ভূমি অফিস বাংলাদেশের এক মহান জায়গা। এক শতক জায়গা আছে এমন বান্দারও ভূমি অফিসে জিয়ারত করতে যেতে হয়। আপনারা শুনে অবাক হবেন বাংলাদেশের অধিকাংশ ফৌজদারি মামলা হওয়ার পেছনে প্রধান কুতুব এই ভূমি। ভূমি সংক্রান্ত ঝামেলার প্রধান আতুরনিবাস বাংলার আঞ্চলিক ভূমি অফিস। ভূমি অফিসে যারা কাজ করেন তারা নিজেকে এই আধুনিক যুগেও খুব উঁচু মানের জমিদার মনে করেন— আর খাজনা প্রদানকারীরা খুব নিচু জাতের প্রজা।
নব্বই দশকে জমিজমার জরিপ হয়েছে যা বিএস বা বাংলাদেশ সার্ভে নামে পরিচিত। তখন মেয়েরা বাপের বাড়ি থেকে নিজ হক নেয়াকে লজ্জাকর মনে করতো— কেউ কেউ মনে করতো ইসলাম বাপের বাড়ি থেকে সম্পত্তি নেয়া নিষেধ করে। ভাই ভাই সম্পত্তি বন্টন করে ফেলতো যেখানে বোনদের জিজ্ঞাসা করার ন্যুনতম প্রয়োজন বোধ করতো না। বোনেরা লজ্জায় লাল হয়ে শাড়ির আচল মাথা থেকে কপালে এনে বলতো— ভাইয়েরা বোনদের দেখবাল করলেই হবে— ভাইয়েরা বোনদের এমন উন্নত দুর্বলতার স্বর্নযুগ সুযোগ কাজে লাগিয়ে মক্কায় হজ্জ করতে গিয়ে দুইপাচটা খেজুর আর জমজম কূপের পানি এনে বোনের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বোনের হক হজ্জ করা টুপির নিচে হজম করে ফেলতো। তাছাড়া জরিপ করতে এসে কীভাবে লোকাল কোর্ট স্থাপন করা হলো বোনরা তার খবর পেতো না বললেই চলে।
ইসলামের নবী হযরত মোহাম্মদ ( দরুদ ও সালাম তিনার শানে) বলেছেন তিন শ্রেণির মানুষের দোয়া ইসলামের আল্লাহ সরাসরি কবুল করেন—
— মা-বাবার দোয়া তার সন্তানের জন্যে।
— অত্যাচারিত নিপিড়ীত মানুষের দোয়া এবং অন্যায়ের প্রতিবাদকারীর দোয়া।
— মুসাফিরের দোয়া!
ফোকাস পয়েন্ট বা কথা হলো এমন শক্তিশালী তিন শ্রেনির মানুষের দোয়াও কাজে লাগে না ঐ ব্যক্তির ব্যাপারে যে অন্যের হক মারে। এখন আমাকে বলুন আপনারা বোনের ভাইয়ের হক মেরে দিয়ে ভাবছেন আপনারা অনেক বড় বিল্ডিং বানাইয়া ফেললেন আর আপনাদের আল্লাহ বলছে আপনারা গর্তে পড়ে গ্যাছন।
কোনো কোনো ব্যক্তি ঘামের টাকা দিয়ে সম্পত্তি কিনতে গিয়ে আরও গর্তে পরে। কারন সম্পত্তি কিনার আগে জানা জরুরি বিক্রয়যোগ্য সম্পত্তিটি ওয়ারিশসূত্রে, না কেনাসূত্রে। ওয়ারিশসূত্রে হলে অবশ্যই সঠিক ওয়ারিশসনদ আবশ্যকীয়ভাবে যাচাই করা প্রয়োজন। ওয়ারিশ সম্পত্তি কেনাবেচা করার ক্ষেত্রে রেজিস্ট্রার অফিসের ওয়ারিশসনদের বিষয়টি অত্যন্ত সুক্ষাতিসুক্ষ উপায়ে নজরে রাখা উচিত— কেবল বিএস নামক টুপির উপর আস্থাশীল হলে হবে না— আমরা জানি শস্যের চেয়ে টুপি বেশি, ধর্মের চেয়ে আগাছা বেশি।
আবার অনেক সময় বাংলাদেশ সার্ভে করতে আসা সরকারি লোক জামাই আদর পেয়ে সরকারি জায়গায়ও তার আপ্যায়নকারী শ্বশুরের নামে রেকর্ড করে দিয়ে যায়— খাস জমি নিজের নামে রেকর্ড করতে পেরে আপ্যায়নকারী শ্বশুর এমন এক হাসি দেয় যা নামজারির বর্তমানকালেও অব্যাহত আছে।
জমিজমার প্রধান তিনটি প্রমানের নাম দলিল, খতিয়ান, নকশা। আপনি নিশ্চয়ই জানেন দলিল আপনার প্রমাণ, খতিয়ান রেকর্ড সরকারের প্রমাণ আর নকশা আপনার এবং সরকারের প্রমাণ। দলিলে যে পরিমাণ সম্পত্তির অংশ উল্লেখ আছে অনেকসময় বিএসে তারচেয়ে কম উল্লেখ থাকে,অনেক সময় বিএসে যে পরিমাণ সম্পত্তির অংশ উল্লেখ আছে নকশাতে তারচেয়ে কম বা বেশি উল্লেখ থাকে। কারন আগের দিনের সোনার মানুষরা নিজের ইচ্ছেমতো জায়গা দলিল করে নিতে পারতো— বিএস সিএস খতিয়ান প্রদর্শনের প্রয়োজন পরতো না সাবের সামনে— সাবের সামনে বাড়ির তরতাজা লাতামোরগ হাজির করলেই হতো।
ভূমি অফিস বাংলাদেশের এক মহান পবিত্র জায়গা— সেখানে পা ফেলা মাত্র আপনি নিজেকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ অপরাধী বলে ফিল করতে থাকবেন—অথবা মনে হবে টেস্ট পরীক্ষায় চার সাবজেক্ট ফেল করা ছাত্র আপনি নিষ্ঠুরতম প্রধান শিক্ষকের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন— আর সেই প্রধান শিক্ষক চশমার ফাক দিয়ে চোখ উচু করে আপনাকে নিরীক্ষণ করছে।
বর্তমান সময়ে ভূমি মন্ত্রণালয় এক নতুন নিয়ম চালু করেছে। জমি আর নতুন করে খারিজ করতে হবে না— দলিল করার সাথে সাথে অটোমেটিক নামজারি হ'য়ে যাবে দলিলকারীর নামে। আনডাউটলি গোড স্টেপ। তবে একটা কিন্তু থেকে যায়! এমতাবস্থায় স্যাটেলমেন্ট,ম্যানেজমেন্ট, রেজিস্ট্রার এক রাস্তায় না হাটলে চোরবাটপার সুযোগ নিবে আপন মনে সোনাবন্ধুর গান গায়তে গায়তে।
অনেক সময় দেখা যায় দলিল এবং দখল একজনের নামে— বিএস খতিয়ান আরেকজনের নামে। যেহেতু কেনাবেচা বিএস খতিয়ান দিয়ে হয়ে থাকে, ভায়া দলিল না থাকলেও চলে সেহেতু বিএস দিয়ে দলিল হবে,দলিল হয়ে থাকে এবং সেই দলিল আবার নামজারি আদেশ পেয়ে যাবে দলিলকারী— দলিলকারী খাজনা দিয়ে 'পড়ে না চোখের পলক আনন্দে' আমলিচু খেতে খেতে মধুমাস যাপন করবে। এইদিকে প্রকৃত জমির মালিক ও দখলদারের দেওয়ানিমামলার শোনানির তারিখ গুনতে গুনতে জুতার ছাল থাকে না।
ভূমি মন্ত্রণালয় ও আইন মন্ত্রণালয় দুজন দুপথে দুভাবে— কে কাকে টেনে ফেরাবে— সাব রেজিস্ট্রার অফিস আবার আলাদা অনুশীলননীতি মেইনটেইন করে যেখানে দলিল লেখক (মাথায় টুপি সাদা পাঞ্জাবি পাচ ওয়াক্ত নিয়মিত নামায পড়া লোকটিও) ন্যূনতম একটি গুনাহের কাজও করেনা— ফলত দলিলপাড়ায় প্রতিনিয়ত আল্লাহ ও ভগবানের জিকির ও জপ চলতে থাকে এবং চলতে থাকে! গুনাহগার বান্দারা তাদের সোহবত মোহকা নিয়ে প্রায় আল্লাহর ওলি হয়ে ফিরে আসে— সুবাহানাল্লা!
মহান ভূমি মন্ত্রণালয় বিএস সিএস আরএস নিয়ে যে পরিমাণ সক্রিয় সক্রেটিস হয়ে বসে আছেন সেই পরিমাণ সক্রিয় মনোভাব তিনি দলিল নিয়ে হচ্ছেন না। তাছাড়া জনগণের হাতে দলিল ঠিকঠাক মতো নেই— স্বাধীনতা যুদ্ধে অনেকের দলিল হারানো গ্যাছে— মানুষ দলিল সংগ্রহ করতো মাটির পাত্রে, টাংকে, বস্তার ভেতরে কাপড়ের সাথে,বালিশের নিচে— ইদুর-বৃষ্টি-তেলাপোকার আক্রমণের ফলে অনেকে দলিল নামক কাগজকে হেফাজতে রাখতে পারেনি। নকল তোলাও মহা মুশকিল! কত সালে দলিল করা হয়েছে নতুন জেনারেশন তা জানে না— ফলে খোঁজ দ্যা সার্চ— আর খোজ দ্যা সার্চ মানে টাকা আর টাকা!
ভূমি মন্ত্রণালয় ইচ্ছে করলে সমগ্র দলিল অন্তর্জালে আপলোড দিতে পারে— বাতাস থেকে মানুষ দলিল সংগ্রহ করে নিবে— আচ্ছা, সমগ্র দলিল বাতাসে আপলোড করতে সময়সাপেক্ষ ব্যাপার হলে আরেকটি কাজ করলে ক্যামন হয়— দলিলের নাম্বার, দলিলের তারিখ, দলিলের শ্রেনি ও প্রকার, মালিকের নাম পর্যায়ক্রমে বাতাসে তো আপলোড করা যেতেই পারে। নাকি— তা করারও পর্যাপ্ত প্রমাণপত্র আপনাদের হাতে নেই!?
মাননীয় ভূমি মন্ত্রণালয় আপনার জানা উচিত— অনেক সহজ সরল মানুষের ভূমি রয়েছে নিজের দখলে কিন্তু নিজের দখলে নানা কারনে দলিল নাই— ফলে মনের কষ্ট মনে লইয়া দিবানিশি কান্দে শুইয়া— বালিশ ভিজে— কেউ জানে না বউও জানে না!
দলিল, দখল, দাখিলা— এই তিন মহানায়কের সামনে বাংলাদেশের মানুষ নতজানু। কারো কাছে দলিল আছে কিন্তু দখল ও দাখিলা নেই— কারো কাছে দখল আছে কিন্তু দলিল ও দাখিলা নেই। আবার কারো কাছে দাখিলা আছে কিন্তু দলিল ও দখল নেই। ফলে স্বাধীনতা অর্জনের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশের মানুষ যে ভূমি পেয়েছে তার শৃঙ্খলা আজও অর্জিত হয়নি।
দেশভাগের পর প্রচুর সনাতন ধর্মাবলম্বী লোক দেশত্যাগ করে— থেকে যায় তাদের ভূসম্পত্তি— তাদের ভূসম্পত্তি স্বাভাবিকভাবে আট নাম্বার রেজিস্ট্রার বইতে জায়গা পাওয়ার মধ্যে দিয়ে সরকারি সম্পত্তি হয়ে যাওয়ার কথা— কিছু হয়েছে, অধিকাংশ হয়নি! কারণ কী!?কারণ এই অঞ্চলের সুপারম্যানদের মাথা— এই অঞ্চলের চালাক মানবিক সুপারম্যানরা ফ্রিহিটে গ্যালারির উপর দিয়ে বাউন্ডারি মারে।
দেবোত্তর সম্পত্তি নিজের নামে দলিল করে নিয়েছে এমন সেবায়েত খুজে পাওয়া যাবে কিনা চশমা দিয়ে দেখার সুবার্তা এখন বাতাসে। প্রয়োজন হলে চশমার শক্তি বাড়ানো যেতে পারে। ওহে নিষাদ— দেবতার অভিশাপ কিন্তু তোমার কপালে— জেগে উঠো নতুবা তোমার প্রজন্ম কোনোদিন জাগবে না— পাবে না প্রতিষ্ঠা কোনোদিন।
খাজনা পরিশোধের বিষয়টি অনলাইনে করা হয়েছে— খুবই আনন্দের কথা— কষ্টের কথা হলো প্রায় নব্বই ভাগ ভূমিখাজনা পরিশোধকারী জনগণ অনলাইনে প্রোফাইল তৈরি করা এবং পেমেন্টের মাধ্যমে খাজনা পরিশোধ করার নিয়মকানুনের সাথে অভ্যস্ত হয়ে উঠেনি— ফলে খাজনা পরিশোধের জন্যে তাদেরকে ইউনিয়ন ভূমি অফিসে যেতে হচ্ছে— ইউনিয়ন ভূমি অফিস মহাব্যস্ত! বিশ্বাস করেন অথবা না করেন সাধারণ জনগণ ভূমি অফিসে যেতে ভয় পায়।
খতিয়ানে পুরনো মালিকের নামের জায়গায় নতুন মালিকের নাম প্রতিস্থাপন করানোকে নামজারি বা মিউটেশন বলে— বাংলাদেশে ১৯৫০ সালের রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন অনুযায়ী তার কার্যক্রম পরিচালিত হয়।
রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ আইন ১৯৫০ এর ১৪৩ ধারার পথ ধরে ওয়ারিশ সনদ অনুযায়ী খতিয়ান নাম্বার একই রেখে নামজারি করা হয়। তবে বন্টননামা দলিল থাকলে আলাদা খতিয়ান নির্মাণ করা যায়।
রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ আইন ১৯৫০ এর ১১৭ ধারা মোতাবেক দলিল মূলে মালিকের মধ্যে জমা খারিজের কাজটি সম্পাদিত হয় এবং তাতে নতুন তলব(হোল্ডিং) ও খতিয়ানের সৃষ্টি হয়।
১৯৫০ সালের ১১৬ ধারা অনুযায়ী জমা একত্রিকরনের কাজটি করা হয়— নতুন খতিয়ান সৃষ্টি না করে পুরাতন খতিয়ানে নতুন জমি যুক্ত করে দেয়া হয়— সাধারণ জনগণ এইসব আইনকানুন বুঝে না— তারা বুঝে জমি— জমির মালিক যেনো তার জমিতে সুন্দর উপায়ে নিজের অস্তিত্ব খুজে পায় সেইজন্য সহোযোগিতা করবে ভূমি অফিস। অথচ ভূমি অফিসে ভূমিমালিক যেতে ভয় পায়— সংশয় সন্দেহ ভয় শঙ্কা ভূমিপুত্রদের মনে সদা বাজতে থাকে। কেনো!? সাপ অকালে সাবালক হয়ে গেলে তার মাথা ঠিক থাকে না— ভূমি অফিসের কর্মকর্তা কর্মচারী ভুলে যায় তাদের দায়িত্ব— সাপের মতো অকালে সাবালক হয়ে জনগণের মনে বিষবাষ্প ঢালতে থাকে ফায়দা হাসিলের নির্বাহী আশায়— হায়রে অভাগা জাতি হায়রে লাগামহীন লোভের ফাঁদ!
কষ্টের কথা হলো এইখানে মানে এই বাংলাদেশে যা সহজ হওয়ার কথা ছিলো তা হয়েছে কঠিন, যেখানে থাকার কথা ছিলো অনিবার্য সহযোগিতা সেখানে এখন অনিবার্য বানিজ্য— বানিজ্যের তালে যারা গীত রচনা করতে পারে তাদের কথার ও বিলাসিতার মাটিতে চাপা পড়ে সাধারণ মানুষদের নৈতিক দৈনিক জীবন!