আমরা যখন ট্রেনে চড়ি, যাত্রাপথের সময়টা অনেকেই কাটাই মোবাইল স্ক্রলে, আলাপচারিতায়, কিংবা নিছক অবসর কাটিয়ে— কিন্তু এই সময়টাই হতে পারে পাঠচর্চা আর মননের নতুন জানালা। কল্পনা করুন, প্রতিটি ট্রেনে যদি থাকে একটি ছোট্ট লাইব্রেরি! বইয়ের সুবাস, শান্ত পরিবেশ, আর কিছু জ্ঞানতৃষ্ণু সহযাত্রী — একটা ট্রেনভ্রমণ তখন হয়ে উঠবে একেবারে ব্যতিক্রমী অভিজ্ঞতা।
যাত্রা মানেই যেন শুধু গন্তব্য নয় — নতুন জ্ঞান, নতুন ভাবনার শুরু।
তবে শুধু উদ্যোগ নিলেই হবে না, রক্ষা করতে হবে এর মৌলিক উদ্দেশ্যকে। যেমন আজকের ক্যান্টিন বা ক্যাটারিং সার্ভিসে দেখা যায় — দালালচক্রের দখলে যায় সব, সাধারণ যাত্রীরা বঞ্চিত থাকেন। তাই প্রস্তাব, লাইব্রেরি ও ক্যান্টিন ব্যবহারের অধিকার থাকবে শুধু টিকিটধারী যাত্রীদের জন্য— টিকিট ছাড়া কেউ প্রবেশ করতে পারবে না। ডিজিটাল এনফোর্সমেন্ট ব্যবস্থা থাকলে এই নিয়ম বাস্তবায়ন কঠিন হবে না।
শুধু ট্রেন নয়, প্রতিটি বড় রেলস্টেশনেও থাকতে পারে একটি ঘর — লাইব্রেরি, একটি স্বাস্থ্যকর কফিশপ বা চা স্টল, আর প্রার্থনার জায়গা যেমন থাকবে, তেমনি থাকবে "জ্ঞানঘর" — যেখানে মানুষ জানতে পারবে কেন প্রার্থনা করে, কার জন্য করে, কীভাবে চিন্তা ও অনুভব গভীর হয়— আধুনিক সময় কেমন করে বিজ্ঞানের উপর ভর করে আছে।
শুধু অবকাঠামো নয়, আমাদের দরকার চিন্তার পরিবর্তন। লাইব্রেরি গড়ে তোলার সাথে সাথে আমাদের গড়তে হবে পাঠকও।
কল্পনা করুন, আপনি বসে আছেন ট্রেনের মাঝামাঝি ছোট্ট এক সবুজ বাগানে— চারপাশে পাতার ফিসফাস, হাওয়ার মৃদু দোলা, হাতে ধরা এক কাপ গরম কফি বা লাল চা — আর হৃদয়ের গভীরে শুরু হয় এক নিঃশব্দ ভাবনা— এই বাগানেই আছে ছোট্ট একটি কফিশপ, যেখানে প্রতিটি চুমুক মানে আত্মার আরাম।
কিছু দূরে, ট্রেনের বুকে একটি সাউন্ডপ্রুফ থিয়েটার রুম— যেখানে বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ সিনেমা টিকিট কেটে দেখা যায় যাত্রাকালে । শঙ্খচিলের কান্না, পদ্মার ডাক, কিংবা একালের কোনো সাহসী গল্প — বড়পর্দায় জীবন্ত।
প্রত্যেক বগিতে রয়েছে একটি ডিজিটাল স্ক্রিন, প্রতি এক ঘণ্টা পর পর ভেসে ওঠে — বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, নদী, পাহাড়, শেকড় আর গান। গল্পের মতো করে বলা হয়, “এই যে তুমি যাচ্ছো — জানো কি এই পথের পাশেই জন্মেছিল এক কবি?” “এই স্টেশনেই একদিন নেমেছিলেন এক বীর যোদ্ধা!”
শিশু, কিশোর, প্রবাসী, বৃদ্ধ — সবার চোখে নতুন আলো।
আর ট্রেনের এক কোণে একটি প্রার্থনালয়— একেবারে পরিচ্ছন্ন, তেলাপোকার বাসাবিহীন। তার পাশেই একটি ডিসপেনসারি, আছে একজন অভিজ্ঞ ডাক্তার, একজন সেবাপরায়ণ নার্স — যেন যাত্রাপথে হঠাৎ অসুস্থতাও পায় মমতার ছোঁয়া।
বাংলাদেশ রেলওয়ে, আমরা চাই এমন এক ট্রেন — যেখানে শুধু গন্তব্য নয়, থাকে চিন্তা, পাঠ, সিনেমা, সেবা ও সংস্কৃতির গভীর ছায়া।
আমরা চাই, এই স্বপ্নট্রেন বাস্তব হোক।
চলন্ত বাংলাদেশ হোক সৌন্দর্যে পূর্ণ এক যাত্রা।
এটা কেবলই স্বপ্ন নয় — এটা হতে পারে বাস্তব, যদি আমরা সকলে চাই।
আরিনা পেমি — এক পাহাড়ি মেয়ে, চাকমা বাবার আর বাঙালি মায়ের মেয়ে। ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, কিন্তু মন পড়ে থাকে পাহাড়েই। এবার সে ফিরছে নিজের শিকড়ে — "স্বপ্নট্রেন"-এ চড়ে।
ট্রেনটা যখন চট্টগ্রাম পেরিয়ে পাহাড়ে ঢুকে পড়ে, জানালার কাঁচে মুখ রাখে আরিনা। তার চোখে তখন আলোয় ধোয়া সবুজ পাহাড়, যেন মায়ের আঁচলের মতো কোমল। জুমের ক্ষেতগুলো নিচে ঝুঁকে আছে, যেন পাহাড় নিজেই প্রণাম করছে যাত্রীদের।
ট্রেনের ভেতরের স্ক্রিনে ভেসে ওঠে এক কাব্যিক ভাষ্য:
"এই যে ডান পাশে যে গ্রামটা দেখছেন, ওখানে জন্মেছিলেন রাখাইন বয়নশিল্পী মামা থোয়াই। তাঁর হাতে তৈরি একখানা গামছা আজও জাদুঘরে রক্ষিত..."
আরিনা হঠাৎ চমকে ওঠে। সে তো এই গল্প জানত না! নিজের মাটির এমন ইতিহাস সে কখনও জানেনি — শহরের পাঠ্যপুস্তকেও না, লোকমুখেও না।
ট্রেনের মাঝখানে ছোট্ট সেই বাগান আর কফিশপে বসে সে এক কাপ লাল চা খায়। পাশে বসে থাকা বৃদ্ধ এক মারমা দাদু তাকে বলেন বান্দরবানের লোকগান, আর ট্রেনের থিয়েটার রুমে শুরু হয় "মনপুরা" সিনেমা। কাচের ভেতর জ্বলজ্বলে পর্দা, আর বাইরের প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম সে দৃশ্যপট — আরিনা কখনো কেঁদে ফেলে, কখনো হেসে ওঠে।
একটা ছোট ছেলেকে হঠাৎ পায়ে ব্যথা পেয়ে কাঁদতে দেখে সে নিয়ে যায় ডিসপেনসারিতে, যেখানে সেবিকা তাকে স্নেহভরে সেবা দেন।
আরিনা ভাবে,
"এটা কি সত্যি? আমি কি স্বপ্নে আছি?"
রাঙামাটি পেরিয়ে খাগড়াছড়ি, বান্দরবান হয়ে যখন ট্রেন কক্সবাজারে এসে দাঁড়ায়, তখন সূর্য অস্ত যাচ্ছিল সমুদ্রের মুখে।
আরিনা ট্রেন থেকে নামবার আগে জানালায় একবার চোখ রাখে — পাহাড়ের সেই কুয়াশায় ঢাকা মুখ যেন তাকে বিদায় জানায়।
তার চোখে জল, কিন্তু ঠোঁটে হাসি।
এই ট্রেন তার কাছে শুধু একটা বাহন নয় —
এ এক চলন্ত পাঠশালা, এক বাগান, এক সিনেমা হল, এক ছোট্ট বাংলাদেশ।
আর সে বুঝে যায়, "বাংলাদেশকে জানার সবচেয়ে সুন্দর পথ হতে পারে এমনই এক ট্রেনজার্নি।"
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন