মঙ্গলবার, ৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

চাঁদ দেখবো বলে

ভাষা কোনো এঁদো পাতকুয়ো নয়, বরং প্রবহমান স্রোত যা চলতে চলতে খেয়ালমত দিক পরিবর্তন করে, তাকে সময় দিয়ে বেঁধে রাখা মুশকিল। বিদ্যাসাগর যে বাংলা লিখে গেছিলেন তাঁর গদ্যে, যা প্রধানত সংস্কৃত-নির্ভর, আজকালকার ছেলে-ছোকরারা, যারা বাংলা সাহিত্য সম্বন্ধে তত উৎসাহী নয় অথচ বাংলাভাষীই, তারা তার কতখানি বুঝবে? শ্রীকৃষ্ণকীর্তন যখন লেখা হয়েছিল, তখনও তো এ দেশে পর্তুগীজরাই আসেনি, আলু-টমেটো-আনারসের স্বাদ বাঙালি তখনো পায়নি, চা তো দূরস্থান। আসেনি ফরাসী, ওলন্দাজ, দিনেমার, ইংরেজরাও তাদের নিজেদের ভাষার শব্দের ঝুলি নিয়ে। বাংলা শব্দভান্ডার তখন নিজস্ব শব্দ ছাড়া সংস্কৃত ও প্রাকৃত শব্দ দিয়েই ভর্তি। মুসলমান অনুপ্রবেশের সাথে সাথে আরবি-ফারসি মিশেছে বাংলা শব্দভান্ডারে। তার পরে যত ইওরোপিয় ‘বিদেশি’ শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটেছে, ততই বাংলা পুষ্ট হয়েছে। বাঙালি যতই পরিচিত হয়েছে সমগ্র বিশ্বের সাথে, ততই তাদের কথা বলার, আচার-ব্যবহারের, পোশাক-পরিচ্ছদের পরিবর্তন হয়েছে, বদলে গেছে ভাষাও।

ভাষার ভৌগোলিক সীমারেখা টানাও অসম্ভব। মেদিনীপুর জেলার দাঁতন যদি হয় পশ্চিমবঙ্গ-উড়িষ্যা সীমার পশ্চিমবঙ্গের দিকে শেষ রেলস্টেশন আর জলেশ্বর উড়িষ্যার দিকে প্রথম, তার মানে কি দাঁতনের লোকের ভাষা বাংলা আর জলেশ্বরের ওড়িয়া, আর তারা আপেল আর কমলার মত পুরোপুরি আলাদা? নো ওয়ে! দাঁতনের মানুষ বরং চট্টগ্রামের বা শ্রীহট্টের বাংলাকে হিব্রু বলে ভুল করলে তাদের বিশেষ দোষ দেওয়া যাবে না।

যদি চট্টগ্রামের ভাষা আর পুরুলিয়ার ভাষা দুটোকেই আমরা বাংলা বলে মানি ও স্বীকার করি, তবে চর্যাপদের বা তারও আগে বঙ্গভূমির লোকেরা যে ভাষায় কথা বলত, তাকে বাংলা বলে মানতে কী অসুবিধা?

লিপিও তাই। মনে রাখতে হবে, লিপি শিল্পীর সৃষ্টি। যতক্ষণ না মুদ্রণযন্ত্রে তা ছাপা হচ্ছে, কোনো দুজন ব্যক্তি তা হুবহু একই রকমভাবে লিখতে – অর্থাৎ আঁকতে – পারেন না। তারা দেখতে একই রকম হয় হয়ত, কিন্তু একই হয় না। আমরা এখন যে লিপি লিখতে বা পড়তে অভ্যস্ত, তাও তো হুবহু একই নয়, যদি তা ছাপা হয় বিভিন্ন ফন্টে। সিয়াম রূপালি আর বৃন্দা বা একুশে সিরিজের ফন্টগুলোর মধ্যে পার্থক্য নেই? তাও তো এগুলোর একটা বর্ণ হুবহু একই ছাপা হয়, আমরা যখন লিখি, আমাদের প্রতিটি বর্ণই একটু আধটু আলাদা হয়। সময়ের সঙ্গে এর পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। বাংলা ছাপার ইতিহাস তো মাত্রই দুশো বছরের। মুদ্রাকর চার্লন্স উইলকিন্স বঙ্গসন্তান পঞ্চানন কর্মকারকে দিয়ে কাঠের ও ধাতুর ‘টাইপ’ তৈরি করলেন, প্রতিটি বর্ণের জন্যে চার আনা মজুরি দিয়ে। উইলিয়ম কেরি শ্রীরামপুরে প্রেস বসালেন ঊনবিংশ শতাব্দীর একেবারে গোড়ায়, প্রধানত যাবতীয় ভারতীয় ভাষায় বাইবেল ছাপানোর জন্যে। সেখানে বাইবেলের সঙ্গে সঙ্গে ছাপানো হ’ল রামরাম বসুর লিপিমালা, প্রতাপাদিত্য চরিত, দেওয়ান কার্তিকেয়চন্দ্রের রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের জীবনী ক্ষিতীশবংশাবলিচরিতম্‌। সেই সব করার সময় যে লিপি ব্যবহার করা হ’ল, ধরে নেওয়া অন্যায্য নয় যে সেগুলো পঞ্চানন কর্মকারের নিজের হাতের লেখার মতই বা তিনি যেমন বাংলা লিপি দেখতে অভ্যস্ত ছিলেন, সেই লিপিই। তখন যুক্তাক্ষর লেখার সমস্যা ছিল, র-ফলা, রেফ, ঋ-কার ইত্যাদিরও। যে রকম লেখা হয়েছিল, এখন তার থেকে অনেক আলাদাভাবে লেখা হয়। সে যুগের আগে যারা ভূর্জপত্র-টত্রে লিখতেন, তারা কীভাবে লিখতেন, তারাই জানেন। এখনও অনেকে রঞ্জন-এর ঞ্জ আর বিজ্ঞান-এর জ্ঞ-এর পার্থক্য করতে পারে না নিজে লেখার সময়, স-এর নিচে ত বসালে (অর্থাৎ স্ত লেখার সময়) যে স-এর চেহারা পুরো পালটে যায়, তা কজন নজর করে খেয়াল করে?

উত্তর ভারতের সমস্ত ভাষাই লেখা হয় নাগরী হরফে, যা নাকি ব্রাহ্মী থেকে খরোষ্ঠী হয়ে উদ্ভূত। দেবনাগরী, বাংলা, হিন্দী, পঞ্জাবী, মরাঠী, অসমিয়া – সবই তার বিভিন্ন রূপ। সুদূর তিব্বতের কিছু লিপির সঙ্গে আমাদের বাংলার লিপির মিল আছে।

 সারা পৃথিবীতে এখন বাংলা ভাষাভাষীর সংখ্যা পঁচিশ কোটির বেশি। অথচ এই সেদিন বঙ্কিম লিখে গেছিলেন – সপ্তকোটিকণ্ঠকলকলনিনাদকরালে; রবিও লিখেছিলেন – সাত কোটি সন্তানেরে, হে মুগ্ধ জননী। মানে তখন বঙ্গভূমে সাত কোটির কাছাকাছি মানুষ। ছিয়াত্তরের মন্বন্তর হয়েছিল ১৭৭০ সালে, তাতে এক-তৃতীয়াংশ মানুষ মারা গেছিল, তিন কোটি থেকে লোক হয়ে গেছিল দুই কোটি। এই সংখ্যাগুলো যদি পেছন দিকে নিয়ে যাওয়া যায়, দেখা যাবে শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের সময় এই নদীজপমালাধৃতপ্রান্তর-অধ্যুষিত বিস্তৃত বঙ্গভূমে মানুষ ছিল মাত্রই কয়েক লক্ষ। তাদের মধ্যে খুব যোগাযোগ থাকা খুব স্বাভাবিক নয়, কাজেই ভাষার ও লিপির সাম্য না থাকাই স্বাভাবিক।

বাংলা ভাষা ও তার লিপির ইতিহাস নিয়ে বক্তৃতা করতে গেলে এই সামান্য কথাগুলো মাথায় রাখতেই হবে।
*
*
*
(লেখক-- অমিতাভ প্রামানিক!)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন