বৃহস্পতিবার, ১২ নভেম্বর, ২০২০

শুদ্ধ তারপর

 তাকে বললাম এক বোতল বিশুদ্ধ চোখের জল দাও, এখন তার কান্নাই বন্ধ হয়ে গেছে। রাতে ভালো একটি সিনেমা দেখতে দেখতে চোখে জল আসতেছে, বোতল এনে সংগ্রহ করতে গেলাম জল আর চোখে আসে না। 


আমাদের সভ্যতা বিশুদ্ধ কিছু ধরে রাখতে পারে না

মাও সেতুং

 বেইজিং গনপ্রজাতন্ত্রী চীন সরকারের অধীনে সরাসরি কেন্দ্রশাসিত পৌরসভা হিসেবে পরিচালিত। বেইজিং কথাটির অর্থ "উত্তরের রাজধানী"।


মহানগর এলাকার ভেতর দিয়ে হাই নদী ব্যবস্থার অনেকগুলো উপনদী প্রবাহিত হয়েছে, যাদের মধ্যে ছাওপাই নদী ও ইউংতিং নদীর কথা উল্লেখযোগ্যভাবে বলা যায়। বেইজিং সুসংহতভাবে গঠিত নয়; এখানে গ্রামীন বসতি ও স্থাপনার আধিপত্যই বেশি। প্রাদেশিক মর্যাদাবিশিষ্ট বেইজিং ষোলটি পৌরজেলা, উপ-পৌরজেলা এবং গ্রামীন জেলা নিয়ে গঠিত।


১৯৫০ সাল।১৯৫০ সালের বেইজিংয়ের কথা। ১৯৫০ সালের বেইজিংয়ের একটি গ্রামের কথা।১৯৫০ সালে বেইজিংয়ের একটি গ্রামের একটি ধর্ষিত মেয়ের কথা।চেয়ারম্যান তখন মাও সেতুং। বলা হয়ে থাকে মাও সেতুং কোনোদিন দাত মাজতেন না। কারন হিসাবে তিনি বলতেন বাঘের কথা। বাঘ নাকি দাত মাজে না।


চেয়ারম্যান তখন মাও সেতুং। একটি মেয়ে উদাম মাঠে গণধর্ষণের কবলে পড়ে! মেয়েটি আস্ত শরীর নিয়ে বাড়ি ফিরে কান্না অভিমান অভিযোগ বীতাগ্নি রাগে। চীন দেশে তখন বিশ্বালোচিত মার্ক্সবাদকে হাতিয়ার করে লালফৌজ গঠন করে অক্লান্ত পরিশ্রম অবিরত চেষ্টা কঠিন অধ্যবসায়ের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ ৩৫ হাজার কিলোমিটার লংমার্চ করে মাও সেতুং চীনের মাটিতে জনমানুষের গণমানুষের আশা আকাঙ্ক্ষার আয়নামতি আয়তিসুখদৃশ্য চলমান প্রশান্তিচোখ প্রতিষ্ঠা করেন। বিপ্লব সমাজতন্ত্র রক্ষা করার দায়িত্বে ঘরে বসে স্টাডি করছিলেন কেমন করে সাংস্কৃতিক বিপ্লব সংঘটিত ও সফল করা যায়। সেই সময় মেয়েটির ধর্ষিত হবার খবর তার কানে এসে পৌঁছে। খুবই অল্প সময়ের মধ্যে। 


বেইজিংয়ের জলবায়ুতে ঋতুভেদ আছে-- জলবায়ু মৌসুমী বায়ু দ্বারা প্রভাবিত আর্দ্র মহাদেশীয় ধরনের। উত্তপ্ত ও আর্দ্র গ্রীষ্মকালের জুলাই মাসে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৮° সেলসিয়াসের চেয়ে বেশি এবং হিমশীতল ও শুষ্ক শীতকালের জানুয়ারি মাসে তাপমাত্রা ১৫° সেলসিয়াসের চেয়েও কম হতে পারে। জুন থেকে আগস্ট মাসের মধ্যে সিংহভাগ বৃষ্টিপাত হয়। 


মাও সেতুং খবরটি শুনামাত্র জুলাই মাসের সর্বোচ্চ তাপমাত্রার চেয়েও উত্তপ্ত হয়ে উঠেন।তার মনে তখন জুন ও আগষ্ট মাসের বৃষ্টিধারার মতো জলাপাত হচ্ছিল। তিনি মেয়েটির কাছে গেলেন। মাথায় হাত রাখেন। তার চোখে  ছায়াবর্ষনের চেষ্টা করেন। 


তোমাকে যখন তারা ধর্ষন করছিল তুমি কী তখন চিৎকার করছিলে? 

হ্যা,আমি চিৎকার করছিলাম। 

তেমন করে আবার চিৎকার করতে পারবে? 

সুবিচার পেলে তেমন করে ঠিক তেমন করে চিৎকার করতে পারবো। আপনার প্রতি আমার আস্থা রয়েছে। 


মাও সেতুং তখন এক হাজার সিপাহি প্রস্তুত করেন।মেয়েটিকে স্পটে নিয়ে যায়।মেয়েটিকে চিৎকার করতে বলে। মেয়েটির চিৎকার যতদূর শোনা যায় ততদূরের সমস্ত মানুষকে বন্দী করে আনা হয়। মেয়েটি চারটি পুরুষকে সনাক্ত করে। সাথে সাথে তাদেরকে গুলি করে পরকালের অপ্সরাদের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়। 


ধর্ষন তখনো ছিলো এখনো আছে!  তখন মাও সেতুং ছিলো এখন মাও সেতুং নাই!! মাও সেতুং নাই বিধায় নদীর ঘরে জলের মতো বসে থাকি-- মাছ হয়ে কোনো এক সাগরের কথা ভাবি

তার দায়িত্ব আমার মনে বয়ে গেছে

 কলাতলী। লোকে বলে। কলাবতী। আমি বলি। কলাবতী পয়েন্ট থেকে লাভনী পয়েন্টের দিকে যাচ্ছি। সাগর তখন নিচে নেমে গেছে। জোছনা আকাশে। জলে জোছনা পড়লে বিশেষ করে সাগরের জলে জোছনা পড়লে একটি ম্যাজিক সৃষ্টি হয়। এই ম্যাজিক এমন এক ম্যাজিক যা পৃথিবীর সমস্ত ম্যাজিককে হার মানায়। 


সুন্দর। খুব সুন্দর এক মানুষ সাগর জলের পাশ দিয়ে হাটছে। এক লোক সুন্দর মানুষটিকে দেখে বেড সাউন্ড করে। মানুষটি লোকটির কাছে যায়। আমিও তার পাশে দাড়ালাম। লোকটি স্থানীয়। এবং মদ খেয়ে টাল হয়ে আছে। মেয়েটি কাকে যেনো ফোন দিলো। সাথে সাথে একটি ছেলে চলে আসে।এবং মাতাল লোকটিকে কান ধরে উঠ বস করায়। 


মানুষটি আমাকে ধন্যবাদ দিলো।


তারপর আবার হাটা শুরু করি। লাভনী পয়েন্টের দিকে। মাতাল লোকটা আমার পেছনে পেছনে আসতে থাকে। কারন লোকটি বুঝতে পেরেছে আমি স্থানীয় মানুষ নহে। আমাকে যথাযোগ্য শাস্তি দেয়া দরকার। কেনো আমি অপরাধীকে অপরাধী বলিয়াছি এই শাস্তি। লাভনী পয়েন্টের কাছাকাছি ঝাউবনের সামনের জায়গায় যেখানে সাগর আরও নিচে নেমে গেছে সেখানে দাড়িয়ে জোছনা আর সাগর জলের ম্যাজিক দেখছি।শুনছি সাগরের গর্জন। আমি একা।স্যাররা চলে গেলেন সেন্টমার্টিন। রাত তখন প্রায় দশটা। লোকটা আমার কাছে এসে নানাবিধ কথা বলতে আরম্ভ করছে। পজিশন নিচ্ছে আমার ব্যাপারে মারধর জাতীয় ব্যাপার স্যাপারে যাওয়ার জন্যে। আমি ত তার কথা কিচ্ছু বুঝতেছি না। চট্রগ্রামের ভাষা আমি খুবই কম বুঝি। তাছাড়া সে রেগে আছে চরমভাবে। 


কেবল হাসতেছি আর বলতেছি ' বিরক্ত করো না',  'আর কিছুক্ষন থাকবো, তারপর রুমে চলে যাবো, বিরক্ত করো না।' 


কে শুনে কার কথা। সে বকবক করেই যাচ্ছে। এমন সময় মেয়েটি আমার পাশে এসে দাঁড়ায়, কোনো কথা না বলে বিশাল এক থাপ্পড় জাতীয় দমক দেয়। তারপর ইতিহাস। 


মেয়েটি আমাকে ডিসি বাংলো পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে যায়।তারপর আমার বাসায় যেতে সমস্যা হবে কিনা জানতে চায়।আমি খুব নিরীহভাবে উত্তর দিয়েছি যে সমস্যা হবে না। সে আমার মোবাইল নাম্বারটি নিয়ে তার মোবাইল থেকে আমাকে ফোন দেয়। কোনো সমস্যা হলে যেনো তাকে ফোন দিতে কোনো প্রকার সংশয় কাজ না করে এমন জাতীয় উপদেশ দিয়ে যায়। 


দুইদিন পর ফোন দিয়ে জানতে চায় আমার কোনো সমস্যা হচ্ছে কিনা। আমি অত্যন্ত নিরীহভাবে উত্তর দেই যে আমার কোনো সমস্যা হচ্ছে না। সৎ সাহসী মানুষের কাছে নিরীহ বনে যাওয়ার চেয়ে আনন্দ আর পৃথিবীতে নেই। 


মেয়েটির দায়িত্ববোধ আমাকে মুগ্ধ করেছে। সুন্দর মেয়েদের অহংকার থাকে জানতাম, সুন্দর দায়িত্বজ্ঞানও থাকে নতুন করে জানলাম।

চোখে যে নদী কথা কইতে এসে

 মিষ্টি ঢেউয়ের শব্দ। ঢেউয়ের মিঋষি শব্দ হৃদয়ের কারেন্ট জালে আটকে যায়। ঝাউপাতার ছায়ায় বসে মানুষের কথা মনে ভাসে মনে আসে করচগাছের মিহি রোদ আলোর খেলা। 


জোছনা থেকে অনেক দূরে আজ কলাবতী কান্না। হঠাৎ করে বৃষ্টি এলে সাগরে দেখি একান্নবর্তী সিদ্ধান্ত সিনেমা। ধেয়ে আসা ঢেউ বসে থাকা সিটির মতো চোখ লাল করে সভাপতির চেয়ার দখল করে না। সাগরের জল হয়ে ভেঙেছেন তিনি সীমানার কালো হলুদ লাল নীল নীতি। বালুকাবেলা। সন্ধ্যাতারা। মানুষের ছায়ার শব্দে হেটে যেতে যেতে ভোর হয়ে আসে। সময়ের পুরনো বারান্দা। 


চাদের জোছনায় পাখি হবো। ঢেউ হবো তোমার শিহরনে। হিংসা হবো প্রেমিকার ঠোঁটের ভাজে রাতভর। রাতভর ফটোজেনিক জলশহরে প্রেমিকের পায়ের শব্দ খুজে খুজে হয়রান। কালো শাড়ি পরে চোখে আসে সাগর জল নৃত্য। প্রিয় কোনো ব্যথার মতো আমাকে ভাসায় আমাকে বয়ে নিয়ে যায় দূরতমা শহরের কাছে। আমি ভুলতে পারি না ভুলতে দেয় না সে আমাকে। সময়ের পুরনো বারান্দা। 


থেমে থাকে থোকা থোকা ফুলেল শব্দ। দূরে দেখা যায় জাহাজ। নাবিক কন্যার সুরে বাতাসের মতো মিশে যেতে ইচ্ছে করে গতকাল আজকাল আগামীকাল হয়ে। 


পৃথিবী এক উদ্ভুত ঝনঝন শব্দ। আদমশুমারী পৃথিবী। আদিত্য জল আদমের কান্না হয়ে সাগরে ঘুরাফেরা করে। আদমের হাহাকার বাতাসি মাংসের দামে বিক্রি হচ্ছে রোজ বিলাসবহুল সময়চক্রের কাছে।


সবকিছু রেখে। সব হিসাব ভুলে পৃথিবীর নেমে আসো আমার বুকে চাদ যেমন করে শেষ রাতে গলে গলে গল্প হয়ে পড়ে সাগরের বিশাল আঙিনায় তেমনি করে তেমন করে অঙ্গে নাচো সঙ্গী হয়ে। আমিও মৃত্যুর মতো মিশে যেতে চাই কামতুফানে পৃথিবীর বাইরে এসে পৃথিবীর ভেতরে তোমার রক্ত মাংস ইচ্ছার স্বাধীন দেশে সাইক্লোন টর্নেডো কিংবা আরও কোনো তীব্র আকাঙ্ক্ষার টক ঝাল মিষ্টি রোদের শহরে।


সুগন্ধা,কক্সবাজার 

২৮১০২০২০

মহেশখালীতে এমরানুর রেজা ভাই

 যদি সুন্দর একখান মুখ পাইতাম

যদি নতুন একখান মুখ পাইতাম

মইশখালীর পানের খিলি তারে

বানাই খাওইতাম। 


এই  গানটির সুরকার ও গীতিকার এম এন আখতার। তিনি জীবনে বিচিত্র ধরনের গান রচনা করেছেন। তার গানের সংখ্যা পাচ হাজারের অধিক। তার একনিষ্ঠ শিষ্য শেফালী ঘোষ।শেফালী ঘোষ চট্রগ্রামের গানকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন। শেফালী ঘোষের কন্ঠে প্রথম মহেশখালীর নামটি শুনি। অবশেষে মহেশখালী আসি। সবাই মহেশখালী এসে স্পটের দিকে দৌড়াতে আরম্ভ করে। মহেশখালীর দর্শনীয় স্থান আদিনাথ মন্দির, বৌদ্ধ মন্দির, শুটকি মহাল, হাসের চর ইত্যাদি ইত্যাদি। পৃথিবীর যেখানেই যাই সেখানে যাওয়ার পর আমি নিজে একটি জায়গা আবিষ্কার করি যেটা আমার দর্শনীয় স্থান এবং যেখানে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা দিতে থাকি। পাবলিক বাসের টুরিস্টদের মতো স্পটের দিকে ঘামেটামে দৌড়ানো পাবলিক এমরানুর রেজা নহে। 


লোকাল ঘাট। লোকাল ঘাটে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা কেটে যায় আমার। মহেশখালীর পান খেতে খেতে চলতে থাকে রাসেল ভাইয়ের সাথে আড্ডা। রাসেল ভাই এই লোকাল ঘাটে পান বিক্রি করে। মহেশখালীর নারীদের কাছে প্রেমকুমার নামে পরিচিত সে। প্রায় এক হাজার প্রেম করেছে বলে সে আমাদের জানায়। আমাদের বলতে আমাকে আর সুমন এন্টমকে। রাসেল ভাই নিশ্চয়ই একদিন বিয়ে করবে এবং বউকে সুন্দর করে ইনিয়ে বিনিয়ে বলবে, "ওগো তুমিই আমার জীবনে প্রথম এবং তোমাকেই পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি।" 

আহারে! বউকে খুশি করার জন্যে পুরুষরা কত্ত মিসাইল মিথ্যা কথা বলে-- পান খেয়ে বলে দেখো আমি পান খাইনি, দেখো আমার ঠোট লাল হয়নি দেখো দেখো। মহাভারত অবশ্যই পুরুষদের এই মিথ্যা কথা বলার পক্ষে সুন্দর যুক্তিবাদী ওয়াজ করেছে। যুক্তিবাদী ওয়াজ করবে না কেনো, মহাভারতও যে কোনো না কোনো পুরুষেরই রচনা। 


       ন নর্মযুক্তং বচং হিনস্তি 

           ন স্ত্রীষু রাজন ন বিবাহকালে। 

             প্রাণাত্যয়ে সর্বধনাপহারে 

               পঞ্চানৃতান্যাহুরপাতকানি।।


এন্টমকে নিয়ে ইদানিং একটু ঝামেলা হচ্ছে। কারন তার লম্বা চুল। শরীফ তার প্রাসাদ আমাদের জন্যে ছেড়ে দিয়ে আশুগঞ্জ অবস্থান করছে। জীবন স্যার আর আশরাফুল আজিজ স্যার চলে গেলেন সেন্টমার্টিন। আমি শরীফের প্রাসাদে একা। শরীফ তার প্রাসাদে ফিরতে আরও সপ্তাখানেক সময় নিবে। এমন সময় এন্টম সুমন নরসিংদীর রায়পুরা থেকে চলে আসে কক্সবাজারের ঘোনাপাড়া। শরীফের কাছে ফোন যায় আমার সাথে এই ববকাটিং চুলওয়ালা মেয়ে কে জানতে চাওয়ার নিরিখে। যিনি ফোন দেন তিনি শরীফের প্রাসাদের প্রতিবেশী ভাবি। আমিও নোটিশ করেছি যে এন্টম ঘোনাপাড়া আসার পর থেকে প্রতিবেশী ভাবি আর হাসি দিয়ে আমার সাথে কথা বলে না। অথচ এন্টম আসার আগে ভাবি প্রায়ই জিজ্ঞেস করতো আমার কোনো সমস্যা হচ্ছে কিনা। শরীফ আমার কাছে ফোন দিয়ে জানতে চায় আমার সাথে লম্বা চুলওয়ালা কে আছে যে চুলে বেন পড়ে। শরীফের ফোন পাওয়ার পর নিশ্চিত হলাম কেনো প্রতিবেশী ভাবি আর হাসি দিয়ে আমার সঙ্গে কথা বলে না। 


মহেশখালীর লোকাল ঘাটটি সুন্দর সৃজিত গাছ আর পাখিদের জাদুঘর। সুন্দর বনের দারুন ফ্লেবার এই ঘাটের চারপাশে। এই ঘাটের চারপাশে নোনা পানির প্রচুর গাছ পাওয়া যায়। মাছও পাওয়া যায়। দেখা যায় প্রচুর কাক। বাংলার উপসাগর এখানে এসে হয়ে গেছে বাকখালী নদী। দেবতা মহেশের নাম থেকে মহেশখালী। শিবের ১০৮ নামের মধ্যে মহেশ একটি। আমি মনে করেছিলাম মহিষের নাম থেকে মহেশখালী। মনে মনে প্রচুর বইস বা মহিষ কল্পনাও করে রেখেছিলাম। মহেশখালীর বুকে যে যৌবনা নদী বাকে বাকে চলে ভেবেছিলাম তার নাভিমূলে শরীর ডুবিয়ে চোখভরা আকুতি নিয়ে আমাকে অমর্ত্য অভ্যর্থনা জানাবে গরমগতরের মহিষ। বাস্তবতা একেবারে ভিন্ন। এখানে কোনো মহিষ আছে বলে মনে হইল না। মহিষ না থাকলেও বিচিত্র প্রকারের মাছ এখানকার বক্রনদীর ফেকে ছুটাছুটি খেলে। কেউ ধরতেও যেতে পারে না। কারন এই ফেক বড়ই চোরাবালি ফেক।


মহেশখালীর পান মৈনাক পাহাড়ের আদিনাথ মন্দিরের নিচে কাপড় ব্যবসায়ী আশু বৌদ্ধের হাসির মতো মিষ্টি। এই পান সাগরের ঢেউয়ের মতো স্লিম। মিষ্টি বলতে এই পান খেতে রাজশাহীর পানের মতো দাক লাগে না।


শ্বাসমূলী উদ্ভিদের চুলেমুলে বক আর নানান বর্নের রঙের পরিযায়ী পাখির উড়াউড়ির কোলাহল কুলাহক দেখতে দেখতে শুনতে শুনতে লোকাল ঘাটে বসা আমার সময়স্রোত কখন যে রাতের ঘরে পৌছে যায় বলতেই পারি না। রাতে রাসেল ভাই দোকান বন্ধ করে বাড়ি চলে যায়। এই ঘাটে আরও যারা পান ব্যবসায়ী রয়েছে তারা সবাই চলে যায় নিজ নিজ আবাসনে। সন্ধ্যার পর মানে সাতটার পর কক্সবাজার যাতায়াতের সুযোগ সুবিধা জটিল ও ব্যয়বহুল হয়ে পড়ে। কিন্তু রাতে এই ঘাটে নামে রূপসী কুয়াশা এলোকেশী জোছনা নোলক বাতাস ঢেউয়ের ঠোটেল শব্দ। রাতে এই প্রাকৃতিক প্যারাবন হয়ে উঠে প্রথম প্রেমের প্রথম স্পর্শের প্রথম শিহরনের মতো পুলকসঞ্চারের প্যারামিটার। 


কক্সবাজার থেকে মহেশখালীর এই ঘাটে যেতে খরচ হবে ত্রিশ টাকা থেকে ৭০ টাকা। আসতেও এমনই খরচ হবে। নৌকা দিয়ে যেতে কিংবা আসতে ভালো লাগে। যাওয়ার সময় মনে হয় সুন্দর বনের গোলপাতা গেওয়া সুন্দরী গরান গাছের রাজ্যে যেন ঢুকে যাচ্ছি। আদিনাথ মন্দিরের একেবারে চূড়া থেকে বাকখালী নদীকে দেখতে অনেকটা বাঘের চোখের মতো মনে হয়। আদিনাথ মন্দিরের জায়গায় দিয়েছে এক মুসলমান। একজন মুসলিম কেনো মন্দির প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব নিলো অবশ্যই তার পেছনে রয়েছে ইতিহাস। 


আদিনাথ এলাকাবাসীর মতানুসারে আবিস্কৃত এবং মর্যাদা পায় নূর মোহাম্মদ শিকদার নামক একজন অর্থশালী মুসলিম ধর্মালম্বীর মাধ্যমে। শিকদার গাভী পালন করে এবং তার গাভী ভালোই দুধ দেয়, তার গাভী হঠাৎ দুগ্ধদান বন্ধ করে দেয়। তাতে সে রাখালের উপর সন্ধিহান হয়। রাখাল বিষয়টির কারন অণুসন্ধানে রাত্রিবেলায় গোয়ালঘরে গাভীটিকে পাহারা দেওয়ার ব্যবস্থা করে দেখতে পায় গাভীটি গোয়ালঘর হতে বের হয়ে একটি কাল পাথরের উপর দাড়ায় এবং গাভীর স্তন হতে আপনা আপনি ঐ পাথরে দুধ পড়তে থাকে। দুধ পড়া শেষ হলে গাভীটি গোয়ালঘরে ফিরে আসে। রাখাল বিষয়টি নূর মোহাম্মদ শিকদারকে জানায়। শিকদার সাহেব বিষয়টি  গুরুত্ব না দিয়ে গাভীটিকে বড় মহেশখালী নামক স্থানে সরিয়ে রাখে। একদিন শিকদার সাহেব স্বপ্নাদেশ পায় গাভীটিকে সরিয়ে রাখলেও তার দুধ দেওয়া বন্ধ হবে না বরং সেখানে তাকে একটি মন্দির নির্মান ও হিন্দু জমিদারদের পুজোদানের বিষয়ে বলতে হবে। স্বপ্নানুসারে শিকদার সেখানে একটি মন্দির নির্মান করে। এখন পর্যন্ত যতটুকু জানি আদিনাথ মন্দিরই একমাত্র মন্দির যা মুসলিম ধর্মালম্বী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত।


মৈনাক শিখরেই আদিনাথ মন্দিরের পাশে অষ্টাভূজারূপী দেবী দুর্গার মন্দির রয়েছে। নূর মোহাম্মদ শিকদারই স্বপ্নাদেশ পায় অষ্টাভূজাকে সদূর নেপাল থেকে এখানে এনে প্রতিষ্ঠিত করার। নাগা সন্ন্যাসী নামক একজন সাধক ১৬১২ সালে নেপালের ষ্টেট মন্দির থেকে অষ্টাভূজাকে চুরি করে আনার সময় ধরা পড়ে জেলবন্দী ও বিচারের সম্মুখীন হয়। বিচারের পূর্ব রাত্রিতে সন্ন্যাসী যোগমায়াবলে মহাদেবের কৃপা সান্নিধ্য লাভ করে। মহাদেব অভয় বাণী প্রদান করেন এবং বিচারকের প্রশ্নের প্রেক্ষিতে ইচ্ছামোতাবেক উত্তর দিতে বলেন। বিচারকালে বিচারক প্রথমে নেপালের রাজার নিকট মূর্তির রং জানতে চাইলে রাজা কষ্টি পাথরের মূর্তির রং কালো বলে বর্ননা দেয়। একই প্রশ্ন সন্ন্যাসীকে করা হলে তিনি মূর্তির রং সাদা বলে। বিচারক পড়লো মহা বিপদে। বিপদ যেখানে আছে সেখানে সমাধানও আছে।

সমাধান কী? 

সমাধান হলো মূর্তিকে সকলের সম্মুখে উন্মোচন করা। মূর্তি সকলের সম্মুখে উন্মোচন করা হয় এবং দেখা যায় মূর্তির রঙ সাদা। সবাই অবাক হয়ে যায়। এবং সন্ন্যাসীর পক্ষে রায় ঘোষণা করা হয়। রাজা প্রকৃত ঘটনা জানতে উদগ্রীব হলে সন্ন্যাসী রাজাকে বিস্তারিত বলে। পরবর্তীতে রাজা যথাযথ মর্যাদার সাথে মৈনাক শিখরে আদিনাথের পাশে মন্দির নির্মান করে অষ্টভূজাকে প্রতিষ্ঠান করে। মন্দির কমিটির তত্ত্বাবধায়কের মতে এখনও নেপাল সরকার মাঝে মধ্যে মন্দিরে যথাসাধ্য অনুদান দিয়ে থাকে।


এই মহেশখালীতে হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধদের সম্প্রীতি  খুবই দারুন বলে মনে হয়েছে। মনে করেছিলাম মহেশখালী পরিশুদ্ধ দ্বীপ।কিন্তু না। মহেশখালী চকোরিয়ার সাথে শারীরিক যোগাযোগ স্থাপন করেছে। মহেশখালীতে বৌদ্ধ মেয়েদের শারীরিক গঠন খুবই সুন্দর গোছানো ছিমছাম নরম তুলতুলে। বৌদ্ধ পুরুষদেরও তাই। তবে বৌদ্ধ পুরুষদের চোখে সন্দেহ রয়েছে যা বৌদ্ধ মেয়েদের চোখে দেখতে পাইনি। বৌদ্ধ ছেলেমেয়ে কেউ বসে থাকে না, সবাই কাজ করে।ব্যবসা করে। মেয়েদের বুকে উড়না নেই। সুন্দর গোছানো স্তন চোখে পড়ে কিন্তু তেতুল হুজুর হয়ে যেতে অন্তত আমার ইচ্ছে করেনি। মনে পাপ না থাকলে বাইরে দৃশ্য মনে পাপ সৃষ্টি করতে পারে না। দুধে মাছি বা ময়লা  পড়লে  দুধ নষ্ট হয়ে যায়, দুধে ফুল পড়লে দুধ নষ্ট হয় না। 


আবারও বলছি, বৌদ্ধ হোক ছেলে হোক মেয়ে যারাই চোখে পড়েছে তাদের ফিগার খুব সুন্দর। একটি কথা বিশেষভাবে বলা দরকার যে পাহাড়ি প্রত্যেকটি মানুষের ফিগার সুন্দর ও গোছানো হয়।পাহাড়ি মানুষদের সংগ্রাম মানসিকতা কেন যে আমরা আমাদের জাতীয় জীবনে কাজে লাগাতে পারি না তা আমার বোধগম্য নয়। সমতলের মানুষদের বিশেষ করে বাংলাদেশে মাথার চেয়ে পেট বড় হয়ে যায়। পেটের ভার সহ্য করতে তার বা তাদের খবর হয়ে যায়, জাতীয় কিংবা আন্তর্জাতিক জীবনের সাথে খাপ খাওয়াবে কখন!? 


মহেশখালীতে বৌদ্ধ এক দশমিক তিন পার্সেন্ট। নব্বই পার্সেন্ট মুসলমান। সাত পার্সেন্টের মতো সনাতনী ধর্মাবলম্বী। বৌদ্ধ মেয়ে মহিলা যাদেরকেই দেখেছি তাদেরকে খুব ভালো লেগেছে। কারন তাদের কর্মময় হাত মেদহীন শরীর। তারা ঘরে বসে টিভির মোবাইলের রিমোট নড়াচড়া করতে করতে ক্লান্ত হয়ে স্বামীপ্রভুর কায়াপ্রার্থী হয়ে বসে থাকে না।তারা কেবল সন্তান উৎপাদনের মেশিন নহে। তারা চব্বিশ ঘন্টার পূর্নাঙ্গ মানুষ। তাদের স্তন ডালিমের মতো সুন্দর। স্তন একটি স্পর্শকাতর এলাকা। মেয়েরা সবচেয়ে বেশি ইনফিরিউর ফিল করে ছোট স্তন নিয়ে। যাদের স্তন ছোট তারা মানসিকভাবে নিদারুন বিধস্ত দিন কাটায়।বাথরুমে অন্ধকার ঘরে একা একা কান্নাকাটি করে। ছোট স্তনধারী মেয়েদের মানসিক দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে থাকে কর্পোরেট হাউজ। কর্পোরেট হাউজ ব্রাবানিজ্য চাঙা করে।যাদের স্তন বড় তাদেরকেও কর্পোরেট হাউজ কান পড়া দিয়ে থাকে যথারীতি। 


আপনার স্তন ছোট কোনো সমস্যা নেই, চলে আসেন আমাদের কাছে, আমরাই আপনার স্তনকে মার্কেটপযোগী করে তুলবো, আপনার স্তন বড়, ঝুলে পড়বে শীঘ্রই, একদম চিন্তা করবেন না, আধুনিক ব্রা থেকে শুরু করে আপডেট সার্জারির ব্যবস্থা রয়েছে আমাদের কাছে, আপনার স্তন দেখাবে সুন্দর ও আকর্ষণীয়, ডালিমের মতো না হোক ডাবের মতো তো হবেই।


এমন এমন আরও জাঙ্ক কথাবার্তা প্রলোভন কর্পোরেট হাউজ উপস্থাপন করে থাকে আমাদের অবলা দুর্বলা স্বামীগাছা মেয়েদের কাছে। আর তারাও কর্পোরেট হাউজের প্রলোভন কথা নিজের  মর্যাদাবোধকে মাটির  নিচে চাপা দিয়ে গিলতে থাকে চোখ লাল হওয়ার আগ পর্যন্ত। কর্পোরেট হাউজ তাদের পড়া পানি মহেশখালীর বৌদ্ধ মেয়েদের গিলাতে অক্ষম। ফলে তারা ইজ তারা স্টিল নাউ।


'মহেশখালীর বাকে' হয়তো পুরনো সিনেমার নাম। বর্তমানে মহেশখালীতে উন্নয়নের নামে কোনো সার্কাস সিনেমা চলতেছে কিনা তার দিকে অবশ্যই আমাদের সুনজরের ধারাপতন নয় ধারাদৃষ্টি অটুট রাখতে হবে। কারন বালু দিয়ে কেবল গর্ত ভরাট করলেই উন্নয়ন হয় না। উত্তোলিত বালু বড় ধরনের গর্তসমস্যা তৈরি করছে কিনা তার দিকে বিশেষ দৃষ্টি রাখা এনজিও কর্মীদের দায়িত্বের মধ্যে না পড়লেও, মানুষের দায়িত্ববোধের পর্যায়ে পড়ে। 


মহেশখালীর লোকাল ঘাটটি যেকোনো সুন্দর নারীর চেয়ে সুন্দর, যেকোনো পুষ্টিকর খাবারের চেয়ে পুষ্টিমান সমৃদ্ধ, যেকোনো মনমোহন নৃত্যরত ফিগারের চেয়েও নৃশংস ভয়ংকর ভয়াবহ রকমের মুগ্ধতায় ভরপুর। এই ঘাটে বসে মিষ্টি পান খেতে খেতে রসিক রাসেল ভাইয়ের গল্প শুনতে শুনতে বাকখালী নদীর ঢেউ গুনি। ঢেউ গুনতে গুনতে বেরসিক সময় ফুরিয়ে যায়, ফুরিয়ে যায় কবিতার শেষ শব্দটি-- প্রেমের নেশা সৌন্দর্যের ডান হাতে চুমু দিতে গিয়ে পানকৌড়ির রক্ত পানে বিভোর হয়ে যায়।


মহেশখালীর কথা উঠলেই শেফালী ঘোষের নাম চলে আসে আড্ডাকথায়, চলে আসে মহেশখালীর মিষ্টি পানের কথা। সবকিছু ছাপিয়ে আমার মনে আসে বাকখালী নদীর কথা। বাকখালী অসাধারণ নীরব বিনয়ী নদী। কেউ তাকে দেখে বুঝতে পারবে না যে সাগরের সাথে তার বিশাল নেটওয়ার্ক। ভারতের মিজোরাম রাজ্যের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় পাহাড় থেকে উৎসারিত কিছু স্রোতধারা বান্দরবন জেলার নাইক্ষ্যংছড়িতে মিলিত হয়ে যৌথ ধারায় বাঁকখালী নদীর সৃষ্টি করেছে।


বাকখালী নদীতে পাওয়া যায় পোয়া মাছ। বৈজ্ঞানিক নাম Pama pama। অনেকে এটিকে পামা,কই ভোলা বলে ডাকে।খাদ্য হিসেবে এই মাছ খুবই সুস্বাদু। খাদ্যের ছয়টি উপাদানের মধ্যে প্রোটিন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রোটিন ছাড়া প্রাণীর অস্তিত্ব কল্পনা করা অসম্ভব। প্রোটিনকে সকল প্রাণের প্রধান উপাদান হিসেবে গণ্য করা হয়। সব প্রোটিনই কার্বন, হাইড্রোজেন, অক্সিজেন ও নাইট্রোজেন দিয়ে গঠিত। আর পোয়া মাছের দেহে প্রায় ১৮ শতাংশ প্রোটিন। তাই প্রানিজ আমিষের বিশাল আয়োজন পোয়া মাছ তার আয়োজনে ধারন করে। এক জেলে ১২৫ কেজি ওজনের একটি লাল পোয়া মাছ ধরে একদিনে লাখপতি হয়ে যায়। ঘটনাটি ঘটেছে বাংলাদেশে।বাংলাদেশের পত্রপত্রিকা ঘটনাটি জানে।


ছোট পোয়া জল থেকে উঠানোর প্রথম কিছুক্ষন তাকে সোনালি মনে হয়। তারপর পার্পল কালার ধারন করে,তারও কিছুক্ষন পর মাছটি হয়ে পড়ে সাদা বা জল রঙের। বাকখালী নদীর জল যখন আমার নিষাদ চামড়া স্পর্শ করে তখন আমার শৈশবের বারবার স্বপ্নে দেখা একটি সোনালি কালারের মাছের কথা মনে পড়ে। হয়তো পোয়া মাছকে বারবার স্বপ্ন দেখেছি হয়তো নয়। মনে পড়ে ক্যাপ্টেন হিরাম কক্সের কথা। অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে বার্মা আরাকান দখল করে উৎপীড়ন-নির্যাতন শুরু করলে হাজার হাজার শরনার্থী বাঁকখালী নদী তীরবর্তী রামু ও কক্সবাজারে আশ্রয় নেয়। ক্যাপ্টেন হিরাম কক্স তাদের পুনর্বাসন করে। নদী ভাঙন। দুর্ভাগ্যবশত ক্যাপ্টেন হিরাম কক্সের সমাধী বাঁকখালী নদীর ভাঙনে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। 


হিরাম কক্স (১৭৬০-১৭৯৯) একজন ব্রিটিশ কূটনীতিক, যিনি ১৮ শতকে বঙ্গ ও বার্মায় কর্মরত ছিলেন। আরাকান শরনার্থী ও স্থানীয় রাখাইনদের মধ্যে হাজার বছরের পুরনো সংঘাত ছিলো। হিরাম কক্স এই পুরনো সংঘাত শেষ করে দেয়ার কল্পে বহু পদক্ষেপ হাতে নেন।পদক্ষেপ পুরোপুরি বাস্তবায়নের আগেই তাকে প্রভুর সাথে মিশে যেতে হয়েছে। তার ভালো কাজের পদক্ষেপকে স্মরনীয় করে রাখার জন্যে একটি বাজার প্রতিষ্ঠা করা হয় যার নাম রাখা হয় 'কক্স সাহেবের বাজার'। সাহেব উঠে গেছে,থেকে গেছে কক্সবাজার। 


এইভাবে কত সাহেব আসলো গেলো, কত নদীতে চর পড়লো, কত সাগর হয়ে গেলো নদী, কত নদী হয়ে গেলো কালা মিয়া ওসমান মিয়া অনিন্দিতা কর্মকারের বাড়ি। জলের আদিতে জীবন, জীবনের আদিতে জল। এক রহস্যময় সময় ও সময়ের ঘেরাটোপে বাড়ছে মানুষ, মানুষের চাহিদা, বিলাসিতা। 


আজকের দুরন্ত সাপের মতো বাকখালী নদী একদিন থাকবে কিনা আমরা কেউ জানি না। আমরা জানি না সময়ের মায়া আমাদের কোথায় নিয়ে যায়। নদীর কারনে সাগর, না সাগরের কারনে নদী আমরা জানি না।আমাদের জানাশোনার পরিধি খুবই সীমিত। একটা পুরাতন গল্প মনে পড়ে গেলো। গল্পটি কার কাছ শুনেছিলাম তার নাম মনে নাই।বলছি গল্পটি। 


জাহাজের সব লোক মারা গেলো। বেচে থাকলো কেবল মিস্টার ডলফিন। মিস্টার ডলফিন ভাসতে ভাসতে একটি দ্বীপে আশ্রয় নিলো। দ্বীপের গাছপালা কাজে লাগিয়ে সে একটি ঘর নির্মান করে।অনেক কষ্টে সে দিনাপাত করছে। প্রায়ই বৃষ্টি হয়। ঘরের ভেতর বসে বসে সে মৃত্যুর জন্যে অপেক্ষা করে। গাছের বাকল টাকল খেয়ে কোনো রকমে বেচে আছে মিস্টার ডলফিন। 


দুপুর বেলা।সে খাবারের সন্ধানে বের হই। এমন সময় শুরু হয় প্রচন্ড বজ্রপাত ঝড় বৃষ্টি। বজ্রপাত থেমে গেলে ঘরের দিকে হাটা শুরু করে সে। 


ও খোদা!  বজ্রপাতে ঘর পুড়ে গেছে। সে মনে অত্যন্ত ব্যথা অনুভব করে।একমাত্র আশ্রয় তাও প্রভু নিয়ে গেলো তার কাছ থেকে। মনে বিষন্নতার ঝড় নেমে আসে।অঝোরে কাদতে আরম্ভ করে। কাদতে কাদতে ঘুমিয়ে যায় মিস্টার ডলফিন। 


হঠাৎ।হঠাৎ মানুষের শব্দ শুনে তার ঘুম ভাঙে। সে মানুষ দেখছে!  তার চোখকে সে বিশ্বাস করতে পারছে না। 


আপনারা কোথা থেকে আসলেন? 


এই দিক দিয়ে যাচ্ছিলাম। ধোঁয়া দেখে অনুমান করলাম এই দ্বীপে হয়তো মানুষ রয়েছে। তাই জাহাজ নোঙর করি।


মিস্টার ডলফিন আসমানের দিকে তাকালো। পুড়ে যাওয়া ঘরটির দিকে তাকালো।ধোঁয়া এখনো উড়ছে। মিস্টার ডলফিনের মনের ধোঁয়া মুছে গেছে।

ভালোবাসি তোমারে সহজে সহজে

 ভালোবাসি ভালোবাসি 

সকাল সন্ধ্যা তোমার গন্ধে 

গোলাপ হয়ে আমি ফোটি 

ভালোবাসি ভালোবাসি 

রাতকাশে তোমার চোখে 

চাদ হয়ে আমি উঠি 

ভালোবাসি ভালোবাসি 

সাগর জলে তোমার মনে 

ঢেউ হয়ে আমি ভাসি 

ভালোবাসি ভালোবাসি 

গোপন কথার পুলক ধ্যানে 

তোমার সাথে আমি আছি 

তোমার জলে শাপলা ফুলে 

নৃত্য হয়ে আমি বাচি 

ভালোবাসি ভালোবাসি 


তোমার কথা ভাবতে গিয়ে 

আমি আস্ত ফুল হয়ে যায় 

বোল হয়ে যায় লোকের মুখে 

আকাশ যখন তারার সুখে 

বাতাস হয়ে বয়ে চলি 

তোমার স্বপ্নে তোমার চোখে 


তোমার যখন ঘুম আসে না 

ঘুম আসে না ঘুম আসে না

ঘুম হয়ে আমি আসি 

আস্তে করে চোখের পাশে 

চোখের পাশে মনের পাশে 

আমিই তুমি ঘুমিয়ে হাসি 

ভালোবাসি ভালোবাসি 


ভালোবাসি ভালোবাসি 

বলবো আমি আমৃত্যু কাল 

তুমি আমার জন্ম মৃত্যু 

ভালোবাসার আকাশ পাতাল

সেন্টমার্টিনের সাগর

 জাজিরা। তারপর জিঞ্জিরা। তারপর নারকেল জিঞ্জিরা। তারপর সেন্টমার্টিন।তারপর দারুচিনিদ্বীপ। প্রবালদ্বীপ তারপর।


কৌতুক। একটা কৌতুক বলা যেতে পারে।


ডাক্তার সাহেব।

জ্বি বলুন।

আমার বউ আমাকে সন্তুষ্ট করতে পারছে না!

কী বলেন!?

গ্রামের সব পুরুষ আপনার বউ দ্বারা সন্তুষ্ট, আর আপনি সন্তুষ্ট হতে পারছেন না!?  না না তা হতে পারে না, আপনি শীঘ্রই আপনার স্বাস্থ্যের পরীক্ষা করান।


মাছের বারবিকিউ। কোরাল মাছের বারবিকিউ খাচ্ছি আর ডাক্তার সাহেবের কাছ থেকে কৌতুক শুনছি।তিনি মাঝে মাঝে এমন কৌতুক করেন। বলা হয়ে থাকে তিনি নারকেল জিঞ্জিরার একমাত্র ডাক্তার। এটি একসঙ্গে আশার এবং হতাশার কথা।কারন তো অবশ্যই আছে। তবে সব কারন সব সময় ওপেন করার প্রাসঙ্গিকতা রাখে না। মাছের বারবিকিউ জীবনে প্রথম খেলাম।ডাক্তার সাহেবকে ধন্যবাদ দেয়া দরকার। না। ধন্যবাদ দিলাম না। সেন্টমার্টিনে আমার প্রথম পদক্ষেপ এই আশ্বিন মাসে।১৪২৭। আমাদের ব্যাগপত্র আরাম করছে হোটেল হাসপাতালে। হোটেল হাসপাতাল! হ্যা হোটেল হাসপাতাল। ডাক্তার সাহেব দশটি রুমে,একতলা দুইতলা মিলে একাই থাকেন। তিনি না থাকলে মাকড়সা ইন্দুর সাপ তেলাপোকা থাকতো। যেহেতু তিনি থাকেন সেহেতু ইতরপ্রানিরা থাকেন না।


আমরা পাচটি রুম দখল করি। ডাক্তার সাহেবের নিজস্ব রিসোর্ট রয়েছে সেন্টমার্টিনে।নাম বলতে মানা।তবে রিসোর্টের প্রত্যেকটি রুম এক একটি বইয়ের নামে করা।যেমন একটি রুমের নাম বনলতা সেন,একটি রুমের নাম গীতাঞ্জলি ইত্যাদি ইত্যাদি। তিনার রিসোর্টে সাগরজল জোয়ারের সময় কবিতা পড়তে আসে,আবার ভাটায় কবিতা বানাতে চলে যায় সাগরপথে তার নিজস্ব জায়গায়। তিনার রিসোর্টের পাশে হুমায়ুন আহমেদের 'সমুদ্র বিলাস'। হুমায়ূন সাহেব শেষ জীবনে সমুদ্র বিলাসে থাকতে চেয়েছিলেন। প্রকৃতি তাকে থাকতে দিলো না। তিনি অসীম অপার সমুদ্রের ঢেউয়ের সাথে মিশে গেছেন। সময়ের উপাদান এখন তিনি।


ডাক্তার সাহেব তার রিসোর্টে আমাদেরকে থাকার জন্যে বলেছেন। অবশ্যই তিনি তা নিছক সৌজন্যকথা বোধে বলেছেন। কারন তিনিও চান যেনো আমরা তার সাথে কয়েকটি দিন যাপন করি। আত্মার কথা উপলব্ধি করার ক্ষমতা কাছের মানুষের থাকে। তাই আমরা হোটেল হাসপাতালে থেকে গেলাম। এটি সেন্টমার্টিনের একমাত্র সরকারি হাসপাতাল। দশ শয্যা বিশিষ্ট। সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার একমাত্র তিনি। অথচ তিনার পদবি উপসহকারি কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার। তিনি এই হাসপাতালে জয়েন করার আগেও হাসপাতাল ছিলো এবং ঔষধ রোগীকে সরবরাহ করতো হাসপাতালের এমএলএসএস(অফিস সহকারী)।


আমরা যে রুমে থাকি তার পাশেই হাসপাতাল এলাকার দেয়াল, দেয়ালের পাশে কয়েকটি পরিবার থাকে। সেই পরিবার হাসমুরগী পালন করে।একটি লাতা কী দিন কী রাত কী সকাল কী বিকাল ডাকে আর ডাকে।


১৭ তারিখ। সেপ্টেম্বর। ২০২০। ট্রলারে করে টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিনে যাই। প্রথম সাগর পাড়ি দেয়া।ছোটোকালে সিন্দাবাদকে সাগর পাড়ি দিতে দেখতাম। সিন্দাবাদের মতো কেউ সাগর পাড়ি দিতে গিয়ে এই প্রবালদ্বীপটি আবিষ্কার করে এবং এর নাম দেন জাজিরা, জাজিরা থেকে জিঞ্জিরা, জিঞ্জিরা থেকে নারকেল জিঞ্জিরা। জাজিরা মানে বিশ্রামস্থল।


এখানে সর্বপ্রথম মাত্র তেরো পরিবার জীবনযাত্রা শুরু করে। এখন জনসংখ্যা প্রায় আট হাজার। মাত্র দুটি সনাতনী পরিবার। বাংলাদেশে মাছধরাকাজ সনাতনী সম্প্রদায়কাজ। এখনো জেলে বলতে বাংলাদেশের মানুষ সনাতনী সম্প্রদায়কেই মনে মনে ফিল করে থাকে। কিন্তু। কিন্তু সেন্টমার্টিনে তিতাস একটি নদীর নাম উপন্যাসের চিত্রকল্প কাজ হবে না।এইখানে চিত্রকল্প পুরাই আলাদা। এখানে মুসলমানরা জেলে। মাছ ধরে। জলপুত্র উপন্যাস আমরা পড়েছি। হরিশংকর জলদাস নোনা পানির জেলেদের চিত্র আমাদের সামনে তুলে ধরেন।কিন্তু তার উপন্যাসেও সনাতনী জীবন।


আর সেন্টমার্টিনে? মুসলমানদের জেলেজীবন। এই জীবন নিয়ে কোনো উপন্যাস এখনো আমরা পাইনি।এই দ্বীপে যে কেবল বাঙালি মুসলমান বাস করে এমন না, রাখাইন মুসলমানদের বসবাস বিদ্যমান। অনেকের সাথে কথা হয়েছে আমাদের যারা মায়ানমারের জন্মনিবাসী। কেউ দশ বছর আগে কেউ পাচ বছর আগে বাংলাদেশ চলে এসেছে। বাংলাদেশ এসে জন্মসনদে বাংলাদেশের নাগরিকও হয়ে গেছে!


লাতামুরগী  যখন অন্ধ হয়ে যায় তখন তার সময়-জ্ঞান থাকে না, যেকোনো সময় ডাকাডাকি করতে থাকে। প্রথমদিন লাতামুরগীর ডাক শুনে ঘুম ভাঙে। ভাবছি ভোর হয়ে যাচ্ছে। মোবাইলে নাই চার্জ। সাগরের দিকে হাটা দিলাম।সকালবেলার সাগর দেখবো। পথে একজন মানুষের দেখা পাই। লোকটার কাছ থেকে জানতে পারি রাত দুইটা বাজে। লাতা মুরগিরটির প্রতি মায়া হলো। আহারে তার চোখ নাই বিধায় তার মুখ সঠিক তথ্য দিচ্ছে না। মনে হচ্ছে যারা বাংলাদেশ নিয়ে কাজ করবে তাদের লাতামুরগিটির মতো চোখ নষ্ট হয়ে গেছে, নষ্ট হয়ে গেছে মন। তাই তাদের সময়-জ্ঞান নষ্ট হয়ে গেছে-- রাতের কাজ দিনে করছে, দিনের কাজ করছেই না!


ট্রলারের কান্দিতে আমি আর ভাই বসা যেনো ঘোড়া চালাচ্ছি আমরা। বঙ্গোপসাগরের স্ফটিক নীল জল আমাদের পায়ে শিশু শিশু খেল খেলে যাচ্ছে। দূরে দেখা যাচ্ছে ঢেউয়ের ঐহিক মর্ত্যেসুখ। নিখাকি বৌদি আমার মাঝির সাথে বসে কোনো এক দূরের সময়ের কথা ভাবছে। ট্রলারবুকে বসে আমরা দেখচ্ছি বার্মা মুলুকের পাহাড়,পাহাড়ের সাইডৌলি কোমড়ের ভাজ। একসময় বিপ্লবের বাঙালির গুরুত্বপূর্ণ ব্রাঞ্চ ছিলো এই বার্মা মুলুক। পথের দাবির সব্যসাচী এই বার্মা মুলুকে নিজেকে ওপেন করেছিলেন ডানাওয়ালা পাখির উড়ার মতো। এই বার্মা মুলুক আজ মায়ানমার, অস্ত্র তাক করে আছে আমাদের দিকে। সীমানা এক ইঞ্চি কিংবা আধ ইঞ্চি অতিক্রম করলেই চলবে ফায়ার। মাঝি তাই সদা সতর্ক,সদা জাগ্রত বাংলাদেশ নৌবাহিনী বাংলাদেশ কোস্টকার্ড। বিশাল সাগরের বুকে চিত্রিত হয়েছে সীমানানীতি যেনো মাকে ভাগ করেছে তার সন্তান। মায়ের একভাগ নিয়েছে মায়ানমার একভাগ নিয়েছে বাংলাদেশ। ভাগাভাগির দুনিয়ায় মায়ের মৃত্যু হয়েছে, তাতে তার স্বার্থখেকো সন্তানের অল্প করেও বোধপীড়ন হয় না।


নাফকে অনেকে নদী বলতে চায়, আমি বলি সে সাগরের লেজ। সাগরের লেজ থেকে আমরা যখন সাগরে প্রবেশ করি হৃদয়ের কোথায় যেনো একটা টান লাগে। এই টান জীবন ও মৃত্যুর মাঝে জীবনবোধের আঁকাবাকা স্রোতের এক ইছামতী ঢেউ।এই টান জল থেকে জীবনে ফিরে আসার গল্প, এই টান মানুষ হয়ে জন্মানোর আগেকার কথা। এই টান প্রেমিকের সাথে প্রেমিকার হঠাৎ দেখা হওয়ার পর পলকহীন নীরবতার পারঙ্গম কম্পন।

সেন্টমার্টিনে মসজিদ একুশটি,প্রাইমারি স্কুল পাচটি, মাধ্যমিক স্কুল একটি, কলেজ একটি আর মাদ্রাসা সেন্টমার্টিনের প্রত্যেকটি পরিবার। 


সেন্টমার্টিনে ঔষধের দোকান প্রায় এগারোটা। কোনো কোনো ডাক্তার কোনোদিন প্রায় ত্রিশ হাজার টাকার ঔষধ বিক্রি করে। সেন্টমার্টিনে সরকারি হাসপাতাল থেকে পূর্বপাড়ার সৈকতের কাছাকাছি পর্যন্ত একটি পাকা রাস্তা বিদ্যমান, বাকি রাস্তা নামেমাত্র পাকা। সেন্টমার্টিনের মাধ্যমিক স্কুলে শিক্ষার্থী রয়েছে প্রায় চারশো থেকে পাচশো কিন্তু শিক্ষক তেরো থেকে পনেরো জন।অর্থাৎ শিক্ষকের পর্যাপ্ত ঘাটতি রয়েছে। এই দ্বীপে সবাই আসে কিন্তু কেউ থাকতে চায় না।


এই দ্বীপে মাছের ব্যবসা বেশ জমজমাট। দুই ধরনের ট্রলার নির্মিত হয় এখানে। পারাপার ট্রলার। মাছধরা ট্রলার।পারাপার ট্রলার দুইভাগে বিভক্ত। মানুষ পারাপার। মালামাল পারাপার। একটি ট্রলারের নির্মান খরচ দশ থেকে পনেরো লাখ টাকা। কাঠ আনতে হয় মায়ানমার থেকে। কোনোদিন প্রায় দশ থেকে পনেরো লাখ টাকার মাছ ধরা দেয় জেলেজালে। এমন মাছপ্রাপ্তিকে চরম ভাগ্যের ব্যাপার বলে মনে করে জেলেরা।কোনো জেলে বছরে একবার কোনো জেলে ছয় মাসে একবার কোনো জেলে বছরে ছয় থেকে দশবার এই ক্ষেপ পেয়ে থাকে। এই মাছক্ষেপ পাওয়া মানে টাকায় লালে লাল হয়ে যাওয়া। প্রতিদিন দশ থেকে বিশ হাজার টাকার মাছ পাওয়া স্বাভাবিক ঘটনা। সাগরে বিপদ সংকেত থাকলে মাঝিরা মাছ ধরতে যায় না।বিপদ সংকেতকে তারা সিঙ্গেল বলে। শুটকির ব্যবসাও এই দ্বীপে বেশ রমরমা। তরমুজ এখানে ভালো জন্মে। এই দ্বীপতরমুজ বেশ রসালো ও মিষ্টি।তরমুজকে কেন্দ্র করে একশ্রেণির ব্যবসায়ীর খোঁজ পাওয়া যায় এই দ্বীপে। কুকুর এখানে নারকেল খায়। অবাক হওয়ার মতো ঘটনা। কিন্তু সত্যি। কুকুর সবচেয়ে বেশি মানুষের আচরন কপি করে।এই দ্বীপের মানুষ অতিথি আপ্যায়ন করে ডাব দিয়ে মানে ডাব এদের কাছে অতিসুলভ সহজপাচ্য একটি খাবার উপাদান। হযরত মোহাম্মদ(স) এই দ্বীপে জন্মগ্রহন করলে ডাব হয়ে যেতো বেহেশতের সবচেয়ে অভিজাত খাবার। ডাবকে কেন্দ্র করে একপ্রকার ব্যবসার খোঁজ পাওয়া যায়।


এই দ্বীপের সবচেয়ে বড় ব্যবসা রিসোর্ট বিজনেস। একশোর অধিক রিসোর্ট রয়েছে এই দ্বীপে। রিসোর্টের পরের জায়গাটি খাবার বিজনেস। আট বর্গকিলোমিটার বা দুই হাজার একরের এই ইউনিয়নে প্রায় আটশো কোটি টাকার লেনদেন হয়ে থাকে প্রতি বছরে। মানে টেকনাফ উপজেলার এই সেন্টমার্টিন ইউনিয়নটি প্রায় আটশো কোটি টাকার মার্কেট। শত শত কোটি টাকার লেনদেন যে  দ্বীপে হয়ে থাকে সেই দ্বীপকে এমন গরিবি হালত করে রাখার মানে আমি খুঁজে পাইনা। যে গাভী রোজ দশ কেজি দুধ দেয় সেই গাভীর পেছনে রোজ মিনিমাম তিন কেজি দুধের টাকা খরচ করতে হবেই নতুবা গাভীর স্বাস্থ্যের অধিক ক্ষতি হবে নিশ্চিত। সেন্টমার্টিনে শতকোটি টাকা খরচ করে হাসপাতাল বানানো হলো অথচ ডাক্তার নাই, স্টাফ নাই, নির্মিত অপারেশন থিয়েটার রয়েছে অথচ ডেলিভারির জন্যে কোনো সুযোগ সুবিধা নাই।জরুরি মুহূর্তে বাচ্চা ডেলিভারির জন্যে টেকনাফ যেতে হয়।যেতে যেতে পথেই মারা যান মা।সাগরে বিপদ সংকেত থাকলে প্রাকৃতিক দায়মার উপর নির্ভর করতে হয়,বাচ্চা মারা যায়, মার স্বাস্থ্য পরে হুমকির মুখে। এখানে এই বাংলাদেশে কোনো মানুষ থাকে যাদের চৈতন্য রয়েছে!?


এটি পর্যটন এড়িয়া, এই কথা মানিব্যাগের ভেতর না রেখে মাথায় রাখতে হবে। পর্যটনকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যেতে হয়। পুলিশ বিজিপি কোস্টকার্ড নৌবাহিনী যে প্রয়োজনে মোতায়েন করা দরকার সেই প্রয়োজনে এখানে পরিবেশ বান্ধব প্রশান্তি বান্ধব সহজ গমনাগমন সহায়ক কমফোর্ট কমিনিকেটিব প্রতিবেশ নির্মান করা জরুরী। প্রকৃতি যেমন দিতে পারে তেমনি নিতেও পারে।


তবে সেন্টমার্টিনে তিনভাগের প্রায় পনেদুইভাগ জমির মালিকানা অন্য এলাকার মানুষদের হাতে।এমন সময় আসবে যখন সেন্টমার্টিনের মালিকানা স্থানীয় লোকদের হাতে থাকবে না। তখন বিদ্যুৎবাস স্থাপন হবে, উত্তর থেকে দক্ষিণ সেন্টমার্টিন যাতায়াতের জন্য নির্মিত হবে ইজি রাউন্ড প্যাসেজ, গড়ে উঠবে অত্যাধুনিক প্রাইভেট হাসপাতাল, নারকেল গাছ কেটে লাগানো হবে পরিবেশ বিনাশকারী অতি উচ্চ কাঠগাছ,কেয়া গাছকে বনসাই করে হোটেলের চমকভাঙা জাদুঘরে ঠাই করে রাখা হবে, প্রমোদতরী ভাসবে সেন্টমার্টিন টু টেকনাফ বরাবর, টেকনাফ টু বার্মার উন্মুক্ত হোটেল বরাবর। সবই হবে সবই হতে যাচ্ছে। সময় ঠিকই তার মতো করে মানুষকে নির্মান করে নিতে জানে। সময় এক আজব কারিগর।


রাত তিনটা। সাগর পাড় দিয়ে হাটছি আমরা চারজন। কেউ কেউ জেগে আছে তখনো। সাগর তখনো জেগে আছে। সাগর ঘুমায় না।সাগরের গর্জন তার প্রমান।সাগরের গর্জন পৃথিবীর সবচেয়ে ইউনিক চাংগা সংগীত। বিপ্লবী মারা গেলে সাগরের গর্জন হয়ে যায়। সেন্টমার্টিনে আসার পর আমাকে অবাক হতে হয়েছে। কারন বিপ্লব করতে করতে যারা টিভির পর্দা ফাটিয়ে ফেলে, টিএসসির মাটিকে ধূলায় রূপান্তর করে বড় বড় সোসালিষ্ট কলামিস্ট কমিনিস্ট ফমিনিস্ট মূর্তিমান সাজঘর সাজে তারা কই!? সব হালারা এটেনশন সেকার। নিজের ফেইস ডিগনিটি চকচকে করে তুলার জন্যে কমিনিস্ট ফমিনিস্ট সোসালিষ্ট বালিস্ট ইউনিয়ন ফিউনিয়ন তকমা লাগায়। মাত্র দুইজন কেবল দুইজন মানুষকামী আত্মা এই সেন্টমার্টিনে পদার্পন করামাত্র সেন্টমার্টিনের চেহারা বদলে যাবে। সেন্টমার্টিন হয়ে উঠতে পারতো বিপ্লবের ছুডিঘর। তাই সেন্টমার্টিনের মাটি ও মানুষের জীবন অবলোকন করে সো কল্ড বিপ্লবীদের মুখে থুথু দিতে ইচ্ছে করছে জাস্ট।


সাপ ধরেছে ব্যাঙকে। ব্যাঙ চিৎকার করছে। রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে বিবেক।বিবেককে দেখে ব্যাঙ যেনো বেচে উঠলো। বিবেকের কাছে ব্যাঙ বাচার আকুতি জানালো।সাপ বলে আমি তিন দিন যাবৎ না খেয়ে আছি,আমার খাবার দরকার। বিবেক পড়লো মহা বিপদে!  এখন বিবেক কী করবে? বিবেক সাপকে বললো 'ছেড়ো না' আর ব্যাঙকে বললো ' নড়ো না'। ব্যাঙ যখন নড়ছে না সাপ ভাবলো এবার তাকে মুখ থেকে মাটিতে রাখা যায়, মাটিতে রেখেই তাকে ভালোভাবে খাওয়ার প্রস্তুতি নিবে সাপ। যখন সাপ ব্যাঙকে মাটিতে রাখলো তখন ব্যাঙ দিলো লাফ। এক লাফে সাপের সীমানার বাইরে।


ব্যাঙ আর সাপের গল্প শুনতে শুনতে আমরা ইলিশ মাছ ভাজা খাচ্ছি। সাগরের ইলিশ। ডাক্তার সাহেব তিন হাজার টাকার মাছ কিনেছিলেন বাড়ির জন্যে। মাছ আর বাড়ি নেয়া হলো না তার। রিজিক এক উদ্ভুত ব্যাপার! রিজিককে আমার কাছে সময়ের উপহার মনে হয়। সাগরের ইলিশে নোনা গন্ধ তাজা মিহি স্বাদ রয়েছে। সাগরকে এখনো ইট ভাটা কলকারখানার শ্রমিকরা তাদের দূষণের কবলে পুরোপুরি নিতে পারে নাই। আমি তো অবাক, কেনো সেন্টমার্টিনে কোনো মন্ত্রী আমলা ইটকল বা বজ্রের ফ্যাক্টরি স্থাপন করেনি।


কুরমুরি ইলিশ ভাজা খেয়ে আমরা চললাম ডাক্তার সাহেবের রিসোর্টের দিকে। পরিবেশ অধিদপ্তর সেখানে একটি ওয়াচ টাওয়ার নির্মান করেছে। ওয়াচ টাওয়ার থেকে সমুদ্র দেখবো। রাত নয়টার পর থেকে জোয়ারজল ওয়াচ-টাওয়ার এলাকায় প্রবেশ করে। টাওয়ারের নিচে সমুদ্রের ঢেউ।আমরা উপরে। চারপাশে অন্ধকার। ঢেউজলে ভেসে আসছে শ্বেত ফসফরাস। চারপাশ কাপানো জলের গর্জন। মনে হচ্ছে এখন ভেঙে ফেলবে টাওয়ার। ভাসিয়ে নিয়ে যাবে ডাক্তার সাহেবের রিসোর্ট,পুরো সেন্টমার্টিন। নিখাকি বৌদি আমার শিশুদের আনন্দে বয়স্কদের আতঙ্কে একসঙ্গে বয়ে যাচ্ছে জলগর্জনের তালে তালে। এমন সময় আমার মনে হলো  সাগরের পুরাতন প্রেমিকা এই সেন্টমার্টিন। সাগরকে ছেড়ে সে সংসার করা শুরু করেছে। আর সাগর?  হাজার বছরের মতো বাউল উদাসীন রয়ে গেলো। মাঝেমধ্যে সাগর তার প্রেমিকাকে দেখতে আসে শিবের নীলরং বেশে, কাছে আসে খুব কাছে আসে, তারপর সাগর সেন্টমার্টিনের কানে কানে বলে, 'বন্ধু তোমাকে নিয়ে যেতে পারি আমার হাজার বছরের পুরাতন পথে কিন্তু রেখে গেলাম তোমাকে পৃথিবীর এই সামাজিক নিয়মে রেখে গেলাম তোমাকে তোমারই ইচ্ছার বাধনে', তারপর সাগর আবার নেমে যায় তার পথে তার গতিতে। সাগরের এই নেমে যাওয়া গতিকে লোকে ভাটা বলে।


"আই ভাত ন হাইয়ুম গুসসা ওইয়ুম আর মনত জ্বালা

বেয়াতুনুর বউ সুন্দর সুন্দর আর বউয়া হালা

পূকর বাড়ির শসমো মিয়া ছোড আবতুন

কি সুন্দইয্যা বিয়া গইয্যে রাঙ্গামাটিরত্তুন

বদ্দা রাঙ্গামাটিরত্তুন

আল্লেই আইন্নি রাওজানূত্তুণ চুকচুইক্কে হালা

আর মনত জ্বালা"


এমন রেসিস্ট গান শুনতে নিশ্চয়ই কোনো সচেতন মানুষের ভালো লাগবে না। এই গানে প্রতিযোগী মনোভাবকে তেল দেয়া হয়েছে। একটি জাতি জাস্ট প্রতিযোগিতার মিছিলে স্লোগান দিয়ে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। সুন্দর কোনো রং নয়, সুন্দরে রং থাকে। অথচ কলোনিয়াল মানসিকতার স্পষ্ট ছাপ এই গানে রয়েছে। আর এই গান শুনতে হচ্ছে আমাকে সেন্টমার্টিনে এসে।তবে নিঝুম দ্বীপে আব্দুর রশীদ ভাইয়ের গান শুনে মন ভরে গেলো। চোখের ক্লান্তি মনের ক্লান্তি মুছে গেলো।'মধু হই হই' গানটির সুরকার ও গীতিকার এই আব্দুর রশীদ ভাই। তার গান শুনে, চা খেয়ে আমরা চললাম ছেড়াদ্বীপের উদ্দেশ্যে। প্রবালদ্বীপ পার হয়ে ছেড়াদ্বীপ।ছেড়াদ্বীপে কোনো মানুষ থাকে না। জোয়ারজলে ভেসে যায় এই দ্বীপ। তবে অন্তরে অন্তরে সিনেমায় মৌসুমী সালমান শাহ এই ছেড়াদ্বীপে দুজনে নির্জনে প্রেমের পৃথিবী সাজানোর কথা বলেছিল। ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৯৪ সালের ১০ জুন। ডিরেক্টর শিবলি সাদিক। জানি না এই ছেড়াদ্বীপে তখন সন্ধ্যা নাগাদ জোয়ারজল আসতো কিনা। আসলে প্রেমের পৃথিবী হয়ে যেতো সলিলসমাধি। তবে এই ছেড়াদ্বীপের সাগর একেবারে অন্যরকম। এখানে জল নীল শাড়ি পরে রাধিকারূপে যায় কৃষ্ণবিহারে। এখানে জল বৃন্দাবনসুখী রাধাকৃষ্ণ তপোবন।


অনেকে মনে করেন এই প্রবালদ্বীপটি টেকনাফের অংশ ছিলো।ভূমি পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এটি আজকের রূপ ধারন করেছে। হতেও পারে। কারন টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিনের দূরত্ব এক ম্যারাথন দৌড় পরিমান।আর মায়ানমার তো সেন্টমার্টিন দ্বীপচোখের ছায়ার নিচে। যেহেতু এটি প্রবালদ্বীপ সেহেতু সংশয় থেকে যায়। কারন প্রবাল জমতে জমতে এই দ্বীপ আজকের অবয়ব ধারন করেছে এই কথা অনেকে মনে করেন। জীবিত প্রবালকে দা দিয়ে আঘাত করলে সাদা রক্ত বের হয়। প্রবালকে দেখে মনে হবে দলদলে জুলজুল করে তাকিয়ে আছে। বাস্তবে তা নয়। তারা অত্যন্ত সত্যনিষ্ঠ ঘনিষ্ঠ। ভাইয়ের দারা শখ করে প্রবালে উঠে পা কেটে ফেলে। এই প্রবালের লোমে লোমে বালুকনা জমতে জমতে আজকের দারুচিনিদ্বীপ। এই দ্বীপকে আবেক্ষণ করার পর বলতে পারি আরও প্রবাল এখানে জমা হবে। গবেষণা করে কেবল আবিষ্কার করতে হবে এমন কিছু আছে কিনা যা  প্রবালজীবনে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। ক্ষতিকর প্রভাব থেকে দারুচিনিদ্বীপকে প্রবালজীবনকে মুক্ত রাখতে পারলে তার আয়তন আরও বৃদ্ধি পাবে।


অ্যান্থজোয়া শ্রেনীভুক্ত সামুদ্রিক প্রানি প্রবাল। প্রবালের নিকটাত্মীয় সাগর কুসুম। এরা সাগর কুসুমের মতোই পলিপ তৈরি করে, তবে সাধারনত এরা কলোনি তৈরি করে বসবাস করে। কলোনির সমস্ত পলিপ জেনেটিক্যালি অভিন্ন হয়। এরা প্রানি হলেও অনেকটা সাধুপ্রানি, জীবনের পূর্ণবয়ষ্ক অবস্থায় সাগরতলে কোন দৃঢ় তলের উপর গেড়ে বসে বাকি জীবন পার করে দেয় নিশ্চল হয়ে (হুমায়ূন আহমেদ যেমনটি করতে চেয়েছিলেন সেন্টমার্টিনকে ঘিরে,তিনিও যেনো বয়স্ক প্রবাল হতে চেয়েছিলেন)। প্রতিটি প্রবাল-পলিপ যেখানে গেড়ে বসে সেখানে নিজের দেহের চারপাশে ক্যালসিয়াম কার্বনেট নিঃসরণের মাধ্যমে শক্ত পাথুরে খোলস বা বহিঃকঙ্কাল তৈরি করে।প্রবাল পলিপের মৃত্যুর পরেও খোলসটি রয়ে যায় এবং তা অস্মীভূত হয়ে যেতে পারে। এরকম অস্মীভূত প্রবালের দেহাবশেষের উপর নতুন করে আবার প্রবাল বসতে পারে। এভাবে একটা কলোনি বহু প্রজন্ম ধরে চলার ফলে বড়সড় পাথুরে আকৃতি ধারন করে। এভাবেই তৈরি হয় বড় প্রবাল দ্বীপ এবং প্রবাল প্রাচীর। প্রবাল প্রাচীর মাটিধর্ম থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।


ক্রমবর্ধিষ্ণু প্রবাল কলোনিগুলোকে প্রবাল মস্তক বলা হয়। প্রচলিত ধারণায় সমস্ত মস্তকটিকেই একটি প্রবাল বলে মনে করা হলেও, তা আসলে প্রবাল পলিপ যৌথসভা। প্রবাল পলিপ যৌথসভা প্রত্যেকেই জিনগতভাবে অভিন্ন। তাদের দেহের ব্যাস মাত্র কয়েক মিলিমিটার হয়ে থাকে। কয়েক হাজার প্রজন্ম ধরে প্রবালের জীবনচক্র চলার ফলে একটি প্রবাল কলোনিতে তাদের প্রজাতীর বৈশিষ্ট্যসূচক একটি কঙ্কাল গঠন করতে পারে। প্রবাল মস্তকগুলো বেড়ে ওঠে পলিপগুলোর অযৌন প্রজননের মাধ্যমে বংশবিস্তারের মাধ্যমে। তবে প্রবালেরা বংশবিস্তারে যৌন প্রজননেরও আশ্রয় নেয় প্রজনন ঋতুতে পূর্ণিমার রাতে বা তার কাছাকাছি সময়ে কয়েক রাত ধরে সাগরের পানিতে শুক্রানু এবং ডিম্বানু ছেড়ে দিয়ে। সাগরজীবন প্রবালকীট কমিনিউকেশনে অত্যন্ত সহায়ক। তবে স্কুবা ড্রাইভারের সংখ্যা ও গুরুত্ব বাংলাদেশে বৃদ্ধি পেলে প্রবালজীবন সম্পর্কে আরও ধারনাসমৃদ্ধ বক্তব্য আমাদের ভাষায় জন্ম নিবে।

মাটির প্রত্যেক উপাদানের সাথে তার প্রত্যেকটি উপাদানের যেমন সম্পর্ক তেমন সম্পর্ক প্রবালের সাথে টোটাল প্রবাল গোষ্ঠী কিংবা বালিকনার থাকে না। তাই সেন্টমার্টিনে যত ইট সিমেন্টের ব্যবহার হবে মানে গাথুনিনির্ভর দালান কোঠা নির্মান করা হবে ততই এই প্রবালদ্বীপকে বিপদজনক পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে। প্রবাল প্রাচীর আর মাটি এক না,সাধারণ এলাকার মাটি আর সাগর দ্বীপের মাটি এক না।


এক স্যার অন্ধদের ক্লাস নেন।ক্লাসে গিয়ে স্যার বললেন,'একজন দাড়াও।' একজন বাদে সবাই দাঁড়িয়ে গেলো। স্যার যে ছাত্র বসে আছে তাকে জিজ্ঞেস করলেন কেন সে দাড়ায়নি।' সে বলে, 'স্যার,গতকাল থেকে আমি চোখে দেখতে শুরু করেছি।'


সেন্টমার্টিনে যখন একটি বহুতল বিল্ডিং নির্মান করা হবে তখন সবাই বিল্ডিং নির্মানের দিকে নজর দিবে। একজনও খুজে পাওয়া যাবে না যে অন্ধকার থেকে বের হয় আলোর বাজারে যাবে। যাকে বলে গড্ডালিকা  প্রবাহ। অর্থাৎ দেখাদেখি বিল্ডিং নির্মানের ঢল নামবে, সেই ঢলে ভেসে যাবে সেন্টমার্টিনের বিসতি কিসসা।


সেন্টমার্টিন মূলত জেলেপল্লী। ভাতে মাছে বাঙালি বলতে যা বুঝায় তা এলাকার মানুষের জন্মগত। আমরাও এই দারুচিনিদ্বীপে ভাতে মাছে বাঙালি হয়ে গেছি।আমাদের ইচ্ছা ছিলো দুই-তিন দিন থাকবো। কিন্তু আমাদের থাকতে হয়েছে সাত দিন। ছোটোকালে খালাম্মার বাড়ি গেলে নিজের ইচ্ছায় আসা যেতো না।খালাম্মা কাপড় লুকিয়ে ফেলতেন। এই সাগরও আমাকে দেখে বেশ আনন্দিত। তাই সে আমার বাড়ির ফেরার সময় নিজেকে উত্তাল করে তুলে, কালিরূপ ধারন করে,আবহাওয়া অফিসে জারি হয় তিন নাম্বার বিপদ সংকেত। জাহাজ ট্রলার চলা স্টপ। সাতদিন আপ্যায়ন করার পর সে শান্ত হয়। তাও পুরোপুরি নয়।


 সাগর না শান্ত না অশান্ত এমন অবস্থায় আমরা ট্রলারে উঠি।আমি প্রথমে ছিলাম মাঝির সাথে। পরে দেখি ইঞ্জিনের ধোঁয়া আমার নাকে এসে লাগে। তারপর গিয়ে বসলাম ট্রলারের মাঝখানে। আমার পাশে এক হুজুর ও তার স্ত্রী। চোখবাদে তার স্ত্রীর কিচ্ছু দেখা যায় না।তারপরও দেখি মোবাইল দিয়ে সে তার স্ত্রীর ছবি তুলে। কীসের ছবি তুলে আমি ভেবে পাইনা! সাগরে ঢেউ বাড়ে। ট্রলারের কান্দি দিয়ে জল উঠে। আমার নিখাকি বৌদির ভয়ে চেহারা লাল হয়ে যায়, বোরখা মহিলা সিজদায় পড়ে যায়। আমি তাকে কানে কানে বললাম 'ভয় পাবেন না, আমি যে ট্রলারে আছি নিশ্চিত জেনে রাখুন সেই ট্রলার ডুববে না।' আর তার স্বামীকে বললাম 'আসতাগফিরুল্লাহ জপ করেন', বৌদিকে ইশারা দিয়ে বললাম 'নো টেনশন'। তারপরও বৌদি ডো টেনশনে ছিলো।কারন বৌদি সাতার জানে না। এক মহিলা বমি করা শুরু করে।


তারপর ধ্যানে বসলাম। তারপর আস্তে আস্তে নৌকা ঢেউয়ে ঢেউয়ে ভাসতে শিখে গেলো। আস্তে আস্তে নাফ নদীর ভেতরে আমরা ঢুকে যাই। নাফ নদীতে ট্রলারের মাঝখানে বসে ভাবতেছিলাম শত শত বছর আগে কাঠের নৌকা করে কেমনে তারা আমেরিকা আবিষ্কার করে!? তখন ইঞ্জিন ছিল না। অথচ তাদের সাহস!  আর আমরা পুকুরে নামতে ভয় পাই, নদীতে তো আরও ভয়। আর সাগর?  সাগর তো মহা মুশকিলের জায়গা। পদ্মা মেঘনার ঢেউ গুনতে গুনতে আমাদের দিন যায়, আর তারা হয়ে উঠে কলম্বাস,ইবনে বতুতা,ভাস্কো দা গামা।


মুসলমান জেলেপল্লী আর সনাতনী জেলেপল্লীর মধ্যে পার্থক্য অনেক অন্তত বাংলাদেশে। সনাতনী জেলেপল্লী একটু নোংরা হয়,ময়লার আধিক্য থাকে। 'নোংরা' পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা অর্থে ব্যবহার করেছি। আমরা যে সময়টাতে সেন্টমার্টিনে নোঙর করি সেই সময়টা কিন্তু সেন্টমার্টিনের প্রসাধনী সময় নহে। তার প্রসাধনী সময় নভেম্বর থেকে মার্চ।এই সময় সে চেহারা পার্লারে নিয়ে একেবারে বউসাজ সেজে পুতুল হয়ে থাকে। সনাতনী জেলেপল্লীর ছেলেমেয়েরা মুক্তভাবে চলাচল করতে পারে কিন্তু সেন্টমার্টিনে সেই ব্যবস্থা নেই।সেন্টমার্টিনে আমরা সাতদিন ছিলাম কিন্তু কোনোদিন কোনো যুবতী মেয়ের বা মহিলার সেই অর্থে চেহারা দেখেনি। সেন্টমার্টিনছাড়ার আগের দিন হুমায়ূন আহমেদের বাড়ির আশেপাশে কয়েকজন মেয়েমহিলাকে উন্মুক্ত আলাপ আলোচনা করতে দেখি। এক চাচার কাছে জানতে চেয়েছি মেয়েদের এই ঘরবন্দী থাকার কারন।চাচার বয়স ৭০ থেকে ৭৫।কিন্তু চেহারায় বয়সের ছাপ কম। চাচার মতে মেয়েরা গোয়ালের গরুর মতো মালিকের ইচ্ছাধীন। চাচার হতা হুনে আর মাথায় যেনো বজ্র পড়ে! আই পুরাই ফঅল অয়ে যাই!!


ধীরাজ বাবুর সাথে কাজী নজরুল ইসলামের কোথায় যেনো একটি মিল দেখতে পাই। তবে ধীরাজ বাবুর মতো কাজীদাকে এতো স্পষ্ট সুরে কথা বলতে দেখি নাই। যখন পুলিশ ছিলাম বইটি পড়ে ধীরাজ বাবুর প্রতি আমার যথেষ্ট রাগ হয়েছিল। আবার ভাবলাম, লোকটি নিজের কথা লুকানোর চেষ্টা করেনি। এটাই তার মহৎ আবেশ। মোহব্যূহে পড়ে অনেক লেখক নিজেকে মহৎ করে তুলেন। ধীরাজ ভট্টাচার্য তা করেননি।তিনি বলেছেন মাথিনের কথা, তিনি বলেছেন তার জন্য মাথিন প্রান দিয়েছে কুয়ার জলে।


ওয়ানথিন প্রু চৌধুরীর মেয়ে মাথিন।ওয়ানথিন তৎকালীন সময়ে সেখানকার জমিদার। গোত্রনিয়মের বাইরে গিয়েও মাথিন ধীরাজ ভট্টাচার্যকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ধীরাজ সময়সংঘাতে শেষ পর্যন্ত মাথিনকে বিয়ে করতে পারেনি। মাথিন থেকে গেছে টেকনাফ থানার কুয়ার জলে। প্রেমের জন্য জলহীনা মাথিন সময়ের সাথে লেপ্টে আছে ইতিহাসের পাতায়।


টেকনাফ নেমে প্রথম কাজ সিএনজি ডাকা, তারপর বাজারে যাওয়া, বাজার থেকে কিছু কেনাকাটা করা। দরদাম করে কেনাকাটা করি। বাজার মানেই দরকষাকষি। সিএনজি ড্রাইভার বলে এতো দরদাম করে নাকি এখানকার মানুষ কেনাকাটা করে না। কারন তাদের কাছে নাকি প্রচুর টাকা। টাকার উৎস জানতে চায়লে সিএনজি চালক মাহবুব ইয়াবা ব্যবসার প্রতি সরাসরি ইঙ্গিত করে।


মেরিন ড্রাইভ রাস্তা দিয়ে চলছে আমাদের সিএনজি। আমি মাহবুবের পাশে বসা।সে দুর্দান্ত চালায়। চালক হিসাবে সে যথেষ্ট রুচিশীল ভদ্র। গান শুনছে মাহবুব। একটি ইয়ারফোন সে আমার কানে সংযোগ করে।আমি যে গানগুলো শুনি সেই গানগুলো বাজছে তার মোবাইলে। তাই আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্ট মনে হলো তাকে। কারন আমার ইউটিউব হিস্ট্রি তার কাছে থাকার কথা নয়।


আহা! মেরিন ড্রাইভ!!  বাংলাদেশের ভয়ঙ্কর সুন্দর একটি রাস্তা। একপাশে সমুদ্র, একপাশে পাহাড়। একসময় সাগরের মাতৃরূপ চোখে নামে একসময় পাহাড়ের বিশাল উদার কঙ্কনা চোখে আসে।সাগর আর পাহাড়ের ডেজল অবয়ব পাশে রেখে চোখে নৃত্য করে নৃশংস হৃদয়ছোয়া মেঘ। মনে হয় যেন বেহেশতের তিন হোর এসে আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে প্রশান্তির অধরা পৃথিবীর ছায়ায়। সেই ছায়াতে আমি শিমুল  তুলার মতো উড়তে উড়তে হারানোর কথা ভুলে গিয়ে হারিয়ে যায়।আহা প্রশান্তি!  প্রশান্তির ছবি তুলা যায় না।


কক্সবাজার?  কক্সবাজার নিয়ে আমি কোনো কথা বলতে রাজি না। জলরাশি আর বিল্ডিং দেখতে নিশ্চয়ই মানুষ টাকা খরচ করতে প্রস্তুত থাকবে না। শুনেছি কক্সবাজার নাকি পৃথিবীর বৃহৎ সমুদ্র সৈকত। আরে ভাই 'বৃহৎ' কথাটি বলতে যতটুকু মুখ ফোলে ততটুকু বুক তো ফোলে না।

কক্সবাজারে আমরা ছিলাম শরীফের বাসায়।সেও আমাদের জন্য গেস্টরুম প্রস্তুত করে রেখেছিল কিন্তু আমরা তার বাসাতেই রাতযাপন করি। শরীফ জীবনে যত জায়গায় অবস্থান করেছে প্রত্যেক জায়গায় আমি এক ঘন্টার জন্য হলেও অবস্থান করেছি।শরীফ ছোটোকাল থেকে স্কাউট করেছে, এখন স্কাউটিং তার জীবিকা। শরীফের বউ আমাদেরকে পেয়ে মহাখুশি। আনন্দে রান্না করেছে সে মজার মজার মাছ। আমরাও মজার মাছ খেতে খেতে ভাতেমাছে দিনগুনি।


শরীফের বাসা থেকে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত দশ মিনিটের পথ। সমুদ্র সৈকতে গিয়ে দেখি কয়েকটি ছাতা টাঙানো। ছাতার নিচে বসতে ঘন্টায় ৬০ টাকা গুনতে হয়। সরকারি কোনো পদক্ষেপ আমার চোখে পড়েনি।  এলাকাটিকে সরকারমুক্ত এলাকা মনে হলো। ভালোই, বাংলাদেশের একটি জায়গা পাওয়া গেলো যেখানে সরকার নাই। কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের আশেপাশের এলাকাকে একটি উপজেলা শহরের চেয়েও অগ্নুৎপাত বৃদ্ধভগ্নদশা বলিয়া বোধ হলো। ভালো সৈকতচিন্তার কোনো প্রভাব দেখলাম না।আবার ভাবলাম, যে দেশ তার জাতির পিতাকে হত্যা করে সেইদেশের মানুষ এর চেয়ে ভালো চিন্তা করতে পারে কী করে!?


ট্রেন মিস করেছি। এখন আবার সোনার বাংলা ট্রেনের টিকিট কাটলাম। শোভন চেয়ার। চিটাগং আমি স্নিগ্ধা করে আসা যাওয়া করতে স্বাচ্ছন্দবোধ করি। শোভন চেয়ারে বসে আছি এমন সময় একজন ট্রেনকর্মী আমাকে ডেকে নিয়ে স্নিগ্ধায় বসালেন। ভালো লাগলো। আসলে আমরা যা গভীরভাবে প্রার্থনা করি তাই আমাদের জন্যে অপেক্ষা করে। গ্যালাক্সির প্রত্যেকটি বস্তু আমাদের জন্যে আমরাও গ্যালাক্সির প্রত্যেকটি বস্তুর জন্যে, মাঝখানে কোনো 'অর্থাৎ অথবা কিংবা এবং' জাতীয় শব্দ নাই -- এইখানেই জীবন আর জীবনের অভিধান একসঙ্গে লেপ্টে যায়।


হকবিলস প্রজাতির কচ্ছপ মূলত আটলান্টিক মহাসাগরের। ভারত মহাসাগরেও তার দেখা পাওয়া যায়। গভীর জলে তারা বসবাস করতে পছন্দ করে না। ফিশ, জেলিফিশ স্পঞ্জ তার খাবার। ৩০-৫০ বছর তার সাধারণ আয়ুকাল। ২৪-৪৫ ইঞ্চি তার দৈহিক গাঠনিক আকৃতি। ওজন ১০০--১৫০ পাউন্ড। জলপাই রঙের কিংবা সবুজ রঙের কচ্ছপের মতো তার নেস্টিং সময়টা আলাদা। ডিমপাড়ার সময় সে সাগরতীরের কাছাকাছি চলে আসে। তীরবাহু বালুতে কূপ খনন করে। একটি কূপে ১৩০--১৬০ ডিম রেখে বালু দিয়ে ঢেকে ফেলে। প্রায় ৬০ দিন ধরে চলতে থাকে তাপপ্রক্রিয়া। তাপপ্রক্রিয়ার এই সময়টা কচ্ছপদের জন্য সবচেয়ে জটিল কঠিনতম সময়। কচ্ছপের ডিমের তাপপ্রক্রিয়ার কথা আসলে এক সাধু ও তার শিষ্যের কথা মনে আসে। শিষ্য গুরুকে ছেড়ে যেতে চাচ্ছে না। বিরহে কাতর। তাছাড়া তার মানে শিষ্যের অন্তরে তাসাউফও অর্জিত হয়নি।গুরুর আদেশ অবশ্যই তাকে মানতে হবে। গুরুবাক্য গঙ্গাজলের চেয়েও পবিত্র,  গুরুবাক্য নূহ নবীর কিস্তির চেয়েও নিরাপদ, গুরুবাক্য চলক ধ্রুবক, গুরুবাক্য ভাব-বস্তু। গুরুবাক্য মেনে গুরুকে ছেড়ে যেতে হচ্ছে তাই তো তার মনে বিরহ অপার অসীম।

গুরু তার মনের দুঃখ বিরহ বুঝতে পারলেন। এবং শিষ্যকে বলেন, " তুমি যেখানেই থাকো তোমার সাথে আমি আছি,  কচ্ছপ যেমন তীরে তার ডিম রেখে সাগরজল থেকে তাপ দিয়ে বাচ্চা ফোটায় তেমনি আমিও দূর থেকে তাপ দিয়ে তোমার অন্তর-আত্মা প্রকাশিত করে ফেলবো। তখন তোমার আর আমার মধ্যে কোন দূরত্ব থাকবে না।"


গুরু-শিষ্যের তাসাউফ তাপপ্রক্রিয়া যত সহজ মনে হচ্ছে তত সহজ কিনা জানি না। তবে কচ্ছপজীবনের ডিম তাপপ্রক্রিয়া সহজ নয়। এই সময়টাতে বিভিন্ন কাকড়া শঙ্খচিলের আক্রমনবলয়ের শিকার হয় তাদের। আর মহান মানুষদের বিজ্ঞাপনজ্ঞাপক প্রচারসুখ জাতীয় মহান কর্মকাণ্ডের কথা বলে অভিধান প্রসার না করি।


কচ্ছপের মাংসের কদর আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যাপক। আইন করেও কচ্ছপের ব্যাপারে মানুষের আচরনে দাড়ি কমা সেমিকোলন টানা যাচ্ছে না। প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক উপাদান ধ্বংস করে হলেও মানুষ বিলাসী জীবনের পাহাড়সুখ নির্মান করবেই।


চুনাপাথর, কালোসোনার জন্য সেন্টমার্টিন বিখ্যাত আমরা জানি। আমরা জানি সেন্টমার্টিনের উপকূলে অলিভ, গ্রিন ও হকবিলস প্রজাতির কচ্ছপ ডিম পাড়ে। চোরবিজ্ঞানী যারা আছেন তারা নিশ্চয় কালোসোনা ও চুনাপাথরকে কাজে লাগানোর ব্যাপারে উৎসাহী হবেন না,  তারা উৎসাহী হবে অত্যন্ত ব্যাগ্রভাবে কচ্ছপজীবনকে হুমকির মুখে ফেলে দেয়ার জন্য। কারন তারা বিশ্বাস করে চুরি করো নতুবা ডাকাত তোমাদের মেরে ফেলবে।


ডাকাত মনে করে সবকিছু গ্রাস করো নতুবা 'চোর' ডাকাত হয়ে যাবে। চোর-পুলিশ খেলতে খেলতে আমরা বৃহত্তর সমুদ্র সৈকতকে মেঘনা নদীর তীরঘর বানিয়ে ফেলি আর তারা পর্যটন শিল্পকে হাতিয়ার করে অর্থনৈতিক তরলচাকাকে চাঙ্গা করে তুলছে। 

পৃথিবীর সবচেয়ে নিচু দেশ মালদ্বীপের কথাই ধরুন। ১৯৭২ সালে প্রথম রিসোর্ট প্রতিষ্ঠা করে তারা।৩০০ বর্গকিলোমিটারের এই দ্বীপরাষ্ট্রটি কেবল পর্যটন শিল্পকে কেন্দ্র করে বছরে প্রায় ৩২৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের অধিক ইনকাম করে থাকে। আর আমরা? কেউ ভারতপন্থী, কেউ পাকিস্তানপন্থী, কেউ পশ্চিমা জীবনপন্থী, কেউ বউজামাইপন্থী, কেউ নিয়তিপন্থী অন্ধতন্ত্রকে শাস্ত্র মেনে ব্লাক স্কিন হোয়াইট মাস্ক পাঠ করছি, মহাভারতের কথামৃত না যাচ্ছে আমাদের কানে,  না যাচ্ছে আমাদের বোধে, না লাগছে আমাদের মননে--


ন জাতু কামঃ কামানামুপভোগেন শাম্যতি।

হবিষা কৃষ্ণবর্ত্মেব ভূয় এবাভিবধর্তে।।

যৎ পৃথিব্যাং ব্রীহিযবং হিরন্যং পশবঃ স্ত্রিয়ং।

একস্যাপি ন পর্যাপ্তং তস্মাৎ তৃষ্ণাং পরিত্যজেৎ।।


সোনার বাংলা ট্রেনের স্নিগ্ধায় বসে বসে পাওলো কোয়েলহোর দ্যা এ্যালকেমিস্ট পড়ছি। নিজেকে সান্তিয়াগো মনে হচ্ছে।  দ্যা ওল্ড ম্যান এণ্ড সি উপন্যাসেও একজন সান্তিয়াগো ছিলো। তবে সে সাগরের লড়াকু সৈনিক বা সংশপ্তক।  আর এ্যালকেমিস্টের সান্তিয়াগো মরুভূমির স্বপ্নবাজ স্বপ্নধারী তরুন। এই তরুণ  ঘর ত্যাগ করে পৃথিবী দেখবে বলে, এই তরুন মরুভূমির বুকে প্রতান প্রতীম ফাতেমার খোঁজ পায়। ফাতেমা ভালোবাসে। ফাতেমাকে ভালোবাসে সে।


ফাতেমা মরুভূমিকন্যা। ভালোবাসার অনেক উপরে তার হৃদয়বিতান। গাছে যেমন পাখি ঠাঁই পায় তেমনি ফাতেমার হৃদয়ে ঠাঁই পায় ভালোবাসা। তাই ফাতেমা সান্তিয়াগোর স্বপ্নপথে স্পিডব্যাকার হয়ে অবস্থান করেনি। বরং সান্তিয়াগোর স্বপ্নপথকে আরও উৎসাহপ্রোথিত করে তুলেছে।


 এ্যালকেমিস্ট পড়তে পড়তে মরুভূমির প্রেমে পড়লাম। চাঁদনী রাতে মরুভূমি কেমন দেখতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে। সেন্টমার্টিন মেরিনড্রাইভ রাস্তা, চিটাগাং টু কক্সবাজার যাওয়াপথের সর্পিল পথচলন যেমন করে নুনস্বাদের মতো চোখে লেগে রয়েছে তেমনি করে মনের চোখে আটকে আছে মরুভূমি, মরুভূমির চাঁদনী রাত। কিন্তু ট্রেন চলছে।

বাড়ি ফেরার ট্রেন।

আমাকেও ঘরে ফিরতে হয়। ঘরে ফেরার সুখ ঘরত্যাগ সুখের মতোই লাবন্যধারী-- এই বিষয়ে আমার কোন প্রতর্ক নেই -- সময়েরও কোন প্রতর্ক থাকবার কথা নয়!