রবিবার, ১৩ মে, ২০১৮

ওয়াজাদা এক‌টি বিপ্লবের নাম

আরবি শব্দ وجدة, যার অর্থ দাঁড়ায় এমন একজন নারী যে তার অস্তিত্ব খুঁজে পায়। অস্তিত্ব মানে সাহস যা মানুষের মৌলিক গুন। একমাত্র সাহসই মানুষের চরিত্রের মৌলিক দিক যা মানুষের চরিত্রের অন্য দিকগুলোকে হেফাজত করে বা বিকশিত করে তুলে।

তাহলে ওয়াজাদা সিনেমায় কে সাহসী বা অস্তিত্ববান?

অবশ্যই হাইফা আল মনসুর। কারন অনেক। তবে তার দূরদর্শী মানসিকতার সাথে সর্বময় দৃষ্টিকোনের দিকটি গুরুত্বপূর্নভাবে আলোচনার দাবি রাখে।

ওয়াজাদা এক‌টি সিনেমা। দশ বছরের এক‌টি মেয়ের সাইকেল কেনার কাহিনিকে মূল বিন্দু ধরে সৌদি আরবের জীবনাচার তুলে ধরার প্রয়াসই ওয়াজাদার প্রধান চরিত্র। এই সিনেমার লেখক ও পরিচালক হাইফা আল মনসুর। হাইফা আল মনসুরের বাবা একজন কবি। ফলে ছোটকাল থেকেই সৌদি আরবের ধুলাবালির ভেতর যে জীবননাশকারী সাপ লুকিয়ে আছে তার সন্ধান পেয়েছিলেন হাইফা আল মনসুর। তাইতো নির্মান করেন প্রথার বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষনাকারী সিনেমা ওয়াজাদা।

ওয়াজদা এক‌টি সাইকেল কিনবে। তার সামাজিক প্রথা বলে মেয়েদের সাইকেল কেনা যাবে না। ওয়াজদা সামাজিক প্রথা মানতে রাজি নয়। তার বন্ধু আবদুল্লাহ তাকে সাইকেল শিখতে সহযোগিতা করে। ওয়াজদা বিভিন্ন উপায়ে টাকা জমাতে থাকে। সবুজ কালারের সাইকেলটি কিনতে ওয়াজদার আটশত রিয়াল প্রয়োজন। সে সাতশত তের রিয়াল সংগ্রহ করেছে এবং সাতাশি রিয়াল মাকে দেয়ার জন্য অনুনয় করে। কিন্ত তার মা সাইকেল কেনার ব্যাপারে সরাসরি নিষেধাজ্ঞা জারি করে।

পাঠশালার কুরান প্রতিযোগিতায় ওয়াজদা প্রথম পুরস্কার পায়। পাঠশালার চেয়ারম্যান তাকে অভিন্দন জানায় এবং জানতে চায় পুরস্কার হিসাবে পাওয়া এক হাজার রিয়াল দিয়ে সে কী করবে।
ওয়াজদা পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দেয় যে সে এক‌টি সাইকেল কিনবে। চেয়ারম্যান তার উপর রেগে যায়। কারন চেয়ারম্যানের পাঠশালা মেয়েরা রাস্তায় সাইকেল চালাবে এমন অনুমতি দেয় না। তাই সে পুরস্কারবাবদ এক হাজার রিয়াল পায় না। কিন্তু ওয়াজদার মনে প্রশ্ন থেকে যায় তার বন্ধু আবদুল্লাহ যদি রাস্তায় সাইকেল চালাতে পারে তবে সে কেন নয়! তার মনের প্রশ্ন এক সময় বিজয়ের মুখ দেখে। ওয়াজদা রাস্তায় সাইকেল নিয়ে বের হয় এবং তার বন্ধু আব্দুল্লাহকে অনেক পেছনে ফেলে প্রধান রাস্তার বড় বড় গাড়ির সাথে পাল্লা দেয়ার জন্য প্রস্তুতি নেয় ওয়াজদার সাইকেল।

সিনেমার ব্যাপ্তিকাল আটানব্বই মিনিট। চমৎকার অভিনয় করেছে ওয়াজদা, রিম আব্দুল্লাহ মানে ওয়াজদার মা, ওয়াজদার বন্ধু আব্দুল্লাহ। তারা কাহিনির সাথে মিশে যেতে পেরেছে। সিনেমা দেখতে দেখতে কখনো মনে হয়নি কোনো চরিত্র অভিনয় করছে, মনে হচ্ছে বাস্তবিক চোখের সামনে ঘটে যাওয়া কোনো কাহিনিপ্রবাহ। এর জন্য অবশ্যই ডিরেক্টরকে ধন্যবাদ দিতে হয়। সৌদি আরব সিনেমাটি নির্মানের অনুমতি দিলেও সৌদি আরবের জনগন সিনেমা নির্মানের মানসিকতা লালন করে না, তার উপরেও আরেকটি কথা আছে-- হাইফা আল মনসুর একজন নারী। নারী রাস্তায় নেমে ডিরেকশন দিবে, তাও আবার সিনেমার কেরেক্টারদের! অসম্ভব! একদম অসম্ভব!!

আর এই অসম্ভব কাজটি সম্ভব করলেন হাইফা আল মনসুর। তার জন্য অবশ্যই তাকে অনেক কৌশল অবলম্বন করতে হয়েছে। তিনি ভ্যানে থেকে যন্ত্রের মাধ্যমে ডিরেকশন দিয়েছেন। ফলে দেখা যায় আউটডোর শট থেকে ইনডোর শটগুলো বেশ পরিচ্ছন্ন।

পরিবেশ দেখানোর ব্যাপারে ডিরেক্টর যথেষ্ট মার্জিত। ডিরেক্টরের মূল দৃষ্টি ছিল সৌদি আরবের কালচারে নারীর অবস্থান।

ঘরে ঝুলানো বংশ তালিকায় ওয়াজদার কোনো নাম নেই। কারন সে মেয়ে। ওয়াজদা তা মেনে নেয়নি, ওয়াজদা ঠিকই তালিকায় নিজের নাম লিখে দেয়। মাথায় স্কার্ফ পরে যাওয়ার জন্য বাধ্যতামূলক আদেশ দেয় পাঠশালা। ওয়াজদা তাও মেনে নেয়নি। একটি ছেলের জন্য ওয়াজদার বাবা আরেকটি বিয়ে করতে চায়। ওয়াজদা তাও মেনে নিতে পারে না। ওয়াজদা তার মাকে লাল পোশাকটি মার্কেট থেকে কিনে তার বাবার মাথা ঘুরিয়ে দেয়ার পরামর্শ দেয়। কারন ওয়াজদা মনে করে লাল পোশাকটিতে তার মাকে সুনিপুন অপরূপ দেখায়। কিন্তু তার মা লাল পোশাকটি কিনে নাই, লাল পোশাকের জন্য যে টাকা তার কাছে সঞ্চ‌িত ছিল তা দিয়ে কিনেছে ওয়াজদার জন্য সাইকেল। ওয়াজদাই এখন তার সব, সব ফেলে তার স্বামী চলে গ্যাছে দ্বিতীয় বিয়ের কাছে।

সৌদিজীবনাচার আর আধুনিক জীবনবোধের দ্বন্দ্ব দেখানোর জন্য ওয়াজদার সাইকেল কেনার ইচ্ছাটি মূলত রূপক।

সালাতের জন্য মসজিদে প্রবেশ করবে এমন সময় ওয়াজদা তার বন্ধু আব্দুল্লাহকে শিষ দেয়। সৌদিজীবনাচারে মেয়েদের শিষ দেয়া এমনিতেই নিষিদ্ধ তাও আবার সালাতের জন্য মসজিদে যাচ্ছে এমন এক‌টি যুবককে। এমন করে অনেক নিদারুন সুন্দর আচরন করেছে আধুনিক জীবনের প্রতিবিম্ব ওয়াজদা। প্রতিষ্ঠাকে প্রশ্ন করে ওয়াজদা সফলও হয়েছে, কেবল সফল হতে পারেনি হাজার বছরের পুরাতন পুত্রলিস্পা বাবার কাছে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন