১৬১০ সাল। সুবেদার। বাংলার সুবেদার ইসলাম খান চিশতি ঢাকায় আসন পাতেন। সুবেদার সাহেবের সাথে অসংখ্য পশ্চিম ভারতীয়, আফগান, ইরান-আরবি তথা বহিরাগত মুসলমান-সনাতনী ঢাকায় আসেন। এই আগমন ধারা আরও প্রায় ২৫০ বছর চলমান থাকে বুড়িগঙ্গা নদীর তীর ধরে। সুবেদার ইসলাম খান চিশতিকে মেন্টর মনে করে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে গড়ে উঠা এই বিশাল জনস্রোতের ধারাই আজকের পুরান ঢাকা। তবে আলো ব্যবসা জুতা ব্যবসা আলু ব্যবসা মাছ ব্যবসাকে কেদ্র করে প্রচুর মিশ্রিত জনস্রোত এই পুরান ঢাকায় পাওয়া যায় যা সুবেদার সাহেবের রচিত জনস্রোতের বাইরে।
পুরান ঢাকার মানুষ যে ভাষায় কথা বলে তা মূলত সোব্বাসী ভাষা। সুখে বাস করা বা সুখবাস থেকে সোব্বাস। সোব্বাস ঢাকাইয়ারা সুখকে বলে সোখ।সুখ থেকে সোখ, ফলে সুখবাস থেকে সোব্বাস।
পুরান ঢাকার মানুষ যে সুখে বসবাস করতে পছন্দ করে তার অনেক উদাহরন দেয়া যাবে। তবে একজন মানুষের কথা বলি। মানুষটির সাথে আমার ইদানিং পরিচয় হয়েছে। আমিনুল ইসলাম লিটন। পারিবারিকভাবে পাচ রুমের একটি ফ্লাট পেয়েছেন তিনি। নিচতলায়। কয়েকটি রুম ভাড়া দিয়েছেন, বাকি রুমে পরিবার নিয়ে থাকেন লিটন সাহেব। কোনো কাজ নেই। কোনো কাজ নেই বলতে জীবন নিয়ে পুরান ঢাকার মানুষদের ভাবনা খুবই সাদাসিধা। এতো দৌড়াদৌড়ি নেই।তাড়াহুড়ো নেই।
লিটন সাহেব একটি চায়ের ছোট্ট দোকান দিয়েছেন নিজ ফ্লাটের একপাশে। সারাদিনে চার-ছয়শো টাকা থাকে। বন্ধুবান্দবরা আড্ডা দিতে আসে। দিব্বি আনন্দে দিন চলে যায়। যারা জীবনের অসম প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে স্বস্তি -শান্তিময় শব্দের সাথে কোনো দেখা নাই, দেখা নাই প্রিয় হাসি ☺ আড্ডাময় চলিত জীবনের সাথে, যারা আটকা পড়েছে যান্ত্রিক পৃথিবীর নির্মিত বিলাসিতায় তারা নিশ্চিতভাবে আমিনুল ইসলাম লিটন সাহেবের ছোট্ট চায়ের দোকানে গিয়ে খুজে নিতে পারেন জীবনের নির্ধারিত মানে।
দুইদিন চা খেলাম। একদিনও টাকা দিতে পারি নাই। আপ্যায়ন। তাদের কাছ থেকে শুধু বিরানি খাওয়া শিখলেই চলবে না আক্কাস— আপ্যায়ন করাও শিখতে হবে।
লিটন সাহেবের কাছ থেকে শিখে নিলাম সোব্বাসী সাতটি বারের নাম— শানিচার। ইতোয়ার।সাম।মঙ্গল। বোধ। বৃহস্পতি।জুম্মা।
আওকাত মানে ক্ষমতা। তাও লিটন সাহেবের কাছ থেকে শিখলাম। তবে সোব্বাস আর ঢাকাইয়া উর্দু ভাষার মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে। সোব্বাস আরবি উর্দু হিন্দি ইংরেজি গুজরাটি বাংলার মিশ্রনে এক ভাষা— হামাকো বাড়িমে তোমোকা দাওয়াত।
শিয়া সম্প্রদায় ও নবাব খাজা আব্দুল গনির পরিবার ঢাকাইয়া উর্দু ভাষা ব্যবহার করতেন এবং করেন— হামলোগকা ঘারপে তুমলোগকা দাওয়াত। বলে রাখা ভালো— খাজাদের পারিবারিক কথ্য ভাষা ছিলো কাশ্মীরি ভাষা।
লিটন সাহেব যখন কথা বলেন তখন তিনার মুখের শব্দের দিকে তাকিয়ে থাকি আমি। তিনি বাংলা ভাষায়ও চমৎকার কথা বলতে পারেন। তিনার সহজ সরল ইন্দুরদৌড় প্রতিযোগিতাহীন জীবনকে শ্রদ্ধা করতে ইচ্ছে করে আমার। তাদের প্রায় চারশো বছরের পুরান ঢাকায় বহিরাগত লোকদের ব্যস্ততার ঘাম দেখে তারা নিশ্চয়ই রসিকতার অট্টালিকা হাসি ☺ দিয়ে থাকে মনে মনে— আসলেই জীবন বিক্রি করে আপনারা আমরা জীবনের ছায়া কিনছি ব্যস্ততার বিলাসিতার লোভব্যুহে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন