শনিবার, ২৪ জুলাই, ২০২১

আতকা পর্যটক

 ক


হঠাৎকে আমাদের এলাকায় বলে আতকা। আতকা ফকির আমাদের এলাকায় প্রচুর রয়েছে। আমরা আতকা ফকির না— আতকা পর্যটক। আতকা ঘর থেকে বের হয়ে যাই চোখকে পাঞ্জেরি মেনে।মান্যবর চোখ আমাদের নিয়ে যেতে থাকে গ্রাম থেকে গ্রামে শহর থেকে শহরে। 


জলসাতে আড্ডা দিচ্ছিলাম। সাইদুর আঙ্কেল, আমিনুল ইসলাম ভাই, নবী হোসেন ভাই, সৈকত আর আমি। আতকা পর্যটক হয়ে উঠার ইচ্ছা জাগে। ড্রাইভার বাবুকে পেয়ে গেলাম। চলো নাছিরনগর থেকে ঘুরে আসি।বাবু নিমিষেই রাজি। আমার জানামতে আড়াইসিধা থেকে নাছিরনগর রিক্সাভ্রমন কেউ করে নাই।আমরা প্রথম ইতিহাস নির্মান করলাম।ভবিষ্যতে আরও কেউ করতে পারে। 


সরাইল কুট্টাপাড়ার মোড় থেকে নাছিরনগর আসাযাওয়ার রাস্তাটি অসাধারণ। আমাদের এলাকার মানুষ এই রাস্তাটিকে মিনি কক্সবাজার বলে। দুইপাশে জলের সারি। মাঝখানে রাস্তাটি।এই রাস্তাটি দেখার জন্যে হাজার হাজার মানুষের ঢল নামে এই বর্ষাকালে।  এই বর্ষাকালে মানুষের ঢল নেই।কারন করোনাকাল। তাছাড়া এই বছর ভালো মানের বর্ষা হয়নি। জল আটকে আছে উন্নয়নের জোয়ারে। 


বাবুর রিক্সা চলছে তো চলছে। সরাইল যখন আমাদের শখের বাহন তখন বৃষ্টি আসে আসে করে।আসে আসে করেও থেকে গেলো আসমানের বাতাসে। মিনি কক্সবাজারের রাস্তাটিতে সাক্ষাৎ পেলাম মলফত নামে এক শতবর্ষী চাচার। তিনি বিট্রিশ সময়, পাকিস্তান সময়,বাংলাদেশ সময় পেয়েছেন। চাচার মতে আওয়ামিলীগ সরকার দেশের বহুত উন্নয়ন করেছেন। 


কুন্ডা বিরিবাদ রাস্তাটি দিয়ে যখন আমরা চৈয়ারকুড়ি বাজারে যাওয়ার জন্যে রওয়ানা দিলাম তখন আসমানের বৃষ্টি পৃথিবীতে নেমে আসে। দারুন উপভোগ্য। একপাশে কচুরিপানা সবুজ আরেকপাশে লোকালয়। বৃষ্টি পড়ছে আমাদের মাথার উপরে।  জলে ভিজে যাচ্ছে আমাদের কায়াতনুদেহ। 


গোকর্ন সঠিক মাপের গ্রাম। বৃষ্টি পড়ছে এমন সময় নাকে আসছে পাটকাঠির অরিজিনাল গন্ধ। এক চাচি মাথায় পাটকাঠি নিয়ে বাড়ি ফিরছে। চাচির বয়স অল্প করে হলেও ষাট হবে। ষাট বছর বয়সে শহরের মানুষ নিয়ম করে ডাক্তারের কাছে হাজিরা দিয়ে থাকেন— পানের মতো ঔষধ চিবান নিয়ম করে। আর এখানে?  মানে এই গোকর্ন গ্রামে নিয়ম করে পরিশ্রম করে পারিবারিক উন্নয়নের স্বার্থে। এই গ্রামে ঔষধের নিয়মিত গ্রাহক নাই এমন কথা কেউ বলতে পারবে না। এই গ্রামেও শহুরে মানুষ রয়েছে যযথার্থ হারে।নগর পুড়িলে দেবালয় বাদ থাকে না। 


বসে আছি চৈয়ারকুড়ি বাজারে। মাছ বাজারে। লোকজনের কন্ঠে হাওড়ের টান। পাশেই হাওড়। বিশাল জলরাশি। স্যাতস্যাতে গরম। বাতাস নেই। চমৎকার রায়হান ভাইয়ের চায়ের দোকান। রায়হান ভাইয়ের বয়স পঞ্চাশ।  দোকানের সুন্দর জানালা।  জানালা দিয়ে দেখছি হাওড়ের জলরাশি।  বর্ষা শক্তিশালী হলে রায়হান ভাইয়ের দোকানের নিচে জলের ধারা চলে আসার কথা। কিন্তু আসেনি। বর্ষা তেতত্রিশ বছর কথা রাখলেও এই বছর কথা রাখেনি।  


রায়হান ভাইয়ের দোকানে এসে জানালার পাশে বসে ইচ্ছা হলো পান খাওয়ার। পান খেলাম।মিষ্টি জর্দা দিয়ে। মশিউর রহমান সৈকতেও খেলো। সৈকতের বুকে যেনো পান লেগে গেলো। মামা, পান তো আমার বুকে লেগে গেছে, পানি খাই? না। অপেক্ষা করো চলে যাবে। কিন্তু সৈকত অপেক্ষা করতে রাজি না। সৈকত রায়হান ভাইয়ের কাছে সমাধান জানতে চায়।রায়হান ভাই জানায় তার পান খাওয়ার অভিজ্ঞতা নাই। এক ষাটোর্ধ চাচা আসেন। সৈকত তার কাছে সমাধান জানতে চায়। চাচাও সৈকতকে পানি খাওয়ার কথা বলে।  আমি তখনো পানি খাওয়ার জন্যে 'না' করছি। কিন্তু চাচা বলছে পানি খাওয়ার জন্যে। সৈকত পড়লো সংশয়ের জটিলতায়। চাচা বলছে জোড় দিয়ে " মিয়া ফানি খাও, ফানের বান বড় বান,ফানের বানে অনেক মানুষ মারা যায়।" চৈয়ারকুড়ির মানুষ পানরে ফান বলে,পানিরে বলে ফানি। 


সৈকত চাচার কথা শুনে বড় আকারে ভয় পেয়ে যায়। অবশেষে সে পানি খায়। তার বুকের বানও চলে যায়। তবে চাচার কথা শুনে বুঝতে পারি হাওড় এলাকার মানুষ ভয় দেখাতে পছন্দ করে এবং তারা খুব শক্ত করে ভয় দেখায়।  


বৃষ্টি পড়ছে। হয়তো বৃষ্টিকে মাথায় নিয়ে আমরা বাড়ির দিকে যাত্রা করবো। পথে ডাকাত আক্রমন করতে পারে। মাছ বাজারের আওয়াজের মতো আমাদের মনে হয়তো দেখা দিবে অস্থিরতা। কিন্তু আমি জানি অস্থিরতা আমাদের মনে অভিনয় করে প্রতিনিয়ত। আমরা তার বাধ্যগত প্রতিনিধি না হলেই হলো। যা চলছে তা চলবে, যা থেকে গেছে তাই থেমে থাকে— দেশের অবস্থা যেনো মনের অবস্থা না হয় সেই প্রার্থনায় চলছি পৃথিবীর পথে পথে।



প্রচন্ডভাবে বজ্রপাত বৃষ্টিপাত শুরু হয়েছে। আকাশ এখনই ভেঙে পড়বে ভাবটা এমন। রায়হান ভাইয়ের ছোট্ট দোকানে আশ্রয় নিয়েছি আমরা কজন। ইতিমধ্যে শরীফ,হুমায়ুন আমাদের দলে যুক্ত হয়েছে। হুমায়ুন কোনো রাজ্যের মালিক না— ফার্নিচার দোকানের মালিক। হাওড়ের বজ্রপাত হাওড়ের মানুষের মতো শক্তিশালী— একটানা ক্রিয়াকর্ম কন্টিনিও করতে পারে।কখন বজ্রপাত বৃষ্টিপাত থামবে তা অনুমান করা যাচ্ছে না। 


সৈকতকে বাড়ি ফিরতেই হবে। বাড়ি ফেরার ব্যাপারে আমার আপাততঃ ইচ্ছা বা অনিচ্ছা বলে কিছু নেই। বৃষ্টিপাত হালকা থামতেই সৈকতের তাড়াহুড়ো। আমিও চুপচাপ, তার ইচ্ছাকে অনুসরন করলাম। 


চলছে বাবুর বাহন। আকাশে বিদ্যুৎ চমক পুরোদমে বিদ্যমান। যেকোনো সময় আমাদের উপর বজ্রপাত পড়তে পারে। আমরা হয়ে যেতে পারি ইটারনাল থিউরি। তারপরও আই এম কোল। ধুরন্তির রাস্তা বরাবর চলছে আমাদের দুরন্ত রিক্সা।  ডাকাত যেকোনো সময় এসে আমাদেরকে হালকা করার বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহন করতে পারে। গাছপালা বাড়িঘর কিচ্ছু নাই। পুলিশের টহলও নাই। সিভিলে থাকতে পারে। কারন বিপদজনক এলাকার প্রায় সবটা সময় একটা শাদা গাড়ি আমাদেরকে নজরবন্ধ রেখেছে। 


কালিগুচ্ছের কাছাকাছি এসে বাবুর বাহনের চার্জ শেষ। লক্কর ঝক্কর করে চলছে বাহন। কয়েকটি ছেলে দাড়ানো। এমন ছোট্ট উঠতি ছেলেরাই এখন ছিনতাই ডাকাতি করে।প্রফেশনাল ডাকাতদের সংখ্যা কমে আসছে। আশেপাশে নীরব। আমাদের বাহনের কাছাকাছি এসে গেছে প্রায় তারা। রিক্সা থেমে গ্যাছে। তারা হয়তো মনে করেছে তাদের দেখে রিক্সা থেমে গেছে। বাস্তবতা ভিন্ন। চার্জ নেই তাই থেমে যাচ্ছে চলছে বারবার বাবুর বাহন। 


কোথাও যাবা তোমরা? 

না ভাই, রিক্সা পেলে আইতে কইয়েন। 


এখন কী করা যায়? শফিকুল হক নামে একজন রিক্সা ড্রাইভারের সন্ধান পাওয়া গেলো। সে আমাদেরকে একটি গ্যারেজে কাছে নিয়ে গেলো। গ্যারেজের মালিক হৃদয়। এ গ্যারেজে বাবুর বাহন প্রায় এক ঘন্টা খাওয়া দাওয়া করে। এবার আশুগঞ্জের দিকে যাত্রা করি আমরা। এখনো বিপদ।কারন বাবুর বাহনের পেছনে হেডলাইট নাই। বিশাল দৈত্য বাস যেকোনো সময় ধাক্কা দিয়ে নিজের শক্তি পরীক্ষা করতে পারে।  


বাবুর বাহন চার্জে দেয়া মাত্র বিদ্যুৎ চলে গেলো। যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই রাত হয়। সৈকতের অস্থিরতা আরও বেড়ে গেলো। 


চৈয়ারকুড়ি থাকতেই তরে বলছি চার্জ দেয়া লাগবে কিনা।

তর মুখ দিয়া তখন কোনো কথা বের হই না। 

আজগা থেকে তর রিক্সা বাওয়া শেষ। 


বাবু চুপ। বাবুর কোনো কথা নাই। জসীম ভাই চলে এসেছেন আমাদেরকে হেল্প করার জন্যে। জসীম ভাই ইসলামি ফাউন্ডেশনে চাকরি করেন, ঢাকা কাদরিয়ার ছাত্র। তিনি বারবার বলছেন তার বাসাতে থেকে যাওয়ার জন্যে। বাবুর কাছে থাকা নাথাকা নিয়ে মতামত জানতে চাই।বাবুর মতে গভীর রাত হলেও সে বাড়ি চলে যাবে। বিদ্যুৎ আসা যাওয়া করতেছে। রাত বাড়তেছে। সৈকতের টেনশন বাড়ছে। 


সৈকতের টেনশন উপটেনশন দেখে বললাল সিদ্ধান্ত নেয়ার ব্যাপারে এবার দায়িত্ব কী আমার উপরে দিতে পারো?  সৈকত বিদ্যুৎ বেগে রাজি হয়ে যায়। বিদ্যুৎও চলে আসে। 


এবার সবকিছু ঠিকঠাক। বাবুর বাহন আড়াইসিধা ঢুকার পর চার্জ শেষ আবার। এবার নো টেনশন। লক্কর লক্কর করতে করতে বাড়ি চলে আসি আমরা। বাবুকে বাড়িতে রেখে নিশ্চয়ই আমরা এখন গোসলে মনোযোগী হবো। পরবর্তীতে রিক্সা নিয়ে প্রায় সত্তর আশি কিলোমিটার যাত্রাভ্রমনে বের হলে রিক্সার চার্জ সম্পর্কে সচেতন হবো।গ্রামের প্রবাদের কাছে আবারো মুরিদ হলাম— আছার না খেলে কাছার চিনে না।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন