বৃহস্পতিবার, ১২ নভেম্বর, ২০২০

মহেশখালীতে এমরানুর রেজা ভাই

 যদি সুন্দর একখান মুখ পাইতাম

যদি নতুন একখান মুখ পাইতাম

মইশখালীর পানের খিলি তারে

বানাই খাওইতাম। 


এই  গানটির সুরকার ও গীতিকার এম এন আখতার। তিনি জীবনে বিচিত্র ধরনের গান রচনা করেছেন। তার গানের সংখ্যা পাচ হাজারের অধিক। তার একনিষ্ঠ শিষ্য শেফালী ঘোষ।শেফালী ঘোষ চট্রগ্রামের গানকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন। শেফালী ঘোষের কন্ঠে প্রথম মহেশখালীর নামটি শুনি। অবশেষে মহেশখালী আসি। সবাই মহেশখালী এসে স্পটের দিকে দৌড়াতে আরম্ভ করে। মহেশখালীর দর্শনীয় স্থান আদিনাথ মন্দির, বৌদ্ধ মন্দির, শুটকি মহাল, হাসের চর ইত্যাদি ইত্যাদি। পৃথিবীর যেখানেই যাই সেখানে যাওয়ার পর আমি নিজে একটি জায়গা আবিষ্কার করি যেটা আমার দর্শনীয় স্থান এবং যেখানে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা দিতে থাকি। পাবলিক বাসের টুরিস্টদের মতো স্পটের দিকে ঘামেটামে দৌড়ানো পাবলিক এমরানুর রেজা নহে। 


লোকাল ঘাট। লোকাল ঘাটে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা কেটে যায় আমার। মহেশখালীর পান খেতে খেতে চলতে থাকে রাসেল ভাইয়ের সাথে আড্ডা। রাসেল ভাই এই লোকাল ঘাটে পান বিক্রি করে। মহেশখালীর নারীদের কাছে প্রেমকুমার নামে পরিচিত সে। প্রায় এক হাজার প্রেম করেছে বলে সে আমাদের জানায়। আমাদের বলতে আমাকে আর সুমন এন্টমকে। রাসেল ভাই নিশ্চয়ই একদিন বিয়ে করবে এবং বউকে সুন্দর করে ইনিয়ে বিনিয়ে বলবে, "ওগো তুমিই আমার জীবনে প্রথম এবং তোমাকেই পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি।" 

আহারে! বউকে খুশি করার জন্যে পুরুষরা কত্ত মিসাইল মিথ্যা কথা বলে-- পান খেয়ে বলে দেখো আমি পান খাইনি, দেখো আমার ঠোট লাল হয়নি দেখো দেখো। মহাভারত অবশ্যই পুরুষদের এই মিথ্যা কথা বলার পক্ষে সুন্দর যুক্তিবাদী ওয়াজ করেছে। যুক্তিবাদী ওয়াজ করবে না কেনো, মহাভারতও যে কোনো না কোনো পুরুষেরই রচনা। 


       ন নর্মযুক্তং বচং হিনস্তি 

           ন স্ত্রীষু রাজন ন বিবাহকালে। 

             প্রাণাত্যয়ে সর্বধনাপহারে 

               পঞ্চানৃতান্যাহুরপাতকানি।।


এন্টমকে নিয়ে ইদানিং একটু ঝামেলা হচ্ছে। কারন তার লম্বা চুল। শরীফ তার প্রাসাদ আমাদের জন্যে ছেড়ে দিয়ে আশুগঞ্জ অবস্থান করছে। জীবন স্যার আর আশরাফুল আজিজ স্যার চলে গেলেন সেন্টমার্টিন। আমি শরীফের প্রাসাদে একা। শরীফ তার প্রাসাদে ফিরতে আরও সপ্তাখানেক সময় নিবে। এমন সময় এন্টম সুমন নরসিংদীর রায়পুরা থেকে চলে আসে কক্সবাজারের ঘোনাপাড়া। শরীফের কাছে ফোন যায় আমার সাথে এই ববকাটিং চুলওয়ালা মেয়ে কে জানতে চাওয়ার নিরিখে। যিনি ফোন দেন তিনি শরীফের প্রাসাদের প্রতিবেশী ভাবি। আমিও নোটিশ করেছি যে এন্টম ঘোনাপাড়া আসার পর থেকে প্রতিবেশী ভাবি আর হাসি দিয়ে আমার সাথে কথা বলে না। অথচ এন্টম আসার আগে ভাবি প্রায়ই জিজ্ঞেস করতো আমার কোনো সমস্যা হচ্ছে কিনা। শরীফ আমার কাছে ফোন দিয়ে জানতে চায় আমার সাথে লম্বা চুলওয়ালা কে আছে যে চুলে বেন পড়ে। শরীফের ফোন পাওয়ার পর নিশ্চিত হলাম কেনো প্রতিবেশী ভাবি আর হাসি দিয়ে আমার সঙ্গে কথা বলে না। 


মহেশখালীর লোকাল ঘাটটি সুন্দর সৃজিত গাছ আর পাখিদের জাদুঘর। সুন্দর বনের দারুন ফ্লেবার এই ঘাটের চারপাশে। এই ঘাটের চারপাশে নোনা পানির প্রচুর গাছ পাওয়া যায়। মাছও পাওয়া যায়। দেখা যায় প্রচুর কাক। বাংলার উপসাগর এখানে এসে হয়ে গেছে বাকখালী নদী। দেবতা মহেশের নাম থেকে মহেশখালী। শিবের ১০৮ নামের মধ্যে মহেশ একটি। আমি মনে করেছিলাম মহিষের নাম থেকে মহেশখালী। মনে মনে প্রচুর বইস বা মহিষ কল্পনাও করে রেখেছিলাম। মহেশখালীর বুকে যে যৌবনা নদী বাকে বাকে চলে ভেবেছিলাম তার নাভিমূলে শরীর ডুবিয়ে চোখভরা আকুতি নিয়ে আমাকে অমর্ত্য অভ্যর্থনা জানাবে গরমগতরের মহিষ। বাস্তবতা একেবারে ভিন্ন। এখানে কোনো মহিষ আছে বলে মনে হইল না। মহিষ না থাকলেও বিচিত্র প্রকারের মাছ এখানকার বক্রনদীর ফেকে ছুটাছুটি খেলে। কেউ ধরতেও যেতে পারে না। কারন এই ফেক বড়ই চোরাবালি ফেক।


মহেশখালীর পান মৈনাক পাহাড়ের আদিনাথ মন্দিরের নিচে কাপড় ব্যবসায়ী আশু বৌদ্ধের হাসির মতো মিষ্টি। এই পান সাগরের ঢেউয়ের মতো স্লিম। মিষ্টি বলতে এই পান খেতে রাজশাহীর পানের মতো দাক লাগে না।


শ্বাসমূলী উদ্ভিদের চুলেমুলে বক আর নানান বর্নের রঙের পরিযায়ী পাখির উড়াউড়ির কোলাহল কুলাহক দেখতে দেখতে শুনতে শুনতে লোকাল ঘাটে বসা আমার সময়স্রোত কখন যে রাতের ঘরে পৌছে যায় বলতেই পারি না। রাতে রাসেল ভাই দোকান বন্ধ করে বাড়ি চলে যায়। এই ঘাটে আরও যারা পান ব্যবসায়ী রয়েছে তারা সবাই চলে যায় নিজ নিজ আবাসনে। সন্ধ্যার পর মানে সাতটার পর কক্সবাজার যাতায়াতের সুযোগ সুবিধা জটিল ও ব্যয়বহুল হয়ে পড়ে। কিন্তু রাতে এই ঘাটে নামে রূপসী কুয়াশা এলোকেশী জোছনা নোলক বাতাস ঢেউয়ের ঠোটেল শব্দ। রাতে এই প্রাকৃতিক প্যারাবন হয়ে উঠে প্রথম প্রেমের প্রথম স্পর্শের প্রথম শিহরনের মতো পুলকসঞ্চারের প্যারামিটার। 


কক্সবাজার থেকে মহেশখালীর এই ঘাটে যেতে খরচ হবে ত্রিশ টাকা থেকে ৭০ টাকা। আসতেও এমনই খরচ হবে। নৌকা দিয়ে যেতে কিংবা আসতে ভালো লাগে। যাওয়ার সময় মনে হয় সুন্দর বনের গোলপাতা গেওয়া সুন্দরী গরান গাছের রাজ্যে যেন ঢুকে যাচ্ছি। আদিনাথ মন্দিরের একেবারে চূড়া থেকে বাকখালী নদীকে দেখতে অনেকটা বাঘের চোখের মতো মনে হয়। আদিনাথ মন্দিরের জায়গায় দিয়েছে এক মুসলমান। একজন মুসলিম কেনো মন্দির প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব নিলো অবশ্যই তার পেছনে রয়েছে ইতিহাস। 


আদিনাথ এলাকাবাসীর মতানুসারে আবিস্কৃত এবং মর্যাদা পায় নূর মোহাম্মদ শিকদার নামক একজন অর্থশালী মুসলিম ধর্মালম্বীর মাধ্যমে। শিকদার গাভী পালন করে এবং তার গাভী ভালোই দুধ দেয়, তার গাভী হঠাৎ দুগ্ধদান বন্ধ করে দেয়। তাতে সে রাখালের উপর সন্ধিহান হয়। রাখাল বিষয়টির কারন অণুসন্ধানে রাত্রিবেলায় গোয়ালঘরে গাভীটিকে পাহারা দেওয়ার ব্যবস্থা করে দেখতে পায় গাভীটি গোয়ালঘর হতে বের হয়ে একটি কাল পাথরের উপর দাড়ায় এবং গাভীর স্তন হতে আপনা আপনি ঐ পাথরে দুধ পড়তে থাকে। দুধ পড়া শেষ হলে গাভীটি গোয়ালঘরে ফিরে আসে। রাখাল বিষয়টি নূর মোহাম্মদ শিকদারকে জানায়। শিকদার সাহেব বিষয়টি  গুরুত্ব না দিয়ে গাভীটিকে বড় মহেশখালী নামক স্থানে সরিয়ে রাখে। একদিন শিকদার সাহেব স্বপ্নাদেশ পায় গাভীটিকে সরিয়ে রাখলেও তার দুধ দেওয়া বন্ধ হবে না বরং সেখানে তাকে একটি মন্দির নির্মান ও হিন্দু জমিদারদের পুজোদানের বিষয়ে বলতে হবে। স্বপ্নানুসারে শিকদার সেখানে একটি মন্দির নির্মান করে। এখন পর্যন্ত যতটুকু জানি আদিনাথ মন্দিরই একমাত্র মন্দির যা মুসলিম ধর্মালম্বী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত।


মৈনাক শিখরেই আদিনাথ মন্দিরের পাশে অষ্টাভূজারূপী দেবী দুর্গার মন্দির রয়েছে। নূর মোহাম্মদ শিকদারই স্বপ্নাদেশ পায় অষ্টাভূজাকে সদূর নেপাল থেকে এখানে এনে প্রতিষ্ঠিত করার। নাগা সন্ন্যাসী নামক একজন সাধক ১৬১২ সালে নেপালের ষ্টেট মন্দির থেকে অষ্টাভূজাকে চুরি করে আনার সময় ধরা পড়ে জেলবন্দী ও বিচারের সম্মুখীন হয়। বিচারের পূর্ব রাত্রিতে সন্ন্যাসী যোগমায়াবলে মহাদেবের কৃপা সান্নিধ্য লাভ করে। মহাদেব অভয় বাণী প্রদান করেন এবং বিচারকের প্রশ্নের প্রেক্ষিতে ইচ্ছামোতাবেক উত্তর দিতে বলেন। বিচারকালে বিচারক প্রথমে নেপালের রাজার নিকট মূর্তির রং জানতে চাইলে রাজা কষ্টি পাথরের মূর্তির রং কালো বলে বর্ননা দেয়। একই প্রশ্ন সন্ন্যাসীকে করা হলে তিনি মূর্তির রং সাদা বলে। বিচারক পড়লো মহা বিপদে। বিপদ যেখানে আছে সেখানে সমাধানও আছে।

সমাধান কী? 

সমাধান হলো মূর্তিকে সকলের সম্মুখে উন্মোচন করা। মূর্তি সকলের সম্মুখে উন্মোচন করা হয় এবং দেখা যায় মূর্তির রঙ সাদা। সবাই অবাক হয়ে যায়। এবং সন্ন্যাসীর পক্ষে রায় ঘোষণা করা হয়। রাজা প্রকৃত ঘটনা জানতে উদগ্রীব হলে সন্ন্যাসী রাজাকে বিস্তারিত বলে। পরবর্তীতে রাজা যথাযথ মর্যাদার সাথে মৈনাক শিখরে আদিনাথের পাশে মন্দির নির্মান করে অষ্টভূজাকে প্রতিষ্ঠান করে। মন্দির কমিটির তত্ত্বাবধায়কের মতে এখনও নেপাল সরকার মাঝে মধ্যে মন্দিরে যথাসাধ্য অনুদান দিয়ে থাকে।


এই মহেশখালীতে হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধদের সম্প্রীতি  খুবই দারুন বলে মনে হয়েছে। মনে করেছিলাম মহেশখালী পরিশুদ্ধ দ্বীপ।কিন্তু না। মহেশখালী চকোরিয়ার সাথে শারীরিক যোগাযোগ স্থাপন করেছে। মহেশখালীতে বৌদ্ধ মেয়েদের শারীরিক গঠন খুবই সুন্দর গোছানো ছিমছাম নরম তুলতুলে। বৌদ্ধ পুরুষদেরও তাই। তবে বৌদ্ধ পুরুষদের চোখে সন্দেহ রয়েছে যা বৌদ্ধ মেয়েদের চোখে দেখতে পাইনি। বৌদ্ধ ছেলেমেয়ে কেউ বসে থাকে না, সবাই কাজ করে।ব্যবসা করে। মেয়েদের বুকে উড়না নেই। সুন্দর গোছানো স্তন চোখে পড়ে কিন্তু তেতুল হুজুর হয়ে যেতে অন্তত আমার ইচ্ছে করেনি। মনে পাপ না থাকলে বাইরে দৃশ্য মনে পাপ সৃষ্টি করতে পারে না। দুধে মাছি বা ময়লা  পড়লে  দুধ নষ্ট হয়ে যায়, দুধে ফুল পড়লে দুধ নষ্ট হয় না। 


আবারও বলছি, বৌদ্ধ হোক ছেলে হোক মেয়ে যারাই চোখে পড়েছে তাদের ফিগার খুব সুন্দর। একটি কথা বিশেষভাবে বলা দরকার যে পাহাড়ি প্রত্যেকটি মানুষের ফিগার সুন্দর ও গোছানো হয়।পাহাড়ি মানুষদের সংগ্রাম মানসিকতা কেন যে আমরা আমাদের জাতীয় জীবনে কাজে লাগাতে পারি না তা আমার বোধগম্য নয়। সমতলের মানুষদের বিশেষ করে বাংলাদেশে মাথার চেয়ে পেট বড় হয়ে যায়। পেটের ভার সহ্য করতে তার বা তাদের খবর হয়ে যায়, জাতীয় কিংবা আন্তর্জাতিক জীবনের সাথে খাপ খাওয়াবে কখন!? 


মহেশখালীতে বৌদ্ধ এক দশমিক তিন পার্সেন্ট। নব্বই পার্সেন্ট মুসলমান। সাত পার্সেন্টের মতো সনাতনী ধর্মাবলম্বী। বৌদ্ধ মেয়ে মহিলা যাদেরকেই দেখেছি তাদেরকে খুব ভালো লেগেছে। কারন তাদের কর্মময় হাত মেদহীন শরীর। তারা ঘরে বসে টিভির মোবাইলের রিমোট নড়াচড়া করতে করতে ক্লান্ত হয়ে স্বামীপ্রভুর কায়াপ্রার্থী হয়ে বসে থাকে না।তারা কেবল সন্তান উৎপাদনের মেশিন নহে। তারা চব্বিশ ঘন্টার পূর্নাঙ্গ মানুষ। তাদের স্তন ডালিমের মতো সুন্দর। স্তন একটি স্পর্শকাতর এলাকা। মেয়েরা সবচেয়ে বেশি ইনফিরিউর ফিল করে ছোট স্তন নিয়ে। যাদের স্তন ছোট তারা মানসিকভাবে নিদারুন বিধস্ত দিন কাটায়।বাথরুমে অন্ধকার ঘরে একা একা কান্নাকাটি করে। ছোট স্তনধারী মেয়েদের মানসিক দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে থাকে কর্পোরেট হাউজ। কর্পোরেট হাউজ ব্রাবানিজ্য চাঙা করে।যাদের স্তন বড় তাদেরকেও কর্পোরেট হাউজ কান পড়া দিয়ে থাকে যথারীতি। 


আপনার স্তন ছোট কোনো সমস্যা নেই, চলে আসেন আমাদের কাছে, আমরাই আপনার স্তনকে মার্কেটপযোগী করে তুলবো, আপনার স্তন বড়, ঝুলে পড়বে শীঘ্রই, একদম চিন্তা করবেন না, আধুনিক ব্রা থেকে শুরু করে আপডেট সার্জারির ব্যবস্থা রয়েছে আমাদের কাছে, আপনার স্তন দেখাবে সুন্দর ও আকর্ষণীয়, ডালিমের মতো না হোক ডাবের মতো তো হবেই।


এমন এমন আরও জাঙ্ক কথাবার্তা প্রলোভন কর্পোরেট হাউজ উপস্থাপন করে থাকে আমাদের অবলা দুর্বলা স্বামীগাছা মেয়েদের কাছে। আর তারাও কর্পোরেট হাউজের প্রলোভন কথা নিজের  মর্যাদাবোধকে মাটির  নিচে চাপা দিয়ে গিলতে থাকে চোখ লাল হওয়ার আগ পর্যন্ত। কর্পোরেট হাউজ তাদের পড়া পানি মহেশখালীর বৌদ্ধ মেয়েদের গিলাতে অক্ষম। ফলে তারা ইজ তারা স্টিল নাউ।


'মহেশখালীর বাকে' হয়তো পুরনো সিনেমার নাম। বর্তমানে মহেশখালীতে উন্নয়নের নামে কোনো সার্কাস সিনেমা চলতেছে কিনা তার দিকে অবশ্যই আমাদের সুনজরের ধারাপতন নয় ধারাদৃষ্টি অটুট রাখতে হবে। কারন বালু দিয়ে কেবল গর্ত ভরাট করলেই উন্নয়ন হয় না। উত্তোলিত বালু বড় ধরনের গর্তসমস্যা তৈরি করছে কিনা তার দিকে বিশেষ দৃষ্টি রাখা এনজিও কর্মীদের দায়িত্বের মধ্যে না পড়লেও, মানুষের দায়িত্ববোধের পর্যায়ে পড়ে। 


মহেশখালীর লোকাল ঘাটটি যেকোনো সুন্দর নারীর চেয়ে সুন্দর, যেকোনো পুষ্টিকর খাবারের চেয়ে পুষ্টিমান সমৃদ্ধ, যেকোনো মনমোহন নৃত্যরত ফিগারের চেয়েও নৃশংস ভয়ংকর ভয়াবহ রকমের মুগ্ধতায় ভরপুর। এই ঘাটে বসে মিষ্টি পান খেতে খেতে রসিক রাসেল ভাইয়ের গল্প শুনতে শুনতে বাকখালী নদীর ঢেউ গুনি। ঢেউ গুনতে গুনতে বেরসিক সময় ফুরিয়ে যায়, ফুরিয়ে যায় কবিতার শেষ শব্দটি-- প্রেমের নেশা সৌন্দর্যের ডান হাতে চুমু দিতে গিয়ে পানকৌড়ির রক্ত পানে বিভোর হয়ে যায়।


মহেশখালীর কথা উঠলেই শেফালী ঘোষের নাম চলে আসে আড্ডাকথায়, চলে আসে মহেশখালীর মিষ্টি পানের কথা। সবকিছু ছাপিয়ে আমার মনে আসে বাকখালী নদীর কথা। বাকখালী অসাধারণ নীরব বিনয়ী নদী। কেউ তাকে দেখে বুঝতে পারবে না যে সাগরের সাথে তার বিশাল নেটওয়ার্ক। ভারতের মিজোরাম রাজ্যের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় পাহাড় থেকে উৎসারিত কিছু স্রোতধারা বান্দরবন জেলার নাইক্ষ্যংছড়িতে মিলিত হয়ে যৌথ ধারায় বাঁকখালী নদীর সৃষ্টি করেছে।


বাকখালী নদীতে পাওয়া যায় পোয়া মাছ। বৈজ্ঞানিক নাম Pama pama। অনেকে এটিকে পামা,কই ভোলা বলে ডাকে।খাদ্য হিসেবে এই মাছ খুবই সুস্বাদু। খাদ্যের ছয়টি উপাদানের মধ্যে প্রোটিন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রোটিন ছাড়া প্রাণীর অস্তিত্ব কল্পনা করা অসম্ভব। প্রোটিনকে সকল প্রাণের প্রধান উপাদান হিসেবে গণ্য করা হয়। সব প্রোটিনই কার্বন, হাইড্রোজেন, অক্সিজেন ও নাইট্রোজেন দিয়ে গঠিত। আর পোয়া মাছের দেহে প্রায় ১৮ শতাংশ প্রোটিন। তাই প্রানিজ আমিষের বিশাল আয়োজন পোয়া মাছ তার আয়োজনে ধারন করে। এক জেলে ১২৫ কেজি ওজনের একটি লাল পোয়া মাছ ধরে একদিনে লাখপতি হয়ে যায়। ঘটনাটি ঘটেছে বাংলাদেশে।বাংলাদেশের পত্রপত্রিকা ঘটনাটি জানে।


ছোট পোয়া জল থেকে উঠানোর প্রথম কিছুক্ষন তাকে সোনালি মনে হয়। তারপর পার্পল কালার ধারন করে,তারও কিছুক্ষন পর মাছটি হয়ে পড়ে সাদা বা জল রঙের। বাকখালী নদীর জল যখন আমার নিষাদ চামড়া স্পর্শ করে তখন আমার শৈশবের বারবার স্বপ্নে দেখা একটি সোনালি কালারের মাছের কথা মনে পড়ে। হয়তো পোয়া মাছকে বারবার স্বপ্ন দেখেছি হয়তো নয়। মনে পড়ে ক্যাপ্টেন হিরাম কক্সের কথা। অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে বার্মা আরাকান দখল করে উৎপীড়ন-নির্যাতন শুরু করলে হাজার হাজার শরনার্থী বাঁকখালী নদী তীরবর্তী রামু ও কক্সবাজারে আশ্রয় নেয়। ক্যাপ্টেন হিরাম কক্স তাদের পুনর্বাসন করে। নদী ভাঙন। দুর্ভাগ্যবশত ক্যাপ্টেন হিরাম কক্সের সমাধী বাঁকখালী নদীর ভাঙনে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। 


হিরাম কক্স (১৭৬০-১৭৯৯) একজন ব্রিটিশ কূটনীতিক, যিনি ১৮ শতকে বঙ্গ ও বার্মায় কর্মরত ছিলেন। আরাকান শরনার্থী ও স্থানীয় রাখাইনদের মধ্যে হাজার বছরের পুরনো সংঘাত ছিলো। হিরাম কক্স এই পুরনো সংঘাত শেষ করে দেয়ার কল্পে বহু পদক্ষেপ হাতে নেন।পদক্ষেপ পুরোপুরি বাস্তবায়নের আগেই তাকে প্রভুর সাথে মিশে যেতে হয়েছে। তার ভালো কাজের পদক্ষেপকে স্মরনীয় করে রাখার জন্যে একটি বাজার প্রতিষ্ঠা করা হয় যার নাম রাখা হয় 'কক্স সাহেবের বাজার'। সাহেব উঠে গেছে,থেকে গেছে কক্সবাজার। 


এইভাবে কত সাহেব আসলো গেলো, কত নদীতে চর পড়লো, কত সাগর হয়ে গেলো নদী, কত নদী হয়ে গেলো কালা মিয়া ওসমান মিয়া অনিন্দিতা কর্মকারের বাড়ি। জলের আদিতে জীবন, জীবনের আদিতে জল। এক রহস্যময় সময় ও সময়ের ঘেরাটোপে বাড়ছে মানুষ, মানুষের চাহিদা, বিলাসিতা। 


আজকের দুরন্ত সাপের মতো বাকখালী নদী একদিন থাকবে কিনা আমরা কেউ জানি না। আমরা জানি না সময়ের মায়া আমাদের কোথায় নিয়ে যায়। নদীর কারনে সাগর, না সাগরের কারনে নদী আমরা জানি না।আমাদের জানাশোনার পরিধি খুবই সীমিত। একটা পুরাতন গল্প মনে পড়ে গেলো। গল্পটি কার কাছ শুনেছিলাম তার নাম মনে নাই।বলছি গল্পটি। 


জাহাজের সব লোক মারা গেলো। বেচে থাকলো কেবল মিস্টার ডলফিন। মিস্টার ডলফিন ভাসতে ভাসতে একটি দ্বীপে আশ্রয় নিলো। দ্বীপের গাছপালা কাজে লাগিয়ে সে একটি ঘর নির্মান করে।অনেক কষ্টে সে দিনাপাত করছে। প্রায়ই বৃষ্টি হয়। ঘরের ভেতর বসে বসে সে মৃত্যুর জন্যে অপেক্ষা করে। গাছের বাকল টাকল খেয়ে কোনো রকমে বেচে আছে মিস্টার ডলফিন। 


দুপুর বেলা।সে খাবারের সন্ধানে বের হই। এমন সময় শুরু হয় প্রচন্ড বজ্রপাত ঝড় বৃষ্টি। বজ্রপাত থেমে গেলে ঘরের দিকে হাটা শুরু করে সে। 


ও খোদা!  বজ্রপাতে ঘর পুড়ে গেছে। সে মনে অত্যন্ত ব্যথা অনুভব করে।একমাত্র আশ্রয় তাও প্রভু নিয়ে গেলো তার কাছ থেকে। মনে বিষন্নতার ঝড় নেমে আসে।অঝোরে কাদতে আরম্ভ করে। কাদতে কাদতে ঘুমিয়ে যায় মিস্টার ডলফিন। 


হঠাৎ।হঠাৎ মানুষের শব্দ শুনে তার ঘুম ভাঙে। সে মানুষ দেখছে!  তার চোখকে সে বিশ্বাস করতে পারছে না। 


আপনারা কোথা থেকে আসলেন? 


এই দিক দিয়ে যাচ্ছিলাম। ধোঁয়া দেখে অনুমান করলাম এই দ্বীপে হয়তো মানুষ রয়েছে। তাই জাহাজ নোঙর করি।


মিস্টার ডলফিন আসমানের দিকে তাকালো। পুড়ে যাওয়া ঘরটির দিকে তাকালো।ধোঁয়া এখনো উড়ছে। মিস্টার ডলফিনের মনের ধোঁয়া মুছে গেছে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন