বলেন, লাকমাছড়া বলেন, কিংবা নীলাদ্রি লেকের কথা বলেন, প্রকৃতির হিসাব আলাদা, পারিপার্শ্বিক পরিবেশ আমার কাছে একদম ভালো লাগেনি— তবে জাদুকাটা নদীকে কি যেনো এক আশ্চর্য জাদু আছে— চোখ আটকে রাখে— পড়ে না চোখের পলক— আশ্চর্য এক রূপের ঝলক, ঝলক ঠিক নয়, ঠিক যেনো ঝলমল।


তাহেরপুরে পর্যটন স্পট এবং রাস্তাগুলোকে ধুলাবালি দিয়ে ধূলিসাৎ করার জনগণ এবং তার সরকারের কথা মনে হয়ে আমার একটা কৌতুক মনে পড়লো। 


এক লোক ঘন ঘন পতিতালয়ে যায়— তাকে কোনোভাবে ফেরানো যাচ্ছে না— অনেক ধর্মের কাহিনি, সমাজের কাহিনি, সুন্দর জীবনের কাহিনি শুনানো হলো— সে ফিরছে না। জ্ঞানী বাবার পরামর্শ অনুযায়ী তাকে বিয়ে করানো হলো— সুন্দর চোখধাঁধানো রূপসী কন্যা— রূপকথার কন্যার মতো সুন্দরী বলা যায়। বাসর রাতে যথারীতি গেলো সে। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে অভ্যাসবসত একশো টাকা দিয়ে দিলো বউকে। টাকা দেয়ার সাথে সাথে জিহব্বার কামর দিলো, আমি একি করলাম— মেয়েটিও পঞ্চাশ টাকা ফেরত দিলো কাস্টমারমূল্য অনুযায়ী— বলতে হবে খুবই সৎ!  


এইভাবে দারুণ সরকার আর দারুণ সৎ জনগণ নিয়ে বয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের জীবন— আপনি বলতে পারেন পৃথিবীর যেকোনো দেশের চেয়ে বাঙালি বুদ্ধিমান— আমি বলবো আপনি ঠিকই বলেছেন— তবে আমার দ্বিমত আছে— কারন অসুস্থ বেগকে আমি আবেগ বলি না প্রিয়— যে জ্ঞান তার পারিপার্শ্বিক আবহাওয়ার মন্ডলে কাজে লাগে না তাকে অন্তত বুদ্ধি বা জ্ঞান বলা যায় না। ইংরেজি একটি শব্দ আছে render, এই শব্দটা আমার খুবই প্রিয়। render মানে গড়ে তোলা অর্থাৎ কোনো কিছু সকল অনুমিত শর্ত মেনে গড়ে তোলা। যেমন চায়ের কাপ— চা খাওয়ার সকল অনুমিত শর্ত মেনে গড়ে তোলা হলো। আমাদের বাঙালি সমাজকে একত্রে সুন্দর উপায়ে বসবাসের সকল অনুমিত শর্ত মেনে বিকাশ লাভ করানো হয়নি।  তার জন্যে পারিবারিক বিদ্যাকেন্দ্র দায়ী— তার জন্যে দায়ী আমাদের অভাব, টাকা উপার্জনের জন্যে অর্জিত শিক্ষাপদ্ধতি। অভাব এবং অস্থিরতা একসঙ্গে যুক্ত হলে মানসিক অবস্থা একেবারে মাশাল্লাহ হয়ে যায় যেখান থেকে হতাশা আর হিংসা প্রতিনিয়ত প্রতিনিধি হয়ে যায় ব্যক্তি মানুষের। ফলে সুন্দর পরিবেশ আর সুন্দর রাখতে পারে না সেই ব্যক্তি মানুষ— বিকৃত করাই যেনো তার স্বাভাবিক স্বভাব। 


নীলাদ্রি লেকের পরিবেশও আর স্বাভাবিক নাই— ক্যামেরার চোখে দেখানো হয়েছে বিকৃত উপায়ে— তারপরও সন্ধ্যা আসার প্রাক্কালে কেমন যেনো ভালো লাগা কাজ করলো। মোস্তফা স্যারের ইচ্ছা নৌকাতে চড়া— চড়া হলো— নৌকাতে করে নীলাদ্রি লেকে দিন গিয়ে রাতের আগমন দেখি— চুনাপাথর প্রথম দেখি সরাসরি এই লেকে। মানে নীলাদ্রি লেকে— তাও নৌকা দিয়ে ঘুরতে গিয়ে। জানতে পারি এর ইতিকথা,অতিহার কিংবা ইতিহাস— এটি মূলত এক সময়কার চুনাপাথরের (লাইমস্টোন) খনি ছিল। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে প্রচুর চুনাপাথর পাওয়া যায়, যার অন্যতম কেন্দ্র ছিল টেকেরঘাট অঞ্চল। এখান থেকে বহু বছর ধরে চুনাপাথর উত্তোলন করা হতো— সিমেন্ট কারখানা ও নির্মাণ শিল্পে ব্যবহারের জন্য। খনি খনন শেষে পরিত্যক্ত গর্তগুলোতে ধীরে ধীরে পাহাড়ি পানি জমে যায়। পাহাড়ি ঝরনা ও বৃষ্টির পানিতে পূর্ণ হয়ে তৈরি হয় আজকের নীলাদ্রি লেক। লেকের পানির রঙ নীলচে-সবুজ, যা সূর্যালোক ও পাথরের প্রতিফলনে ভিন্ন ভিন্ন আভা নেয়। এই নীলচে রঙের কারণেই এর নাম রাখা হয় “নীলাদ্রি”— অর্থাৎ “নীল পর্বত” বা “নীলের দেশ”। চুনাপাথরের গঠন এখনো লেকের আশপাশে দেখা যায়। লেকের তলদেশেও চুনাপাথরের স্তর বিদ্যমান।


তবে বর্তমানে এখানে আর কোনো উত্তোলন কার্যক্রম চলে না। খনিটি বহু আগেই বন্ধ হয়ে গেছে, এখন এটি একটি পর্যটন কেন্দ্র। স্থানীয় মানুষ একে “টেকেরঘাট লেক” বা “চুনার লেক” বলেও ডাকে। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত ঘেঁষা এই স্থানটি সীমান্তরক্ষী বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। লেকের চারপাশে পাহাড়, নদী ও মেঘের মিলনে সৃষ্টি হয়েছে এক অনন্য দৃশ্য। চুনাপাথরের অবশিষ্ট খণ্ড, পাহাড়ের ধূসর দাগ ও নীল পানির ঝলক মিলে এক অপূর্ব দৃশ্যরচনা করে। এখানে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের দৃশ্য বিশেষভাবে মোহনীয় বলে শুনে আসছি— পাইনি যদিও— তবে মানুষের বিকৃত আচরণের প্রভাব না থাকলে এই জায়গাটি যে মোহনীয় তা তো বলার অবকাশ রাখে না— দুই স্তনের উপত্যকার ঠিক নিচের জায়গাটির মতো মোহনীয় লাবন্যধারী হতো এই জায়গাটি।


পর্যটকেরা সাধারণত নৌকায় করে শ্রীপুর, যাদুকাটা ও বারিক টিলা ঘুরতে যান এখান থেকে। এশার নামাযের আযানের সাথে সাথে আমরা ছুটে চলি আমাদের জাহাজের দিকে। আজকে জাহাজে গানসন্ধ্যা। জাহাজে গিয়ে দেখি গায়করা উপস্থিত— ফ্রেশ হতে না হতে গান শুরু হয়ে যায়— গান পরিবেশন করছে তাহেরপুর আঞ্চলিক শিল্পীগোষ্ঠী গানপুর। তারা হাসন রাজা, আব্দুল করিম এবং লালনের মজার মজার গান করেন— জাহাজের বসার রুমের দুর্দান্ত সাউন্ড সিস্টেম এবং আপডেটেট এসিব্যবস্থাপনা। বাইরে তাপমাত্রা বেশি থাকলেও আমরা তা মোটেও টের পাচ্ছি না। গান শুনে সবার সারাদিনের ক্লান্তি যেনো শেষ হয়ে গেলো ম্যাজিকের মতো। গান চলাকালীন সময়ে একটা দারুণ খাবার আসে সবার সামনে— মুড়ি, সাথে ঝাল মরিচ এবং চানাচুর এবং মুড়িতে হালকা সরিষার তেল। বাহ! দারুণ দারুণ!!


গান শেষে যথারীতি মজার মজার খাবার। কর্তৃপক্ষের খাবার ব্যবস্থাপনা ফাইবস্টার মানসিকতার মতো— সবকিছু সুন্দর গোছানো। এক মাসের জন্য এমন একটি ভ্রমনব্যবস্থাপনা হলে ভালো হতো— শিরোনাম থাকতো— জলপথে বাংলাদেশ। 


সবশেষে আজকের জন্যে সবাই চলে গেলো সবার শীতাতপনিয়ন্ত্রক কামরায়। আমি কেবল একা একা ছাদে দাঁড়িয়ে দেখছি মিশকালো সবুজবীথি পাহাড়কে যার পেট থেকে বের হয়ে আসছে টাঙুয়ার হাওর— মা আর সন্তান আজ আলাদা আলাদা অথচ তারা একসঙ্গে এক পতাকা তলে থাকতে পারতো। মোস্তফা স্যার অনেক আগেই চলে গ্যাছে রুমে। আমি কেবল ছাদে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছি মিশকালো পাহাড়ের শরীরভঙ্গি যার নৃত্য দেখা যায় কিন্তু স্পর্শ করতে ভিসা লাগে— হায়রে ভিসা তুমি কতই না শক্তিশালী— মানুষ আর প্রকৃতির মাঝে রচনা করেছো দেয়াল! 

রুমে গেলাম। স্যার জেগে আছেন। ঘুমিয়ে যাবেন। প্রস্তুতি নিচ্ছেন। হেরমেন হেসের সিদ্ধার্থ বইটি পড়ছিলেন এতোক্ষণ। আমিও পড়ে শেষ করেছি বইটি এই ভ্রমনে। এই বইটিতে জীবনের গভীর অর্থ সিদ্ধার্থ খুজে পায় নদীর কাছে, যে নদী ধারণ করে সবকিছু এবং তা বয়ে নিয়ে যায় সমুদ্রে। ঘুমিয়ে যাওয়ার আগে একটি চিঠি লিখি এক মহান আত্মার কাছে— 


প্রিয় বন্ধু— হে আমার সোনাপাখি! 


তুমি সেদিন জানতে চেয়েছিলে— ভৈরব-আশুগঞ্জের মাঝ দিয়ে যে রাজকীয় নদী মেঘনা বয়ে চলে, সে এসেছে কোথা থেকে?

তখন হুট করে বলা হয়নি, কারণ তার উত্তর কেবল তথ্য দিয়ে হয় না— লাগে গল্প, লাগে ভ্রমণ, লাগে নদীর ধ্যানে ডুবে থাকার সাধনা। আজ সেই সাধনার কথা বলি। শোনো, অনেকে বলে মেঘনা নাকি বাংলাদেশের মূল নদী। কেন!? কারন মেঘনা বঙ্গোপসাগরে নিজের উপস্থিতি জানান দিয়েছে অথবা নিজের অস্তিত্ব অসাধারণ জলরাশির সাথে লীন করতে পেরেছে। 


এই যে বিশাল মেঘনা, সে জন্মায় এক আশ্চর্য নদীজ চক্র থেকে— শুরুটা সিলেটের সুরমা ও কুশিয়ারা দিয়ে— এই দুই নদী প্রেমের মতো পাশাপাশি চলে, তারপর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বালিখোলার কাছে এসে তারা মিলিত হয় কালনী নামে।

কিন্তু মেঘনা কেবল কালনী নয়, তার আরও সঙ্গী আছে, আছে  অন্য স্রোতধারা— এখন আসি সেই ঢেউগুলোর গল্পে—

ঘোড়াউত্রা নদী — এক নিবিড় ও গম্ভীর জলস্রোত— তার সাথে মিশেছে ধনুনদী। ঘোড়াউত্রা আবার বলাই নদীর পাশ ঘেঁষে বয়ে যায়— বলাই এসেছে সোজা জাদুকাটা নদী থেকে। তাদের স্রোত একাকার না হলেও, লক্ষ্য এক— মেঘনার দিকে। এই ঘোড়াউত্তরা-ধনুনদী-বলাই-জাদুকাটার যৌথচিত্র যেন একেকটা নদী-বাঁশির সুর। 


ঘোড়াউত্রা বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কিশোরগঞ্জ জেলার একটি নদী— নদীটির দৈর্ঘ্য ৩৩ কিলোমিটার, গড় প্রস্থ ৪৩৯ মিটার এবং নদীটির প্রকৃতি সর্পিলাকার। ঘুরে ঘুরে উঠে আসতো জলের পাক— জলের পাক দেখে হাওর অঞ্চলের মানুষ ভয় পেয়ে যেতো সেই থেকে এই নদীর নাম ঘোড়াউত্রা। 

যেহেতু আমি মেঘনার সন্তান সেহেতু ছোটোকাল থেকে একটি কিসসা শুনতে শুনতে আমাকে বড় হতে হয়— কিসসাটি হলো তিন নদীর এই মোহনায় নাকি জ্বিন আছে এবং সেই জ্বিনেরা প্রায়ই নৌকা একেবারে টান দিয়ে নিজেদের রাজ্যে নিয়ে যায়। তাই ঘোড়াউত্রা, কালনি এবং মেঘনা নদীর এই মোহনায় এলে যার যার ধর্ম অনুযায়ী ধর্মের প্রভুকে ঢেকে ঢেকে হয়রান হয়ে যেতো মানুষ! এখন এমন ঘটনা আর ঘটে না— নদীর স্রোত কমে গ্যাছে, নৌকাও হয়ে গেছে অনেক আধুনিক।  


তুমি জানো, এই ঘোড়াউত্রার কোল ঘেঁষেই আছে এক চমৎকার সাজানো গোছানো চর— ছাতিরচর— প্রাকৃতিক চর। 

লোকেরা একে বলে ‘মিনি রাতারগুল’। কল্পনা করো— ১৬ হাজার মানুষের বসতি, ঘন জলের ভেতরে ভেসে থাকা তিনটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, তিনটি মাদ্রাসা, একটি মাধ্যমিক স্কুল।


তাহলে তাদের একমাত্র বাহন? 

জলযান!


শব্দ নেই, গাড়ির হর্ন নেই, কেবল দাঁড় আর বৈঠার শব্দে জীবন চলে— যদিও ইঞ্জিনের আধুনিক শব্দ শুনতে পাওয়া যায় আজকাল। তবু এই চর যেন এক জলজ সভ্যতার হীরকখণ্ড।


তো, প্রিয় বন্ধু, মেঘনা একটাই না— সে এক সমুদ্রমুখী মহাযাত্রা, যার শরীরে জড়িয়ে আছে সুরমা, কুশিয়ারা, কালনী, ঘোড়াউত্রা, ধনুনদী, বলাই আর জাদুকাটার আলাদা আলাদা গল্প।


ভৈরব-আশুগঞ্জের মাঝ দিয়ে যে মেঘনা চলে গেছে— সে আসলে বহু নদীর মিলনের ফল, অনেক চর, অনেক গ্রামের গল্প।


তোমাকে কথাটি তখন বলা হয়নি। আজ বললাম। নৌকায় বসে যদি কখনো ছাতিরচর দেখতে যাও, মনে করো— প্রতিটি ঢেউ একেকটা গল্প বইছে।

ভালো থেকো। আবার কথা হবে নদীর পাশে বসেই।

তোমার বন্ধু,

এমরানুর রেজা


চিঠি লেখা শেষে ঘুমিয়ে যাই— ঘুম থেকে উঠে দেখি জাহাজ চলছে। জাহাজ চলছে ঢাকার দিকে। আসামের পাহাড় এখনো চোখে আসছে, বলতে চায় সে আমাকে কতিপয় কথা বিদায়বেলা। তার কথা না শুনেও বুঝে নিতে হয়, বুঝে নিতে  হয়েছে। জাহাজ চলছে— যথারীতি নাস্তা করে আবারও একটা ঘুম দেই— এক ঘুমে দুপুরের খাবারের সময় হয়ে যায়। খাবার শেষে চলে ম্যারাথন আড্ডা— বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেন ডক্টর সালাউদ্দিন সাহেব আর গোলাম মোস্তফা মিয়া স্যার। আমি চুপ করে শুনতে থাকি। মাঝে মাঝে আমিও যুক্ত হয় টীকাটিপ্পনীসহ। যথারীতি সন্ধ্যা আসে। সন্ধ্যার নাস্তা শেষে চলে পরিচয় পর্ব। চলে নিজেদের গানের আয়োজন। এখন শিল্পী নিজেরা নিজেরা। আমাদের মাঝে অনেকে আছেন ভালো গান করেন। বারবার আমাকে বলা হলো গান করার জন্যে। আমার চুল বড় দেখে সবাই মনে করছেন আমি বিরাট এক গানওয়ালা লোক অথচ আমি যে গানের বালও জানি না তারা তা জানে না, জানেন না। রাতের খাবার পর্ব আসে। আমাদের জাহাজ চলছে। আজকেই খাবারপর্বের শেষ অধ্যায়। ঢাকা পৌঁছাতে পৌঁছাতে সকাল হয়ে যাবে। খাবার পর্বের শেষে চলে অনুভূতিপর্ব— অনুভূতি পর্বে মাইক আমার হাতে আসে। আমি কোনো কথা বলতে চাইনি, তারপরও চাপাচাপিতে কিছু বলতে হলো। আমার কথা শেষে ঘটে গেলো এক অবিশ্বাস্য কান্ড। আমি বিশাল এক সিলিব্রিটি বনে গেলাম— দয়াল আমাকে ক্ষমা করো— বাংলাদেশের বড় বড় ডাক্তার গবেষক ইঞ্জিনিয়ার সচিব আমাকে ঘিরে ধরলো, ছবি তুললো নিজস্ব ক্যামেরা দিয়ে— এতো ভালোবাসা স্নেহ কোথায় রাখি প্রভু! 


তবে সবাই দারুণ শৃঙ্খলাঘনিষ্ঠ মানুষ— শৃঙ্খলাঘনিষ্ঠ মানুষের সাথে যে কটা দিন জাহাজে জলে ছিলাম সে কটা দিন আমি পেয়েছি জীবনের সুস্থ সঙ্গের প্রশান্তি— এটাকেই সাধুসঙ্গ বলে কিনা আমি জানি না— অনেককিছু না জেনে চলেছি এক অজানা গন্তব্যের মাতৃগর্ভে যেখান থেকে আমার জন্ম সেখানে— সেখানে পৌছানোর অল্প আগেও আমি এক মুসাফির— পথই আমার আদিম অনিবার্য বন্ধু— বন্ধুবর!


বন্ধুবর এই জলপথে চার রাত ধরে আছি— জলপথে ভ্রমণযাত্রা  বিমানের চেয়ে আরামদায়ক। বাংলাদেশের জলপথে যোগাযোগ একসময় খুবই জনপ্রিয় ছিলো— আস্তে আস্তে শেষ হয়ে যাচ্ছে— শেষ করা ঠিক হচ্ছে না— চালু করা উচিত পুরোদমে— বাজেট বরাদ্দ করা এবং বরাদ্দকৃত বাজেট বর্ধিত করা দরকার জলযোগাযোগের কথা মাথায় রেখে। নদী খনন দরকার— নদী খননের টাকা যেনো কুমির খেয়ে না ফেলে সেই দিকে কড়া নজর রাখতে হবে। আন্তর্জাতিক জলযোগাযোগের ব্যবস্থা করতে হবে— জল নিজেই একটা শক্তি— এই শক্তি বাংলার আছে মানে অপশক্তি বাংলাকে পরাস্ত করতে পারবে না। বাংলার জল এবং জলাশয় এবং জলাকর বাংলার প্রতিরক্ষা বাহিনীর চেয়ে শক্তিশালী। এই যে ভ্রমণ, তাও জলপথে, এটি আমার জীবনের একটি শক্তিশালী ভ্রমণ এবং জলপথে কাঞ্চনব্রিজ থেকে মেঘালয়ের পাদদেশ পর্যন্ত যা দেখলাম তা অভিজ্ঞতার অদৃশ্য পাতায় জমা থাকবে স্মৃতিময় জীবনের পাতায় পাতায় কাল থেকে কালে, পাল থেকে পালে।


আমরা প্রায় সাড়ে সাতশো কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়েছি এই জলপথে— আসা যাওয়া মিলে। আজ রাতটি এই জাহাজে আমাদের শেষ রাত। সবাই ঘুমিয়ে গ্যাছে। আমিও ঘুমিয়ে যাবো। রাত জেগে জেগে দেখছি রাতের জেলেদের, যারা মাছ ধরে জীবিকার প্রয়োজনে— আর আমি জীবনের প্রয়োজনে ভ্রমণ করি। জোনাক আলোর মতো দেখায় তাদের নৌকা— নৌকা করে সারারাত তারা মাছ ধরে— সকালে বাজারে যায় সেই মাছ— বাজারের মাছ যায় ফ্রিজে এবং রান্নায়— আর জেলে যায় ঘুমাতে। আমিও ঘুমাতে যাই যখন আমাদের জাহাজ সেই পার্লারে সজ্জিত শীতলক্ষ্যায়। ঘুম থেকে উঠে দেখি— নতুন এক সকাল— আবার জাগিনু আমি— রাত্রি হল ক্ষয়— পাপড়ি মেলিল বিশ্ব— এই তো বিস্ময়— অন্তহীন এই বিষ্ময়কর সকালে দেখি সমগ্র জাহাজ নীরব— জাহাজে রয়ে গেছি কেবল আমি আর গোলাম মোস্তাফা মিয়া স্যার। কর্তৃপক্ষ তো আছেই। ফ্রেশ হয়ে বিদায় নিলাম আমাদের প্রিয়তম সঙ্গী রুমের কাছ থেকে— সবার কাছ থেকে। সবাই বলতে ম্যানেজমেন্টে যারা আছে  তাদের কাছ থেকে।  ছোটো নৌকা করে ডাঙায় উঠি। ডাঙায় উঠে জাহাজের দিকে ফিরে তাকাই— একটা করুন দৃষ্টি নামে চোখে— করুন দৃষ্টিতে দেখি টাইগার জাহাজটির শরীরে লেগে আছে মেঘালয় পাহাড়ের মিশকালো সবুজবীথি— আর আমার শরীরে লেপ্টে আছে বাংলাদেশের নদী ও হাওড়ের মা মা জলগর্ভ গন্ধ!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন