আজও মনে পড়ে তাকে। আজও মনে পড়ে তার সেই হাসি। আজও মনে পড়ে তার সেই চোখ।
বাংলা বিভাগে ভর্তির যাবতীয় কাজ শেষ করলাম। এখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। মনে আনন্দ আর আনন্দ।
কলাভবনের দ্বিতীয় তলায় আমাদের বাংলা বিভাগ। রুদ্র মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ এই কড়িডোর দিয়ে হাঁটাহাঁটি করতেন, আমি এখন এই কড়িডোর দিয়ে পায়চারী করে রোদেলা সময় যাপন করবো। এতো আনন্দ আমি কোথায় রাখি!
আনন্দ মনে গানে গানে সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামি। ডিন অফিসের সামনের দরজায় বের হয়ে যাবো। দেখি ডিন অফিসের সামনে কস্টিউম করা সুন্দরী মেয়েরা ম ম করছে।
এক সুন্দরী মেয়েকে জিজ্ঞেস করলাম এখানে কী?
মেয়েটি হাসিমাখা চোখে উত্তর দেয়-- নাট্যকলা ও সঙ্গীতের ভাইভা হচ্ছে।
ও তাই।
জ্বী তাই।
তারপর মেয়েটি আমার সম্পর্কে জানতে চায়লো। আমি আপনি আপনি আমার আনন্দের নিউজটা প্রকাশ করার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছি, তারউপরে আবার ঢোলের বারি।
গড়গড় করে সব বলতে লাগলাম। আমার কথা শুনে যখন সে মুগ্ধ তখন তাকে টিপস দিতে লাগলাম, কী করে ভাইভা ফেইস করবে সেই টিপস।
একপর্যায়ে তার সাথে আমিও লাইনে দাঁড়িয়ে পড়ি। আমিও ভাইভা ফেইস করবো।
নাট্যকলা ও সঙ্গীত বিভাগে পড়ার ইচ্ছা আমার নেই। জাস্ট গ্রাম থেকে আসা এক ছেলের কৌতূহল থেকে এমন কাজ করার অভিলাষ।
সাতজন করে লাইন। এখন আমাদের লাইন রুমের ভেতরে যাবে। আমি লাইনের একপ্রান্তে। আমি পরিধান করেছি কালো টিশার্ট, টিশার্টে গোল একখান লাটিম, জিন্স পেন্ট, পায়ে কেটস, পেছনে ব্যাগ। ব্যাগ নিয়ে অফিস রুমের ভেতরে ঢুকে পড়ি-- আমাকে দেখামাত্র ধমক-- এই ছেলে, এই ছেলে ব্যাগ রেখে আসো।
ধমক শুনে ব্যাগ বাইরের চেয়ারে রেখে আসি। যখন রুমের ভেতরে আসি তখনই পকেটে মোবাইল বেজে ওঠে-- আবার আমার দিকে তীব্রবেগে নেমে আসে ধমক। তাড়াতাড়ি মোবাইল অফ করি।
এখন শুরু হয় নিয়মতান্ত্রিক ভাইভা। ভাইভা প্রধান রহমত আলী স্যার, তাঁকে প্রায় টিভিতে দেখে অভ্যাস্থ। এখন সরাসরি দেখছি, তাও আবার আমার ভাইভা নিচ্ছে। সব মিলিয়ে অন্য রকম অবস্থা। কিন্তু মনেপ্রানে আমি চাচ্ছি যেন সিলেকশন না হই।
একটি মিউজিক বাজবে। মিউজিকের তালে তালে তোমরা হাঁটতে থাকবে।
আমরা তাই করলাম।
আরেকটি মিউজিক বাজবে। তোমরা মিউজিকের তালে তালে হাঁটবে।
আমরা তাই করলাম।
চারজন সামনে আসো। তিনজন পেছনে যাও।
আমি পেছনে গেলাম।
এই ছেলে তুমি সামনে আসো।
যখন আমাকে সামনে যেতে বলে আমি ভয় পেয়ে যাই। কারন আমি চাই আমি যেন সিলেকশন না হই। তারপরও প্রাথমিভাবে টিকে গেলাম। যারা বিদায় নিলো তাদের জন্য মনে মনে মায়া হলো।
দ্বিতীয় সেশনে মেয়েটি নৃত্য করে, আরো দুজন ঢোলতবলা বাজিয়ে দেখায়। আমার পালা-- এই ছেলে গান পারো?
জ্বী স্যার, হালকা হালকা।
গাও ....
আমি গান ধরি, যে গানের কথায় নদীর জলে দুঃখ লুকিয়ে থাকে।
রিদম দিয়ে গাও আরেকটি গান।
আমি কাহারবা তালের একটি গান ধরি যেখানে পাহাড়ি কন্যার কথা আছে।
তারপর তারাও গান গায়। তাদের কন্ঠের আশেপাশেও আমার কন্ঠ নাই, তাদের সুরেলা কন্ঠ আমাকে বেশ মুগ্ধ করে।
এই ছেলে একটি কবিতা আবৃত্তি করো।
আমি চোখ বন্ধ করে বনলতা সেন কবিতাটি আবৃত্তি করি। তারপর তারা আমার জন্মস্থান জিজ্ঞেস করে।
ব্রাক্ষ্মনবাড়ীয়া।
প্রত্যেকে প্রত্যেকের চোখের দিকে কেন যেন তাকায়। আমার ভয় আরও বাড়তে থাকে। তারপর একটি কবিতার বই হাতে দিয়ে বলে একটি কবিতা আবৃত্তি করার জন্য। এমন কবির নাম আমার জীবনেও শুনেনি। তারপরও আবৃত্তি করার চেষ্টা করি-- কী জটিল জটিল শব্দ রে বাবা।
একজন সামনে আসো, বাকীরা পেছনে যাও।
আমি প্রথমেই পেছনে চলে যাই।
এই ছেলে তুমি সামনে আসো।
আমার স্নায়ুতন্ত্র দুর্বল হয়ে আসে, নিজয়েন্টে একদম শক্তি পাচ্ছি না।
তোমার নাম কী, মিরিট পজিশন কত?
স্যার, আমি বাংলায় আজ ভর্তি হলাম, এখন এখানে কী ভর্তি হতে পারবো?
সাথে সাথে রহমত আলী স্যারসহ সবাই রেগে গেলেন।
তোমাকে এখনি পুলিশে দেয়া দরকার।
বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান ন রহমান স্যার । তিনি ভাইভা বোর্ডে বসা। আমি তিনাকে চিনি না। তিনি আস্তে করে কী যেন বলেন। তাঁর বলা বাক্যটি শুনিনি, দেখি রুমের ভেতর শীতল বাতাস বইতে লাগলো।
যাও, আর কখনো এমন করবে না।
আমি পিলপিল পায়ে হাসি হাসি মুখে ভাইভা রুম থেকে বের হয়ে আসি।
বাইরে এসে দেখি মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে, তার মুখে পৃথিবীর মেঘ, চোখে শীতের কুয়াশা।
তার অসহায় চোখেমুখে দৃষ্টি রেখে আমি আর একটি শব্দও উচ্চারন করতে পারিনি। অসহায় পদক্ষেপে আমি কলাভবন ত্যাগ করি। মেয়েটি নিথর দেহে দাঁড়িয়ে থাকে।
কিছুদূর অতিক্রম করে পেছনে তাকাতেই দেখি ফেসিয়াল টিস্যু তার কস্টিউম করা চোখে।
আজও আমি তার সেই চোখটি ভুলতে পারিনি। আজও তার নিথর দেহের অসহায় দৃষ্টি ভুলতে পারিনি।
বাংলা বিভাগে ভর্তির যাবতীয় কাজ শেষ করলাম। এখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। মনে আনন্দ আর আনন্দ।
কলাভবনের দ্বিতীয় তলায় আমাদের বাংলা বিভাগ। রুদ্র মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ এই কড়িডোর দিয়ে হাঁটাহাঁটি করতেন, আমি এখন এই কড়িডোর দিয়ে পায়চারী করে রোদেলা সময় যাপন করবো। এতো আনন্দ আমি কোথায় রাখি!
আনন্দ মনে গানে গানে সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামি। ডিন অফিসের সামনের দরজায় বের হয়ে যাবো। দেখি ডিন অফিসের সামনে কস্টিউম করা সুন্দরী মেয়েরা ম ম করছে।
এক সুন্দরী মেয়েকে জিজ্ঞেস করলাম এখানে কী?
মেয়েটি হাসিমাখা চোখে উত্তর দেয়-- নাট্যকলা ও সঙ্গীতের ভাইভা হচ্ছে।
ও তাই।
জ্বী তাই।
তারপর মেয়েটি আমার সম্পর্কে জানতে চায়লো। আমি আপনি আপনি আমার আনন্দের নিউজটা প্রকাশ করার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছি, তারউপরে আবার ঢোলের বারি।
গড়গড় করে সব বলতে লাগলাম। আমার কথা শুনে যখন সে মুগ্ধ তখন তাকে টিপস দিতে লাগলাম, কী করে ভাইভা ফেইস করবে সেই টিপস।
একপর্যায়ে তার সাথে আমিও লাইনে দাঁড়িয়ে পড়ি। আমিও ভাইভা ফেইস করবো।
নাট্যকলা ও সঙ্গীত বিভাগে পড়ার ইচ্ছা আমার নেই। জাস্ট গ্রাম থেকে আসা এক ছেলের কৌতূহল থেকে এমন কাজ করার অভিলাষ।
সাতজন করে লাইন। এখন আমাদের লাইন রুমের ভেতরে যাবে। আমি লাইনের একপ্রান্তে। আমি পরিধান করেছি কালো টিশার্ট, টিশার্টে গোল একখান লাটিম, জিন্স পেন্ট, পায়ে কেটস, পেছনে ব্যাগ। ব্যাগ নিয়ে অফিস রুমের ভেতরে ঢুকে পড়ি-- আমাকে দেখামাত্র ধমক-- এই ছেলে, এই ছেলে ব্যাগ রেখে আসো।
ধমক শুনে ব্যাগ বাইরের চেয়ারে রেখে আসি। যখন রুমের ভেতরে আসি তখনই পকেটে মোবাইল বেজে ওঠে-- আবার আমার দিকে তীব্রবেগে নেমে আসে ধমক। তাড়াতাড়ি মোবাইল অফ করি।
এখন শুরু হয় নিয়মতান্ত্রিক ভাইভা। ভাইভা প্রধান রহমত আলী স্যার, তাঁকে প্রায় টিভিতে দেখে অভ্যাস্থ। এখন সরাসরি দেখছি, তাও আবার আমার ভাইভা নিচ্ছে। সব মিলিয়ে অন্য রকম অবস্থা। কিন্তু মনেপ্রানে আমি চাচ্ছি যেন সিলেকশন না হই।
একটি মিউজিক বাজবে। মিউজিকের তালে তালে তোমরা হাঁটতে থাকবে।
আমরা তাই করলাম।
আরেকটি মিউজিক বাজবে। তোমরা মিউজিকের তালে তালে হাঁটবে।
আমরা তাই করলাম।
চারজন সামনে আসো। তিনজন পেছনে যাও।
আমি পেছনে গেলাম।
এই ছেলে তুমি সামনে আসো।
যখন আমাকে সামনে যেতে বলে আমি ভয় পেয়ে যাই। কারন আমি চাই আমি যেন সিলেকশন না হই। তারপরও প্রাথমিভাবে টিকে গেলাম। যারা বিদায় নিলো তাদের জন্য মনে মনে মায়া হলো।
দ্বিতীয় সেশনে মেয়েটি নৃত্য করে, আরো দুজন ঢোলতবলা বাজিয়ে দেখায়। আমার পালা-- এই ছেলে গান পারো?
জ্বী স্যার, হালকা হালকা।
গাও ....
আমি গান ধরি, যে গানের কথায় নদীর জলে দুঃখ লুকিয়ে থাকে।
রিদম দিয়ে গাও আরেকটি গান।
আমি কাহারবা তালের একটি গান ধরি যেখানে পাহাড়ি কন্যার কথা আছে।
তারপর তারাও গান গায়। তাদের কন্ঠের আশেপাশেও আমার কন্ঠ নাই, তাদের সুরেলা কন্ঠ আমাকে বেশ মুগ্ধ করে।
এই ছেলে একটি কবিতা আবৃত্তি করো।
আমি চোখ বন্ধ করে বনলতা সেন কবিতাটি আবৃত্তি করি। তারপর তারা আমার জন্মস্থান জিজ্ঞেস করে।
ব্রাক্ষ্মনবাড়ীয়া।
প্রত্যেকে প্রত্যেকের চোখের দিকে কেন যেন তাকায়। আমার ভয় আরও বাড়তে থাকে। তারপর একটি কবিতার বই হাতে দিয়ে বলে একটি কবিতা আবৃত্তি করার জন্য। এমন কবির নাম আমার জীবনেও শুনেনি। তারপরও আবৃত্তি করার চেষ্টা করি-- কী জটিল জটিল শব্দ রে বাবা।
একজন সামনে আসো, বাকীরা পেছনে যাও।
আমি প্রথমেই পেছনে চলে যাই।
এই ছেলে তুমি সামনে আসো।
আমার স্নায়ুতন্ত্র দুর্বল হয়ে আসে, নিজয়েন্টে একদম শক্তি পাচ্ছি না।
তোমার নাম কী, মিরিট পজিশন কত?
স্যার, আমি বাংলায় আজ ভর্তি হলাম, এখন এখানে কী ভর্তি হতে পারবো?
সাথে সাথে রহমত আলী স্যারসহ সবাই রেগে গেলেন।
তোমাকে এখনি পুলিশে দেয়া দরকার।
বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান ন রহমান স্যার । তিনি ভাইভা বোর্ডে বসা। আমি তিনাকে চিনি না। তিনি আস্তে করে কী যেন বলেন। তাঁর বলা বাক্যটি শুনিনি, দেখি রুমের ভেতর শীতল বাতাস বইতে লাগলো।
যাও, আর কখনো এমন করবে না।
আমি পিলপিল পায়ে হাসি হাসি মুখে ভাইভা রুম থেকে বের হয়ে আসি।
বাইরে এসে দেখি মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে, তার মুখে পৃথিবীর মেঘ, চোখে শীতের কুয়াশা।
তার অসহায় চোখেমুখে দৃষ্টি রেখে আমি আর একটি শব্দও উচ্চারন করতে পারিনি। অসহায় পদক্ষেপে আমি কলাভবন ত্যাগ করি। মেয়েটি নিথর দেহে দাঁড়িয়ে থাকে।
কিছুদূর অতিক্রম করে পেছনে তাকাতেই দেখি ফেসিয়াল টিস্যু তার কস্টিউম করা চোখে।
আজও আমি তার সেই চোখটি ভুলতে পারিনি। আজও তার নিথর দেহের অসহায় দৃষ্টি ভুলতে পারিনি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন