বুধবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০২২

ভাষার চলাফেরা

 বাজে কয়টা ভাই?

দশটা।

সই দশটা?

হুম। 

ব্রাহ্মণবাড়িয়া নরসিংদী কিশোরগঞ্জে সই মানে সমান। সই দশটা মানে সমান দশটা। সই(সহি) দেয়া মানে স্বাক্ষর  দেয়া— টিপসই শব্দটি বৃহত্তর ময়মনসিংহ ও ত্রিপুরা রাজ্যে বহুল প্রচলিত। সই আবার বান্ধবী অর্থেও ব্যবহৃত হয়— দুস্ত মানে বন্ধু, দুস্তের বিপরীত শব্দ হিসাবে সই ব্যবহৃত হয়— তখন সখি হতে সই শব্দের জন্ম।


'সই কইরা লামু' শব্দটি ঠিক করে ফেলা অর্থে ব্যবহৃত হয়। কেউ যখন খুব বাড়াবাড়ি করে তখন 'সই কইরা লামু' শব্দটি ব্রাহ্মণবাড়িয়া অঞ্চলের মানুষ বলে থাকে। 'সই করা' মানে সমান করা। লাঙল দিয়ে চাষ করার পর ক্ষেতে ইডা বা মাটির ঢিলা জমা হয়। আর সেই ইডা বা মাটির ঢিলা মই বা চগম দিয়ে অথবা মুহৈর<মুগুর ব্যবহার করে ভেঙে সমান করে বিজ ফেলার উপযোগিতা নির্মাণ করতে হয়। ক্ষেতের ইডা বা মাটির ঢিলা ভেঙে সমান করাকে ত্রিপুরা রাজ্য ও ময়মনসিংহের মানুষ বলে 'সই করা'। তাই সই করা মানে নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী কাউকে নির্মান করা। আবার 'সই করা' তাক করা অর্থেও ব্যবহৃত হয়ে থাকে। 


—হে আমারে সই কইরা ইডা মারছে।


ইডা মানে মাটির ঢিলা বা মাটির শক্ত গোলক। ইডার চাহা মূলত বিশেষ্য। ইডা ক্রিয়া+বিশেষ্য অর্থে ব্যবহৃত হয়—ইডা শব্দটি একা একা খুবই কম ব্যবহৃত হয়— ইডা দেয়া,ইডা মারা, ইডা ভাঙা,ইডা খাওয়া, ইডা দেখা। ইডা দেখা আবার প্রবাদ বাক্য যার অর্থ চোখে বিপদ দেখা বা ভবিষ্যতে বিপদের সম্ভাবনা দেখা। 


আবেগ যখন ঘন হয়ে আসে তখন ব্রাহ্মণবাড়িয়া অঞ্চলের মানুষ ইডাকে বলে ইডাল অথবা ইন্ডাল।


আবার ইডা শব্দটি কিন্তু এটা অর্থেও ব্যবহৃত হয়ে থাকে— এটা>এইডা>ইডা>ইতা— ইডা শব্দটি তখন সর্বনাম এবং তাচ্ছিল্য ও রাগ প্রকাশে এই ইডা সর্বনামটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। 'ইডা'র বহুবচন ইতা এবং ইতান। খুবই নিচু ও তাচ্ছিল্যের সুরে কোনো সর্বনামকে ইঙ্গিত করতে 'ইতান' শব্দটি উচ্চারণ করা হয় এবং প্রায়ই ইতান+এ=ইতানে বলা হয় রাগের আবেগকে আরও ঘন করে আনার জন্যে। ইতানে সর্বনামটি কখনো কখনো কর্ম আবার কখনো কখনো কর্তা হিসাবে বাক্যে বসে।


— আমি জানি ইতানে গ্রামের সর্বনাশ করছে!=কর্তা

—মাস্টার ইতানরে ছাত্র মনে করে না।= কর্ম

— ইডা কার পোলা?

—ইতা কোন জীবনে মানুষের কামে লাগযে?

— ইতানে শুধু খায় আর ঘুমায়।

— ইতানরে কেডা কইছে মেম্বরের কাছে যাইত?


ইডা (This one) সর্বনামটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে নিকটে অবস্থান করছে এমন কাউকে বুঝাতে। হিডা (That one) সর্বনামটি একবচনে ব্যবহৃত হয়ে থাকে নিকট দূরে অথবা দূরে অবস্থান করছে এমন কাউকে বুঝাতে। ইডার বহুবচন ইতা বা ইতানে। হিডার বহুবচন হিতা বা হিতানে। 


— ইতানে এ কতা না কইলে হিতানে জানছে কেমনে?


ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও ময়মনসিংহ অঞ্চলের মানুষের 'স'কে 'হ' উচ্চারণ করার একটি সুন্দর প্রবনতা রয়েছে~সকলে>হগলে,  সিঁথি সিঁদু> হিতি হিদু। 


সিথান,শিথান, (বিশেষ্য)= শিয়রদেশ; শয়নকারীর শীর্ষদেশ; শোয়া অবস্থায় মাথার দিক(মেঘের মতো গুচ্ছ কেশরাশি শিথান ঢাকি পড়ছে ভারে ভারে— রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর),উপাধান; মাথার বালিশ, মাথা (শিথানে সিদুঁর)। (বিপরীতার্থক শব্দ) পৈথান। {(তৎসম বা সংস্কৃত) শিরঃস্থান>}।


এই সিথান শব্দটিকে নরসিংদী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ময়মনসিংহ অঞ্চলে 'হিতান' বলে— এই জনের পরিবর্তে বলে 'ইলা', সেই জনের পরিবর্তে বলে 'হিলা'। ইলা এবং হিলা সর্বনামটি বড়জনকে বুঝাতে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।


— ইলা এ্যাস্টনকে ডাকছে।

— হিলা হালি ভাই ভাই করে। 


বিষয়টি মজার। কারন ইলা এবং হিলা যেমন কর্তা হিসাবে বাক্যে বসে তেমনি সম্বন্ধ পদ হিসাবেও বাক্যে  ব্যবহৃত হতে আমরা দেখতে পাই। 


—ইলার লাইগগা তোরে আজগা মাফ করছি।

—হিলার লগে তুমি কতা কইতে গেছ কেরে?

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন