রবিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২১

পাজুন বিছুন বইল ফাজুন বিছঐন

 বইল। আমের মকুলকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া অঞ্চলের মানুষ বইল বলে। মুকুল> বুকুল> বইল অথবা বউল> বইল। 


ফাজুন মানে লাঠি।গরুকে দিয়ে হালচাষ করার জন্যে একধরনের লাঠির দরকার হতো— সেই বিশেষ ধরনের ছোট মাঝারি  শক্তিশালী লাঠিকে ফাজুন বলে। এই লাঠিটা সাধারণত বরাক বাশ দিয়ে তৈরি করা হতো। 


হালের বলদ দিয়ে মাঠে হাল বাওয়া হতো ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত— কোন কোন সময় হালের বলদ দুর্বল হয়ে শুয়ে পড়তো— আইল্লা পাজুন দিয়ে পিটানো হতো এক্টিভেট হওয়ার জন্য— তাতেও যদি বলদ সক্রিয় না হতো, তাহলে বলদের লেজের মাথায় সুঁই ঢুকানো হতো— কোনো কোনো সময় ম্যাচ জ্বালিয়ে সেকা দেওয়া হতো লেজের আগায়— সেকা খেয়ে বলদ লাফ দিয়ে উঠে পড়তো!


বিছঐন মানে পাখা— চমৎকার হাতের কারুকাজ সংবলিত পাখা। যখন বিদ্যুৎ ছিল না তখন কৃষি প্রধান বাংলার মানুষের শরীরে বাতাস করার প্রধান হাতিয়ার ছিলো বিছঐন। বিছঐন হওয়া মানে বিচলিত হওয়া— অতো বিছঐন  অইছো কেরে? বিছঔনে গ্রামবাংলার মায়েরা বউরা সুইসুতা দিয়ে চমৎকার চমৎকার কথা লিখে রাখতেন—



পাখি উড়ে গেলে নিচে থাকে ছায়া 

মানুষ মরে গেলে থাকে শুধু মায়া



ফুল ফুটে ঝরে যায় দুনিয়ার রীতি

মানুষ মরে গেলে থাকে শুধু স্মৃতি


বিছঐনে অনেক গ্রামীন নারী আবার তার মুর্শিদের নাম,তার স্বামীর নাম অথবা ছেলের নাম লিখে রাখতো। সন্তান জন্মগ্রহন করলে অনেকে বিছঐনে জন্মতারিখটি লিখে রাখতো সন্তানের নামসহ। তালপাতার বিছঐন খুবই আলোচিত ও জনপ্রিয়।  তবে কাপড় দিয়ে বানানো বিছঐন খুবই প্রচলিত ও টেকসই এবং সহজলভ্য। ফুল পাখি লতা পাতার চিত্রের সুইসুতা-অঙ্কন একটি স্বাভাবিক ব্যাপার। গ্রামের মহিলারা এই শিল্পকর্মটি করতো বর্ষাকালে। কারন তখন তাদের হাতে তেমন কাজ থাকতো না— টানা বৃষ্টি হতো। 


বাংলাদেশের অনেক এলাকায় বিশেষ করে টাঙ্গাইল ও ঢাকার কয়েকটি অঞ্চলে বিছঐনকে বলে পাংখা। 'পুরাই পাংখা' এমন একটি শব্দ শুনতে পাওয়া যায়। 'পুরাই পাংখা' মানে খুব আনন্দে আছে, ভাবে আছে, ইউফোরিয়া মোডে রয়েছে এমন ভাবকে নির্দেশ করে। 


সংস্কৃত ব্যজন ( বি+ অজ্+অন) মানে বাতাস করার কাজ বা পাখাকে নির্দেশ করে। পাখাকে সংস্কৃতিতে ব্যজনীও বলে। এই ব্যজনী শব্দ থেকে বিছঐন শব্দের সৃষ্টি। বর্তমানে প্লাস্টিকের বিছঐন পাওয়া যায়। রাজাদের আমলে বিখ্যাত ছিলো ময়ূর পালকের বিছঐন।


টাঙ্গাইল জেলায় বিছুন মানে বীজ— টাঙ্গাইলের কোনো কোনো জায়গায় বিছন শব্দের ব্যবহার পাখা অর্থে শুনতে পাওয়া যায়। তবে ময়মনসিংহ ও নরসিংদী জেলায় বিছুন মানে বিজনি মানে হাতপাখা। বিছুন নিয়ে আমরা আঞ্চলিক ছড়ারও খোঁজ পেয়ে থাকি,


ইছুন বিছুন

দরগার বিচুন

উঠ উঠ বউগো

মোমের ছাতি ধরগো

মোমের ছাতি উগুরা

ফাল দিয়ে ধরে ডুগুরা


বেচয়েন ফারসি শব্দ এবং এটি বিশেষন যার অর্থ অস্থির। বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলে 'চৈন নাই' বলে একটি শব্দ ব্যবহার হয়ে থাকে। চৈন নাই মানে স্থিরতা নাই— অস্থির। অনেকে মনে করেন বেচয়েন বা বেচৈন থেকে বিছুন শব্দের যাত্রাপথ রচিত হয়েছে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন