মঙ্গলবার, ১৪ জানুয়ারী, ২০২০

আমাদের ম্যারাথন আমাদের দেখা গল্পের সাপলুডু

দেবলছেড়া পুঞ্জি। কেউ কেউ বলে ডাবলছেড়া পুঞ্জি। শমশেরনগরের এক‌টি জায়গা। বাগান এলাকা। চা বাগান। দেবলছড়া পুঞ্জির পাশেই খাসিয়া পল্লী। মিস্টার পিডিশন এই পল্লীর প্রধান। খাসিয়া পল্লীর পাশেই প্রাইমারি স্কুল। স্কুলের বিশাল মাঠ। মন ঠান্ডা করে দেয় এমন মাঠ। এই মাঠ থেকে সকাল ছয়টা ৪৫ মিনিটে শুরু হয় আমাদের ট্রেইল ম্যারাথন। ৪২.২ কিলোমিটার। আমরা কিন্তু ছয়টা ৪৫ মিনিটে ম্যারাথন শুরু করিনি। আমরা বলতে আমি আর সাদিয়া দেওয়ান মুনা। মুনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের philosophy ডিপার্টমেন্টের স্টুডেন্ট। ম্যারাথন করে প্রায় দুই বছর আগ থেকে। মুনার আন্তরিক সহযোগিতার ফলে ম্যারাথনযাত্রা শুরু করতে পারলাম, তাও আবার ট্রেইল ম্যারাথন দিয়ে।

কেন আমরা ৫৫ মিনিট পরে ম্যারাথন শুরু করি?

ড্রেস পরিবর্তন করার জন্যে কোনো জায়গা খুজে পাচ্ছিলাম না। ব্যাগ রাখার জন্যে কোনো নিরাপদ জায়গায় খুজে পাচ্ছিলাম না। তাছাড়া শমশেরনগর থেকে এক ঘন্টা সিএনজি জার্নির পর স্বাভাবিকভাবেই এক ঘন্টা হাতে থাকা লাগে refreshment এর জন্যে। এটা ম্যারাথন। ৪২.২ কিলোমিটার ম্যারাথন। তাও আবার আকাবাকা পাহাড়ি রাস্তায়। তাই ইচ্ছা করেই আমরা সঠিক সময়ে ম্যারাথন শুরু করিনি। শুরু করেছি প্রায় ৫৫ মিনিট পর। আমরা যখন ম্যারাথন শুরু করি তখন যারা সঠিক সময়ে শুরু করেছে তারা আমাদের থেকে প্রায় দশ কিলোমিটার সামনে।

দেবলছেড়া পুঞ্জির স্কুলের মাঠে নামি আমরা ছয়টা ২৭ মিনিটে। তারপর আমরা গেলাম সন্তু দার চায়ের দোকানে। এই এলাকার চা খুবই আরামদায়ক। চা বাগান এলাকা। এমনটাই হওয়া স্বাভাবিক। সন্তু দা রামকৃষ্ণ- ভক্ত- প্রান মানুষ। চা বাদে পান সিগারেট কিচ্ছু খান না। চা বাগান এলাকায় একটি বিশেষ মদ তৈরি হয়। এই মদের ঘ্রান এই এলাকাকে বিভাসিত করে ফেলে। চুই মদ নামে পরিচিত। একটি বিশেষ গাছের ছাল আর গুর দিয়ে এই মদ তৈরি করা হয়। এই মদ খেয়ে সন্তু দার বাবা মারা যান। তখন থেকে সন্তু দার পরিবারের লোক মদ ত দূরের কথা পান সিগারেটও খায় না। সন্তু দা চায়ের বাগানে কাজ করে। মজুরি ১০২ টাকা। সন্তু দা যখন প্রথম চা বাগানে কাজ শুরু করে তখন মজুরি ছিল ১২ টাকা। আপনি প্রশ্ন করতে পারেন ১০২ টাকা  মজুরি দিয়ে কেমন করে এই শ্রমিকরা দিনাপাত করে। প্রশ্নটি আমারও।

ম্যারাথন আমার কাছে symbol of purification।   শরীর ও আত্মার সুস্থতা ও শুদ্ধতার জন্যে ম্যারাথন গুরুত্বপূর্নভাবে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। বুকে দম আর শরীরের সুস্থতা না থাকলে কেউ ম্যারাথন করতে পারবে বলে আমার মনে হয় না।

শমশেরনগর থেকে আমরা পাচজন সিএনজি করে দেবলছড়া পুঞ্জির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেই। একজন ছিলেন আমেরিকান। মিসেস রুন্ডি। একত্রিশ বছর আগে আমেরিকাতে সে ম্যারাথন দিয়েছিল। এখন তার বয়স ৬২। সিএনজিতে আমরা যখন যাচ্ছিলাম আমাদের সাথে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রও ছিল। তারা মিসেস রুন্ডির কাছে বাংলাদেশের নেগেটিভ দিকগুলো তুলে ধরছিল।
আরে ভাই, বাংলাদেশের চমৎকার দিকও আছে, একজন বিদেশির কাছে নেগেটিভ দিক তুলে ধরার কী আছে।  তুমি যখন বাইরের লোকের সাথে কথা বলো তখন কী তোমার পরিবারের নেগেটিভ দিকগুলি তুলে ধরো? বাথরুম থেকে বের হয়ে হাতধৌত করার সাবান আছে কিনা তোমার বেসিনে তা নিয়ে আলোচনা করো? অবশ্যই না।
যত সুন্দর করে পারো নিজের পরিবারকে হাইলাইট করো। কেন? কারন এর সাথে তোমার সম্মান জড়িত। কেন মনে করতে পারো না দেশটা তোমার!? দেশটা অপমানিত হলে তুমিও অপমানিত হও ....

একটা দিক অনেক দৃষ্টিকোন থেকে দেখা যায়। দৃষ্টিকোনগত জায়গা থেকে আলোচনা করলে আপনি যতই মহান সফেস্টিকেট হোন না কেন আপনার বগলে দুর্গন্ধের জঙ্গল আছেই। আপনি পারফিউম ব্যবহার করে দুর্গন্ধের জঙ্গল ঢেকে রাখতে পারবেন কিন্তু একেবারে বিনাশ করে দিতে পারবেন না।

যাক, আমি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেটির কথা ইগনোর করার জন্যে সিএনজি চালক তুহিনের পাশে বসে গান ধরলাম আস্তে আস্তে। রুন্ডি মুগ্ধ হয়ে জানতে চায়লো সিএনজিচালক তুহিন গান গাচ্ছে কিনা। জনাব শরীফ (ছদ্মনাম) এখানেও কথা বসালেন। নিজের মতো করে আমার একটা নাম বসিয়ে মজা করতে লাগলেন। তারপর শুরু করলেন ইন্ডিয়াকে গালি দেয়া। আমার আর বুঝতে কষ্ট হলো না মিস্টার শরীফ কোন ক্যাটাগরিতে আছেন এবং তার প্রত্যেকটি কথা কার উদ্দেশ্য সার্ভ করছে।

ম্যারাথন শেষ করে মনে এক বিশাল প্রশান্তির বন্যা বয়ে গেলো। খাওয়া দাওয়া হলো মজা করে। কর্তৃপক্ষ খাওয়া দাওয়ার আয়োজন করেছে। ম্যারাথন শেষ করে মনে হলো পৃথিবীর সব খাবার আমিই একাই খেয়ে ফেলতে পারবো। খেয়েছিও প্রচুর। যদিও ম্যারাথন শেষ করার সাথে সাথে বেশি খাওয়া দাওয়া করা ঠিক না।

খাওয়া দাওয়া শেষ করে আমরা গেলাম সন্তু দার দোকানে। আমরা বলতে আমি আর মুনা। আমি আর মুনা খুব এনজয় করে ম্যারাথন শেষ করেছি। একেবারে পেছন থেকে শুরু করে একজন একজন অংশগ্রহনকারীকে অতিক্রম করছিলাম। ইহা এক বিশাল আনন্দপ্লাস মেটার। আমাদের স্মরনীয় দিন। চা পাতার কচিরব। চা বাগানের মানু‌ষের নিরাপদ হাসি ছল আনন্দ। বিজিবি ভাইদের উষ্ণ অভ্যর্থনা। সব কিছু। সব কিছু উপভোগ করতে করতে আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। তখন প্রত্যেক অংশগ্রহনকারীকে মনে হচ্ছিল মিল্কিওয়ের এক একটা বিন্দু। বিন্দু যেন বিন্দুকে অতিক্রম করার খেলায় মেতেছে।

সন্তু দার দোকানে চা খেয়ে কূপজলে স্নান সেরে আমরা আসি শমশেরনগর রেলওয়ে স্টেশনে। কূপজলের পানি খুবই আরামদায়ক ঠান্ডা। পানি তুলার পদ্ধতিটাও স্বাস্থ্যের জন্যে হিতকর। দেবলছেড়া পুঞ্জির প্রায় সবাই কুয়া বা কূপ থেকে খাবার পানি সংগ্রহ করে।

টিকেট কাউন্টার টিকেট দিতে ব্যর্থ হলেন। কারন টিকেট নিয়ে ব্যবসা করা তাদের দায়িত্বের মধ্যে পরে। টিকেট পেলাম তবে ব্যবসায়ী পদ্ধতির মধ্য দিয়ে। তারপর আমরা চলে আসি পতনঊষা গ্রামে। এই গ্রামটি আসলেই গ্রাম। বেসিক survival এর বাইরে তারা আর কোনো নতুন চিন্তা করতে পারে না। তাদের কাছে উন্নত চিন্তার একমাত্র চিহ্নসূচক মাধ্যম ধর্ম।

দুঃখ হয়। খুব দুঃখ হয়।  বাংলাদেশের মানুষ ধর্ম শেখার আগে পাপ পুন্য শিখে ফেলে, অংশগ্রহন শেখার আগে শিখে ফেলে প্রতিযোগিতা, প্রেম শেখার আগে শিখে ফেলে সেক্স। আমিও বাংলাদেশের একজন গর্বিত নাগরিক!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন