বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের দিনাজপুর শহরের রেস্ট হাউজটি বা পর্যটন মোটেলটি ভালো— ভালো বলতে দিনাজপুর শহরে এর চেয়ে ভালো মোটেল কিংবা রেস্ট হাউজ আর নেই— তবে সে আরও ভালো হতে পারতো— রুমে সেই পুরাতন এসি— সেই পুরাতন সামগ্রিক সেটআপ— তোয়ালে থেকে শুরু করে নুয়ালে পর্যন্ত। পরিবেশ নিরব শান্ত, নিরাপত্তা পদ্ধতি যথেষ্ট ভালো। কিন্তু সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে পর্যটন মোটেল দিনাজপুর আপডেট হতে পারেনি।
সকালে ঘুম থেকে উঠি নয়টায়— তারপর নাস্তা খাওয়ার পালা— নাস্তায় দুটি রুটি একটি ডিম একটি পানির বোতল এক কাপ কফি— বাড়তি একটি রুটি খেতে গেলেও এক্সট্রা বিল পে করতে হবে! অথচ এক রাতের জন্য তারা আমার কাছ থেকে নিয়েছে তিন হাজার দুইশো টাকা!!
নাস্তা খেয়ে অটোরিকশা করে যাত্রা করি কান্তজিউ মন্দিরের উদ্দেশ্যে— আগে কান্তজিউকে বলতাম কান্তজির। মাত্র দুইশো টাকায় আসা-যাওয়া ভাড়া—আসাযাওয়াতে পথদুরত্ব প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার—চালক আবুজার আলী — সে কোরানের হাফেজ— দুই সন্তানের পিতা। অন্য রিকশা চালকদের মধ্যে কেউ চারশো টাকা কেউ পাচশো টাকা ডিমান্ড করেছে— ধরদামে তারা টিকেনি— টিকেছে আবুজার আলী।
যাচ্ছে তো যাচ্ছে। যাচ্ছি তো যাচ্ছি। রাস্তার দুইপাশে হালকা পাতলা ঘরবাড়ি। আমবাগান— লিচু বাগান— ধানের ক্ষেত— আখ খেত চোখে পড়ে কেবল। চোখে আসে হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়— রাস্তার একেবারে বগলে হাবিপ্রবির অবস্থান।
চোখে আসে চেহেল গাজী মাজার শরীফ— চল্লিশ জন সুফি সাধকের মাজার— যারা ধর্ম প্রচার করতে বাংলায় পা রাখে তাদের মধ্যে থেকে চল্লিশ জন এখানে শায়িত আছেন— চল্লিশ জনকে লম্বা করে একসঙ্গে সমাধিস্থ করা হয়েছে।
যাচ্ছি কান্তজিউ মন্দিরের ⛪ দিকে। যাচ্ছি তো যাচ্ছি। আর চোখ ভরে দেখছি সবুজ শান্ত প্রকৃতি— মন ভরে নিচ্ছি নির্মল বাতাসের শুদ্ধ আভাস বিশুদ্ধ প্রভাস। প্রাণনাথ রায় কান্তজিউকে বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণ ও তার প্রথম স্ত্রী রুক্মিণীকে স্মরণত্যাগে অর্পণ করেছে।
রুক্মিণীকে সংস্কৃত ভাষায় বললে, বলতে হয় रुक्मिणी যার বাংলা অর্থ জ্যোতির্ময়ী বা প্রভাশালিনী। রুক্মিণীকে লক্ষ্মীর অবতার এবং সৌভাগ্যের দেবী হিসাবে বিবেচনা করে শাস্ত্রে।
রুক্মিণী হলো শ্রীকৃষ্ণের সহধর্মিণী ও দ্বারকার রাণী— রুক্মিণীকে নিয়ে বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণ কান্দজিউতে বসবাস করে। কান্ত অর্থ কৃষ্ণ। কান্তজিউ মন্দির মানে কৃষ্ণ মন্দির।
কান্তজিউ মন্দির দিনাজপুরের কাহারোল উপজেলার সুন্দরপুর ইউনিয়নের ঢেপা নদীর তীরে আশ্রিত। অলঙ্কারের বৈচিত্র্যে এবং ইন্দো-পারস্য স্থাপনা কৌশল অবলম্বনে মন্দিরটি নির্মিত— শ্রীকৃষ্ণের যুদ্ধ-বিগ্রহ অধিষ্ঠানের জন্য মন্দিরটি নির্মিত। মন্দিরটির অবস্থান শ্যামগড় এলাকায় হলেও বিগ্রহের নাম অনুসারে নতুন নাম দেয়া হয় কান্তনগর— বিগ্রহ মানে দেবতার মূর্তি— বিশেষ করে কৃষ্ণের বিশেষ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন অবয়ব ভাব। গ্রহ যখন অনুকূলে থাকে না তখন তাকেও বিগ্রহ বলে।
দিনাজপুরের বীরগঞ্জ পৌর এলাকার কোলঘেঁষে প্রবাহিত হওয়ার পর ঢেপা নদী দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়ে দিনাজপুর সদরের পৌর এলাকার নিকটবর্তী রাজাপোড়া ঘাট নামক স্থানে পুনর্ভবা নদীতে পতিত হয়েছে। পচিশ মাইল দৈর্ঘ্যের এই ছিমছাম নদীটি কান্দজিউ মন্দিরের ⛪ কপালে চুমু দিয়ে সামনের দিকে প্রাগ্রসর হয়েছে— নদী ও মন্দির কে যে কার অলঙ্কার বুঝা বড় মুশকিল! ঢেপা নদী হলেও বেশভূষায় তাকে সাগরের আপন ছোট বোন মনে হয়।
কান্তজিউ মন্দিরের টেরাকোটায় রামায়ণ ও মহাভারতের ঘটনা ও মুঘল আমলের বাংলার সাধারন মানুষের জীবনযাত্রার স্বাভাবিক প্রবাহ ছবিচিত্রের মাধ্যমে কল্পনাবাস্তব থেকে দৃশ্যমান বাস্তব করে তোলা হয়েছে— মন্দিরের টেরাকোটার চিত্রে নারী পুরুষের যৌন জীবন অত্যন্ত সুন্দর উপায়ে স্পষ্ট— বিশেষ করে নারী ও পুরুষের শারীরিক গঠন খুবই সুন্দর মন্দিরের দেয়ালে আশ্রিত চিত্রে। কান্তজিউ মন্দির নির্মানে ব্যবহৃত পাথর আনা হয়েছে হিমালয়, আসামের পার্বত্যাঞ্চল ও বিহারের রাজ মহল পাহাড় থেকে— এছাড়াও ইট-বালি টেরাকোটা ও কঠিন পাথরের সংমিশ্রনে মন্দিরটি নির্মিত।
মহারাজা প্রাণনাথ রায় মন্দিরটি ১৭০৪ খ্রিস্টাব্দে নির্মাণ কাজ শুরু করে কিন্তু সে নির্মান কাজ শেষ করতে পারেনি— ১৭৫২ খ্রিস্টাব্দে প্রাননাথপুত্র রাজা রামনাথ রায় নির্মান কাজ শেষ করে। মন্দিরটিতে নবরত্ন বা ‘নয় শিখর’ ছিলো কিন্তু ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে নবরত্ন ধ্বংস হয়ে যায় । বলে রাখা ভালো, রাজা প্রাণনাথের রক্তের কোনো সন্তান ছিলো না।
বাংলাদেশের সর্বোৎকৃষ্ট টেরাকোটা শিল্পের চিহ্নময়ী কান্তজিউ এক নীরব প্রেম ও নীরবতার স্বাক্ষী— মন ভালো হয়ে আসে ভেতর থেকে এই মন্দিরের ভেতরের নীরবতার শরীরের কিছুক্ষণ ডুব দিয়ে থাকার পর— বহু পুরাতন বটগাছের দেখা মিলে— দেখা মিলে এক সুশৃঙ্খল সুশীতল ছায়াময় কায়ার সাথে যা হৃদয় দিয়ে দেখতে হয়— আমি যখন মন্দিরে প্রথম শরীর রাখি তখন মন আনন্দে ভরে উঠে। কারন ছোটোকাল থেকে কান্তজিউ মন্দিরের নাম শুনে আসছি— আজ চোখে দেখছি। দিনাজপুর বলতে বুঝতাম কান্তজিউ মন্দির!
বলতে গেলে কান্তনগরটিই খুবই শান্ত— লিচু গাছের সমারোহ। ধান গাছের সমারোহ। মাটির ধরন না এটেল না বেলে না মিশ্র— একেবারে ভিন্ন ধরনের— জনবসতি হালকা। মানুষের মেজাজ শান্তশিষ্ট এবং ভদ্র— ঢেপা নদীর মতোই সেখানকার মানুষ এবং তাদের নীরব সেবামুখর উপায়ে বয়ে চলা— কথা কম কাজ বেশি।
ঢাকা-দিনাজপুর প্রধান সড়ক ধরে মাত্র এক ঘন্টায় দিনাজপুর শহর থেকে পৌছে গেলাম কান্তজিউ মন্দিরে। এক ঘন্টার মতো অবস্থান করি। সময় তেমন হাতে ছিলো না— তবে সময় হাতে থাকার দরকার ছিলো— অর্ধদিবস কান্তজিরে যাপন করলে কিছুটা হলেও মনের স্বাদ পূর্ণ হতো— স্বাদ থেকে যাওয়া ভালো— পুনরায় ভরা স্বাদে যাওয়ার এক মনপথ নির্মাণ হলো মনে— কান্দজিউ কেবল মন্দির নয়— গবেষণার এক প্রামাণিক ল্যাবরেটরি!
কান্তজিউ মন্দির যখন নির্মিত হচ্ছে ঠিক একই সময় নির্মিত হচ্ছে নয়াবাদ মসজিদ— ১.১৫ বিঘা জমিতে নয়াবাদ মসজিদটি নির্মিত হয়। কান্তজিউ মন্দির নির্মাণ করা জন্যে ইরান তুরান পারস্য থেকে লোকবল আমদানি করা হয়— জাতে তারা ছিলো মুসলমান— মুসলমানদের থাকা এবং ইবাদত করার আস্তানা হিসাবে মহারাজ প্রাননাথ রায় মুসলমানদের ১.১৫ বিঘা জায়গা বরাদ্দ করে। তবে মসজিদের ঢুকার মেইন দরজার উপর স্থাপিত ফলক থেকে প্রমানিত হয় মসজিদটি সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের রাজত্ব কালে ২ জৈষ্ঠ্য ১২০০ বঙ্গাব্দে, ইংরেজি ১৭৯৩ সালে নির্মিত— ঠিক তখন জমিদার ছিলো রাজা বৈদ্যনাথ— সে দিনাজপুর রাজ পরিবারের সর্বশেষ বংশধর।
বিষয়টি ভাবতে ভালো লাগে— মনে পড়ে সেই গানের কথা— আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম— একজন হিন্দু শাষক নির্মাণ করে দিচ্ছেন মুসলমানদের মসজিদ— রাজ্যের নদী নালা খাল বিল কুকুর মানুষ সবকিছুর রাজার— সে কোন ধর্মের জায়গা থেকে রাজ্য পরিচালনা করলে রাজ্য তার গতি হারাবে— তবে রাজার নিজস্ব ধর্মবোধ থাকতেও পারে আবার নাও থাকতে পারে— এটা তার একান্ত ব্যক্তিগত উপলব্ধি বা অভিমত। একজন রাজা নদীর মতো— সবাইকে জল দেয়— একটি রাষ্ট্রের সংবিধান গাছের মতো— সবাইকে ফল দেয়।
এখানে মানে দিনাজপুরে যত জলমিছিল দেখেছি সব জলমিছিলের স্বচ্ছতা স্পষ্ট— কান্তজিউ মন্দিরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ঢেপা নদীর জল অত্যন্ত স্বচ্ছ— তেতুলিয়ার মহানন্দার জল মনমাতানো স্বচ্ছ— করতোয়া ও আত্রাই নদীর জল প্রানবন্ত এবং প্রানবন্ত চমৎকার স্বচ্ছ। রামসাগরের জলও চোখ ধাধানো মনমাতানো রূপসী যেনো অপরূপ রূপের মিছিল।
রামসাগর মানে কিন্তু বড় সাগর এমন না— যদিও রামসাগরকে বাংলাদেশের বৃহত্তম মানবসৃষ্ট দীঘি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তটভূমিসহ রামসাগরের আয়তন ৪,৩৭,৪৯২ বর্গমিটার— দৈর্ঘ্য ১,০৩১ মিটার ও প্রস্থ ৩৬৪ মিটার। গভীরতা গড়ে প্রায় ১০ মিটার। পাড়ের উচ্চতা ১৩.৫ মিটার। ভগবান রামের নাম অনুসারে রামসাগরের নামকরণ করা হয়নি। রামসাগরের নামকরন করা হয় প্রাণনাথ রায়ের পুত্র রামনাথ রায়ের নাম অনুসারে। রাজ্যে যখন প্রচন্ড খরা দেখা দেয় তখন দয়ালু রাজা প্রাণনাথ এই পুকুরটি মাত্র পনেরো দিনে ১৭৫০ খ্রিষ্টাব্দে ত্রিশ হাজার টাকা ব্যয় করে খনন করেন— ১৫,০০,০০০ শ্রমিক পুকুরটি খনন করতে কাজ করেন।
পুকুর খনন করা হয়ে গেলো কিন্তু জল উঠছে না। রাজা বিশাল টেনশনে আছেন। তখন রাজা স্বপ্ন দেখেন তার পুত্রের জীবনের বিনিময়ে পুকুরে জল উঠবে— দয়ালু রাজা জনগণের কথা চিন্তা করে পুত্রের জীবন বিসর্জন দিতে রাজি হলেন— পুত্রও রাজি হলো নিজের জীবন ত্যাগ করতে। পুকুরের নিচে একটি মন্দির নির্মাণ করা হয় রাজার আদেশে। প্রাণনাথের পুত্র রামনাথ পুকুরের মন্দিরে গিয়ে পৌছতে না পৌছতে সলিলসমাধি ঘটে রামনাথের— সাগরের মতো বিশাল ত্যাগমহিমার পরিচয় দিলেন রামনাথ— সেই থেকে এই দিঘীর নাম রামসাগর!
রামসাগরে গিয়ে দেখি প্রচুর লোক আধুনিক সব জিনিসপাতি নিয়ে মাছ ধরছে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তারা মাছ ধরে— নিজে খানাদানা রান্না করে নিয়ে আসে— কেউ কেউ রান্না করার সামগ্রী ও রাধুনি নিয়ে আসে। কেউ কেউ দেখছি তাবু ⛺ করে রাতে থাকে— এ এক মহা যজ্ঞ!
রামসাগরে বনবিভাগের একটি বাংলো আছে— নীরব সুন্দর— রাতে থাকতে পারলে নীরবতার জঙ্গলে কেমন করে মানুষ থাকে তা ফিল করা যেতো— হয়তো সময় সুযোগ করে একদিন থাকবো।
হাতে সময় বেশি নাই— একটু পরে সূর্য ☀ ডুবে যাবে— যাচ্ছি খানপুর সীমান্ত ফাড়ির দিকে— যাচ্ছি তো যাচ্ছি। খানপুর সীমান্ত ফাড়ির সাথেই বাংলাদেশের গ্রাম— আমরা দেখি এক বাড়ির সাথে আরেক বাড়ির সীমানা প্রাচীর— আর তাদের শিশুরা এক দেশের সাথে আরেক দেশের সীমানা প্রাচীর দেখে বড় হয়— নিষ্ঠুরতম আচরণ এটি, পৃথিবীর নিষ্ঠুরতম আচরণ।
এই খানপুর সীমান্ত ফাড়ি দেখে মন ভিষণ বিষন্নতার স্বপজাল বুনতে বুনতে ফিরে আসি দিনাজপুর শহরের পর্যটন কর্পোরেশনের মোটেলে— রুমভর্তি মশা— সবচেয়ে ভিআইপি রুমে যদি এমন করে মশা থাকে তাহলে বাংলাদেশ কেমন করে পর্যটন খাত থেকে লাভবান হবে? অথচ বাংলাদেশ টুরিজম খাত থেকে প্রচুর পরিমানে বৈদেশিক অর্থ উপার্জন করতে পারে— কেবল সুন্দর পরিকল্পনা সঠিক পদক্ষেপ এবং কার্যকর প্রয়োগ দরকার— তোমার যখন ভাঙবে ঘুম তখনই তোমার সকাল— কবে যে বাংলার সকাল হবে!?
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন