মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০১৯

আমার মতো যেদিন পৃথিবী হবে

ছোটকাল থেকে আমার একটা বিশেষ রোগ আছে। আর তাহলো সাজানো রোগ। আমার চারপাশটাকে সব সময় সাজিয়ে রাখতে চাই। সাজানো যেকোনো কিছু  আমার ভালো লাগে খুব করে।

যেদিন থেকে পড়ার টেবিল বলে কিছু একটা আছে সেইদিন থেকে আমার টেবিলে অন্য কারো হাত দেয়া বারন। একটা পোকাও যদি আমার টেবিলের উপর দিয়ে হেঁটে যেতো কোনো প্রকার সিসি ক্যামেরা ছাড়াই আমি টের পেতাম। টেবিলে হাত দেয়া বারন কারন অন্য কেউ হাত দেয়া মানে অগোছালো করে ফেলা। আমি দেখেছি আমি ব্যবহারিক জিনিস সম্পর্কে যত যত্নবান তত যত্নবান মানুষ আজও আমার চোখে পড়েনি।

অনেকে নিজের জিনিসটা খুব যত্ন করে রাখে কিন্তু অন্যের জিনিসের প্রতি উদাসীন। আমি নিজের জিনিসের চেয়ে অন্যের জিনিসের প্রতি অধিক যত্নবান। হ্যাঁ। দায়িত্ব নিয়ে বলছি।

আমরা যদি আমাদের চারপাশটা সুন্দর পরিচ্ছন্ন মার্জিত করে রাখি তাহলে কী খুব অর্থের প্রয়োজন!?

অবশ্যই না।

জাস্ট ইচ্ছার প্রয়োজন।

বাড়িতে আমাদের ঘরের সামনে যে ফুলের বাগান আছে তা আমার চেষ্টায় করা। ফুলের বাগান করার পর দেখা গেল বাড়ির লুকই দৃ‌ষ্টিনন্দনের ডাক খায়। পেয়ারা গাছের চারপাশ সিমেন্টের প্রলেপ দিয়ে ঘের দেয়ার পর পেয়ারা গাছের পরিবেশ অন্যরকম সৌন্দর্যের হাতছানি দিয়ে ডাকতে থাকে। এই কাজগুলো করেছিলাম ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার আগে। কাজগুলো করতে আমার অনেক টাকা খরচ হয়নি। জাস্ট ইচ্ছা করেছিলাম। লালপুর বাজার থেকে কয়েকটি ফুলের চারা কিনে আনছিলাম। ইট বাড়িতেই ছিল। এক বিকালে কয়েক ঘন্টার জন্য এক ইটমিস্ত্রিকে ডেকে আনি এবং কাজ শেষে তার হাতে তিনশত টাকা তুলে দেই। বেস-- হয়ে গেলো।

তারপর হাসনাহেনা ফুল কিনে আনি। যেহেতু রাস্তার পাশেই আমাদের বাড়ি সেহেতু জোছনা রাতে হাসনাহেনা যখন গন্ধ ছাড়ে প্রায় মানুষ কিছুক্ষনের জন্যে হলেও একটু দাঁড়ায়। তাতেই পথিকের আনন্দ, আমারও আনন্দ।

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এক রুমে আটজন থাকতাম। আটজন এক রুমে রিফিউজিরাও থাকে না। একটা গোয়াল ঘরেও গরু হিসাব মাফিক রাখা হয়। আটজন কেমন করে এক রুমে থাকতাম তা ভাবতে গেলে ঘৃনায় লজ্জায় মাথা নত হয়ে আসে। কাছের ছোট ভাই বড় ভাই সারা বাংলাদেশেই আমার আছে। কাছের মানে খুব কাছের। তারা রাতে আমার সাথে থাকতে চায়তো মাঝেমধ্যে কিন্তু তাদেরকে আমি রাখতে পারতাম না। সরকারি হাসপাতালের বেডের চেয়েও ছোট বেডে দুইজন থাকতাম, দুজন করে চারটি বেডে আটজন। নিজেদের কার্বনডাইঅক্সাইডে যখন রাত বাড়ার সাথে সাথে রুম ভার হয়ে আসে তখন অতিথিদের এনে কষ্ট দেয়ার চিন্তা কবিরা গুনার শামিল। কবিরা গুনা মানে বড় অপরাধ।

একবার মনে আছে গভীর রাতে আমার সেনাবাহিনী ভাই ফোন দেন। রাতে আমার সাথে থাকতে চান। আমি ভাইকে না করতে পারিনি, আবার আমার রুমেও নিতে পারিনি। সোহেলের সাথে ভাইকে রাতে থাকার ব্যবস্থা করে দেই। সোহেল এখন বাংলাদেশ পুলিশে আছে। কেউ যখন আমার সাথে থাকতে চায়তো আমি যখন না করতে পারতাম না তখনই আমি সোহেলকে ফোন দিতাম। সোহেল খুব ভালো অবস্থায় থাকতো এমন না। আমার অবস্থা দেখে আমার মানুষেরা কষ্ট পাক তা আমি চাইতাম না। সোহেল থাকত সূর্যসেন হলে আর আমি থাকতাম••••। যাক আমার হলের নামটা নাইবা বললাম।

যেহেতু ঢাকা মেডিকেলের পাশেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেহেতু প্রায় পরিচিত মানুষ একটা রাত থাকার জন্যে ফোন দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের। তাছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের খুব বড় মানের বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে সমাদৃত। ফলে এখানে যখন কেউ পড়তে আসে তার প্রতি স্বাভাবিকভাবে অন্যদের নিডসাম ডিমান্ড অধিক থাকে। তারপরও  হলজীবনে রুমে আমি কোনো গেস্ট আনিনি। আমার কাছের কয়েকজন আমার রুমে ছিল কিন্তু তখন রুম একেবারে ফাঁকা ছিল। অর্থাৎ কোনো ছুটিতে সবাই যখন বাড়ি যায় বা রুমের সদস্য সংখ্যা যখন কোনো কারনে দুইতিন জন থাকতো আমি রুমে কয়েকজনকে এনেছি বিচ্ছিন্নভাবে। তবে তা খুবই নগন্য ঘটনা। আমি যাদের সাথে বেড শেয়ার করতাম তাদের প্রায় গেস্ট আসতো।

একদিন রাতে চাঁদপুরের এক গেস্ট আমার সাথে থাকে। আমি তাকে চিনি না। বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে অনেক রাতে হলে ফিরতাম। আমি ওয়াশরুমে গেলে আমার সাথে একজনের প্রায় দেখা হতো। তিনি হলেন ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি সোহাগ ভাই। ভাই আমাকে দেখে একটা হাসি দিতেন, আমিও হাসি দিতাম। সোহাগ ভাই ফ্রেশওয়াশ দিয়ে মুখ পরিষ্কার করতেন। ভাইয়ের দেখাদেখি আমিও একটা ফ্রেশওয়াশ কিনে আনি। একদিন ব্যবহার করেছিলাম। তারপর আর ব্যবহার করা হয়নি। ফ্রেশওয়াশ দিয়ে মুখে ঢলাঢলি খুবই ক্লান্তিকর ব্যাপার।

বলছিলাম অনেক রাতে হলে ফিরে দেখি একজন অপরিচিত ছেলে বেডে শুয়ে আছে। বুঝতে পারি গেস্ট। অনেক অস্বস্তি থাকার পরও আস্তে করে শুয়ে পড়ি। শুয়ার কিছুক্ষনের মধ্যে লাফ দিয়ে বিছানা থেকে উঠে বসি। না না। কোনো বাজে স্বপ্ন দেখার ব্যাপার স্যাপার না। আমার মুখ ভরে গ্যাছে ছেফে। ছেফে মানে থুথুতে। আমার পাশে ঘুমানো অতিথি কাকে যেন স্বপ্নে গালি দিচ্ছে আর ছেফ দিচ্ছে। স্বপ্নের সেই ভাগ্যবান লোক কে আমি জানি না কিন্তু বাস্তবের ভাগ্যহত লোকটি আমি। তাড়াতাড়ি ওয়াশরুমে যাই এবং স্নান করি। তারপর সেই রাতে আর ঘুমাইনি। মলচত্ত্বরে হাঁটতে হাঁটতে সকাল করে ফেলি।

হলজীবনে আমরা যে রুমে থাকি তা পরিষ্কার করার জন্য প্রতিদিন সকালে একজন আসেন। তিনি কোনোরহমে নিজের উপর অর্পিত দায়িত্বখানা পালন করে যান। যে ময়লা বসবাস করে রুমে আল্লার রহমতে সেই ময়লাই থেকে যায়। তাছাড়া রুমসদস্য বাইরে থেকে এসেই বিছানায় শরীর লেলিয়ে দেন। পায়ের ময়লা পায়ের জায়গায় থাকে না-- বিছানায় যায়। প্রথম প্রথম খুব ঘেন্না লাগতো। আস্তে আস্তে আমিও তাদের মতো মানে বিশ্ববিদ্যালয়ের হল জীবনমতো হয়ে উঠি। ডাস্টবিন সামথিংকে ডাস্টবিন হুলথিং ভাবতে শিখি।

আমার এক প্রিয় ভাইয়ের রুমে আমি প্রায় থাকতাম। ভাইয়ের রুম ঢাকা শহর থেকে একটু দূরে। ভাই আমাকে প্রায় গালি দিতেন। গালি দেয়ার কারন পরিচ্ছন্নতা বিষয়ক। ভাইয়ের গালি শুনে আমি মনে মনে হাসতাম। গামছা বাথরুমে রেখেই বের হয়ে যেতাম। ভাই এ জন্যে গালি দিতেন। বাথরুম শেষে এক বালতি পানি ঢালার জন্যে বলতেন, আমি তা করতাম না, ভাই এ জন্যে গালি দিতেন। ভাইয়ের গালি শুনে আমি মনে মনে হাসতাম। কারন তিনি যে পরিচ্ছন্নতার কথা বলতেন তা অনেকটা ডাস্টবিনে পারফিউম দেয়ার মতো। তাই আমি ভাইয়ের পরিচ্ছন্নতার জ্ঞান দেখে ভেতরে ভেতরে হাসতাম।

পরিচ্ছন্নজ্ঞান আর রুচিবোধের চমৎকার এক জায়গা আবিষ্কার করেছিলাম সাবিতা আপার বাসায়। সাবিতা আপা আমাদের চীনাগ্রুপকে তাঁর বাসায় নেমন্তন্ন দেন। আমরাও যাই। গিয়ে অবাক হয়ে যাই। কত সুন্দর করে সাজালেন তিনি তাঁর চারপাশ! আপা সুফিয়া কামাল হলের প্রভোস্ট। আপা যেমন করে তাঁর ফ্লাট সাজাতে পেরেছেন তেমন করে কী হলকে সজ্জিত করতে পেরেছেন!? মন এক, সৌন্দর্যচেতনা এক, তাহলে ব্যষ্টিক আর সামষ্টিক জায়গায় এতো পার্থক্য কেন!?

অবশ্যই কারন রয়েছে। পাহাড় সহনশীল বলেই আমরা পাহাড় বেয়ে উঠতে পারি। চারপাশকে গোছানো আর পরিচ্ছন্ন করে গড়ে তুলার জন্য যে সহনশীল মানসিকতা প্রয়োজন তা আমাদের নেই। আমরা টাকার উপরে ঘুমাতে রাজি আছি কিন্তু সৌন্দর্যের ভেতর ঘুমাতে অক্ষম।

ছোটকালে ইসলাম শিক্ষা বইয়ে পড়েছিলাম পরিচ্ছন্নতা ইমানের অঙ্গ। বই থেকে কথাটি জানার আগেও পরিচ্ছন্নতা আমার চরিত্রে ছিল। চরিত্রে ছিল থাকবে আছে। এখন আর টেবিল না-- পুরো ফ্লাট পরিচ্ছন্ন রাখি। একদিন! একদিন পুরো পৃথিবীটা পরিচ্ছন্ন গোছানো স্বাস্থ্যকর করে রাখবো!!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন