সাগর, মহাসাগর ।সংখ্যার বাঁধনে বাঁধা যায় না এমন অ-বলা ,অবর্ণনীয় জলরাশি বুকে পিঠে ধারণ করে তাদের দিনযাপন ।প্রতিটি জলকণার জীবন ,মনন ,প্রকৃতি ,প্রত্যয় ,জীবনবলয়ের অব্যয় ভিন্ন থেকে ভিন্নতর কখনো কখনো ভিন্নতম। কখনো এক জলকণাবর্গের সাথে অন্য জলকণাবর্গের প্রচণ্ড তর্জন ,গর্জন ,আন্দোলন হয়ে থাকে । তার ফলস্বরূপ জন্মগ্রহণ করে তৃতীয় একটা দৃশ্যমান কিছু -ফেনা- তাই কবিতা ।
আর কবি হলেন সেই ব্যথা ,কথা ,প্রথা যিনি বুঝেন কখনো কখনো বোঝান ।তবে কবি কখনো গৃহ শিক্ষকের মতো বোঝানোর উদ্দেশ্য কলম ধরেন না । তাঁর কলম কথা বলতে আরম্ভ করে যখন চিন্তার গোলায় আগুন লাগে ।আগুনের দুটি রূপ -- আলো ,তাপ । কখনো তাপের তাড়নায় কবি লেখেন আবার কখনো আলোর ঘ্রাণে লেখেন ।কবির লেখা মূলত অন্তরে চাষকৃত সম্প্রসারিত আগুনের অনুপ্রকাশ । আবুল হাসানের কবিতায় যখন পায়চারি করি তখন মন বলে তিনি যথার্থই বলেছেন--
ঝিনুক নীরবে সহো
ঝিনুক নীরবে সহো
ঝিনুক নীরবে সহে যাও
ভিতরে বিষের বালি
মুখ বুঝে মুক্তা ফলাও
সাগর ।ঝিনুকের দেশ ।সাগরের জল যখন ঘুমিয়ে পড়ে তখন ঝিনুক খাবারের সন্ধানে বের হয় ।জলের ঘুম হঠাৎ আসে হঠাৎ চলে যায় ।তাইতো সাগরের মাতৃরূপ ও বীররূপ দৃশ্যমান ।ঝিনুক শান্ত , ঘুমন্ত সাগরের জল থেকে 'প্লাঙ্কটন' খাবার হিসেবে গ্রহণ করে ।হঠাৎ সাগরের তর্জন ,গর্জন শুরু হয়ে যায় ।বালি ঢেউয়ের দেয়ালে আছাড় খেয়ে ঝিনুকের মুখের ভেতরের কাঁচা মাংসে আশ্রয় লাভ করে ।চোখে বালি পড়া অসহ্য ।তার চেয়ে অসহ্য বিব্রতকর অবস্থায় মুখোমুখি ঝিনুক । কাঁচা মাংসে প্রচণ্ড পেইন অনুভূত হয় ।আর এই পেইন থেকে রক্ষা পাওয়ার নিমিত্তে সে রস নিঃসরণ করে- বালিকে কেন্দ্র করে । নিসৃত রস বালির চারদিক ঘিরে ফেলে ।এক সময় বালির চারিদিকে একটা আবরণ তৈরি হয় - অনেকটা মার্বেলের মতো - তাই মুক্তা ।ঝিনুক সাগরের গভীর দেশে চলে যায় (ঝিনুকে মুক্ত হলে চুপ মেরে যায় মুখ মেলে না /যায় যে চলে গভীর জলে /কিনারেতে আর আসে না)। সাগরের গভীর দেশে চলাচলকারী ঝিনুক আর পূর্বের সামাজিক ঝিনুক এক নয় - সে এখন মুক্তাওয়ালা ঝিনুক ।এক ঝাঁক ডুবরি তাকে খুঁজতে সাগরের গভীর দেশে তল্লাশি চালায় ।কারণ পেইন ঝিনুকের মধ্যে জন্ম দিয়েছে মুক্তা - কবিতা ।যা ঝিনুকের ব্যথার ফল ।
হে ব্যথা তুমিই কবিতা ।তাইতো অন্তরে ঘুমিয়ে থাকা অনুভূতিকে বেত্রাঘাত করে ভাষার আস্তরণে নিয়ে আসো - প্রলেপ দিয়ে যাও বিভিন্ন রীতিবদ্ধ নিয়মের সারিবদ্ধ প্রাপ্তির । তুমি বেঁচে থাক ব্যথা ,বেঁচে থাক ।লালিত -পালিত হও তুমি প্রতিটি সৃষ্টিশীল সত্তায় –
আমি একটা পাখি পুষি
গোলাপ ফুলের কুঁড়ি পুষি
ব্যথা ।
কুড়ির থেকে গোলাপ ফোটে
পাখি নাচে পাখি ওড়ে
ব্যথা নাচে ব্যথা ফোটে
ব্যথা।
আমি একটা ব্যথা পুষি । আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ
অনেকে মনে করেন কবি সমাজের অসঙ্গতি সামাজিক মানুষের কাছে তুলে ধরেন ,সমাজকে বদলানোর চেষ্টা করেন ।আসলে কী তাই ? সমাজ বদলানোর জন্য কী তাঁর লেখনি ।মোটেও না । কবিতার মানুষটির কাছে কবিতা হলো খাদ্যগ্রহণের মতো একটি জৈবিক কাজ । বনে বাস করে সাধক । তাকে খাদ্যগ্রহণ করতে হয় ।বনে চাল ,মাছ পাওয়া যায় না । রান্না করার উপকরণ এখানে স্বপ্ন ।তবুও সাধক বাঁচতে চায় ।পাখিরাও সেখানে বাঁচে ।ফল খেয়ে ।সব ফল আবার সাধকের খাবার নয় ।পাখি যে ফল খায় ,সাধক তা খেতে পারে ।কারণ ,পাখি যে ফল খেয়ে মারা যায় না ,সাধকও মারা যাবে না ।সাধক --পাখির খাদ্য ফল ,নিজের খাদ্য হিসেবে বেছে নিলো ।পাখি কোনোদিন বলেনি তুমি তা খাও ।সাধকের নিজের প্রয়োজনে তা খেতে হয় ।তাই বলছি -- কবিতা হলো চিন্তার জৈবিক বলয়ে ঠিক পাখির খাদ্যের মতো ।সে সমাজকে বলে না তোমরা কবিতা পড় । তবে সমাজকে তার অস্তিত্ব রক্ষার দাবিতে কবির জৈবিক বলয়-- কবিতার দেশে যেতে হয় ।আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ একথাটিই খুব সুন্দর করে তাঁর কবিতায় বলেছেন –
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে ঝড়ের আর্তনাদ শুনবে ।
যে কবিতা শুনতে জানে না সে দিগন্তের অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে ।
যে কবিতা শুনতে জানে না সে আজন্ম ক্রীতদাস থেকে যাবে ।
আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি : আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ
হয়তো সে কারণে কবিরা কবিমানুষের কবিতার দেশে বিচরণ করে । আমি প্রায়ই বলি যাদের অনুভূতি আছে তারাই কবি -- আর কবিতা হলো সেই অনুভূতির প্রকাশ । তবে আমরা ভুল করব যদি বলি প্রতিটি মানুষ কবি না ।প্রতিটি মানুষই কবি তবে অনুভূতির সাপেক্ষে ।কবিতার আসনে ভর করে কবি হয় না ,কবির আসনেই কবিতার জন্ম ।
তবে কবিতার মানুষ আর কবির মধ্যে একটি পার্থক্য আছেই ।কবি সারা জীবন অনুভূতিকে গারগিল করে আর কবিতার মানুষ সেই অনুভূতিকে হজম করে শক্তি আহরণ করে ,জীবনের আয়োজন ও প্রয়োজনের মধ্যে সমন্বয় ঘটান । কবিগণ আজীবন শিশু থেকে যায় কিন্তু কবিতার মানুষ মরণ অবধি অনুভূতির বাজারে নতুন নতুন চিন্তার চাষ করে কালের যোনিতে স্থাপন করে ।মনে পড়ে গেল John Keats তাঁর বন্ধুকে (John Hamilton Reynolds) ১৮১৮সালের ১৯ফেব্রুয়ারিতে লেখা চিঠির কয়েকটি লাইন , An old man and a child would talk together and the old man be lead on his path and the child left thinking ... অনুভূতি তুমিই কবি- তবে কবিতা নও !
সূর্য অন্ধকারের দেশে যাচ্ছে ।ঘুমাবে ।সারাদিন কাজ করে ক্লান্ত ।বাল্মীকি ।এক ডাকাতের নাম ।তবে তারও অনুভূতি আছে ।বসে আছে অনুভূতির সাগরে চিন্তার শরীরকে ডুবিয়ে ।জীবনে প্রোথিত নিয়ম মেনে দুটি ক্রৌঞ্চ পাখি প্রণয়লীলায় ব্যস্ত । হঠাৎ এক শিকারির চোখে দোল খায় পাখিদ্বয়ের প্রণয়কার্য ।শিকারির ধনুকের আঘাতে মারা যায় ছেলে পাখিটি-- পড়ে থাকে তার মৃত দেহ ।স্বামীর বিরহে মেয়ে পাখিটি লাশের চারদিক ঘুরতে থাকে ।আর কান্না করতে থাকে ।ডাকাত বাল্মীকির অনুভূতির এম্বুলেন্স তখন কবিতার হাসপাতালে ।সৃষ্টি হয়ে যায় কবিতা—
মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শাশ্বতী সমাঃ ।
যৎ ক্রৌঞ্চমিথুনাদেকবধীঃ কামমোহিতম্ ।।
কবি বাল্মীকি হয়ে গেলেন কবিতার বাল্মীকি ! আমি সিঙ্গাপুরের অন্যতম প্রধান আধুনিক কবিকণ্ঠ লী জু পেং কে সাধুবাদ জানাই | কারণ কবিতা সম্পর্কে তাঁর কথা নয় ,ভাবের সাথে সত্যিকারের কবি ও কবিতার বিষয়বস্তু অনেকটা তথ্য -উপাত্তের সঠিকতা খুঁজে পাওয়া যায় বলে --কবিতা লেখাটা হলো ম্যাজিসিয়ানরা যেভাবে হ্যাটের ভেতর থেকে এটা ওটা বের করে তেমনি ।তবে একটা পার্থক্য :ম্যাজিসিয়ানরা জানে কি বের হবে ।কিন্তু কবিরা লিখতে আরম্ভ করলে বুঝতে পারে না ,শেষ পর্যন্ত কি লিখবেন । প্রশ্ন উঠতে পারে কবিতার মধ্যে শিল্প থাকবে কি না ।অবশ্যই শিল্প থাকবে ।ভালোবাসা ।কবিতার শিল্প ।ভালোবাসা ছাড়া মানুষ অচল -কবিতাও তাই ।এ ভালোবাসা কেবল নারীর মাংস ,পুরুষ ও নারীর মনে সীমাবদ্ধ নয় ।কোনো ভালোবাসা ,প্রেম স্বর্গ থেকে আসে না ,আসে মানুষের অনুভূতির শেকড় থেকে ।আর সেখানে মানুষ যত সুন্দর যত সাবলীল তার সজ্জিত অনুভূতিগুলোতে চিন্তা ততোই নান্দনিক ।ব্যক্তিমানুষ হয়ে যায় স্বর্গমানুষ ।ফলে তার মন হয় স্বর্গের চারণভূমি ।আর এই স্বর্গ কবিতার মানুষের কবিতা -কবিতার দেশ ।যেখানে উপকরণ অনেক ,উপকরণ প্রণেতা একজন –
Alone ,alone all ,all alone
Alone on a wide wide sea
আর একের কুঞ্জে কবির কবিতা বাস করে ।তাই হল ঈশ্বর ।সংকোচনে বললে কবিতার মানুষ ।কবিতার ঈশ্বর সমাজে প্রচলিত ঈশ্বর ,দেবী ,দেবতা তৈরি করেছেন ,করে থাকবেন ।কিন্তু হাসি ।একা একা ।সাথে অবশ্যই মনদেবতাকে ডিসকাসমেট হিসাবে নিই যখন শুনি ,দেখি --সৃষ্ট ঈশ্বর ,দেব ,দেবী কবিতার ঈশ্বরকে কাব্যজ্ঞান দান করে –
পুরাকালে সরস্বতী পুত্র কামনা করিয়া হিমালয় পর্বতে তপস্যা করিয়াছিলেন ।সন্তুষ্ট মনে ব্রক্ষা তাঁহাকে বলিলেন -'আমি তোমার পুত্র সৃষ্টি করিতেছি ।'(রাজশেখর ও কাব্যমীমাংসা: শ্রীনগেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী )ফলে সৃষ্টি হয় কাব্যপুরুষ । কিন্তু আমার অন্তর পাড়ে বেদনার সুনামি বার বার আঘাত হানে যখন কবিতার ঈশ্বররা সৃষ্ট ঈশ্বরের কাছে কাব্য সৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করে ,পূজা নিবেদন করে - -
বন্দি চরণাবিন্দ অতি মন্দমতি
আমি , ডাকি আবার তোমায় ,শ্বেতভুজে
ভারতি !যেমতি ,মাতঃ,বসিলা আসিয়া ,
বাল্মীকির রসনায় (পদ্মাসনে যেন )
যবে খরতর শরে ,গহন কাননে ,
তাহলে কবিতার মানুষ মাইকেল ,তোষামোদকারী ?সমাজে প্রচলিত দেবীর বন্দনা করে সে কি কবিসত্তাকে নর্দমায় নামায়নি ? তাকে কবিতার ঈশ্বর বলা যায় ?নাকি সে বিদেশি সাহিত্যের অন্ধ অনুকরণে নিজের চিন্তায় গা ভাসিয়ে দিয়েছে –
Sing to me of the man , Muse ,
the man of twists and turns
driven time and again off course
Once he had plundered the hallowed heights of Troy
(The Odessa-Robert Fagles ,Translation 1996)
O Muse ,o high genius ,aid me now
O memory that engraved the things I saw ,
Here shall your worth be manifesto to all !
Dante Alighieri canto of the Inferno- Anthony Esoler translation ,2002
তবে মনোজগতে সান্তনার হাওয়া দোল খায় ঢলে ঢলে এই ভেবে মিউজ কিংবা সরস্বতী চরিত্রগুলো অন্য কোন কবিতার মানুষ তথা ঈশ্বরের সৃষ্টি ।এখানে কেবল পুরাতন অনুভূতির নতুন সংযোজন ছাপিয়ে উঠেছে ।আর কবিতার মানুষ তো অনুভূতি নিয়েই খেলা করে –
Poetry is the spontaneous over flow of powerful feelings ,it takes its origin from emotion recollected in tranquility .
( Wordsworth)
কবিতার মানুষের সার্থকতা এখানেই এঁরা পরিচিত বিষয়টাকে অনুভূতির মশলা মিশিয়ে এমনভাবে উপস্থাপন করে যেন তা চিরনতুন ,চিরযৌবনা ,রক্ত-মাংসের ফুলেল শরীরের মতো আবেদনময় ।সম্পূর্ণ নতুন ।প্রচলিত চিন্তায় যদি মননের আশ্রয়ে আরেকটি নতুন সংযোজন না হয় তবে তা কবিমানুষের ব্যর্থতা –
It (poetry)awakens and enlarges the mind itself ...poetry lifts the veil from the hidden beauty of the world,and makes familiar object be as if they were unfamiliar .
(A Defence Of Poetry by Shelly )
অনুভূতির প্রকাশ ,বিকাশ ঘটিয়ে যে কবিতার জন্ম হয় তা কখনো দৃশ্যমান নয় ।দৃশ্যমান কেবলই লেখা ,আঁকাআঁকি ।সৃষ্ট কবিতার জায়গা মনে ,বোধে ।তাইতো কবিতা বুঝার জন্য অবশ্যই একটা প্রস্তুতিপর্বের দরকার ।কবিতা বুঝার জন্য সাত সমুদ্র তের শত নদী পাড়ি দিতে হয় ।কবিতা আলো নয় --রশ্মি ।কবিতা তো বাতাস নয় --তার শিহরণ ।কবিতা তো ভেজা বৃষ্টি নয় --তার বাণ ।কবিতা তো ছায়া নয়-- তার আবরণ । তাইতো আজও আমার কাছে বসওয়েল জনসনের কবিতা কি প্রশ্নের উত্তরটি অর্থসহ মনে হয়-- কবিতা কি নয় সেটা বলে দেওয়াই সবচেয়ে সহজ ।আলো কি জিনিস আমরা সকলেই জানি ।কিন্তু আলো কি সেটা বলা আদৌ সহজ নয় । তাই আবারও বলছি কবিতা দৃশ্যমান নয় ।অদৃশ্য কবিতা অদৃশ্য মননের পুষ্টি সাধন করে থাকে । ফলে কবি হয়ে ওঠে চিন্তাশীল ,মননশীল ।তবে মনে রাখা দরকার -ভাবনার একক -- অনুভূতি ।কবিতাকে সাধারণত দুটি দিক থেকে বিচার করা হয় ।তার ভাষা ও ভাবনা ।ভাষা ও ভাবনা পরিপূরক ।ভাষা ভাবনাবৃক্ষের আশ্রয়ে লালিত পালিত হয় ।তবে ভাবনার একটা ফাউন্ডেশন রয়েছে -- বিষয়বস্তু ।তাই কাব্য বিচারে ভাষা ও ভাবনার মধ্যে বিষয়বস্তু অবশ্যই বিচার্য বিষয় । রবীন্দ্রনাথের কাব্যভাষা সম্পর্কে কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদের মন্তব্য : উড়িসনে রে পায়রা-কবি খোপের ভিতর থাক ঢাকা , বাকবাকম আর ফোঁসফোঁসানি তাও কবিত্বের ভাব মাখা তাও ছাপালি গ্রন্থ হল নগদ মূল্য এক টাকা । মিঠে কড়া :কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদ রবি ঠাকুর সম্পর্কে কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদের মন্তব্য কেন ?বিষয়বস্তু পছন্দ হয়নি ,নাকি বাবু অনুভূতির বাজারে আগুন লাগাতে পারেনি ?তাঁর বিচার সময়ের আয়োজনে ।তবে বলতে পারি অনুভূতির প্রকাশ যেহেতু হয়েছে সেহেতু কবিতার জন্মও হয়েছে- এখন মহাকাল তাকে গ্রহণ করবে, কি করবে না, তা মহাকালের বিবেচ্য বিষয় ।অন্ধকার সরাতে আলোর আগমন ।আর সেই আলোতেই জন্মগ্রহণ করে ঈশ্বর ,কবিতার মানুষ ।আর কবিতার মানুষের প্রকাশিত বিষয়--যা প্রকাশ করার মাধ্যমে অপ্রকাশিত তা-ই কবিতা । কবিতা কী ?এই প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তাহলে এখন আমরা বলতে পারি যে ,কবিতা আসলে শব্দ নয় ,বরং শব্দকে ব্যবহার করবার এক রকমের গুণপনা ।ভাষার মধ্যে যা কিনা অন্যবিধ একটি দ্যোতনা এনে দেয় ।অথবা বলতে পারি কবিতা আসলে ভাষার একটি স্তর যা অনুভূতির আশ্রয়ে গড়ে ওঠে ।কবিভাবনা অবশ্যই ভাষার আশ্রয়ে তরতাজা হয়ে ওঠে –
অর্থ নয় ,কীর্তি নয় ,সচ্ছলতা নয়-
আরো এক বিপন্ন বিস্ময়
আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে খেলা করে
আট বছর আগের একদিন : জীবনানন্দ দাশ
কবিভাবনা প্রকাশের জন্য খুব অলঙ্কার শাস্ত্রের পারদর্শিতার প্রয়োজন নেই--প্রয়োজন ভালোবাসার ।ভাবনার প্রতি প্রীতি ।নদীর জলের সাগরের প্রতি ভালোবাসাই নদীকে সাগরে নিয়ে যায় ।ছন্দ তো নির্দিষ্ট নিয়মের পুনরাবৃত্তি ।আর শিল্প হলো সেই নির্দিষ্ট নিয়মের ভালোবাসার সংমিশ্রণ
The word poetry imports something quite peculiar in its nature ;something which may exist in What is called prose as well as in verse ;something which does not even require the instrument of words ,but can speak through the other audible symbols called musical sounds ,and even through the visible ones which are the language of Sculpture ,painting,and architecture-all this we believe,is and must be felt,though perhaps indistinctly,by all upon whom poetry in any of its shapes produces any impression beyond that of tickling the ear .
What is Poetry by John Stuart Mill (1806-1873)
তবুও বলি কবিতা বিষাদের ফল ।দুঃখের আবরণ ।আনন্দে কবিতা হয় না -নৃত্য হয় ।যেহেতু প্রতিটা মানুষই কবি ।তাই তার দুঃখ ,আনন্দ দুই ই আছে ।তবে আনন্দের মাঝে দুঃখের প্রলেপ আসবেই ।দুঃখের মধ্যে আনন্দ(হরিষে বিষাদ)মনোতীর্থের ব্যাপারমাত্র ।দুঃখকে ভাষায় রূপ দেয়া হচ্ছে কবিতা -- সেই কবিতার স্রষ্টাই হচ্ছে কবিতার মানুষ –
"সদর স্ট্রীটের রাস্তাটা যেখানে গিয় শেষ হইয়াছে ,সেইখানে বোধ করি ফ্রি স্কুলের বাগানের গাছ দেখা যায় ।একদিন সকালে বারান্দায় দাঁড়াইয়া আমি সেইদিকে চাহিলাম । তখন সেই গাছগুলির পল্লবান্তরাল হইতে সূর্যোদয় হইতেছিল ।চাহিয়া থাকিতে থাকিতে হঠাৎ এক মুহুর্তের মধ্যে আমার চোখের উপর হইতে যে একটা পর্দা সরিয়া গেল ।দেখিলাম ,একটি অপরূপা মহিমাময় বিশ্বসংসার সমাচ্ছন্ন ,আনন্দে এবং সৌন্দর্যে সর্বত্র তরঙ্গিত । আমার হৃদয়ে স্তরে স্তরে যে একটা বিষাদের আচ্ছাদর ছিল তাহা নিমিষেই ভেদ করিয়া আমার সমস্ত ভিতরটাকে বিশ্বের সমস্ত আলোক একেবারে বিচ্ছুরিত হইয়া পড়িল । " ফলে বিষাদ ফেটে জন্ম নিল রবি ঠাকুরের 'নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ' কবিতাটি । তবে কবিতার মানুষ কবিতা প্রসব করার সাথে সাথে ভুলে যায় সমস্ত দুঃখ ,ব্যথা ,যন্ত্রণা ।কবিতার ফুটফুটে মুখের দিকে চেয়ে কবিতার মানুষ 'পুষ্পের হাসি' হাসে ।যদি কবিতার মানুষ তখন জাহান্নামেও থাকে । কবিতার মানুষ অকপটে নিজের দুঃখগাঁথা কবিতামানবীর কাছে বলে ।বলে যাওয়ার মধ্যে তার সান্ত্বনা ,প্রাপ্তি ।এক সময়ে মানুষ ঘুমিয়ে যায় ।অনুভূতিও ঘুমিয়ে যায় ।ঘুমিয়ে যায় কবিতার মানুষ ।কবিতা ।মহাকাল শুধু রেখে যাওয়া সংঘবদ্ধ অনুভূতিগুলো নিয়ে খেলা করে—
'শ্রাবণ গগন ঘিরে ঘন মেঘ ঘুরে ফিরে
শূন্য নদীর তীরে রহিনু পড়ি
যাহা ছিল নিয়ে গেল সোনার তরী '
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর :সোনার তরী
ঘুমিয়ে যাওয়া কবিতার মানুষ আর বলে না –
হে বঙ্গ ,ভাণ্ডারে তব বিবধ রতন
তা সবে ,(অবোধ আমি )অবহেলা করি
মাইকেল মধুসূদন দত্ত :বঙ্গভাষা
My country! in the day of glory past
A beauteous halo circled round the brow
And worshipped as a deity thou must ;
(To India--my Native Land :H .L.V.Derozio)
'Poet a nasciture ,non fit .'তাই বলছি- - কবিরা কবি হয়েই জন্মায় ,তাঁদের তৈরি করে তোলা যায় না ।
আর কবি হলেন সেই ব্যথা ,কথা ,প্রথা যিনি বুঝেন কখনো কখনো বোঝান ।তবে কবি কখনো গৃহ শিক্ষকের মতো বোঝানোর উদ্দেশ্য কলম ধরেন না । তাঁর কলম কথা বলতে আরম্ভ করে যখন চিন্তার গোলায় আগুন লাগে ।আগুনের দুটি রূপ -- আলো ,তাপ । কখনো তাপের তাড়নায় কবি লেখেন আবার কখনো আলোর ঘ্রাণে লেখেন ।কবির লেখা মূলত অন্তরে চাষকৃত সম্প্রসারিত আগুনের অনুপ্রকাশ । আবুল হাসানের কবিতায় যখন পায়চারি করি তখন মন বলে তিনি যথার্থই বলেছেন--
ঝিনুক নীরবে সহো
ঝিনুক নীরবে সহো
ঝিনুক নীরবে সহে যাও
ভিতরে বিষের বালি
মুখ বুঝে মুক্তা ফলাও
সাগর ।ঝিনুকের দেশ ।সাগরের জল যখন ঘুমিয়ে পড়ে তখন ঝিনুক খাবারের সন্ধানে বের হয় ।জলের ঘুম হঠাৎ আসে হঠাৎ চলে যায় ।তাইতো সাগরের মাতৃরূপ ও বীররূপ দৃশ্যমান ।ঝিনুক শান্ত , ঘুমন্ত সাগরের জল থেকে 'প্লাঙ্কটন' খাবার হিসেবে গ্রহণ করে ।হঠাৎ সাগরের তর্জন ,গর্জন শুরু হয়ে যায় ।বালি ঢেউয়ের দেয়ালে আছাড় খেয়ে ঝিনুকের মুখের ভেতরের কাঁচা মাংসে আশ্রয় লাভ করে ।চোখে বালি পড়া অসহ্য ।তার চেয়ে অসহ্য বিব্রতকর অবস্থায় মুখোমুখি ঝিনুক । কাঁচা মাংসে প্রচণ্ড পেইন অনুভূত হয় ।আর এই পেইন থেকে রক্ষা পাওয়ার নিমিত্তে সে রস নিঃসরণ করে- বালিকে কেন্দ্র করে । নিসৃত রস বালির চারদিক ঘিরে ফেলে ।এক সময় বালির চারিদিকে একটা আবরণ তৈরি হয় - অনেকটা মার্বেলের মতো - তাই মুক্তা ।ঝিনুক সাগরের গভীর দেশে চলে যায় (ঝিনুকে মুক্ত হলে চুপ মেরে যায় মুখ মেলে না /যায় যে চলে গভীর জলে /কিনারেতে আর আসে না)। সাগরের গভীর দেশে চলাচলকারী ঝিনুক আর পূর্বের সামাজিক ঝিনুক এক নয় - সে এখন মুক্তাওয়ালা ঝিনুক ।এক ঝাঁক ডুবরি তাকে খুঁজতে সাগরের গভীর দেশে তল্লাশি চালায় ।কারণ পেইন ঝিনুকের মধ্যে জন্ম দিয়েছে মুক্তা - কবিতা ।যা ঝিনুকের ব্যথার ফল ।
হে ব্যথা তুমিই কবিতা ।তাইতো অন্তরে ঘুমিয়ে থাকা অনুভূতিকে বেত্রাঘাত করে ভাষার আস্তরণে নিয়ে আসো - প্রলেপ দিয়ে যাও বিভিন্ন রীতিবদ্ধ নিয়মের সারিবদ্ধ প্রাপ্তির । তুমি বেঁচে থাক ব্যথা ,বেঁচে থাক ।লালিত -পালিত হও তুমি প্রতিটি সৃষ্টিশীল সত্তায় –
আমি একটা পাখি পুষি
গোলাপ ফুলের কুঁড়ি পুষি
ব্যথা ।
কুড়ির থেকে গোলাপ ফোটে
পাখি নাচে পাখি ওড়ে
ব্যথা নাচে ব্যথা ফোটে
ব্যথা।
আমি একটা ব্যথা পুষি । আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ
অনেকে মনে করেন কবি সমাজের অসঙ্গতি সামাজিক মানুষের কাছে তুলে ধরেন ,সমাজকে বদলানোর চেষ্টা করেন ।আসলে কী তাই ? সমাজ বদলানোর জন্য কী তাঁর লেখনি ।মোটেও না । কবিতার মানুষটির কাছে কবিতা হলো খাদ্যগ্রহণের মতো একটি জৈবিক কাজ । বনে বাস করে সাধক । তাকে খাদ্যগ্রহণ করতে হয় ।বনে চাল ,মাছ পাওয়া যায় না । রান্না করার উপকরণ এখানে স্বপ্ন ।তবুও সাধক বাঁচতে চায় ।পাখিরাও সেখানে বাঁচে ।ফল খেয়ে ।সব ফল আবার সাধকের খাবার নয় ।পাখি যে ফল খায় ,সাধক তা খেতে পারে ।কারণ ,পাখি যে ফল খেয়ে মারা যায় না ,সাধকও মারা যাবে না ।সাধক --পাখির খাদ্য ফল ,নিজের খাদ্য হিসেবে বেছে নিলো ।পাখি কোনোদিন বলেনি তুমি তা খাও ।সাধকের নিজের প্রয়োজনে তা খেতে হয় ।তাই বলছি -- কবিতা হলো চিন্তার জৈবিক বলয়ে ঠিক পাখির খাদ্যের মতো ।সে সমাজকে বলে না তোমরা কবিতা পড় । তবে সমাজকে তার অস্তিত্ব রক্ষার দাবিতে কবির জৈবিক বলয়-- কবিতার দেশে যেতে হয় ।আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ একথাটিই খুব সুন্দর করে তাঁর কবিতায় বলেছেন –
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে ঝড়ের আর্তনাদ শুনবে ।
যে কবিতা শুনতে জানে না সে দিগন্তের অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে ।
যে কবিতা শুনতে জানে না সে আজন্ম ক্রীতদাস থেকে যাবে ।
আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি : আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ
হয়তো সে কারণে কবিরা কবিমানুষের কবিতার দেশে বিচরণ করে । আমি প্রায়ই বলি যাদের অনুভূতি আছে তারাই কবি -- আর কবিতা হলো সেই অনুভূতির প্রকাশ । তবে আমরা ভুল করব যদি বলি প্রতিটি মানুষ কবি না ।প্রতিটি মানুষই কবি তবে অনুভূতির সাপেক্ষে ।কবিতার আসনে ভর করে কবি হয় না ,কবির আসনেই কবিতার জন্ম ।
তবে কবিতার মানুষ আর কবির মধ্যে একটি পার্থক্য আছেই ।কবি সারা জীবন অনুভূতিকে গারগিল করে আর কবিতার মানুষ সেই অনুভূতিকে হজম করে শক্তি আহরণ করে ,জীবনের আয়োজন ও প্রয়োজনের মধ্যে সমন্বয় ঘটান । কবিগণ আজীবন শিশু থেকে যায় কিন্তু কবিতার মানুষ মরণ অবধি অনুভূতির বাজারে নতুন নতুন চিন্তার চাষ করে কালের যোনিতে স্থাপন করে ।মনে পড়ে গেল John Keats তাঁর বন্ধুকে (John Hamilton Reynolds) ১৮১৮সালের ১৯ফেব্রুয়ারিতে লেখা চিঠির কয়েকটি লাইন , An old man and a child would talk together and the old man be lead on his path and the child left thinking ... অনুভূতি তুমিই কবি- তবে কবিতা নও !
সূর্য অন্ধকারের দেশে যাচ্ছে ।ঘুমাবে ।সারাদিন কাজ করে ক্লান্ত ।বাল্মীকি ।এক ডাকাতের নাম ।তবে তারও অনুভূতি আছে ।বসে আছে অনুভূতির সাগরে চিন্তার শরীরকে ডুবিয়ে ।জীবনে প্রোথিত নিয়ম মেনে দুটি ক্রৌঞ্চ পাখি প্রণয়লীলায় ব্যস্ত । হঠাৎ এক শিকারির চোখে দোল খায় পাখিদ্বয়ের প্রণয়কার্য ।শিকারির ধনুকের আঘাতে মারা যায় ছেলে পাখিটি-- পড়ে থাকে তার মৃত দেহ ।স্বামীর বিরহে মেয়ে পাখিটি লাশের চারদিক ঘুরতে থাকে ।আর কান্না করতে থাকে ।ডাকাত বাল্মীকির অনুভূতির এম্বুলেন্স তখন কবিতার হাসপাতালে ।সৃষ্টি হয়ে যায় কবিতা—
মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শাশ্বতী সমাঃ ।
যৎ ক্রৌঞ্চমিথুনাদেকবধীঃ কামমোহিতম্ ।।
কবি বাল্মীকি হয়ে গেলেন কবিতার বাল্মীকি ! আমি সিঙ্গাপুরের অন্যতম প্রধান আধুনিক কবিকণ্ঠ লী জু পেং কে সাধুবাদ জানাই | কারণ কবিতা সম্পর্কে তাঁর কথা নয় ,ভাবের সাথে সত্যিকারের কবি ও কবিতার বিষয়বস্তু অনেকটা তথ্য -উপাত্তের সঠিকতা খুঁজে পাওয়া যায় বলে --কবিতা লেখাটা হলো ম্যাজিসিয়ানরা যেভাবে হ্যাটের ভেতর থেকে এটা ওটা বের করে তেমনি ।তবে একটা পার্থক্য :ম্যাজিসিয়ানরা জানে কি বের হবে ।কিন্তু কবিরা লিখতে আরম্ভ করলে বুঝতে পারে না ,শেষ পর্যন্ত কি লিখবেন । প্রশ্ন উঠতে পারে কবিতার মধ্যে শিল্প থাকবে কি না ।অবশ্যই শিল্প থাকবে ।ভালোবাসা ।কবিতার শিল্প ।ভালোবাসা ছাড়া মানুষ অচল -কবিতাও তাই ।এ ভালোবাসা কেবল নারীর মাংস ,পুরুষ ও নারীর মনে সীমাবদ্ধ নয় ।কোনো ভালোবাসা ,প্রেম স্বর্গ থেকে আসে না ,আসে মানুষের অনুভূতির শেকড় থেকে ।আর সেখানে মানুষ যত সুন্দর যত সাবলীল তার সজ্জিত অনুভূতিগুলোতে চিন্তা ততোই নান্দনিক ।ব্যক্তিমানুষ হয়ে যায় স্বর্গমানুষ ।ফলে তার মন হয় স্বর্গের চারণভূমি ।আর এই স্বর্গ কবিতার মানুষের কবিতা -কবিতার দেশ ।যেখানে উপকরণ অনেক ,উপকরণ প্রণেতা একজন –
Alone ,alone all ,all alone
Alone on a wide wide sea
আর একের কুঞ্জে কবির কবিতা বাস করে ।তাই হল ঈশ্বর ।সংকোচনে বললে কবিতার মানুষ ।কবিতার ঈশ্বর সমাজে প্রচলিত ঈশ্বর ,দেবী ,দেবতা তৈরি করেছেন ,করে থাকবেন ।কিন্তু হাসি ।একা একা ।সাথে অবশ্যই মনদেবতাকে ডিসকাসমেট হিসাবে নিই যখন শুনি ,দেখি --সৃষ্ট ঈশ্বর ,দেব ,দেবী কবিতার ঈশ্বরকে কাব্যজ্ঞান দান করে –
পুরাকালে সরস্বতী পুত্র কামনা করিয়া হিমালয় পর্বতে তপস্যা করিয়াছিলেন ।সন্তুষ্ট মনে ব্রক্ষা তাঁহাকে বলিলেন -'আমি তোমার পুত্র সৃষ্টি করিতেছি ।'(রাজশেখর ও কাব্যমীমাংসা: শ্রীনগেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী )ফলে সৃষ্টি হয় কাব্যপুরুষ । কিন্তু আমার অন্তর পাড়ে বেদনার সুনামি বার বার আঘাত হানে যখন কবিতার ঈশ্বররা সৃষ্ট ঈশ্বরের কাছে কাব্য সৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করে ,পূজা নিবেদন করে - -
বন্দি চরণাবিন্দ অতি মন্দমতি
আমি , ডাকি আবার তোমায় ,শ্বেতভুজে
ভারতি !যেমতি ,মাতঃ,বসিলা আসিয়া ,
বাল্মীকির রসনায় (পদ্মাসনে যেন )
যবে খরতর শরে ,গহন কাননে ,
তাহলে কবিতার মানুষ মাইকেল ,তোষামোদকারী ?সমাজে প্রচলিত দেবীর বন্দনা করে সে কি কবিসত্তাকে নর্দমায় নামায়নি ? তাকে কবিতার ঈশ্বর বলা যায় ?নাকি সে বিদেশি সাহিত্যের অন্ধ অনুকরণে নিজের চিন্তায় গা ভাসিয়ে দিয়েছে –
Sing to me of the man , Muse ,
the man of twists and turns
driven time and again off course
Once he had plundered the hallowed heights of Troy
(The Odessa-Robert Fagles ,Translation 1996)
O Muse ,o high genius ,aid me now
O memory that engraved the things I saw ,
Here shall your worth be manifesto to all !
Dante Alighieri canto of the Inferno- Anthony Esoler translation ,2002
তবে মনোজগতে সান্তনার হাওয়া দোল খায় ঢলে ঢলে এই ভেবে মিউজ কিংবা সরস্বতী চরিত্রগুলো অন্য কোন কবিতার মানুষ তথা ঈশ্বরের সৃষ্টি ।এখানে কেবল পুরাতন অনুভূতির নতুন সংযোজন ছাপিয়ে উঠেছে ।আর কবিতার মানুষ তো অনুভূতি নিয়েই খেলা করে –
Poetry is the spontaneous over flow of powerful feelings ,it takes its origin from emotion recollected in tranquility .
( Wordsworth)
কবিতার মানুষের সার্থকতা এখানেই এঁরা পরিচিত বিষয়টাকে অনুভূতির মশলা মিশিয়ে এমনভাবে উপস্থাপন করে যেন তা চিরনতুন ,চিরযৌবনা ,রক্ত-মাংসের ফুলেল শরীরের মতো আবেদনময় ।সম্পূর্ণ নতুন ।প্রচলিত চিন্তায় যদি মননের আশ্রয়ে আরেকটি নতুন সংযোজন না হয় তবে তা কবিমানুষের ব্যর্থতা –
It (poetry)awakens and enlarges the mind itself ...poetry lifts the veil from the hidden beauty of the world,and makes familiar object be as if they were unfamiliar .
(A Defence Of Poetry by Shelly )
অনুভূতির প্রকাশ ,বিকাশ ঘটিয়ে যে কবিতার জন্ম হয় তা কখনো দৃশ্যমান নয় ।দৃশ্যমান কেবলই লেখা ,আঁকাআঁকি ।সৃষ্ট কবিতার জায়গা মনে ,বোধে ।তাইতো কবিতা বুঝার জন্য অবশ্যই একটা প্রস্তুতিপর্বের দরকার ।কবিতা বুঝার জন্য সাত সমুদ্র তের শত নদী পাড়ি দিতে হয় ।কবিতা আলো নয় --রশ্মি ।কবিতা তো বাতাস নয় --তার শিহরণ ।কবিতা তো ভেজা বৃষ্টি নয় --তার বাণ ।কবিতা তো ছায়া নয়-- তার আবরণ । তাইতো আজও আমার কাছে বসওয়েল জনসনের কবিতা কি প্রশ্নের উত্তরটি অর্থসহ মনে হয়-- কবিতা কি নয় সেটা বলে দেওয়াই সবচেয়ে সহজ ।আলো কি জিনিস আমরা সকলেই জানি ।কিন্তু আলো কি সেটা বলা আদৌ সহজ নয় । তাই আবারও বলছি কবিতা দৃশ্যমান নয় ।অদৃশ্য কবিতা অদৃশ্য মননের পুষ্টি সাধন করে থাকে । ফলে কবি হয়ে ওঠে চিন্তাশীল ,মননশীল ।তবে মনে রাখা দরকার -ভাবনার একক -- অনুভূতি ।কবিতাকে সাধারণত দুটি দিক থেকে বিচার করা হয় ।তার ভাষা ও ভাবনা ।ভাষা ও ভাবনা পরিপূরক ।ভাষা ভাবনাবৃক্ষের আশ্রয়ে লালিত পালিত হয় ।তবে ভাবনার একটা ফাউন্ডেশন রয়েছে -- বিষয়বস্তু ।তাই কাব্য বিচারে ভাষা ও ভাবনার মধ্যে বিষয়বস্তু অবশ্যই বিচার্য বিষয় । রবীন্দ্রনাথের কাব্যভাষা সম্পর্কে কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদের মন্তব্য : উড়িসনে রে পায়রা-কবি খোপের ভিতর থাক ঢাকা , বাকবাকম আর ফোঁসফোঁসানি তাও কবিত্বের ভাব মাখা তাও ছাপালি গ্রন্থ হল নগদ মূল্য এক টাকা । মিঠে কড়া :কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদ রবি ঠাকুর সম্পর্কে কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদের মন্তব্য কেন ?বিষয়বস্তু পছন্দ হয়নি ,নাকি বাবু অনুভূতির বাজারে আগুন লাগাতে পারেনি ?তাঁর বিচার সময়ের আয়োজনে ।তবে বলতে পারি অনুভূতির প্রকাশ যেহেতু হয়েছে সেহেতু কবিতার জন্মও হয়েছে- এখন মহাকাল তাকে গ্রহণ করবে, কি করবে না, তা মহাকালের বিবেচ্য বিষয় ।অন্ধকার সরাতে আলোর আগমন ।আর সেই আলোতেই জন্মগ্রহণ করে ঈশ্বর ,কবিতার মানুষ ।আর কবিতার মানুষের প্রকাশিত বিষয়--যা প্রকাশ করার মাধ্যমে অপ্রকাশিত তা-ই কবিতা । কবিতা কী ?এই প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তাহলে এখন আমরা বলতে পারি যে ,কবিতা আসলে শব্দ নয় ,বরং শব্দকে ব্যবহার করবার এক রকমের গুণপনা ।ভাষার মধ্যে যা কিনা অন্যবিধ একটি দ্যোতনা এনে দেয় ।অথবা বলতে পারি কবিতা আসলে ভাষার একটি স্তর যা অনুভূতির আশ্রয়ে গড়ে ওঠে ।কবিভাবনা অবশ্যই ভাষার আশ্রয়ে তরতাজা হয়ে ওঠে –
অর্থ নয় ,কীর্তি নয় ,সচ্ছলতা নয়-
আরো এক বিপন্ন বিস্ময়
আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে খেলা করে
আট বছর আগের একদিন : জীবনানন্দ দাশ
কবিভাবনা প্রকাশের জন্য খুব অলঙ্কার শাস্ত্রের পারদর্শিতার প্রয়োজন নেই--প্রয়োজন ভালোবাসার ।ভাবনার প্রতি প্রীতি ।নদীর জলের সাগরের প্রতি ভালোবাসাই নদীকে সাগরে নিয়ে যায় ।ছন্দ তো নির্দিষ্ট নিয়মের পুনরাবৃত্তি ।আর শিল্প হলো সেই নির্দিষ্ট নিয়মের ভালোবাসার সংমিশ্রণ
The word poetry imports something quite peculiar in its nature ;something which may exist in What is called prose as well as in verse ;something which does not even require the instrument of words ,but can speak through the other audible symbols called musical sounds ,and even through the visible ones which are the language of Sculpture ,painting,and architecture-all this we believe,is and must be felt,though perhaps indistinctly,by all upon whom poetry in any of its shapes produces any impression beyond that of tickling the ear .
What is Poetry by John Stuart Mill (1806-1873)
তবুও বলি কবিতা বিষাদের ফল ।দুঃখের আবরণ ।আনন্দে কবিতা হয় না -নৃত্য হয় ।যেহেতু প্রতিটা মানুষই কবি ।তাই তার দুঃখ ,আনন্দ দুই ই আছে ।তবে আনন্দের মাঝে দুঃখের প্রলেপ আসবেই ।দুঃখের মধ্যে আনন্দ(হরিষে বিষাদ)মনোতীর্থের ব্যাপারমাত্র ।দুঃখকে ভাষায় রূপ দেয়া হচ্ছে কবিতা -- সেই কবিতার স্রষ্টাই হচ্ছে কবিতার মানুষ –
"সদর স্ট্রীটের রাস্তাটা যেখানে গিয় শেষ হইয়াছে ,সেইখানে বোধ করি ফ্রি স্কুলের বাগানের গাছ দেখা যায় ।একদিন সকালে বারান্দায় দাঁড়াইয়া আমি সেইদিকে চাহিলাম । তখন সেই গাছগুলির পল্লবান্তরাল হইতে সূর্যোদয় হইতেছিল ।চাহিয়া থাকিতে থাকিতে হঠাৎ এক মুহুর্তের মধ্যে আমার চোখের উপর হইতে যে একটা পর্দা সরিয়া গেল ।দেখিলাম ,একটি অপরূপা মহিমাময় বিশ্বসংসার সমাচ্ছন্ন ,আনন্দে এবং সৌন্দর্যে সর্বত্র তরঙ্গিত । আমার হৃদয়ে স্তরে স্তরে যে একটা বিষাদের আচ্ছাদর ছিল তাহা নিমিষেই ভেদ করিয়া আমার সমস্ত ভিতরটাকে বিশ্বের সমস্ত আলোক একেবারে বিচ্ছুরিত হইয়া পড়িল । " ফলে বিষাদ ফেটে জন্ম নিল রবি ঠাকুরের 'নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ' কবিতাটি । তবে কবিতার মানুষ কবিতা প্রসব করার সাথে সাথে ভুলে যায় সমস্ত দুঃখ ,ব্যথা ,যন্ত্রণা ।কবিতার ফুটফুটে মুখের দিকে চেয়ে কবিতার মানুষ 'পুষ্পের হাসি' হাসে ।যদি কবিতার মানুষ তখন জাহান্নামেও থাকে । কবিতার মানুষ অকপটে নিজের দুঃখগাঁথা কবিতামানবীর কাছে বলে ।বলে যাওয়ার মধ্যে তার সান্ত্বনা ,প্রাপ্তি ।এক সময়ে মানুষ ঘুমিয়ে যায় ।অনুভূতিও ঘুমিয়ে যায় ।ঘুমিয়ে যায় কবিতার মানুষ ।কবিতা ।মহাকাল শুধু রেখে যাওয়া সংঘবদ্ধ অনুভূতিগুলো নিয়ে খেলা করে—
'শ্রাবণ গগন ঘিরে ঘন মেঘ ঘুরে ফিরে
শূন্য নদীর তীরে রহিনু পড়ি
যাহা ছিল নিয়ে গেল সোনার তরী '
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর :সোনার তরী
ঘুমিয়ে যাওয়া কবিতার মানুষ আর বলে না –
হে বঙ্গ ,ভাণ্ডারে তব বিবধ রতন
তা সবে ,(অবোধ আমি )অবহেলা করি
মাইকেল মধুসূদন দত্ত :বঙ্গভাষা
My country! in the day of glory past
A beauteous halo circled round the brow
And worshipped as a deity thou must ;
(To India--my Native Land :H .L.V.Derozio)
'Poet a nasciture ,non fit .'তাই বলছি- - কবিরা কবি হয়েই জন্মায় ,তাঁদের তৈরি করে তোলা যায় না ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন