রবিবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০১৪

জীবনের ঘ্রাণ

ভৈরব থেকে আশুগঞ্জ। অটোরিক্সা করে আসা যায়। তার জন্য ভাড়া গুনতে হয় পঁচিশ টাকা। সৈয়দ নজরুল ইসলাম সেতু অতিক্রম করে আশুগঞ্জ তিন রাস্তার মোড়ে এসে নামলাম। মিষ্টি খিদা অনুভব করছি। তাই সরাসরি বাড়ি যাওয়া বেটার। তিন রাস্তার মোড় থেকে দুইভাবে বাড়ি যাওয়া যায়,

এক : আলম নগরের রাস্তা দিয়ে
দুই : আশুগঞ্জ ফার্টিলাইজার-এর পথ দিয়ে

ভাই, যাবেন?
কই?
বাজার চারতলা।

 ওডেন।

রিক্সাওয়ালার নাম ইকবাল মিয়া। বাড়ি দৌলত কান্দি। তার দুই ছেলে,  এক মেয়ে। বড় ছেলেটা ক্লাস সেবেনে পড়ে, ছোট মেয়ে প্লে ওয়ানে, মেজ ছেলে ক্লাস ফোরে।

বাপ যদি সন্তান জন্ম দিয়া পরালেহা না করাইতে পারে তইলে হে বাপের নামে কলংক

ইকবাল মিয়ার কথা শুনে বেশ ভালো লাগল। চুপ করে কথা শুনতে থাকি। মাঝে মাঝে ছোট ছোট প্রশ্ন করি। এই ছোট্ট প্রশ্ন তার কথাকে দীর্ঘমেয়াদি করে। আমার সাথে কথা বলে সেও হয়তো আরামবোধ করছে। কারন দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছানোর তাড়া তার প্যাডেলে দেখতে পাচ্ছি না।
সে নয় বছর মালয়েশিয়া ছিল। ছোট দুইটা ভাইকে বিদেশ নিয়ে সে দেশে চলে আসে। আবার চলে যাবে। সন্তান নেয়ার ব্যাপারে সে খুব হিসাবী। তিন বছর পর পর সে সন্তান নিয়েছে।

ভাই দেশ কেমন চলছে?

হুব বালা। পুলিশের বেতন বারছে, অহন হেরা বালা কইরা ডিউটি পালন করে, আগে এমন দেহি নাই।

ইকবাল মিয়ার আপন চাচাতো ভাই মেজর। এখন মিশনে আছে আফ্রিকায়।  আগে তার ভাইটি বিএনপি করত। এখন নাকি আওয়ামীলীগ-এ যোগ দিয়েছে। তবে চার লাইনের রেলপথ তৈরির সিদ্ধান্ত ও বাস্তবায়নের প্রক্রিয়ার সরল প্রসংশা করেছে ইকবাল মিয়া।
ইকবাল মিয়া বসে থাকতে রাজি না। সে মনে করে বিদেশে বাঙালীরা যে ডিউটি পালন করে বাংলাদেশে যদি তা করে তবে টাকার অভাব হবে না।

আপনার দৈনিক উপার্জন কত?
আদা বেলায় পাচ শ টেহা।

নিজের রিক্সা। তাই রিক্সাভাড়া গুনতে হয়না। আমি কে বা কী করি সে একবারও জানতে চায়নি। নিজের কথা, দেশের কথা বলতে বলতে লালপুরের কোণায় চলে আসে ।
তাকে চল্লিশ টাকা ভাড়া দিয়ে বিদায় নিলাম। এখান থেকে বাবার বাড়ি পাঁচ মিনিটের পথ। বর্ষাকালে এখান থেকেই খেয়ানৌকায়
উঠতে হয়। শীতকাল বলে শুধু বাঁশের সাঁকো পার  হলেই বাজার চারতলা। শীতকালের এই মরা নদীটির পূর্বপাড় ঘিরে আড়াইসিধা গ্রাম, পশ্চিম পাড় ধরে চরচারতলা ইউনিয়ন তথা আশুগঞ্জ বন্দরের অবস্থান। এক সময় চরচারতলাও আড়াইসিধা ইউনিয়নের অন্তুর্ভুক্ত ছিল। গ্রাম্য স্বার্থকে কেন্দ্র করে বড় ধরনের একটি ঝগড়া হয়, তাতে চরচারতলার একজন মানুষ মারা যায়, আড়াইসিধারও একজন মানুষ মারা যায়। তখন থেকে তারা আলাদা ইউনিয়ন।

বাঁশের সাঁকোর ভাড়া দুই টাকা। আমি যখন ছোট ছিলাম তখন ভাড়া ছিল পঞ্চাশ পয়সা। কখনো পয়সা দিতাম না। কোনোক্রমে সাঁকো থেকে নেমে এক দৌড়, আমাকে আর পায় কোথায়। সপ্তম শ্রেণীতে যখন পড়ি তখন থেকে সাঁকো ভাড়া দেয়ার বিষয়ে সচেতন হয়। কিন্তু আমি যখন দিতে শিখলাম তারা আর নিতে চায়না।

আজকে ভাড়া নেয়ার দায়িত্বে আছে সুজন। প্রতিবন্ধী। ছোট কালে পোলিও হয়েছিল। ফলে বাম পাটি শক্তিহীন হয়ে পড়ে। এখনো পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে। সে এখন  নবম শ্রেণীর ছাত্র।  আমাকে দেখা মাত্র ভরাট কণ্ঠে `কাকা ডাক'। তারপর একগাদা অভিযোগ -- আমি নাকি সুজনের ছবিতে কোনো লাইক দেয়না অথচ সে আমার ছবি দেখামাত্র লাইক দেয়, তার কবিতা কেন আমার পত্রিকায় ছাপায়নি ....এমন অনেক অভিযোগ।
সুজনকে ভাড়া দিতে চাইলাম। সে আমার কাছ থেকে ভাড়া নিবে না তো নিবে না।
সাঁকোর পাশেই কনি জাল দিয়ে মাছ ধরার চেষ্টা চলছে। মাছ আসে না।

কীভাবে আসবে?
নদীতে তো মাছ নেই।

তারপরও চেষ্টা থেমে থাকে না।
সুজনকে চা খাওয়ার দাওয়াত দিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটছি। রাস্তার কুমারী বাঁক, বাঁকে বাঁকে জীবনের ঘ্রাণ, আমার লেপ্টে থাকা শৈশব।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন