শনিবার, ২০ ফেব্রুয়ারী, ২০২১

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্প 'সদর-অন্দর'

 বিপিন। বিপিনকিশোর। তার নামের শেষে কিশোর আছে মানে বিপিন সারা জীবন কিশোর থাকবে এমন ভাববার কোনো কারন নাই।কনক্রিট সময় মানুষকে বাস্তবতার মুখোমুখি করেই থাকে। শিশু থেকে কিশোর, কিশোর থেকে যুবক, যুবক থেকে বৃদ্ধ হওয়া পর্যন্ত যে চক্র সেই চক্রে মানুষকে পড়তেই হয়।আর তাই সময় বাস্তবতা। 


বিপিনকিশোরের জন্ম ধনীঘরে। তাই সে অর্থ ব্যয় করা জানে ভালোই।কিন্তু অর্থ উপার্জনের মন্ত্র তার তেমন ভালো জানা নাই।ব্যয়ের সাথে আয়ের ব্যালেন্স না থাকলে হিসাবের অভিধানে অপচয় বলে একাউন্ট হয়ে থাকে। অপচয়কারী শয়তানের ভাই। লোকে বলে। শয়তানের কোনো টাকা পয়সা ধন দৌলত নাই। বিপিনেরও টাকা পয়সা ধন দৌলত থাকে না। তার সম্বল দুই টাকা মাত্র। তাও শেষ পর্যন্ত রাজভৃত্য পুটের পকেট ভারী করে। 


বিপিনকিশোর আসমান থেকে পৃথিবীতে নেমে আসছিল কিনা আমরা জানি না।আমরা জানি না তার পরিবারের সদস্য সবাই করোনায় মারা গিয়েছিল কিনা। আমাদের জানানো হয়েছে তার জন্ম ধনীঘরে এবং সে অর্থ ব্যয় করতে জানে কিন্তু আয় করতে জানে না। অর্থ ব্যয় করা ও আয় করার হিসাবটা মানুষ পরিবার থেকেই লাভ করে। যেহেতু ডালপালা গজানো কোনো পরিবারের সন্ধান আমরা বিপিনের জীবনে পাইনা সেহেতু তার আয় ব্যয়ের হিসাবটা তুলা থাকুক। তবে বিপিন একেবারে ঝুলেঝালে গরিবি হালতের লোক নহে। গানবাজনায় সে কিন্তু মাথায় ঠাকুর। দেখতেও সুকুমার মূর্তি তরুন যুবক। অর্থবিত্তহীন লোকের সৌন্দর্য যে তারই অনিষ্টের কারন তা আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাবো অন্তত বিপিনকিশোরের বেলায়। 


বি.এ.পাস। রাজা চিত্তরঞ্জন বি.এ.পাস। তার আপন স্ত্রী বসন্তকুমারী। রাজা প্রায় সময় ঘরেই থাকেন। বন্য জীবন তার চালচলনে লক্ষ্য করা যায় না। খাওয়া দাওয়া ঘুমানো এমনকি খাওয়া দাওয়া ঘুমানোর জায়গা পর্যন্ত নির্দিষ্ট। 


রাজা সাহেবের থিয়েটার করার ইচ্ছা হলো। লোক দরকার। লোক পেয়েও গেলেন।বিপিনকিশোর। বিপিনকিশোর রাজার শখের থিয়েটারের লোক। রাজা বিপিনকে দারুন পছন্দ করলেন। শুধু পছন্দ বললে ভুল হবে পছন্দের অধিক কিছু যদি থাকে তবে সেটাই।রাজা বিপিনের গানে এতো তন্ময় হয়ে থাকেন যে খাওয়া দাওয়ার কথা একেবারে ভুলেই যান। ভাত ঠান্ডা হতে থাকে। রাজার আপন স্ত্রী বসন্তকুমারী তাতে গরম হতে থাকে। বসন্তকুমারী গরম হলে কি হবে রাজা আর বিপিনকিশোর আড্ডা ঠান্ডা হতে চায় না। রাজা চিত্তরঞ্জন তার পুরনো জীবন ভুলে গিয়ে নতুন জীবনে অভ্যস্ত হতে থাকে যেখানে বন্যতার ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠে। 


বিপিনের উপর রাজা কেনো এমন রবিগ্রহ টান প্রকাশ করছেন রানী বসন্তকুমারী তার কারন খুজে না পেয়ে বিপিনের উপর চরম বিরক্ত হয়ে উঠে। বিপিনকে রাজা থেকে দূর করতে পারলে যেনো রানীর হাড়ে বাতাস লাগে। 


রাজা, যুবতী স্ত্রীর ঈর্ষানল উপলব্ধি করে মনে মনে খুশি হতে থাকেন। রাজা মনে করেন মেয়েরা যাকে ভালোবাসে কেবল তাকেই ভালো জানে,জগতে যে আদরের পাত্র অনেক গুনী আছে স্ত্রীলোকের শাস্ত্রে সে কথা লেখা নাই। 


বিপিনের উপর রাজার আদর যেমন বাড়তে থাকে তেমনি সেবাদর কমতে থাকে রানীর। সদর ও অন্দরের দ্বন্দ্বে বিপিনের ভাগ্যে সেবাসুখ কেবল মুচকি হাসে। অর্থাৎ রাজকীয় খেলা বিপিনের পক্ষে সুবিধাজনক হয় নাই।


সুভদ্রাহরন গীতিনাট্য রাজার বাড়িতে মঞ্চায়ন হলো। রাজা কৃষ্ণ আর বিপিনকিশোর অর্জুনের চরিত্রে অভিনয় করে। বসন্তকুমারী বিপিনকিশোরের অভিনয়ে মুগ্ধ। রাজার চেয়েও বিপিনের অধিক গুনগ্রাহী এখন রানী। রানী বিপিনের খাবারের সুব্যবস্থা করে। অথচ এই বসন্তকুমারীর জন্যেই বিপিনের খাবারের অব্যবস্থা ছিলো এতোদিন। বিপিনের গান শুনার প্রস্তাব দেয় রানী রাজার কাছে। রাজার কাছে রানীর প্রস্তাব গ্রহনযোগ্য হয়নি। পর্দার আড়াল থেকেই শুনতে চায় সে বিপিনকিশোরের গান। তাও গ্রহনযোগ্য মনে করেনি চিত্তরঞ্জন।বিপিনকিশোরের থাকার ব্যবস্থা আরও ভালো করার জন্যে রাজার কাছে অনুরোধ করে রানী। বসন্তকুমারী যতই বিপিনের প্রশংসা করতে থাকে ততই রাজা বিপিনের প্রতি বিরক্ত হতে থাকে। 


একদিন রাজা ঘরে ফিরে দেখে রানী কি যেনো পড়তেছে। রাজা পড়ার বিষয় জানতে চায়। বিপিনের খাতা এনে রানী কয়েকটি প্রিয় গানের কথা তুলে রাখছে এমনটাই জানায় রাজাকে। রাজার সিংহাসনের কোথায় যেনো খুব বড় ধরনের আঘাত লাগে। রাজা চিত্তরঞ্জন নিজের শরীরের সমস্ত সৈন্য সামন্ত ব্যবহার করে বিপিনকিশোরকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। রচিত হয় মধ্যপদলোপী কর্মধারয় সমাস। বিপিনকিশোর পুনর্মূষিক হয়ে পড়ে।


নিজের প্রয়োজনে রাজা বিপিনকিশোরের প্রশংসা করে আবার নিজের প্রয়োজনে বিপিনকে রাজগৃহ ছাড়তে বাধ্য করে। অর্থবিত্তহীন লোকদের গুন কর্ম সৌন্দর্য কোনো কাজে লাগে না। অর্থনৈতিক মেরুদন্ড পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন ও শক্তিশালী দন্ড-- এই দন্ডের উপর ভিত্তি করে রচিত হয় শাষন শোষন শাষিত শোষিতের মানদন্ড। গিরীশ রাজ্যে একজন রানী কিংবা গুনাধার বিপিনকিশোর একপ্রকার পাতড়া কিংবা পলিতা। 


রানী রাজার অধীন। তার কোনো অর্থনৈতিক মেরুদন্ড নেই। তাই তার কাকে ভালো লাগলো কিংবা কাকে ভালো লাগলো না তা বিবেচনায় আনার মতো চিন্তাবিনিয়োগ করতে চায় না রাজা। 


কেউ কেউ বলতে পারেন বসন্তকুমারী ইচ্ছা করেই রাজার মনে আগুন ধরালো যাতে বিপিনকিশোরকে বাড়ি থেকে চিরতরে দূর করা যায়। তাও হতে পারে।পৃথিবীতে অসম্ভব বলে কিচ্ছু থাকে না। কেবল বিপিনকিশোরের পক্ষে রাজগৃহে থাকা সম্ভব হয়নি! 


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'সদর ও অন্দর' গল্পের বেদন অবেদন নিবেদন 

এমরানুর রেজা 

18022021

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন