শুক্রবার, ১২ জুলাই, ২০২৪

ভাষার আকাশে উড়ছে পাখি

 বুরাকালে কনে ন হয় সতী 

পোয়াকালে কনে ন খায় লতি 


এটি চট্রগ্রামের একটি আঞ্চলিক প্রবাদ— বুরাকাল এবং পোয়াকাল দুটি সময়বিন্দু— এই সময়বিন্দু দুটি অনেকটা স্টেশনের মতো কাজ করে।


তাস দাবা পাশা— তিনটি সর্বনাশা। পোয়াবারো শব্দটির সাথে পাশা খেলার মানসিক সম্পর্ক আছে— লুডো খেলার ছক্কার মতো পাশাতেও আছে তিনটি গুটি। গুটিগুলো যখন চালা হয় সেটাকে বলা হয় দান। প্রতি দানে পাশা খেলায় তিনটি গুটি একসঙ্গে ফেলা হয়— প্রত্যেকটি গুটিতে ১,২,৫,৬ নাম্বার থাকে।  ছক্কা পড়লে গুটি বের হয় ঘর থেকে লুডো খেলাতে— পাশা খেলায় তিনটি গুটি মিলে ৯ উঠলো তো খেলা শুরু। পাশা খেলায় একের পোশাকি নাম পোয়া— সবচেয়ে বড় দান পোয়াবারো— ৬+৬+১=১৩— এটি সবচেয়ে দামি দান এবং দুর্লভও বটে। পোয়াবারো পাশা খেলায় সৌভাগ্যের দান হিসাবে মান্য করা হতো এবং হয়।


এখনো অনেক সম্প্রদায়ের কাছে ১৩ সংখ্যাটি সংকট সংকেত সংখ্যা হিসাবে ঘৃণা করা হয় এবং পরিহার করতে পারলে যেনো ভালো হয় এমন একটা ভাবনোটিশ দেখা যায়। তবে সমগ্র ভারতবর্ষের কাছে ১৩ সংখ্যাটি মোটেও অশুভ নয় বরং বিপুল সৌভাগ্যের প্রতীক হিসাবে ধরা হয়।


সুতরাং পোয়াকাল মানে সৌভাগ্যের কাল— আবার পোয়াতি মানে গর্ভবতী— পোয়াকাল মানে গর্ভকালীন সময়।


ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অনেক জায়গায় পোয়াকাল মানে গর্ভকালীন সময়কে বুঝিয়ে থাকে। চট্রগ্রামে পো মানে পুত্র— পোয়ার সংক্ষিপ্ত রূপ। পোয়া মাছ মানে কিন্তু পুত্র মাছ না। পোয়া মাছ ইজ পোয়া মাছ— পোয়া মাছ( pama pama) বাংলাদেশের স্বাদু পানির মাছ— অনেকে এটিকে পামা,কই ভোলা বা পোয়া বলে ডাকে— পোয়া মাছে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি এসিড, ভিটামিন এ এবং ভিটামিন ডি থাকে— পোয়া মাছের ওমেগা-৩ নামক ফ্যাটি এসিড হৃদযন্ত্রের জন্য উপকারী— কোলেস্টরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে—হৃদরোগে আক্রান্ত ও ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য এ মাছ খুবই উপকারী।


বড়,বড়ো= অভিজাত, বিশাল। আবার বড়ো মানে  খারাপ। বড়োকে চট্রগ্রাম বিভাগের মানুষ বলে বুরা।  বুরা মানে জীবন ও মৃত্যুর মাঝখানে অবস্থান করছেন এমন কর্মক্ষম অথবা কর্ম অক্ষম মানুষ— বুরার স্ত্রীলিঙ্গ বুরি/বুড়ি অথবা বুন্নি। বুরাবুন্নি খুবই জনপ্রিয় শব্দ—


বুড়ি হইলাম তোর কারণে

পরানের বান্ধব রে

বুড়ি হইলাম তোর কারণে

পরানের বান্ধব রে

বুড়ি হইলাম তোর কারণে


বুরা শব্দটি কিশোরগঞ্জ নরসিংদী ব্রাহ্মণবাড়িয়া অঞ্চলে ভালোর বিপরীত শব্দার্থে ব্যবহার হয়ে থাকে। ভালোকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া অঞ্চলের মানুষ বলে 'বালা'।  


না হাইয়্যা যাইস না

বালা বুরা যা আছে তা দিয়া হাইয়্যা যাইস।


অভিধানে বালা অর্থ যুবতী= বাল+আ। বালা সংস্কৃত শব্দ। হিন্দিতে বাল, বাংলায় চুল। আ+বাল= আবাল। আবালবৃদ্ধবনিতা খুবই কানপ্রিয় মুখপ্রিয় শব্দ। আবাল সাধিত শব্দ— যার এখনো ভালো করে চুল গজায়নি এমন— পজিটিভ অর্থে আবাল মানে এমন বালক যার এখনো সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা জন্মায়নি— তুচ্ছতাচ্ছিল্য অর্থেও আবাল শব্দটি বাংলায় ব্যবহার হয়ে থাকে যেখানে আবাল মানে ইঁচড়েপাকার চেয়েও ভয়ঙ্কর। ইচড়েপাকাকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া অঞ্চলের মানুষ বলে বাল ফাকনা। হাতের বালা মানে একপ্রকার অলঙ্কার যা বালারা বা কন্যারা হাতে পরিধান করে থাকে সাধারণত।


আমি ত বালা না 

বালা লইয়া থাইক ক।


এখানে কিন্তু গীতিকার মাহবুব শাহ বলে নাই— হে সুন্দরী আমি কিন্তু তোমার হাতের অলঙ্কার না— তুমি অলঙ্কার নিয়ে থেকো। এখানে গীতিকার অভিমানের অভিযোগ দিয়েছেন যে আমি খারাপ বা বুরা, সুতরাং তুমি ভালো নিয়ে থাকো। 


আরেকটি কথা,লতি যা ব্রাহ্মণবাড়িয়া অঞ্চলে বলে লতা, কচুর লতা খুবই ভালো খাবার— হাড় শক্ত করে— চুলপড়া রোধ করে— কুচুর লতিতে ডায়াটারি ফাইবার বা আঁশের পরিমান খুব বেশি— যা খাবার হজমে সাহায্য করে কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। কচুর লতিতে প্রচুর পরিমানে ভিটামিন সি আছে— যা সংক্রামক রোগের আক্রমন থেকে রক্ষা করে। 


কচুকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কিশোরগঞ্জ ময়মনসিংহ অঞ্চলের মানুষ এবং নরসিংদীর কিছু অংশে 'কুছু' বলে। কুছু আবার অল্প অর্থেও নিকট অর্থে ক্ষুদ্র অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। 


টেনশন করিস না— হে তোর কুছুও ছিরতে পারবো না।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন