বুধবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৪

শীতলক্ষ্যা

নদীর সাথে নদীর, নদীর সাথে সাগরের, সাগরের সাথে মহাসাগরের সম্পর্ক সরাসরি। আল্লার সাথে বান্দার সম্পর্ক সরাসরি বলেই আল্লা- বান্দার সম্পর্কে কখনো ফাটল সৃষ্টি হয়না। জলের এই শুদ্ধতম সম্পর্ক দেখে উপলব্ধির জায়গা শাণিত করার জন্য সুযোগ পেলেই ছুটে চলি নদীর আলিঙ্গনে। দিনটা ঢেকে আছে কুয়াশার আবরনে। জানুয়ারি শীতলতম মাস। শীতলতাও বেশ প্রাসঙ্গিক। শীতকালে শীতলক্ষ্যা স্নানে প্রশান্তিময় হবে আমার গোপন আস্তানা। তাইতো শীতলক্ষ্যার দিকে ছুটে চলা।
শীতালক্ষ্যা নদী (যা লক্ষ্ম্যা নদী নামেও পরিচিত) হল ব্রহ্মপুত্র নদের একটি উপনদী। এর গতিপথের প্রাথমিক পর্যায়ে এটি দক্ষিণ পশ্চিমে এবং পরে নারায়ণগঞ্জের পূর্ব দিয়ে কালাগাছিয়ার কাছে ধলেশ্বরী নদীর সাথে মিশেছে। এর উপরিভাগের একটি অংশ বানর নদী নামে পরিচিত। নদীটি প্রায় 39 কিলোমিটার লম্বা এবং নারায়ণগঞ্জের নিকটে এর সর্বোচ্চ প্রস্থ প্রায় ৩০০ মিটার। এর সর্বোচ্চ প্রবাহ ডেমরার কাছে ২,৬০০ কিউসেক। সারা বছর ধরে এর নাব্যতা বজায় থাকে।
এই শীতলক্ষ্যার জোয়ার নিয়মতান্ত্রিক। অর্থাৎ পলিসি মেইনটেইন করে চলে। নদী অবশ্যই মাত্রা, ছন্দ মেনে চলে। তবে দৃশ্যমান চোখে তা সবসময় মাপা যায়না। কিন্তু যে শীতলক্ষ্যাকে দেখলাম সেই শীতলক্ষ্যার গতিবিধি চোখের ক্যালকুলাসে ধৃত। চুপচাপ বয়ে চলার দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে।

আমরা তিন জন। কাজী বর্ণাঢ্য, মাইন উদ্দিন সরকার আর আমি। ইচ্ছে ছিল রিক্সা করে চরসিন্দুর গ্রামে যাওয়া। কিন্তু কলের কাজ যে বলে চলেনা। তাই সিএনজি করে শীতলক্ষ্যা অভিমুখে। সিএনজি গ্রাম্যনিয়মে ছুটে চলছে। আমি ড্রাইভারের বাম পাশে বসা। সম্পাদক ও কবি বসে আছে পেছনের সিটে। গল্প করা ইচ্ছা থাকলেও সুযোগ নেই। কারন সিএনজি কাজের চেয়ে কেওয়াজ করে বেশি। চারপাশের দৃশ্যগুলো চোখকে টেনে তার দিকে নিয়ে যায়। গ্রামগুলো যেন সবুজের পাহাড়। আর আমরা সবুজপাহাড়ের গুহার ভেতর দিয়ে স্বর্গয়ীয় ঝরণার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। তালতলী গ্রামে যখন আমরা তখন একটি নতুন কবরের দিকে তাকানোর জন্য মন চোখকে হুকুম দেয়। চেয়ে দেখি এটি কবর নয়, মাজার।নাম নাজানা বাবার মাজার। তাও আবার রাস্তার পাশে। রাস্তার পাশে মাজার থাকলে ব্যবসা ভালো হওয়ার সম্ভাবনা বেশ। তাছাড়া গ্রামের মানু মাজারকে বৈষয়িক সফলতার হাসপাতাল মনে করে। ফলে মাজারে বিশ্রাম নেয়া বাবার ফান্ডে দুই-এক টাকা করে জমা হতে থাকে। যেহেতু বাবা রাস্তার পাশে তার সোস্যাল কেপিটেল ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাবে আবশ্যিকহারে।

যাক, বাবার কাছে দোয়াপ্রার্থনা করে উদ্দেশ্যের দিকে যাচ্ছি। কিছুক্ষণ পর চোখে আসে সবুজের মাঠে ইটমিল। সারি সারি কাঁচা ইট রাখা। এইভাবে রাখা হয় পনেরো দিন। তারপর আগুনের চুল্লিতে রাখা হয় প্রায় পনেরো দিন। ইট বলতে যা বোঝানো হয় তাকে আমরা পাই প্রায় দেড় মাস পর। আর দেড় ঘণ্টা পর সূর্যের  স্বাভাবিক আভাটুকু থাকবেনা।সূর্যের আভাহীন শীতলক্ষ্যা দেখার অভিপ্রায় নেই প্রায়। তাই একটু তাড়া।

চরসিন্দুর গ্রামে এসে পৌঁছালাম বিকালের শেষ লগ্নে। সোমেন চন্দ পাঠাগারের সামনে আমরা। অনেক দিন আগ থেকেই এই পাঠাগারের গল্প শুনতাম। গল্প শুনতাম শহিদুল হক সুমন ভাইয়ের। তিনি সুমন স্যার নামে এলাকায় পরিচিত। মুক্তমনা মানুষ। গল্প লিখেন। তার সাংগঠনিক ব্যবহার প্রসংশা করার মতো। সমাজ, মানুষকে নিয়ে তাঁর ভাবনা স্তাবকতার যোগ্যতা রাখে। পাঠাগার থেকে একটি সিগারেট খাওয়ার দূরত্বে আমাদের আরাধ্য শীতলক্ষ্যা। শীতলক্ষ্যার গন্ধ পাচ্ছি। মৃন্ময় গন্ধ। প্রিয়ার ডাকে প্রিয় লেইট অস্তির বিরক্তিকর। তাই আমার শরীর, মন নিয়ে শীতলক্ষ্যার কাছে নিজেকে সমর্পণ করলাম। নদী মানেই মা, নদী মানেই প্রিয়া। তাইতো সব নদীর পাড়ে মানুষের বসতি। এই শীতলক্ষ্যায় জেলের প্রাচুর্য নেই, স্বল্পতার গ্লানিও নেই। জেলেরা শীতলক্ষ্যার মতোই ধারাবাহিক। কুমিল্লার গোমতী নদী যেন এই নদীর ছোট বোন। দুই বোন নিজ কাজে আড়ম্বরহীন আন্তরিক। নদীর এপারে নরসিংদী, ওপারে গাজীপুর। নদীকে কেন্দ্র করে অধিকাংশ প্রাদেশিক বিভক্তি হয়ে থাকে। কিন্তু নদী তো বিভক্তি চায়না। নদী কখনো চায়না পৃথিবীর বুকে আরেকটি পৃথিবী হোক। অথচ সে-ই বিভক্তির অনুঘটক। নদীর দুঃখ হয়তো এখানেই।
রাত নেমে আসে। শীতের রাত। শীতলক্ষ্যার সাথে দেখা করার জন্য অন্ধকারে সাথে দলে দলে নেমে আসে কুয়াশার তাবলিক। শীতলক্ষ্যার কাছ থেকে বিদায় নিলাম। সেও আমাদের বিদায় দিল, বড়ই নির্লিপ্ত শীতলক্ষ্যার বিদায়ভাষা। অটোরিক্সা করে নীড়ে ফেরার পরিক্রমা ।সবুজের পাহাড় থেকে নেমে আসা বাতাসের সাথে ধাক্কা অনুভূত ,শীতল ধাক্কা। একেকটি ধাক্কা যেন একেকটি জীবনের স্পন্দন, মধুময় প্রশান্তি।কত অব্যক্ত দৃশ্যপ্রিয়া লেপ্টে আছে সেই প্রশান্তির কানায়-কোনায়।। 

1 টি মন্তব্য:

  1. শীতলক্ষা য়ে আপনার লেখাটা পড়ে ভাল লাগল। খুব ভালো বলতে পারলামনা কারণ বিস্তারিত বিবরন উপন্যাসের, মূল শীতলক্ষার বিবরন ছোট গল্পের মত মনে হল। আবশেষ ধন্যবাদ।

    উত্তরমুছুন