মঙ্গলবার, ১৭ জুন, ২০২৫

তারপর গাধা

গাধাকে সিংহাসনে বসতে দিলাম। 

— তারপর 

গাধা সিংহাসনকে পীঠে নিলো। 

— তারপর 

সিংহাসনকে পীঠে নিয়ে গাধা হাটতে লাগলো। 

— তারপর 

সিংহাসনকে পীঠে নিয়ে হাটতে হাটতে গাধা দেশের বাইরে চলে গেলো। 

—তারপর 

সিংহাসনকে গাধা দেশের বাইরে রেখে আসলো। 

—তারপর 

তারপর গাধা আরেকটি বোঝাভার খুজতে লাগলো।

সত্য বলতে সত্যিই কিছু আছে!?

 সিনেমা বিনোদনের মাধ্যম— বিনোদনের মাধ্যমে সিনেমা  সমাজ, বিচার, নীতি ও মানবমনের জটিলতা অন্বেষণের এক শক্তিশালী রূপ— ব্যতিক্রমী এবং গভীর চিন্তনমূলক চলচ্চিত্র সৃজিত মুখোপাধ্যায় পরিচালিত “সত্যি বলে সত্যি কিছু নেই”। ২০২৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এই বাংলা চলচ্চিত্রটি একটি আইনি থ্রিলার, যা মূলত আমেরিকান ক্লাসিক 12 Angry Men এবং তার হিন্দি রূপান্তর Ek Ruka Hua Faisla-র আধুনিক ও প্রাসঙ্গিক বাংলা পুনরায় নির্মাণ।


চলচ্চিত্রটির কেন্দ্রে রয়েছে একটি বিচারপ্রক্রিয়া, যেখানে বারো জন জুরি সদস্য এক তরুণের বিরুদ্ধে খুনের মামলায় রায় দিতে বসেন। শুরুতে সবাই ছেলেটিকে দোষী বলে মনে করলেও, একজন সদস্য যুক্তির মাধ্যমে অন্যদের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে থাকেন। এই ধাপে ধাপে যুক্তি, তর্ক ও মানবিক বিবেচনার উত্তরণই চলচ্চিত্রটির আসল সৌন্দর্য। ঘটনাটি ঘটতে থাকে স্বপ্নের মাধ্যমে। এক ঘুমে বিচার শেষ— তাও মাতাল ঘুম। কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় অভিনয় করেছেন ব্রজেশ্বর দত্ত চরিত্রে—তিনি প্রধান বিচারপতি— তার বাড়িতে একটি পার্টির সময় একটি খুনের মামলার আলোচনা শুরু হয়। তারই ঘুমেই বিচারের কাজটা চলে।   


"সত্যি বলে সত্যি কিছু নেই" নামটিই চলচ্চিত্রটির দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির ইঙ্গিত দেয়। এখানে 'সত্য' আপেক্ষিক—যা আমরা চোখে দেখি, তা হয়তো পূর্ণ সত্য নয়। প্রত্যেক মানুষের অভিজ্ঞতা, সামাজিক অবস্থান ও মানসিক অবস্থা ‘সত্য’কে ভিন্নভাবে উপলব্ধি করে। এই চলচ্চিত্র আমাদের শেখায়, কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর আগে নিরপেক্ষ ভাবনায় এবং সহানুভূতিশীল দৃষ্টিতে বিষয়টি দেখা জরুরি।


চলচ্চিত্রটির সবচেয়ে বড় শক্তি এর অভিনয়— অভিনয়টা চলে থিয়েটার মোডে— সংলাপের আলাপ এখানে মুখ্যত আলোচনার দাবি রাখে।


কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়, পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়, ঋত্বিক চক্রবর্তী, অর্জুন চক্রবর্তীসহ প্রথিতযশা শিল্পীদের অভিনয়ে প্রত্যেক জুরি সদস্য এক একটি জীবন্ত চরিত্র হয়ে উঠেছে। সংলাপভিত্তিক দৃশ্যগুলিতে তাদের চোখের চাহনি, কণ্ঠস্বরে ওঠানামা, ছোট ছোট অঙ্গভঙ্গিতে ফুটে উঠেছে চরিত্রের গভীরতা।

সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের পরিচালনায় একঘেয়ে সেটিংও দর্শককে বেঁধে রাখে। একই ঘরে পুরো সিনেমা চললেও সংলাপ ও চরিত্রের মধ্যেকার উত্তেজনা কখনোই ক্লান্তি এনে দেয় না। চিত্রগ্রহণ, সম্পাদনা এবং আবহসংগীত অত্যন্ত সংযত ও অর্থবহ। সিনেমার সেট বানানো হয়েছে ছয়টি জায়গায়, ঠিক সিনেমার সেট নয়— বলতে গেলে আলোচনার সেট— রুমে, মাঠে, মাঠে মানে গল্ফ ⛳ মাঠে, সিনেমার হলে, ওভারব্রিজে, সাগরে এবং শেষে জঙ্গলে। জঙ্গল মানে মঙ্গল। জঙ্গলে বুঝতে পারে প্রত্যেকেই এই আলোচনাটা শুরু হওয়ার দরকার ছিলো সাতচল্লিশের আগে, তাহলে হিসাবটা অন্যরকম হতে পারতো। 


আজকের বিশ্বে যেখানে দ্রুত বিচার, গণমাধ্যমের চাপ এবং পক্ষপাতদুষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি বিচারব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছে, সেখানে এই চলচ্চিত্রটি এক সতর্কবার্তা। আমাদের মনে করিয়ে দেয়, প্রতিটি অভিযুক্ত ব্যক্তির পেছনে একটি জীবন, একটি গল্প থাকে—আর সেই গল্প শোনার দায় আমাদের।

পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় – চরিত্রের নাম সত্য, যিনি একমাত্র ব্যক্তি যিনি অভিযুক্তকে নির্দোষ মনে করেন এবং বাকিদের মত পরিবর্তনে প্রভাব ফেলেন। সত্যের এন্ট্রিতেই একধরনের চমক খেলে যায় মনে— তার কস্টিউম এতো সুন্দর লাগছিলো, বিশেষ করে চোখের চশমাটা— মনে হলো পরমব্রত নিজেকে যেনো খুজে পেলো। 


"সত্যি বলে সত্যি কিছু নেই" একটি সিনেমা এবং সিনেমার আদলে একটি  আয়না যা সমাজের বিচারব্যবস্থা, ব্যক্তিগত পক্ষপাত এবং নৈতিক দ্বন্দ্বগুলিকে প্রকাশ্যে আনে। এটি এমন একটি চলচ্চিত্র যা শেষ হওয়ার পরও দর্শকের মনে প্রশ্ন তোলে, আলোচনার জন্ম দেয় এবং আত্মবিশ্লেষণের সুযোগ তৈরি করে। এই চলচ্চিত্রটি শুধু ভাল সিনেমা প্রেমীদের জন্য নয়, বরং শিক্ষার্থী, বিচারপতি, আইনজীবী, শিক্ষকসহ সকল সচেতন মানুষের জন্যে— কারণ এখানে প্রশ্ন করা হয়েছে, “আমরা যা সত্য ভাবি, তা আসলেই কতটা সত্য?”


"সত্যি বলে সত্যি কিছু নেই" সিনেমাটি যদি 12 Angry Men এবং Ek Ruka Hua Faisla–র বাংলা রূপান্তর হয়, তবে এটির কাহিনি ও সংলাপ কি হুবহু মিলেছে?— উত্তর হল: আংশিক মিল রয়েছে, তবে এটি নিছক অনুবাদ নয়—বরং একটি সৃজনশীল পুনরায় নির্মাণ (creative adaptation)।


তাহলে মিল কোথায়?


মূল কাঠামো ঠিক রাখা হয়েছে— বারো জন জুরি—এক তরুণের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ— প্রাথমিকভাবে সবাই ছেলেটিকে দোষী বলে ধরে নেওয়া— এবং একজন সদস্য ধাপে ধাপে সন্দেহ জাগিয়ে বাকিদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দেওয়া—এই প্রেক্ষাপটটি মূল ছবির (12 Angry Men) মতোই।


কিছু গুরুত্বপূর্ণ যুক্তি ও নাটকীয় মুহূর্তও মূল সিনেমার ছায়া বহন করে। যেমন—

প্রত্যক্ষদর্শীর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন।

প্রমাণভিত্তিক সন্দেহের গুরুত্ব (reasonable doubt)।

সামাজিক ও মানসিক পক্ষপাত।


তাহলে এই সিনেমার পার্থক্য বা নতুনত্ব কোথায়?


বাংলার সংস্কৃতির উপযোগী করে সংলাপ রচিত হয়েছে। ব্যবহৃত শব্দ, ভঙ্গি, সামাজিক টানাপোড়েন— সবকিছুই আধুনিক কলকাতার প্রেক্ষিতে রূপান্তরিত— প্রতিটি জুরি সদস্যের পেছনে আছে ভিন্ন পেশা, শ্রেণি, এবং জীবন অভিজ্ঞতা, যা সৃজিত নিজস্ব ভঙ্গিতে পুনর্গঠন করেছেন— কিছু চরিত্রে নতুন মনস্তত্ত্ব যোগ করা হয়েছে। অনেক সংলাপ নতুনভাবে লেখা হয়েছে, যাতে বাংলা ভাষার নিজস্ব রস ও শৈলী বজায় থাকে— হুবহু অনুবাদ নয় বরং ভাবানুবাদ ও রূপান্তর ঘটেছে— সৃজিত মুখোপাধ্যায় নিজেই একাধিক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, এটি Ek Ruka Hua Faisla-র ‘রিমেক’ হলেও তিনি এটি “রিমিক্স নয়, রিইমাজিনেশন” হিসেবে তৈরি করেছেন।


রিইমাজিনেশন (Reimagination) শব্দটি মূলত একটি সৃজনশীল ধারণা, যার মাধ্যমে পূর্ব-বিদ্যমান কোনো সাহিত্য, সিনেমা, নাটক বা গল্পকে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি, নতুন প্রেক্ষাপট, এবং নতুন ব্যাখ্যায় পুনর্গঠিত করা হয়। এটি রিমেক বা রিমিক্স থেকে ভিন্ন, কারণ এখানে কেবল গল্পটি পুনরাবৃত্ত হয় না—বরং গল্পটির অন্তর্নিহিত ভাবনা বা থিমটিকে নতুনভাবে কল্পনা করা হয়। Reimagination = পুরনো গল্প + নতুন চোখে দেখা + নতুন বাস্তবতায় রূপান্তর।


১৯৮০–৯০ দশকের দিকে এই শব্দটি জনপ্রিয় হতে শুরু করে, বিশেষ করে চলচ্চিত্র ও সাহিত্য বিশ্লেষনে—হলিউড ও ব্রিটিশ ফিল্ম থিওরিস্টরা প্রথমে “reimagining” বা “reimagination” শব্দটি ব্যবহার শুরু করেন, যখন পুরোনো ক্লাসিক চরিত্র (যেমন: শার্লক হোমস, ব্যাটম্যান, সুপারম্যান, রোমিও-জুলিয়েট ইত্যাদি) আধুনিক ভাষা, প্রেক্ষাপট ও দর্শনে ফিরে আসতে শুরু করে। তাই বলছি, Reimagination শব্দটি ভাষাবিজ্ঞান বা অভিধানের নির্দিষ্ট আবিষ্কার নয়— শিল্প ও সংস্কৃতির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে বই, চলচ্চিত্র ও নাটকের জগতে জন্ম নিয়েছে এই শব্দটি। 


এই সিনেমাটি যে একটি রিইমাজিনেশন তার প্রমাণ আমরা পাই যখন দেখি ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের সীমানা পেরিয়ে কোনো চরিত্র সিদ্ধান্ত দিতে পারছে না ঠিক তখন। আমাদের বাঙালিরদের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা জাতিগত উপলব্ধির  জায়গায় আমরা খুব গরীব এবং কৃপন।  জাস্ট কোপন বা লটারি দিয়ে এই জাতির মননে লোভ জাগ্রত করা যায়। আমাদের পার্সোনাল দ্বন্দ্ব জাতিগত দ্বন্দ্ব উস্কানিতে রাখে— আহারে আমাদের কোনো সামষ্টিক ঘৃণা বা ভালোবাসা নেই! 


"সত্যি বলে সত্যি কিছু নেই" সিনেমাটির নামকরনে মনে হয় যেনো এটি একটি দার্শনিক জার্নি। সিনেমা দেখতে দেখতে মনে হতে থাকে  আলোচনাটা হালকা অতীত রাজনৈতিক, আরেকটু সামনে গিয়ে মনে হয় আলোচনাটা সামাজিক লুচিমাংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, সবশেষে গিয়ে বুঝতে পারি সিনেমাটা আসলে একজন মাতালের জেগে উঠার গল্প— ঘোরগ্রস্ত বাঙালির ঘুম শেষে সকালের খবর যেনো চেতনার আলো নিয়ে এলো।  তবে একটি কথা আমাকে বলতে হবে— কাওয়ালি গানটার টাইম অব ইন্টারেস্ট দারুণ ছিলো কিন্তু ডট ডট ডট!  কিন্তু কাওয়ালি গানটি আরও সুন্দর করে উপস্থাপন করা যেতো, সেট আরও ভালোভাবে সাজানো যেতো, গান নির্বাচন আরও দারুণ হতে পারতো। কিন্তু হলো না।  


সিনেমা শুরু হচ্ছে বাতাসের শব্দ দিয়ে কিন্তু প্রথম দৃশ্যে নাস্তার টেবিল। নাস্তায় ভাত নেই,আলুর ভর্তাও নেই, লুচিকুচিও নেই— আছে ব্রেড,আছে জেলি, আছে জুসের গ্লাস। আর চরিত্রের সংলাপে গার্হস্থ আলোচনা— কলকাতার একেবারে উঁচু শ্রেনির আলাপ— বিয়ে না করা, সিনেমা নির্মাণ এবং ক্যারিয়ার, অফিস পলিটিক্স অথবা ইদুরদৌড় ইত্যাদি ইত্যাদি। তারা আবার রুটি কাটে, সরি, ব্রেড— চামচ দিয়ে কেটে খায়। আর পার্টিতে হাবুল দা আসতে পারবে না— কারন তার শরীরটা মেজমেজ করতেছে। কিন্তু একজন হাবুল দার জন্যে পার্টি তো আর থেমে থাকে না। উঁচু শ্রেণির পার্টি সারাবছর লেগেই থাকে। হাবুল দা পার্টিতে না আসতে পারলেও বিচারপতির স্বপ্নে কিন্তু ঠিকই আসে— শুধু আসে না, এসে একেবারে বিচার জমিয়ে তুলে। বিচারের মোড় ঘুরিয়ে দেয় একজন মাত্র ব্যক্তি— সত্য। সত্য বারবার বলতেছে একটি কথা— ছেলেটিকে গিল্টি বলার আগে আমাদের মগজ ব্যবহার করা প্রয়োজন। এবং একের পর এক প্রশ্ন তুলতে থাকে, তার প্রশ্ন উঠতে থাকে, ক্যামেরার কোলাজ শট দারুণভাবে উঠানামা করতে থাকে— বিষয়টি সুন্দর। সিনেমার কালার যথেষ্ট স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করা হয়েছে এবং চেষ্টা অপচেষ্টার অবয়ব না পেয়ে প্রচেষ্টার নাম নিয়েছে বলা যায়। সত্যিই সিনেমাটি বহুদিক থেকে আলোচনা সমালোচনা পণ্যোৎপাদন-পর্যালোচনা করার মতো একখান সিনেমা।

এই সিনেমা একটা ম্যাসেজ দিতে চেয়েছে— তা হলো স্বাভাবিক বিচার প্রক্রিয়ায় স্বাভাবিক মানুষ থাকা জরুরি বিচারক হিসেবে। কোনো ট্রমায় আক্রান্ত মানুষ সুস্থ হওয়ার দাবি রাখে— সমাজকে সুস্থ করার দায়িত্ব নিতে পারে না— একজন ট্রমায় আক্রান্ত মানুষ তার সাথে ঘটে যাওয়া অন্যায় বা অস্বাভাবিক আচরণ দিয়ে পৃথিবীর তাবৎ আচরণের গতিবিধি জাজ করতে থাকে— সে তখন নিজেই একটা কমেন্টবক্স যেখান থেকে একই দৃষ্টিকোন বারবার বের হতে থাকে— ফলে বহুচলক পথের মধ্যে দিয়ে স্বাভাবিক সত্য আবিষ্কার করা যায় না। তাই সিনেমাটি একটি প্রতীকধর্মী মেজাজে গল্পের শরীরে লাইট ক্যামেরা এ্যাকশন হয়ে কাজ করেছে। প্রকৃতির একটা সুন্দর দিক হলো তাকে বহুদৃষ্টিকোন থেকে ব্যাখ্যা করা যায়, তারপরও মনে হয় আরও আরও ব্যাখ্যা করা যায় আরও আরও দৃষ্টিভঙ্গির জায়গা থেকে।  এই সিনেমাটি যাপিত জীবনের প্রকৃতিকে ধরতে পেরেছে— ফলে এই সিনেমাটিকে বহুদূর পথচলা মুসাফির মনে হচ্ছে যার ঝুলিতে লেগে আছে লেপ্টে আছে অনেক অভিজ্ঞতা, প্রজ্ঞা ও সত্যজিজ্ঞাসার ছাপ।