কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়। পাহাড়ের উপরে মাস্তানি করে দাঁড়িয়ে আছে। তার গায়ে সুনসান নীরবতা। পাহাড়ি মেজাজে ছাত্ররা ক্লাসে যায়, হলে ঘুমায়। ঝিঁঝিপোকার মাত্রাবৃত্ত কোলাহল, শিয়ালের কমলা রঙ্গের ডাক, অন্ধকারের মতো গাঢ় কুয়াশা পাহাড়ের শীতকালীন চরিত্র। হলের এক কোণায় দাঁড়িয়ে আছি।
শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ হল।
ধীরেন্দ্রনাথ ছিলেন সাহসী ভাষা সৈনিক। পাকিস্তানি পার্লামেন্টে যখন উর্দু ভাষাকে পূর্বপাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার পরিকল্পনা চলছে তখনই ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বিরোধিতা করেন। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ছিলেন প্রথম মানুষ যিনি উর্দু ভাষাকে পূর্বপাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার বিরোধিতা করেছিলেন। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উর্দু ভাষাকে বাংলার রাষ্ট্র করার বিরোধিতা করে বাংলার বিমান বন্দরের ল্যান্ড করেন। দেখেন কয়েকজন যুবক দাঁড়ানো। কুয়াশার কারনে তাদের চেহারা তেমন দেখা যায় না। তিনি মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি নিলেন। তিনি চোখ বন্ধ করে সামনের দিকে হাঁটছেন। কিছুক্ষণের মধ্যে তিনি অনুভব করতে লাগলেন তাঁর মাথায় কিছু পড়ছে। তিনি নিশ্চিত হলেন আজ তাঁর মৃত্যু।
কিন্তু না।
তাঁর মাথায় যা পড়ছে তা পাথরের মতো শক্ত না, ফুলের মতো নরম। তখনও তাঁর চোখ বন্ধ। চোখ খুললেন। সত্যিই তাঁকে ফুল দিয়ে অভিনন্দন জানানো হচ্ছে। তাঁর সামনে তখন দাঁড়িয়ে আছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় তরুণ।
শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ হলের এক কোণায় আমি। পাহাড়ের চরিত্র উপলব্ধি করার চেষ্টা। তবুও মনে আছে অন্য এক ভয়। ভয়টাকে অবশ্যই শঙ্কা হিসাবে চালিয়ে দেয়া যায়-- কী যে হয়, কী যে হয়!
আর মাত্র দশ দিন। দশ দিন পর ভাইভাফেইস করতে হবে। আজকের পর ইদের ছুটি। সুতরাং আজকের কর্মদিবসই আমার জন্য শেষ। ঘুমের ভেতর শঙ্কা জেগে থাকায় ঘুম ভালো হয়নি।
সকাল সকাল কুমিল্লা বোর্ডে এলাম। শিক্ষা বোর্ডের প্রত্যেক ইট ঘুষ খাওয়ার ব্যাপারে খুব আগ্রহী। আমিও ঘুষ দেয়ার ছহি নিয়ত নিয়ে এসেছি। তবুও আমার কাজ আজকের ভেতর শেষ করতেই হবে।
বলছি,স্যার আমাকে আপনার কাছে পাঠিয়েছেন।
কোন স্যার?
আড়াইসিধা কে বি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক কামাল স্যার।
ও আচ্ছা, তিনি কেমন আছেন?
বেশ ভালো।
আচ্ছা বাবা, তোমার জন্য কী করতে পারি?
আমার এস.এস.সি সার্টিফিকেটে আম্মার নামের বানানে একটি বর্ণ ভুল আছে।
আচ্ছা বাবা, কাজটি তো অনেক জটিল, তারপরও কামাল ভাই যেহেতু পাঠিয়েছেন ....।
কাজটি জটিল হতে পারে কিন্তু আমাকে তা আজকের মধ্যেই করতে হবে।
অসম্ভব, একদম অসম্ভব।
সব পথ যখন বন্ধ হয়ে যায় তখন একটি অদৃশ্য পথ খুলে যায়, যে পথ আগের পথগুলোর চেয়ে অনেক মসৃণ, যারা হতাশ তারা সেই মসৃণ পথটি আবিষ্কার করতে পারে না। আমি তাই হতাশ হইনি।
দেখুন না কোনো পথ খোলা আছে কিনা।
দেখ বাবা, তুমি আমার ছেলের মতো। কীভাবে বলি, তারপরও বলতে হবে। যদি তিন হাজার টাকা দিতে পারো তাহলে এক সপ্তাহের মধ্যে কাজটি সম্পূর্ণ করে তোমার ঠিকানায় পৌঁছে দেব।
আমার সাথে জীবন ভাই। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। বিশ্ববিদ্যালয়ের মেজাজ তার আচরণে।
ও মিয়া, কী কন, আমরারে বোদাই পাইছেন!
জীবন ভাইকে অনেক চেষ্টা করে শান্ত করে বললাম আপনি চা খেয়ে আসেন। জীবন ভাই চলে গেলেন।
লোকটির হাতে আড়াইশত টাকা দিয়ে বললাম বাকিটুকু পরে দিচ্ছি। প্লিজ মনে কিছু করবেন না ....।
চা খেয়ে আমি আর জীবন ভাই সিদ্ধান্ত নিলাম কাজটি নিজেরাই করবো। তিনশত টাকা ব্যাংক ড্রাফট করে প্রক্রিয়ামতো ধীরে ধীরে কাজ করতে লাগলাম। অত্যন্ত নিরিহভাবে সবাইকে আমার সমস্যার কথা খুলে বললাম। নিরীহ সারল্যে এতো শক্তি প্রথমবারের মতো অনুধাবন করি।
দুপুর থেকে সন্ধ্যার দিকে সূর্য। কাজও প্রায় শেষ। ফাইল সব অফিস ঘুরে এখন চেয়ারম্যানের রুমে। তার রুম থেকে আমার হাতে হয়তো আসবে।
স্যার আমি এমরানুর রেজা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার ভর্তিভাইভা ইদের পর। বানান কারেকশনের জন্য আপনাদের স্মরণাপন্ন হয়েছি। এখন আপনি স্বাক্ষর করলেই .....।
আমার কাছে আপনার ফাইল আপনি কীভাবে জানেন?
সকাল থেকে এখন পর্যন্ত ফাইল ট্রান্সফরমার আমার হাত দিয়েই তো হয়েছে।
কী!!!!! যান, আপনার ফাইল আর মুভ করবে না!
মাথার উপর যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। আস্তে করে চোখ বন্ধ করলাম। চোখ বন্ধ করেই ফ্লোরে পড়ে গেলাম। তারপরও ....।
মজার ঘটনা।
ক্লিং ক্লিং ক্লিং
আমাকে পানি দিতে নিয়ে যাওয়া হলো। জীবন ভাই চিন্তিত। জীবন ভাইয়ের কানের কাছে মাথা নিলাম, আস্তে করে বললাম-- আমার কিছু হয় নি। কথা শুনে জীবন ভাই স্বাভাবিক। ফ্যানের নিচে বসানো হলো। কিছুক্ষণের মধ্যে আমার ফাইল কমপ্লিট।
এখন বাড়ি যাওয়ার পালা। হাসতে হাসতে সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামছি । নিচে নামতেই লোকটির সাথে দেখা।
আপনার কাজ শেষ?
শেষ তবে আরেকটি ছোট্ট কাজ রয়েছে।
কী?
আপনার কাছে আমার আড়াই শত টাকা রয়েছে।
লোকটি বুকপকেট থেকে আড়াই শত টাকা বের করে দিলো। তার কাছ থেকে দোয়া নিয়ে বিদায় নিলাম।
একটু সামনে গিয়ে পেছনে ফিরে তাকালাম, লোকটিও তাকালো। তার মুখে মৃদু হাসি। তার হাসির দিকে তাকিয়ে বলতে ইচ্ছে হলো যে কিছু পাখি আছে যাদের পালক অনেক বেশি স্বচ্ছ তবুও তাদের চেনা যায় না!
শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ হল।
ধীরেন্দ্রনাথ ছিলেন সাহসী ভাষা সৈনিক। পাকিস্তানি পার্লামেন্টে যখন উর্দু ভাষাকে পূর্বপাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার পরিকল্পনা চলছে তখনই ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বিরোধিতা করেন। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ছিলেন প্রথম মানুষ যিনি উর্দু ভাষাকে পূর্বপাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার বিরোধিতা করেছিলেন। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উর্দু ভাষাকে বাংলার রাষ্ট্র করার বিরোধিতা করে বাংলার বিমান বন্দরের ল্যান্ড করেন। দেখেন কয়েকজন যুবক দাঁড়ানো। কুয়াশার কারনে তাদের চেহারা তেমন দেখা যায় না। তিনি মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি নিলেন। তিনি চোখ বন্ধ করে সামনের দিকে হাঁটছেন। কিছুক্ষণের মধ্যে তিনি অনুভব করতে লাগলেন তাঁর মাথায় কিছু পড়ছে। তিনি নিশ্চিত হলেন আজ তাঁর মৃত্যু।
কিন্তু না।
তাঁর মাথায় যা পড়ছে তা পাথরের মতো শক্ত না, ফুলের মতো নরম। তখনও তাঁর চোখ বন্ধ। চোখ খুললেন। সত্যিই তাঁকে ফুল দিয়ে অভিনন্দন জানানো হচ্ছে। তাঁর সামনে তখন দাঁড়িয়ে আছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় তরুণ।
শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ হলের এক কোণায় আমি। পাহাড়ের চরিত্র উপলব্ধি করার চেষ্টা। তবুও মনে আছে অন্য এক ভয়। ভয়টাকে অবশ্যই শঙ্কা হিসাবে চালিয়ে দেয়া যায়-- কী যে হয়, কী যে হয়!
আর মাত্র দশ দিন। দশ দিন পর ভাইভাফেইস করতে হবে। আজকের পর ইদের ছুটি। সুতরাং আজকের কর্মদিবসই আমার জন্য শেষ। ঘুমের ভেতর শঙ্কা জেগে থাকায় ঘুম ভালো হয়নি।
সকাল সকাল কুমিল্লা বোর্ডে এলাম। শিক্ষা বোর্ডের প্রত্যেক ইট ঘুষ খাওয়ার ব্যাপারে খুব আগ্রহী। আমিও ঘুষ দেয়ার ছহি নিয়ত নিয়ে এসেছি। তবুও আমার কাজ আজকের ভেতর শেষ করতেই হবে।
বলছি,স্যার আমাকে আপনার কাছে পাঠিয়েছেন।
কোন স্যার?
আড়াইসিধা কে বি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক কামাল স্যার।
ও আচ্ছা, তিনি কেমন আছেন?
বেশ ভালো।
আচ্ছা বাবা, তোমার জন্য কী করতে পারি?
আমার এস.এস.সি সার্টিফিকেটে আম্মার নামের বানানে একটি বর্ণ ভুল আছে।
আচ্ছা বাবা, কাজটি তো অনেক জটিল, তারপরও কামাল ভাই যেহেতু পাঠিয়েছেন ....।
কাজটি জটিল হতে পারে কিন্তু আমাকে তা আজকের মধ্যেই করতে হবে।
অসম্ভব, একদম অসম্ভব।
সব পথ যখন বন্ধ হয়ে যায় তখন একটি অদৃশ্য পথ খুলে যায়, যে পথ আগের পথগুলোর চেয়ে অনেক মসৃণ, যারা হতাশ তারা সেই মসৃণ পথটি আবিষ্কার করতে পারে না। আমি তাই হতাশ হইনি।
দেখুন না কোনো পথ খোলা আছে কিনা।
দেখ বাবা, তুমি আমার ছেলের মতো। কীভাবে বলি, তারপরও বলতে হবে। যদি তিন হাজার টাকা দিতে পারো তাহলে এক সপ্তাহের মধ্যে কাজটি সম্পূর্ণ করে তোমার ঠিকানায় পৌঁছে দেব।
আমার সাথে জীবন ভাই। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। বিশ্ববিদ্যালয়ের মেজাজ তার আচরণে।
ও মিয়া, কী কন, আমরারে বোদাই পাইছেন!
জীবন ভাইকে অনেক চেষ্টা করে শান্ত করে বললাম আপনি চা খেয়ে আসেন। জীবন ভাই চলে গেলেন।
লোকটির হাতে আড়াইশত টাকা দিয়ে বললাম বাকিটুকু পরে দিচ্ছি। প্লিজ মনে কিছু করবেন না ....।
চা খেয়ে আমি আর জীবন ভাই সিদ্ধান্ত নিলাম কাজটি নিজেরাই করবো। তিনশত টাকা ব্যাংক ড্রাফট করে প্রক্রিয়ামতো ধীরে ধীরে কাজ করতে লাগলাম। অত্যন্ত নিরিহভাবে সবাইকে আমার সমস্যার কথা খুলে বললাম। নিরীহ সারল্যে এতো শক্তি প্রথমবারের মতো অনুধাবন করি।
দুপুর থেকে সন্ধ্যার দিকে সূর্য। কাজও প্রায় শেষ। ফাইল সব অফিস ঘুরে এখন চেয়ারম্যানের রুমে। তার রুম থেকে আমার হাতে হয়তো আসবে।
স্যার আমি এমরানুর রেজা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার ভর্তিভাইভা ইদের পর। বানান কারেকশনের জন্য আপনাদের স্মরণাপন্ন হয়েছি। এখন আপনি স্বাক্ষর করলেই .....।
আমার কাছে আপনার ফাইল আপনি কীভাবে জানেন?
সকাল থেকে এখন পর্যন্ত ফাইল ট্রান্সফরমার আমার হাত দিয়েই তো হয়েছে।
কী!!!!! যান, আপনার ফাইল আর মুভ করবে না!
মাথার উপর যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। আস্তে করে চোখ বন্ধ করলাম। চোখ বন্ধ করেই ফ্লোরে পড়ে গেলাম। তারপরও ....।
মজার ঘটনা।
ক্লিং ক্লিং ক্লিং
আমাকে পানি দিতে নিয়ে যাওয়া হলো। জীবন ভাই চিন্তিত। জীবন ভাইয়ের কানের কাছে মাথা নিলাম, আস্তে করে বললাম-- আমার কিছু হয় নি। কথা শুনে জীবন ভাই স্বাভাবিক। ফ্যানের নিচে বসানো হলো। কিছুক্ষণের মধ্যে আমার ফাইল কমপ্লিট।
এখন বাড়ি যাওয়ার পালা। হাসতে হাসতে সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামছি । নিচে নামতেই লোকটির সাথে দেখা।
আপনার কাজ শেষ?
শেষ তবে আরেকটি ছোট্ট কাজ রয়েছে।
কী?
আপনার কাছে আমার আড়াই শত টাকা রয়েছে।
লোকটি বুকপকেট থেকে আড়াই শত টাকা বের করে দিলো। তার কাছ থেকে দোয়া নিয়ে বিদায় নিলাম।
একটু সামনে গিয়ে পেছনে ফিরে তাকালাম, লোকটিও তাকালো। তার মুখে মৃদু হাসি। তার হাসির দিকে তাকিয়ে বলতে ইচ্ছে হলো যে কিছু পাখি আছে যাদের পালক অনেক বেশি স্বচ্ছ তবুও তাদের চেনা যায় না!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন