একটা শব্দ আমরা যখন শুনি, আমাদের অনেকেরই ধারনা শব্দটা বাইরে হচ্ছে। বাইরে হয়তবা শব্দটা হয়। কিন্তু শব্দটা আসলে ভেতরে হয়। আমরা শব্দটা শুনি আমাদের ভেতরে। প্রশ্ন আসতে পারে, শব্দ যদি বাইরে না হয় আমরা ভেতরে শুনি কীভাবে? অনেক শব্দ বাইরে হয় আমরা ভেতরে শুনি না। কারন যে শব্দকম্পনগুলোর সাথে আমাদের অভ্যাস হয়েছে, বায়োলজিক্যাল রিদম সম্পূর্ন হয়েছে, ঐ শব্দগুলো আমরা শুনি। কারন কুকুর যে শব্দগুলো শুনে আমরা সেই শব্দগুলো শুনি না। কিন্তু বাইরে তো কুকুরের শোনা শব্দটা ঠিকই রয়েছে।
আমি একটা খাবার খেয়ে খুব স্বাদ পেলাম। কিন্তু এই আমিই যখন অসুস্থ হয়ে যাই তখন কিন্তু এ খাবারের স্বাদটা আর পাই না।
এর মানে কি?
খাবারের মধ্যে স্বাদ নাই?
অবশ্যই খাবারের মধ্যে স্বাদ আছে। আমার মধ্যে নাই। আমার মধ্যে নাই বিধায় আমি ঐ স্বাদ পাচ্ছি না। ফুল দেখতে খুব সুন্দর। কিন্তু আমার চোখে যখন ব্যাথা থাকে, মাথায় যখন ব্যাথা থাকে, পেইন উঠে তখন কিন্তু ফুলটা আর সুন্দর মনে হয় না।
এর মানে কি?
সৌন্দর্যটা ম্লান হয়ে গেছে?
আসলে এই সৌন্দর্যটা নেয়ার মতো ক্যাপাসিটি আমার নাই। এটাকেই সায়েন্স বলে-- ম্যাকানিজম, ফাংশন ফ্যাক্টর।
দুইটা লোক একসাথে বৃষ্টিজলে ভিজলো। একজন লোক ঠান্ডায় আক্রান্ত হলো আর একজন হবে না। যার ডিফেন্স ম্যাকানিজম ভালো সে ঠান্ডায় আক্রান্ত হবে না। আর যার ডিফেন্স ম্যাকানিজম ভালো না সে ঠান্ডায় আক্রান্ত হয়ে যাবে।
তাহলে বিষয়টি কি বাইরের?
না।
বিষয়টা হলো ভেতরের। এই ভেতরটার দিক বাউল কিংবা সুফি খুব গুরুত্ব সহকারে দেখে। যেমন:
এক সুফি সাধকের কাছে আইসা এক বুড়ি বললেন, "আমার কুয়ার মধ্যে প্রচন্ড দুর্গন্ধ হচ্ছে। কি করতে পারি?"
সাধু বললেন যে আপনার কুয়ার ভেতরে কোন পঁচা থাকলে পঁচাটাকে ফেলে ৪০ বালতি পানি ফেলে দিবেন।
বুড়ি কানে কম শুনতো। সে শুনে নাই যে, ৪০ বালতি পানি ফেলার আগে পঁচাটাকে ফেলে দিতে হবে। বুড়ি ঠিকই ৪০ বালতি পানি ফেলে দিল। কিন্তু ৪০ বালতি পানি ফেলে দিলে কি হবে দুর্গন্ধ তো যাচ্ছে না। আবার সুফি সাধকের কাছে আসে বুড়ি। আইসা বলে, "দু্র্গন্ধ তো দূর হচ্ছে না। কি করতে পারি?"
তুমি কি পঁচাটা তুলেছো?
না।
আগে পঁচাটা তুলো দ্যান ৪০ বালতি পানি ফেল। দেখবে দুর্গন্ধ থাকবে না। বুড়ি গিয়ে পঁচা তুললো, ৪০ বালতি পানি ফেললো। কুয়ার মধ্যে আর দুর্গন্ধ থাকলো না।
এই উদাহরনটা টেনে সুফি সাধকরা বলেন, আমাদের ভেতরে যে পঁচা আছে, এই পঁচা যদি আমরা দূর করতে পারি দ্যান বাইরের সৌন্দর্য আমাদের কাছে ধরা দিবে। কারন, আমাদের চোখের সীমানার নাম আকাশ। We are imperfect media at all. আমরা যত পারফেকশনের দিকে যাব, পৃথিবীর সৌন্দর্য, মহাকালের সৌন্দর্য, আমাদের কাছে তত উত্তম রূপে ধরা দিবে। তাই বাউলরা এই ভেতরটাকে সংশোধন করার দিকে বরাবরই জোড় দিয়েছেন। বাউলদের কাছে এই ভেতর মানেই পৃথিবী।
পৃথিবী কি?
পৃথিবী মানে বাউলদের কাছে, সুফিদের কাছে ৩ টা জিনিস।
১. খাবারের প্রতি বিলাসিতা দূর করা।
২. বিলাসিতার প্রতি লোভ দূর করা।
৩. নারী বা পুরুষের প্রতি লোভ দূর করা।
বাউল কিংবা সুফি দুজনের উদ্দেশ্য এক। ডেস্টিনেশন এক। যে জল বৃষ্টি হয়ে পৃথিবীতে আসলো সেও মহাসাগরের সাথে মিশতে চায়।যে জল ঝরনা হয়ে পৃথিবীতে আসলো সেও মহাসাগরের সাথে মিশতে চায়। তাই বাউল কিংবা সুফির উদ্দেশ্য হলো-- মহাসাগরের সাথে মিশে যাওয়া।
আমি যে তোমার
তুমি যে আমার
আমি যেন দেহ
তুমি আমার আত্মা
লোকে যেন বলে না
তুমি আর আমি ভিন্ন সত্তা
পৃথিবীতে থেকে পৃথিবীকে দেখা যায় না। যেমনভাবে ট্রেনের ভেতর থেকে ট্রেন দেখা যায় না, বিমানের ভেতর থেকেও বিমান দেখা যায় না। ট্রেনের ভেতর থেকে ট্রেন একটি কক্ষ মাত্র, বিমানের ভেতর থেকে বিমান একটা কক্ষ মাত্র। তাই, পৃথিবীকে জয় করার পরই সম্পূর্ন পৃথিবী তার কাছে ধরা দেয়।"মান লাহুল মাওলা ফালা হুল কুল"। সম্পূর্ণরূপে পৃথিবী তার কাছে ধরা দেয়।
পৃথিবীকে জয় করা মানে কি?
পৃথিবীকে জয় করা মানে হল ৩টা দিক।
১. খাবারের প্রতি লোভ দূর করা।
২. বিলাসিতার প্রতি লোভ দূর করা।
৩. শিব বা শিবানীর প্রতি লোভ দূর করা/ নারী বা পুরুষের প্রতি লোভ দূর করা।
বাউলরা বা সুফিরা যখন সাধনায় নামে তখন প্রথমেই খাবারের প্রতি লোভ ইচ্ছাকৃতভাবে আস্তে আস্তে দূর হয়ে যায়। বিলাসিতার প্রতি লোভটা আরও দ্রুত দূর হয়ে যায়। কিন্তু একটা লোভ দূর করা যায় না। এটা হলো নারী বা পুরুষের প্রতি লোভ। এখানে বাউলরা কি করেন? সূফিদের আরেকটা আলাদা পদ্ধতি আছে। বাউলরা গুরু-শিষ্য পরম্পরার মধ্যদিয়ে নদীতে নামেন। যখন নদীতে নামেন একবার, দুইবার, তিনবার জল খেয়ে ফেলে। পানি খেয়ে ফেলে। যখন জল খেয়ে ফেলে? খাওয়ার পর একসময় আর জল খায় না। ভেসে থাকতে পারে। জলের উপর ভেসে থাকতে পারে। যতক্ষন ভেসে থাকা ততক্ষনই জীবন। জলের উপর ভেসে থাকতে পারে। সবাই যে পারে বিষয়টা এমনও না। অনেকেই ডুবে যায়।
এই যে জলের উপর ভেসে থাকতে পারা এটা হলো বাউলদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন সাধনা। কারন শ্বাস নেয়া ও শ্বাস ছাড়ার মধ্যে, প্রশ্বাস এবং নিশ্বাসের মধ্যে একটা ছোট্ট বিরতি আছে। বাউলদের কাজ হলো এই বিরতিটাকে ধীরে-ধীরে, ধীরে-ধীরে, ধীরে-ধীরে বড় করা। নারী-পুরুষ যখন সাধারনত কাছে আসে শ্বাস-প্রশ্বাস আরও ঘন হয়ে আসে। ঘনিষ্ঠ মুহূর্তে গেলে শ্বাস-প্রশ্বাস আরও ঘন হয়ে আসে। বাউলদের কাজ হলো এই শ্বাস-প্রশ্বাসটা ধীরে-ধীরে, ধীরে-ধীরে,ধীরে-ধীরে দীর্ঘতর করা। দীর্ঘতর করার সাধনায় এরা থাকেন।
এখন এ সাধনা করতে গিয়ে একবার, দুইবার, তিনবার জল খেয়ে ফেলে। মানে বীর্যপাত হয়ে যায়। বাউলরা মনে করে বীর্যপাত করা মহাপাপ। জীবন ক্ষয় করা। বীর্য মানে তাদের কাছে জীবন। জমিতে আমরা কখন ফসল ফলাই? জমিতে আমরা তখনই ফসল ফলাই যখন ফসল ফলানোর প্রয়োজন হয়। ফসল ফলানোর প্রয়োজন যখন হয় তখনই আমরা জমিতে বীজ ফেলি। অন্যথায় বীজ ফেলা অপচয়। ঠিক তেমনি বীজ বা বীর্য তখনই শুক্রানু-ডিম্বানু খেলা খেলতে পারে যখন প্রয়োজন হয়। পৃথিবীতে সন্তান আনার প্রয়োজন হয়। সন্তান আনা ব্যতীত বাউলরা বীজ অপচয় করেন না; সংরক্ষন করেন।
বীজ যদি সংরক্ষন করা হয় তাহলে কি হবে? বীজ যেমন পৃথিবীতে এসে সন্তান উৎপাদন করে ঠিক তেমনি দেহের ভেতরে থেকেও বীজ গাছ উৎপাদন করে। সন্তান উৎপাদন করে। সুফিরা এই সন্তানকে বলে ' তিফফুল মানি'। পবিত্র সন্তান। আর বাউলরা এটাকে বলেন সাঁইরূপে নিজেকে দেখা।(গারমু এহছার বার তার ফরম / ফুরুগে তাজ্জালি বুছুজাত ফরম)।
যতই বীজ সংরক্ষন করতে থাকে, নিজের ভেতরে আরেকটা সত্তার জন্ম হতে থাকে। আরেকটা ভাবের জন্ম হতে থাকে। ভাবটা গুরুত্বপূর্ন। বাউলরা যখন গান গায়, এরা সুর গায় না। ভাব গায়। কোনো কোনো জায়গায় এই ভাবটাকে শখ বলে। শখের বাংলা ইচ্ছা হিসেবে আসে। অনেকে শখকে ইচ্ছা হিসেবে বলে। না। শখটা হলো ভাবেরই ভিন্নরূপ। একটা গান আছে এমন
চিংড়ি মাছের ভেতর কাড়া তাই ডালেছি ঘি
আরে নিজের হাতে ভাব ছাড়েছি ভাবলে হবে কি
চালুর চুলা লম্বা কচা কুলি কুলি যায়
দেখি সামের বিবেচনা কার ঘরে সামায়
বলতেছে যে, ভুল করে আমি ভাব ছেড়ে দিয়েছি। বীর্য ছেড়ে দিয়েছি। বীজ ছেড়ে দিয়েছি। এখন তো ভাবলে কিছুই হবে না। সময় চলে গেছে। তাই, এই বীর্য সংরক্ষনের বিষয়টা বাউল সাধনায় খুব তাৎপর্যপূর্ন। যখন বীজ সংরক্ষণ করে ফেলতে পারে, জলে যখন সাঁতার কাটতে পারে
শ্যাম সায়রে নাইতে যাবি
গায়ের বসন ভিজবে ক্যানে
যখন নদীতে জলে সাঁতার কাটতে পারে গায়ের বসন ভিজে না। কাপড় ভিজে না। বীজ অপচয় হয় না। তখন বাউলরা পৃথিবী জয় করে ফেলে। পৃথিবীকে জয় করার মানে হলো সে মহাকালের পথে যাত্রা শুরু করে। মহাকালের পথে যাত্রা শুরু করার মানেই কিন্তু মহাকালে পৌঁছে যাওয়া না। আমি ফ্রান্সের পথে যাত্রা শুরু করলাম, এর মানে এই না আমি ফ্রান্সে পৌঁছে গেলাম। On the way to France.
মহাকালের পথে যাত্রাপথিকের আরেক ধরনের দায়িত্ব। মহাকালের পথে যাত্রা করতে গিয়ে কেউ কেউ ফিরে আসতে পারে, কেউ কেউ আর ফিরে আসতে পারে না।'ফানাফিল্লাহ'। যেটাকে বলে প্রভুতে ফানাহ হয়ে যাওয়া। লীন হয়ে যাওয়া। ফকির। ফা কাফ র ইয়া। ফানা হয়ে যাওয়া। এখান থেকে কেউ কেউ পৃথিবীতে ফিরে এসে পৃথিবীর মানুষকে চিনতে পারে, কেউ কেউ পৃথিবীর মানুষকে আর চিনতে পারে না। মহাকালের পথে যাত্রা করে। মহাকালের পথে যাত্রা শুরু করার ২টি উপায়।
১. সচেতনভাবে।
২.অচেতনভাবে।
অচেতনভাবে যে মহাকালের পথে যাত্রা করে এটার নাম হলো মৃত্যু। আর সচেতনভাবে যে মহাকালের পথে যাত্রা করে এটাকে বলে ফানাফিল্লাহ। নির্বান লাভ।এটাকে বলে আরশীনগরের দেখা পাওয়া। 'বাড়ির পাশে আরশীনগর/ এক পরশী বসত করে'। পড়শির দেখা পাওয়া। আর এমনিতেই-
ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই-- ছোটো সে তরী
আমারি সোনার ধানে গিয়েছে ভরি।
শ্রাবণগগন ঘিরে
ঘন মেঘ ঘুরে ফিরে,
শূন্য নদীর তীরে
রহিনু পড়ি--
যাহা ছিল নিয়ে গেল সোনার তরী।
আমি মহাকালের সাথে মিশে যাই।আর আমার দুনিয়ার অর্জন ফসল হিসাবে পৃথিবীতে পড়ে থাকে। আর যখন সচেতনভাবে যায় কেউ, তখন পৃথিবীকে জয় করে যায়। মায়ের পেটে,মায়ের জঠরে আমরা কোথা থেকে আসলাম আমরা যেমন বলতে পারি না। ঠিক তেমনি পৃথিবীর মা থেকে যখন আমরা চলে যাই আমরাও বলতে পারি না। কিন্তু মহাকালের পথে যখন কেউ জেনে যাত্রা করে, তখন সে বলতে পারে সে কোথায় যাচ্ছে। এবং কোথাও যে যাচ্ছে এটা হলো প্রত্যেকের জ্ঞান অনুযায়ী যাওয়া। প্রত্যেকের ভাব অনুযায়ী যাওয়া। প্রত্যেকের শখ অনুযায়ী যাওয়া। যার ভাব যত প্রগাঢ়, যার ভাবের যত স্পেস বেশি, জায়গা বেশি, তার যাওয়ার জায়গাটা তত বেশি।
তাই বাউলদের প্রথম এবং প্রাথমিক সাধনা হলো পৃথিবী জয় করার সাধনা। পৃথিবী জয় করার সাধনা, জয় করার পরে তারা মহাকালের পথে যাত্রা করে।
হুমায়ূন আহমেদ যে হিমু ক্যারেক্টারটা নির্মান করেছেন,এই হিমু মূলত মহাকালের পথে যাত্রা করা এক পথিক। সে মহাপুরুষ না। মহাপুরুষ হলো ঐ লোক যে মহাকালে লীন হয়ে গেছে। প্রশ্ন আসতে পারে, তার তো কোন সাধন সঙ্গী নাই। তারও সাধন সঙ্গী আছে।রূপা।
রূপা তুমি কোথায়?
আমি ঘরেই আছি।
তুমি বারান্দায় এসে দাঁড়াবা?
রাত ৩টা। গভীর রাত। রূপা জানে হিমু আসবে না। তারপরও সে নীল শাড়ি পড়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকে। কেনো? কারন হলো এই - তাদের, ঐ হিমু এবং রূপার মধ্যে একটা সাধনার পর্যায় ছিল। এই সাধনার পর্যায়টা, যেহেতু এই সমাজ বাউলদের সাধন পর্যায়টা নেয় না শুধু মহাকালের পথে যাত্রাটা নেয়। তাই হুমায়ূন আহমেদ এই সাধন প্রক্রিয়া দেখায়নি। কিন্তু সে বিষয়টা দেখাইলো কি? রূপা হল তার ভাবসঙ্গী। দেহসঙ্গী না। তা, ভাবসঙ্গী কখন হয়? দেহ সঙ্গীর পর।
তাহলে বাউল কিংবা সুফি যারাই মহাকালের পথে লীন হতে চায়, মহাকালে নিজেকে রাখতে চায়, তাদেরকে পৃথিবীটাকে জয় করতে হয়।
পৃথিবীটাকে জয় করার পর মহাকালের পথে আদিম অন্ধকার, আদিম অন্ধকার, আদিম অন্ধকারের দিকে তারা এগিয়ে যায়। থাকে শুধু অন্ধকার, থাকে শুধু অন্ধকার, থাকে শুধু অন্ধকার মুখোমুখি বসিবার 'বনলতা সেন'।
আমি একটা খাবার খেয়ে খুব স্বাদ পেলাম। কিন্তু এই আমিই যখন অসুস্থ হয়ে যাই তখন কিন্তু এ খাবারের স্বাদটা আর পাই না।
এর মানে কি?
খাবারের মধ্যে স্বাদ নাই?
অবশ্যই খাবারের মধ্যে স্বাদ আছে। আমার মধ্যে নাই। আমার মধ্যে নাই বিধায় আমি ঐ স্বাদ পাচ্ছি না। ফুল দেখতে খুব সুন্দর। কিন্তু আমার চোখে যখন ব্যাথা থাকে, মাথায় যখন ব্যাথা থাকে, পেইন উঠে তখন কিন্তু ফুলটা আর সুন্দর মনে হয় না।
এর মানে কি?
সৌন্দর্যটা ম্লান হয়ে গেছে?
আসলে এই সৌন্দর্যটা নেয়ার মতো ক্যাপাসিটি আমার নাই। এটাকেই সায়েন্স বলে-- ম্যাকানিজম, ফাংশন ফ্যাক্টর।
দুইটা লোক একসাথে বৃষ্টিজলে ভিজলো। একজন লোক ঠান্ডায় আক্রান্ত হলো আর একজন হবে না। যার ডিফেন্স ম্যাকানিজম ভালো সে ঠান্ডায় আক্রান্ত হবে না। আর যার ডিফেন্স ম্যাকানিজম ভালো না সে ঠান্ডায় আক্রান্ত হয়ে যাবে।
তাহলে বিষয়টি কি বাইরের?
না।
বিষয়টা হলো ভেতরের। এই ভেতরটার দিক বাউল কিংবা সুফি খুব গুরুত্ব সহকারে দেখে। যেমন:
এক সুফি সাধকের কাছে আইসা এক বুড়ি বললেন, "আমার কুয়ার মধ্যে প্রচন্ড দুর্গন্ধ হচ্ছে। কি করতে পারি?"
সাধু বললেন যে আপনার কুয়ার ভেতরে কোন পঁচা থাকলে পঁচাটাকে ফেলে ৪০ বালতি পানি ফেলে দিবেন।
বুড়ি কানে কম শুনতো। সে শুনে নাই যে, ৪০ বালতি পানি ফেলার আগে পঁচাটাকে ফেলে দিতে হবে। বুড়ি ঠিকই ৪০ বালতি পানি ফেলে দিল। কিন্তু ৪০ বালতি পানি ফেলে দিলে কি হবে দুর্গন্ধ তো যাচ্ছে না। আবার সুফি সাধকের কাছে আসে বুড়ি। আইসা বলে, "দু্র্গন্ধ তো দূর হচ্ছে না। কি করতে পারি?"
তুমি কি পঁচাটা তুলেছো?
না।
আগে পঁচাটা তুলো দ্যান ৪০ বালতি পানি ফেল। দেখবে দুর্গন্ধ থাকবে না। বুড়ি গিয়ে পঁচা তুললো, ৪০ বালতি পানি ফেললো। কুয়ার মধ্যে আর দুর্গন্ধ থাকলো না।
এই উদাহরনটা টেনে সুফি সাধকরা বলেন, আমাদের ভেতরে যে পঁচা আছে, এই পঁচা যদি আমরা দূর করতে পারি দ্যান বাইরের সৌন্দর্য আমাদের কাছে ধরা দিবে। কারন, আমাদের চোখের সীমানার নাম আকাশ। We are imperfect media at all. আমরা যত পারফেকশনের দিকে যাব, পৃথিবীর সৌন্দর্য, মহাকালের সৌন্দর্য, আমাদের কাছে তত উত্তম রূপে ধরা দিবে। তাই বাউলরা এই ভেতরটাকে সংশোধন করার দিকে বরাবরই জোড় দিয়েছেন। বাউলদের কাছে এই ভেতর মানেই পৃথিবী।
পৃথিবী কি?
পৃথিবী মানে বাউলদের কাছে, সুফিদের কাছে ৩ টা জিনিস।
১. খাবারের প্রতি বিলাসিতা দূর করা।
২. বিলাসিতার প্রতি লোভ দূর করা।
৩. নারী বা পুরুষের প্রতি লোভ দূর করা।
বাউল কিংবা সুফি দুজনের উদ্দেশ্য এক। ডেস্টিনেশন এক। যে জল বৃষ্টি হয়ে পৃথিবীতে আসলো সেও মহাসাগরের সাথে মিশতে চায়।যে জল ঝরনা হয়ে পৃথিবীতে আসলো সেও মহাসাগরের সাথে মিশতে চায়। তাই বাউল কিংবা সুফির উদ্দেশ্য হলো-- মহাসাগরের সাথে মিশে যাওয়া।
আমি যে তোমার
তুমি যে আমার
আমি যেন দেহ
তুমি আমার আত্মা
লোকে যেন বলে না
তুমি আর আমি ভিন্ন সত্তা
পৃথিবীতে থেকে পৃথিবীকে দেখা যায় না। যেমনভাবে ট্রেনের ভেতর থেকে ট্রেন দেখা যায় না, বিমানের ভেতর থেকেও বিমান দেখা যায় না। ট্রেনের ভেতর থেকে ট্রেন একটি কক্ষ মাত্র, বিমানের ভেতর থেকে বিমান একটা কক্ষ মাত্র। তাই, পৃথিবীকে জয় করার পরই সম্পূর্ন পৃথিবী তার কাছে ধরা দেয়।"মান লাহুল মাওলা ফালা হুল কুল"। সম্পূর্ণরূপে পৃথিবী তার কাছে ধরা দেয়।
পৃথিবীকে জয় করা মানে কি?
পৃথিবীকে জয় করা মানে হল ৩টা দিক।
১. খাবারের প্রতি লোভ দূর করা।
২. বিলাসিতার প্রতি লোভ দূর করা।
৩. শিব বা শিবানীর প্রতি লোভ দূর করা/ নারী বা পুরুষের প্রতি লোভ দূর করা।
বাউলরা বা সুফিরা যখন সাধনায় নামে তখন প্রথমেই খাবারের প্রতি লোভ ইচ্ছাকৃতভাবে আস্তে আস্তে দূর হয়ে যায়। বিলাসিতার প্রতি লোভটা আরও দ্রুত দূর হয়ে যায়। কিন্তু একটা লোভ দূর করা যায় না। এটা হলো নারী বা পুরুষের প্রতি লোভ। এখানে বাউলরা কি করেন? সূফিদের আরেকটা আলাদা পদ্ধতি আছে। বাউলরা গুরু-শিষ্য পরম্পরার মধ্যদিয়ে নদীতে নামেন। যখন নদীতে নামেন একবার, দুইবার, তিনবার জল খেয়ে ফেলে। পানি খেয়ে ফেলে। যখন জল খেয়ে ফেলে? খাওয়ার পর একসময় আর জল খায় না। ভেসে থাকতে পারে। জলের উপর ভেসে থাকতে পারে। যতক্ষন ভেসে থাকা ততক্ষনই জীবন। জলের উপর ভেসে থাকতে পারে। সবাই যে পারে বিষয়টা এমনও না। অনেকেই ডুবে যায়।
এই যে জলের উপর ভেসে থাকতে পারা এটা হলো বাউলদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন সাধনা। কারন শ্বাস নেয়া ও শ্বাস ছাড়ার মধ্যে, প্রশ্বাস এবং নিশ্বাসের মধ্যে একটা ছোট্ট বিরতি আছে। বাউলদের কাজ হলো এই বিরতিটাকে ধীরে-ধীরে, ধীরে-ধীরে, ধীরে-ধীরে বড় করা। নারী-পুরুষ যখন সাধারনত কাছে আসে শ্বাস-প্রশ্বাস আরও ঘন হয়ে আসে। ঘনিষ্ঠ মুহূর্তে গেলে শ্বাস-প্রশ্বাস আরও ঘন হয়ে আসে। বাউলদের কাজ হলো এই শ্বাস-প্রশ্বাসটা ধীরে-ধীরে, ধীরে-ধীরে,ধীরে-ধীরে দীর্ঘতর করা। দীর্ঘতর করার সাধনায় এরা থাকেন।
এখন এ সাধনা করতে গিয়ে একবার, দুইবার, তিনবার জল খেয়ে ফেলে। মানে বীর্যপাত হয়ে যায়। বাউলরা মনে করে বীর্যপাত করা মহাপাপ। জীবন ক্ষয় করা। বীর্য মানে তাদের কাছে জীবন। জমিতে আমরা কখন ফসল ফলাই? জমিতে আমরা তখনই ফসল ফলাই যখন ফসল ফলানোর প্রয়োজন হয়। ফসল ফলানোর প্রয়োজন যখন হয় তখনই আমরা জমিতে বীজ ফেলি। অন্যথায় বীজ ফেলা অপচয়। ঠিক তেমনি বীজ বা বীর্য তখনই শুক্রানু-ডিম্বানু খেলা খেলতে পারে যখন প্রয়োজন হয়। পৃথিবীতে সন্তান আনার প্রয়োজন হয়। সন্তান আনা ব্যতীত বাউলরা বীজ অপচয় করেন না; সংরক্ষন করেন।
বীজ যদি সংরক্ষন করা হয় তাহলে কি হবে? বীজ যেমন পৃথিবীতে এসে সন্তান উৎপাদন করে ঠিক তেমনি দেহের ভেতরে থেকেও বীজ গাছ উৎপাদন করে। সন্তান উৎপাদন করে। সুফিরা এই সন্তানকে বলে ' তিফফুল মানি'। পবিত্র সন্তান। আর বাউলরা এটাকে বলেন সাঁইরূপে নিজেকে দেখা।(গারমু এহছার বার তার ফরম / ফুরুগে তাজ্জালি বুছুজাত ফরম)।
যতই বীজ সংরক্ষন করতে থাকে, নিজের ভেতরে আরেকটা সত্তার জন্ম হতে থাকে। আরেকটা ভাবের জন্ম হতে থাকে। ভাবটা গুরুত্বপূর্ন। বাউলরা যখন গান গায়, এরা সুর গায় না। ভাব গায়। কোনো কোনো জায়গায় এই ভাবটাকে শখ বলে। শখের বাংলা ইচ্ছা হিসেবে আসে। অনেকে শখকে ইচ্ছা হিসেবে বলে। না। শখটা হলো ভাবেরই ভিন্নরূপ। একটা গান আছে এমন
চিংড়ি মাছের ভেতর কাড়া তাই ডালেছি ঘি
আরে নিজের হাতে ভাব ছাড়েছি ভাবলে হবে কি
চালুর চুলা লম্বা কচা কুলি কুলি যায়
দেখি সামের বিবেচনা কার ঘরে সামায়
বলতেছে যে, ভুল করে আমি ভাব ছেড়ে দিয়েছি। বীর্য ছেড়ে দিয়েছি। বীজ ছেড়ে দিয়েছি। এখন তো ভাবলে কিছুই হবে না। সময় চলে গেছে। তাই, এই বীর্য সংরক্ষনের বিষয়টা বাউল সাধনায় খুব তাৎপর্যপূর্ন। যখন বীজ সংরক্ষণ করে ফেলতে পারে, জলে যখন সাঁতার কাটতে পারে
শ্যাম সায়রে নাইতে যাবি
গায়ের বসন ভিজবে ক্যানে
যখন নদীতে জলে সাঁতার কাটতে পারে গায়ের বসন ভিজে না। কাপড় ভিজে না। বীজ অপচয় হয় না। তখন বাউলরা পৃথিবী জয় করে ফেলে। পৃথিবীকে জয় করার মানে হলো সে মহাকালের পথে যাত্রা শুরু করে। মহাকালের পথে যাত্রা শুরু করার মানেই কিন্তু মহাকালে পৌঁছে যাওয়া না। আমি ফ্রান্সের পথে যাত্রা শুরু করলাম, এর মানে এই না আমি ফ্রান্সে পৌঁছে গেলাম। On the way to France.
মহাকালের পথে যাত্রাপথিকের আরেক ধরনের দায়িত্ব। মহাকালের পথে যাত্রা করতে গিয়ে কেউ কেউ ফিরে আসতে পারে, কেউ কেউ আর ফিরে আসতে পারে না।'ফানাফিল্লাহ'। যেটাকে বলে প্রভুতে ফানাহ হয়ে যাওয়া। লীন হয়ে যাওয়া। ফকির। ফা কাফ র ইয়া। ফানা হয়ে যাওয়া। এখান থেকে কেউ কেউ পৃথিবীতে ফিরে এসে পৃথিবীর মানুষকে চিনতে পারে, কেউ কেউ পৃথিবীর মানুষকে আর চিনতে পারে না। মহাকালের পথে যাত্রা করে। মহাকালের পথে যাত্রা শুরু করার ২টি উপায়।
১. সচেতনভাবে।
২.অচেতনভাবে।
অচেতনভাবে যে মহাকালের পথে যাত্রা করে এটার নাম হলো মৃত্যু। আর সচেতনভাবে যে মহাকালের পথে যাত্রা করে এটাকে বলে ফানাফিল্লাহ। নির্বান লাভ।এটাকে বলে আরশীনগরের দেখা পাওয়া। 'বাড়ির পাশে আরশীনগর/ এক পরশী বসত করে'। পড়শির দেখা পাওয়া। আর এমনিতেই-
ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই-- ছোটো সে তরী
আমারি সোনার ধানে গিয়েছে ভরি।
শ্রাবণগগন ঘিরে
ঘন মেঘ ঘুরে ফিরে,
শূন্য নদীর তীরে
রহিনু পড়ি--
যাহা ছিল নিয়ে গেল সোনার তরী।
আমি মহাকালের সাথে মিশে যাই।আর আমার দুনিয়ার অর্জন ফসল হিসাবে পৃথিবীতে পড়ে থাকে। আর যখন সচেতনভাবে যায় কেউ, তখন পৃথিবীকে জয় করে যায়। মায়ের পেটে,মায়ের জঠরে আমরা কোথা থেকে আসলাম আমরা যেমন বলতে পারি না। ঠিক তেমনি পৃথিবীর মা থেকে যখন আমরা চলে যাই আমরাও বলতে পারি না। কিন্তু মহাকালের পথে যখন কেউ জেনে যাত্রা করে, তখন সে বলতে পারে সে কোথায় যাচ্ছে। এবং কোথাও যে যাচ্ছে এটা হলো প্রত্যেকের জ্ঞান অনুযায়ী যাওয়া। প্রত্যেকের ভাব অনুযায়ী যাওয়া। প্রত্যেকের শখ অনুযায়ী যাওয়া। যার ভাব যত প্রগাঢ়, যার ভাবের যত স্পেস বেশি, জায়গা বেশি, তার যাওয়ার জায়গাটা তত বেশি।
তাই বাউলদের প্রথম এবং প্রাথমিক সাধনা হলো পৃথিবী জয় করার সাধনা। পৃথিবী জয় করার সাধনা, জয় করার পরে তারা মহাকালের পথে যাত্রা করে।
হুমায়ূন আহমেদ যে হিমু ক্যারেক্টারটা নির্মান করেছেন,এই হিমু মূলত মহাকালের পথে যাত্রা করা এক পথিক। সে মহাপুরুষ না। মহাপুরুষ হলো ঐ লোক যে মহাকালে লীন হয়ে গেছে। প্রশ্ন আসতে পারে, তার তো কোন সাধন সঙ্গী নাই। তারও সাধন সঙ্গী আছে।রূপা।
রূপা তুমি কোথায়?
আমি ঘরেই আছি।
তুমি বারান্দায় এসে দাঁড়াবা?
রাত ৩টা। গভীর রাত। রূপা জানে হিমু আসবে না। তারপরও সে নীল শাড়ি পড়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকে। কেনো? কারন হলো এই - তাদের, ঐ হিমু এবং রূপার মধ্যে একটা সাধনার পর্যায় ছিল। এই সাধনার পর্যায়টা, যেহেতু এই সমাজ বাউলদের সাধন পর্যায়টা নেয় না শুধু মহাকালের পথে যাত্রাটা নেয়। তাই হুমায়ূন আহমেদ এই সাধন প্রক্রিয়া দেখায়নি। কিন্তু সে বিষয়টা দেখাইলো কি? রূপা হল তার ভাবসঙ্গী। দেহসঙ্গী না। তা, ভাবসঙ্গী কখন হয়? দেহ সঙ্গীর পর।
তাহলে বাউল কিংবা সুফি যারাই মহাকালের পথে লীন হতে চায়, মহাকালে নিজেকে রাখতে চায়, তাদেরকে পৃথিবীটাকে জয় করতে হয়।
পৃথিবীটাকে জয় করার পর মহাকালের পথে আদিম অন্ধকার, আদিম অন্ধকার, আদিম অন্ধকারের দিকে তারা এগিয়ে যায়। থাকে শুধু অন্ধকার, থাকে শুধু অন্ধকার, থাকে শুধু অন্ধকার মুখোমুখি বসিবার 'বনলতা সেন'।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন