চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে দুইবার আসলাম। তিন বছর আগে এসেছিলাম ছোট বোনকে ভর্তি করানোর জন্য, আবার এইবার আসলাম আমাদের সবার ছোট বোনকে ভর্তি করানোর জন্য। আগে চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে আমার ধারনা ছিল গুড বেটার বেস্ট জাতীয় স্কেলে। এখন সিদ্ধানে অবস্থান নিয়ে কিছু কথা বলা যেতেই পারে।
বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞান অর্জনের জায়গা না, জ্ঞান চর্চার জায়গা। মানুষ জ্ঞান অর্জন করে মানুষের কাছ থেকে, তার পারিপার্শ্বিকতার জায়গা থেকে, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মানুষ কখনো জ্ঞান অর্জন করতে পারে না। অর্থাৎ জ্ঞান অর্জনের জন্য একটি পারিবারিক বলয়ের প্রয়োজন হয়ে থাকে। চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় পারিবারিক বলয়ের এক জীবন্ত ব্লাকহোল-- এখানে সবাই আসে বিচ্ছিন্ন মানসিকতা নিয়ে কিন্তু এক পারিবারিক মানসিকতা নিয়ে বের হয়ে যায়। চলনে বলনে এমন যৌথ খামার পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল যদিও বিপুলা এই পৃথিবীর কতটুকু আর জানি।
পাহাড় থেকে জুদা হওয়া এক সৌন্দর্য কন্যার নাম চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। পাহাড়ি অতিথি মাঝেমাঝে হৃদয়ের টানে বেড়াতে আসে লোকালয়ে। তাই কোনো সকালে আপনি হয়তো মর্নিংভ্রমনে হাঁটতে বের হলেন, দেখবেন হরিন এসে আপনার সামনে কিছু গোপন দৃষ্টি বিনিময় করছে। চিতা বাঘও নেমে আসে। তবে রাতের আড়ালে ডাকাতের মতো, আবার সিদুঁরকাটা চোরের মতো চলেও যায়। নাগও কিন্তু নাগিনীকে নিয়ে হানিমুন করতে আসে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে-- ছাত্ররা তাদের বিশেষ আপ্যায়নের ব্যবস্থা করে, তবে অধিকাংশ সময় নাগনাগিনী মনুষ্যআপ্যায়নের কোনো সুযোগই গ্রহন করে না।
টিব্যাগের চা এখানে পাইনি। কোমল পানীয় এখানকার ছাত্ররা তেমন পান করে না! বিটিভির রুটিনমাফিক প্রোগ্রাম এখনো এখানকার পাহাড়ি মাটির ঘরে একমাত্র চ্যানেল। কোথাও কোথাও অবশ্যই ডিশ চ্যানেলের আধিক্য দেখা যায়। ফাস্টফুড দোকানের আধিক্য নেই। জোবরা গ্রামের সিএনজি চালক ওসমান অবশ্যই ইংরেজিতে কথা বলে নিজেকে আন্তর্জাতিক মানুষ হিসাবে প্রমান করতে চায়। তাহলে চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বারী ভাই? বারী ভাই তো বারী ভাই!
বারী অর্থ পবিত্র, বিরত থাকা, সব কিছুর উর্ধ্বে। বারী ভাই অন্তত বিয়ে করা থেকে বিরত থেকে নিজের নামের যথার্থ গুরুত্ব রক্ষা করেছে। তার নামে প্রীতিলতা হলের পাশে হতাশার মোড় তৈরি হয়েছে। প্রেমিকা না পাওয়ার কারনে বিনয় মজুমদার চলে গেলেন গ্রামে, হেলাল হাফিজ বসবাস করতে লাগলেন আবাসিক হোটেলে আর বারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে। বারী ভাই প্রীতিলতা হলের সামনে যে জায়গাটিতে দীর্ঘশ্বাস উড়ায় সেই জায়গাটি আজকে
হতাশার মোড় নামে পরিচিত। মিস্টার বারী কিন্তু সত্যিই একজন জ্ঞানী মানুষ, কথায় কথায় ইংরেজি শব্দ বলে নিজেকে আন্তর্জাতিক মানুষ প্রমান করতে চায় না।
জিরো পয়েন্ট থেকে ফরেস্টি বিভাগের দিকে হাঁটতে লাগলাম। আমার সাথে শাওন, বয়াতি, রুবেল। শাওন লেখক মানুষ। চেহারায় মাটির গন্ধ। বয়াতি গায়ক মানুষ। কন্ঠে জীবনচেতনা, মর্মে প্রেম। রুবেল ছোট ভাই। পাহাড়ি রাস্তা পাহাড়ি কন্যার মতো হৃদয়ে প্রেম তৈরি করে, দৃষ্টিতে নিয়ে আসে ওঁম শান্তি।
রাত তখন এগারো। কবিতা স্মরনী রাস্তায় যেতেই মানুষ দেয়া আলো অফ, নেমে আসে প্রকৃতির শাসন। পাহাড় থেকে গাছের ফাঁকে ফাঁকে নেমে আসছে চমৎকার মিষ্টি অন্ধকার, পাহাড়ি অন্ধকার জীবনে প্রথমবারের মতো দেখা, অব্যক্ত ভালো লাগা হৃদয়ের কুরছিতে জমা হতে থাকে-- বাসর রাতে বউকে দেখার মতো পাহাড়ি অন্ধকারকে লাজুক চোখে খুড়ে খুড়ে দেখতে হয়। তারপর চলে পাহাড়ের অনেক ভেতরে কোনও এক গোপন আস্তানায় বাঁশি আর গানের একটানা সুর।
আজ চাঁদ পৃথিবীর খুব কাছে চলে আসছে। সরকার আমিন ভাই ফোন করে জানতে চাইলেন আমি কোথায়। তারপর জানতে চাইলেন চট্রগ্রামে চাঁদ আছে কিনা। বললাম খুব আছে, সুন্দর করে আছে, ঝাউফুলের ফাঁকে ফাঁকে আছে।
ছিনাল জোছনা গতরে মেখে আমরা ঝুপড়ি থেকে শাটল ট্রেনের উদ্দেশে হাঁটছি। আমরা বলতে বয়াতি, পাথর, দীপান্বিতা, শাওন, অনিক, সুমন, রুবেল আর আমি এমরানুর রেজা। পাথর চমৎকার প্রানশক্তির অধিকারী এক নারী, সদানন্দময়ী, উচ্ছ্বাসে সাইডুলি। চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে সে প্রথম কোনো নারী যে আঞ্চলিক সংগঠনের সভাপতি। চরম আড্ডাবাজ। গতরের কালারে অবশ্যই আমি আর সে কোরাম করতে পারি। তবে আমরা কোরামচর্চা করতে রাজি না। আমরা মনে করি মানুষ শেষ পর্যন্ত মানুষের কাছে বেঁচে থাকে, আবার মানুষের কাছ থেকেই মানুষের মৃত্যু ঘটে। তাই আমাদের কোরামের নাম হৃদয়, মনুষ্যহৃদয়।
দীপান্বিতা ব্রাক্ষ্মনবাড়ীয়ার মেয়ে। প্রান থেকে হাসে। অনিকের পান চিবানোর মধ্যে একটি রসিক রসিক ভাব আছে, তার দৃষ্টিতে কোথায় যেন একখান ঢাকনা আছে, সহজে পাঠ করা যায় না। সুমনের হৃদয়স্পর্শী একটি সবুজ মাঠ আছে যেখানে কোনো এক ভোরে দৃষ্টি বিনিয়োগ করার কথা।
আমরা হাঁটছি। বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরির সামনে আসতে কোনো এক ছলাৎছলাৎ শব্দের দিকে আমার কান যায়। চমৎকার সুন্দর মিষ্টি এক নারী যেন চাঁদ দিয়ে বানানো এক বিশেষ অবয়ব। চাঁদের দিকে তাকাব, না মেয়েটির দিকে তাকাব বুঝতে পারছি না। আমাকে বুঝতে হবে, কারন আমার হাতে বেশি সময় নেই, কারন আমাকে আজকে বাড়ি যেতে হবে, কারন আমাকে শাটল ট্রেন ধরতে হবে।
শাটল ট্রেন একটি বিনোদন পার্কের নাম। শহরে যে ছাত্ররা থাকে তারা এই পার্কে করে ক্লাস করার জন্য আসে। লাইভ কনসার্ট এই পার্কের নিয়মিত উপন্যাস। এখানে সিনেমার ব্যবস্থাও আছে, আবার রেটিনার মতো বস্তুকে উল্টো করে দেখার প্রবনতাও রয়েছে-- মস্তিষ্ক একসময় তার মতো করে উল্টো সাজেশনকে সোজাও করে নেয়। শাটল ট্রেনে যে লাইভ কনসার্ট চলে সেটা আসলে প্রস্তুতি পর্ব বলা যায়। ফাইনাল রাউন্ড চলে ঝুপড়িতে এসে।
ঝুপড়ি অনেকটাই চায়ের দোকান। ঝুপড়ির টেবিল মিউজিক্যাল ইন্সট্রুমেন্ট। চায়ের চামচ, গ্লাসও সঙ্গীতানুষ্ঠানে সহযোগিতা করার জন্য আসে। ঝুপড়ি কেন্দ্রিক গানের যে আসর সত্যিই তা হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করার মতো, তারন্য দিয়ে আবেগ খরচ করার মতো।
ট্রেনে উঠে গেলাম। তাদের আন্তরিক চোখগুলো দৃষ্টিসীমানার আড়ালে চলে গেলো। কানে বাজতে থাকে শাওনের কথাটি--
রেজা ভাই, খুব রুমমুখো হয়ে গিয়েছিলাম, আবার হয়ে যেতে হবে।